প্রধান সড়ক থেকে সামান্য ডানদিকে অগ্রসর হলে নীল রঙের সুপ্রাচীন গেট, ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা দ্বারা যা চিহ্নিত; তাকে অতিক্রম করে সম্মুখ বরাবর এগোলে দীঘি, প্রাতিস্বিকতায় ক্ষয়িষ্ণু ও বহমানতায় পর্যবেক্ষণযোগ্য। দীঘিটির সমান্তরালে অবস্থিত মসজিদটি ক্রমশ মানুষ হারিয়ে দার্শনিকতার প্রশ্নে দিশেহারা, আর্থিক উপযোগিতা বিচারে তার ইমাম জর্জরিত। বিশ বছর আগেও যা হাঁটতে বেরোবার সুবিশাল স্পেস হিসাবে বিবেচিত ছিলো, সেই জায়গাটুকু হাউজিং স্টেট কর্তৃক দখলীকৃত হয়ে স্থানীয়দের বিবিধ বৈকালিক অনুভূতি কিংবা উপলব্ধির প্রবাহমানতাকে করে তুলেছে দুরূহ।
আকমল হোসেনের নিজস্ব অবলোকনে তার গৃহটি এভাবে বিচার্যঃ অবিরাম দৃশ্যমানতার সাথে অন্ধত্বের সখ্যতা অনিবার্য। সেই বাস্তবতায়- স্পন্দন দূরের নিয়তি, অন্তর্গত কিছু সূক্ষ্ণ প্রগাঢ় অনুভূতি নির্বাসিত এবং অবধারিতভাবে, আত্মচেতনা ক্রমশ বিলুপ্তির দিকে ধাবিত। সন্তরণশীলতাই যখন আরাধ্য, আদর্শ কিংবা চিন্তার তার অনুগামী হয়ে ওঠাটা যখন অনিবার্য, স্বীয় জন্মদাগের সাথে বিচ্ছিন্নতাকে তখন কি ঠেকানো যায়? সেই পরিণতিকে অস্বীকার করবার আরোপিত প্রবণতাটি কতোটুকু সমর্থনযোগ্য? আকমল হোসেন ভাবেন, সমর্থন- অসমর্থনের বাইনারীর বাইরেও কোন ভাবনা কিংবা উপলব্ধি বিরাজ করতে পারে; প্রায়শই দীর্ঘশ্বাস যার সহযাত্রী।
নরেন্দ্র সদ্যগজানো পাতলা ফিনফিনে দাঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে উত্তেজিত ভঙ্গিতে বললো, “কেনো নয়? এভাবে কতোকাল বসে থাকা যায়?” গতোকালকেও পত্রিকায় দেখলাম। ঢাকায় ম্যাসাকার চলছে প্রতিদিন। চট্টগ্রামেও যাচ্ছেতাই অবস্থা। আর আমরা কিনা একে অপরের সাথে তর্ক করছি? এই যুদ্ধ নিয়ে আমার অবস্থান কী হবে সেটা নিয়ে? এভাবে ……”
নরেন্দ্রকে জোর করেই থামিয়ে দিলো আকমল হোসেন। বলার ভঙ্গিতে, বক্তব্যের সারবস্তুতে সে বরাবরই সতর্ক। প্রিসাইজও থাকতে পারে বটে। ফলে বাগ্নীতার সহজাত দক্ষতায় অন্যদের উপরে এক ধরণের প্রভাব বজায়ে সে সিদ্ধহস্ত। বললো, “প্রশ্নটা বোধকরি ঝাঁপিয়ে পড়া বনাম বিশ্বাসঘাতকতার নয়। যদি অন্ধ আবেগে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাও তবে কে তোমাকে বাধা দিতে পারে? কিন্তু ভেবে দেখো, সংকটের সময়ে আত্মত্যাগই কি চূড়ান্ত লক্ষ্য হতে পারে, না হওয়া উচিত? তুমি কি নিজের সম্ভাব্য স্যাক্রিফাইসকে বিক্রি করে কোন মিথিকাল চরিত্রে পরিণত হতে চাও, নাকি মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার সংকল্পটাই তোমার কাছে শেষ কথা?”
আকমল হোসেনের সেই কথার পরে উপস্থিত সকলে চুপ হয়ে গিয়েছিলো। এখনো তিনি স্পষ্ট স্মরণ করতে পারেন। নাজমুন কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গিয়েছিলো। সম্ভবত সামান্য দেরীতে হলেও বুঝতে পেরেছিলো আকমল হোসেন কী বলতে চান। নরেন্দ্রর পরিকল্পনা ছিলো আলাপটাকে আরো বিস্তৃত করার। কিন্তু আকমল হোসেনের যথার্থ কথাগুলোর যথার্থ প্রত্যুত্তর তার কাছে আদপেই ছিলোনা। সিকান্দার, হেলাল, রতন, বংশী- ওরা প্রত্যেকেই স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলো। আদর্শিক প্রশ্নটিকে সামনে না রেখে অগ্রসর যদি হওয়াও হয়, তার বৈধতা? এ তো নিজের জীবনকে জুয়ার টেবিলে বাজি রাখবার বিলাসিতা নয়, যেখানে সর্বস্বহারা হলে ব্যক্তিগত আহাজারিতে বাদবাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যাবে। তাদের মধ্যে রতন কিছু কম্যুনাল ভ্যাল্যুজ ধারণ করে এ কথা তারা সবাই জানতেন। পশ্চিম পাকিস্তান, ইয়াহিয়া খান, পাকিস্তানের অখণ্ডতা – এসকল প্রশ্নে সেই বিপদসংকুল পরিস্থিতিতেও তার কিছু বিশ্বাস অপরিবর্তিত, এই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে আকমল হোসেনের আপত্তি কিংবা সংকোচ কোনটাই ছিলোনা। তার পরিকল্পনা ছিলো ইতিহাসের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেই রতনের সেই মূল্যবোধগুলোকে তার ব্যক্তিক সত্তার বিপ্রতীপে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার। এই ভূখণ্ডের ইতিহাসই সময়ে সময়ে এক্ষেত্রে সবচাইতে বেশী প্রাসঙ্গিক। হিন্দু এবং মুসলমান সময়ে সময়ে যতোবারই একে অপরের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে, শুদ্ধতার প্রশ্ন সামনে চলে আসলে নিজেদের মধ্যেও কি দ্বন্দ্ব- সংঘাতে জড়ায়নি? স্বীয় ধর্মের প্রতিপক্ষ গোত্রের বুক বিদীর্ণ করতে কখনো পিছপা হয়েছে কি? আকমল হোসেন জানতেন, রতনের কাছে এর সদুত্তর ছিলোনা। বিশ্বাস যখন ব্যাপ্তির সৌন্দর্য কিংবা উদারতার ন্যায্যতাকে অগ্রাহ্য করে ব্যক্তিগত অহমের দাসানুদাস হয়ে পড়ে; ভাবনা এবং কর্মের পারস্পরিক সৌকর্য তখন সুদূর পরাহত। কিন্তু সেদিনকার সেই আলাপের পরে আর কখনো একত্রে বসা হলোনা তাদের। সাতদিনের ভেতরে এদিকেও আঁচ পড়তে শুরু করেছিলো। আদর্শিক প্রশ্নের সাথে সম্পর্কিত সকল ভাবনা কিংবা উপলব্ধিকে যুদ্ধে ব্যাপৃত হবার বাস্তবতার সমান্তরালে রেখে আকমল হোসেন জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাদের সকলকে বিস্মিত এবং নির্দিষ্টভাবে তাকে হতাশ করে সেই ঝঞ্ঝাপূর্ণ সময়েই নাজমুন এক অংকের প্রফেসরকে বিয়ে করে বসলো। নরেন্দ্র, সিকান্দার, হেলাল, বংশী ওরাও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে দেরী করেনি। প্রত্যেকেই যার যার নিজস্ব প্রেক্ষিত এবং তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ধ্যানধারণাগুলোকে অবলম্বন করে নিজেদের যুক্ত করেছিলো। রতনের খবর যুদ্ধ শেষ হবারও অনেক পরে পেয়েছিলেন আকমল হোসেন। ততোমধ্যে নদীর তীরে রতনের নিথর পড়ে থাকার মাধ্যমে, নিজের বিশ্বাস এবং দৃশ্যগ্রাহ্য বাস্তবতার সংঘাতের উপরে যবনিকা পড়ার ঘটনাটিও সুদূর অতীত।
“এভাবে না, এভাবে না। আমার কাছে আয় মা, শিখায়ে দেই।” সেলাইয়ে অদক্ষ বিবাহিতা কন্যা শায়লার উদ্দেশ্যেই হয়ে থাকবে, ঘুমের ভেতরেই আত্মজাকে কাছে আসার আহ্বান জানিয়ে স্ত্রী জাহানারা পাশ ফিরে ফের ঘুমে তলিয়ে গেলেন।
বাইরে ঝোড়ো বাতাসের সাথে ঘরহীন মানুষের বিপন্ন লড়াই; আদিম ঘ্রাণে মৃত্তিকার সম্ভাব্য আত্মপ্রকাশ, শঙ্কিত গাছপালাগুলো দুলতে শুরু করে দিয়েছে। থানা থেকে পঁচিশ গজ দক্ষিণ- পশ্চিমে ছয়টি গাছ শেষবার উৎপাটিত হয়ে গিয়েছিলো। আজ তবে কয়টি গাছ নিজেদের উন্মুল হিসাবে আবিষ্কার করবে? আকমল হোসেন ভাবেন, প্রকৃতির পুনরাবৃত্তি স্বয়ম্ভু হয়ে ওঠে পরিপার্শ্বের ক্ষয়িষ্ণুতায়। যতো পরিপাট্যই তাকে ঘিরে থাকুক না কেনো, একেকটি পুনরাবৃত্তিতে নিজেকে দুর্বল হিসাবে আবিষ্কার করে ফের পরিপাটি হবার ক্লান্তিকর প্রক্রিয়াটির সাথে যুক্ত হওয়াটাই পরিপার্শ্বের চিহ্নিত নিয়তি। দীর্ঘসময় জীবনের ঋজুতার প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে গিয়ে তিনি বোধে কিংবা উপলব্ধিতে নিসর্গের মাধুর্যের প্রতি মনোযোগ দেননি। প্রাত্যহিক জীবনের কেজো বাস্তবতার সাথে মানব সংবেদনের নৈসর্গিক চেতনার দ্বন্দ্বটি কি অন্তর্গতভাবেই বৈরী? এই নিয়ে কখনো গভীরভাবে ভেবে দেখেননি। তবে যে কোন প্রকারের নৈবেদ্য বরাবরই তার কাছে অরুচিকর। কোন সমর্পণ তার সার্বিকতা নিয়েই অনন্যসাধারণ। আত্মচেতনার অস্বীকৃতি কিংবা তাকে অগ্রাহ্য করে সমর্পণ হতে পারেনা। নৈবেদ্য বোধকরি সে কারণেই প্রাতিষ্ঠানিকতা দ্বারা আবৃত এবং প্রতিনিয়ত পুষ্ট হয়। ফলত, জাড্যতার কাছে তার লুটিয়ে পড়াটা অনিবার্য।
বাইরে ঝড় শুরু হয়ে গিয়েছে। ক্ষীণ আলোতে টেবিলের কাছে গিয়ে নীল রঙের মোটা ডাইরীটি হাতে নিয়ে আকমল হোসেন সুনিপুণ মগ্নতায় চোখ বুলাতে শুরু করলেন। বছর দশেক আগেকার লেখা ফের হাতড়ে বেড়ানো।
২১ ডিসেম্বর, ২০০৭
যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার এক বছরের মধ্যেই আবিষ্কার করেছিলাম, স্বপ্নগুলোর যেই নিজস্ব চেতনা ভেতর থেকে ঝাঁকুনি দিয়ে থাকে সেগুলো ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসছে মানুষের। চারপাশে সকল অশুভ পায়তারা ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যেনো পরাজিতরা অনিবার্যভাবে সভ্যতার প্রাগৈতিহাসিক জারজ, শুভর উপরে অশুভর আধিপত্য প্রশ্নাতীত এবং বৈচিত্র্যের অস্বিত্ব মাত্রই ধ্বংসের জন্য অপেক্ষমান। খবরের কাগজে পড়লাম, টাকার জন্য বারো বছরের বাচ্চা ছেলের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে তার পিতাকে কুড়াল দিয়ে হত্যা করতে বাধ্য করেছে সন্ত্রাসীরা। পরে ছেলেটিকেও খুব কাছ থেকে গুলি করে চলে গিয়েছে।
২৩ মার্চ, ২০০৮
নরেন্দ্র স্বভাবে উত্তেজিত ছিলো। আমার দেখা পরিচিত মানুষদের মধ্যে সেই একমাত্র যে কিনা অন্তর্গত সকল উত্তেজনা নিয়েও মলিন হয়নি। যতোদিন বেঁচে ছিলো কোন না কোনভাবে তাকে চ্যানেলাইজ করে গেছে লুম্পেন প্রবণতাগুলোর বিরুদ্ধে। সেখান থেকেই কি নিজের বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধ করে যাবার প্রণোদনাটুকু সে পেয়ে থাকতো? ওর সার্টিফিকেটগুলো আমার কাছে রয়ে গেছে। ধুলা ঝাড়তে ঝাড়তে ওর কথা মনে পড়লো। বহুদিন পর।
১৭ মে, ২০০৮
যুদ্ধ বলি কিংবা বিপ্লব, এমনকি হঠকারীতার সময়েও তাতে যুক্ত থাকবার স্থূল আনন্দ কিংবা সন্তুষ্টিতে যেই ফাঁক রয়ে যায়; তাতে যা কিছু প্রবেশ করে, সেগুলোই পরবর্তীতে সার্বিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে জীবনকে এবং পরিপার্শ্বকে। জয়োল্লাসের মাঝেও নিকটবর্তী কারো দীর্ঘঃশ্বাস কিংবা এক লহমার অভিব্যক্তিকে এড়িয়ে যাওয়াটা ঠিক নয়। দিনের শেষে উল্লাস কিংবা উদযাপনটাই অপসৃয়মান, চাপা কিন্তু সুতীব্র অভিব্যক্তিগুলো নয়। নাজমুনকে সময় থাকতে থাকতেই কথাগুলো বলতে পারলে অন্তর্গত কিছু ক্লেদকে এতোদিন ধরে বহন করে যেতে হতোনা।
২২ জুলাই, ২০০৮
জাহানারা এবং আমি আজ পর্যন্ত কথিত স্বাভাবিক জীবনের মাঝে নিজেদের দাম্পত্যকে ঘুরপাক খেতে দেখলাম। কিছু অলিখিত প্রতিশ্রুতি, প্রত্যাশিত কিছু সামাজিকতা এবং জীবনের মাংসল দিকটির প্রতি অখণ্ড আনুগত্য। বস্তুত, স্বীয় প্রয়োজনে বহুমাত্রিক ছুরির সন্ধান এবং সঙ্গোপন সংগ্রহ। সংসারজীবনের অন্তহীন অনিবার্য অপরিণামদর্শী দ্বন্দ্ব- সংঘাতে যার সদ্বব্যবহার ব্যতীত স্বতন্ত্র প্রাণীগত সত্তা মুহূর্তে স্থির থাকতে পারার জরুরী দক্ষতায় অপারগ।
১৩ অক্টোবর, ২০০৮
যুদ্ধে যাবার আগে আমার পিতার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। শহরের কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। সামাজিক সমঝোতার প্রশ্নে বরাবরই কৌশলী এবং অক্লান্ত। প্রাত্যহিকতার ছাপ পড়ে যাওয়া মনন। ফলে, নির্ণিমেষ চোখে কারো দিকে তাকিয়ে থাকাতে আড়ষ্ট। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে চটিজোড়ার সশব্দ আওয়াজ পেয়েছিলাম। ঘাড় ঘুরে তাকিয়ে দেখি, অন্য দিনগুলার চাইতে কলাপসিবল গেট লাগাতে একটু বেশীই সময় নিচ্ছেন।
৮ ডিসেম্বর, ২০০৮
ইন্ডেন্টিঙের ব্যবসাটা আমাকে স্বচ্ছলতা এনে দিয়েছিলো । যুদ্ধ শেষ হবার পরপরই যদি ব্যবসাটা ধরতাম তাহলে সম্ভ্রান্ত বলে বিবেচিত হবার সকল শর্তই বোধকরি পূরণ করা যেতো। বিবিধ অন্তর্গত মনোজাগতিক জটিলতাকে অগ্রাহ্য করতে ভারবহ সোশাল স্ট্যাটাস বেশ সাহায্য করে। আমার ভেতরে অপরাধবোধ কাজ করেনা। যুদ্ধ করতে করতেই উপলব্ধি করেছিলাম, ব্যক্তিমানুষ কতোটা ঠুনকো আর নাজুক হতে পারে। নিজেকে সুপারম্যানরূপে গড়ে তুলে চারপাশের কাছে শ্রদ্ধেয় কিংবা অনুপ্রেরণার বস্তু হবার বাসনার মাঝে কখনোই নিজেকে খুঁজে পাইনি। মনে হয়েছে সেই নিস্তেজ, স্থবির সম্মাননায় অন্তর্গত কাঁটাগুলো জাগরূক থেকে যাবে। ইন্ডেন্টিঙের ব্যবসাটা অর্থকরি প্রাপ্তির সাথে সাথে মানবচরিত্রের বিচিত্র সব দিক পরিপূর্ণভাবে আমার কাছে উন্মোচিত করেছিলো। এগিয়ে যাবার সীমাটা কতোদূর, কীভাবে তা সময়ে সময়ে মানুষদের যুক্তিবোধ এবং সংবেদনকে প্রশ্নের মুখোমুখি ফেলে দেয়, মরণাপন্ন সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়- এসব আমার পরিপূর্ণভাবে শেখা হয়েছে পরিশ্রমের সাথে ব্যবসাটার পেছনে লেগে থাকার ফলে। স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হবার দশ বছরের মধ্যেই জনগণ বিনাপ্রশ্নে আদর্শিকতা্মুক্ত চেতনার অনুগামী হয়ে সার্বিকভাবে রাষ্ট্রের সাথে সমান্তরাল হয়ে গিয়েছিলো। পুঁজিমুখী ঐক্যে। ভালোবাসাকে অনুসরণ করে রাইফেলের বেয়নেট মোছা থেকে মানুষ ভাঙ্গিয়ে এফ্লুয়েন্ট সোসাইটির বাসিন্দা হওয়া; জীবনের বিবিধ রূপান্তর আমার দেখা হয়েছে, স্বীকারে দ্বিধা নেই তবু তা আজীবন আমার কাছে অধরা রয়ে গেলো। এই ইলিউসিভনেসের অনুভূতি মাঝেমাঝে মস্তিষ্কে কঠিনভাবে আঘাত করে। করতেই থাকে।
৭ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯
বাতেন শিকদার বারো বছর পরে ইউরোপ থেকে ফিরে এসেছে। নেদারল্যান্ডে ছিলো। লোকমুখে শুনলাম সেখানে জমিজমা যা আছে সব বিক্রি করে এখানেই পাকাপাকিভাবে থাকবে। আমি যতোরকমভাবে সম্ভব তাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছি। আদর্শিক প্রশ্নে কিংবা ব্যক্তিগত কোন রেষারেষি থেকে নয়, বর্তমানকার মানসিক বিপর্যস্ততা তার মুখোমুখি হবার বাস্তবতায় আমাকে ভেতর থেকে ডুবিয়ে দিতে পারে। এর কাছে আমি নতজানু হতে প্রস্তুত নই। তার দেশে প্রত্যাবর্তনের কথা শুনে মনে পড়লো; শিউলীর বোন পারুল যুদ্ধ শুরু হবার আগেও সবুজ পাড়ের শাড়িটা পরে প্রায়ই ঘাটের কাছাকাছি বসে থাকতো। মেয়েটার উপরে বাতেন শিকদারের কী রাগ ছিলো কে জানে। ছয়মাসের অন্তঃসত্ত্বা একজন নারীকে শত্রুর হাতে তুলে দেওয়ার মাঝে কোন বাসনা ক্রিয়াশীল থাকতে পারে? স্মৃতিশক্তির প্রখরতার জন্য একসময়ে বিখ্যাত ছিলাম। আরো মনে পড়লো, পারুলকে বাতেন শিকদার পাকবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিলো অক্টোবরের ১৯ তারিখ।
১২ মে, ২০০৯
দুই ছেলেমেয়ে আমার। তারা যতোদিন চোখের সামনে ছিলো, খুব কমই মনোযোগের কেন্দ্রে আসতে পেরেছিলো। যদিও আমি জনকের অলঙ্ঘনীয় দায়দায়িত্ব থেকে নিজেকে বিরত রাখিনি। মেয়ের বিয়ে দেবার চার বছর পরে চাকরীসূত্রে ছেলের ঢাকায় চলে যাওয়া- এর কোনটাই আমাকে আলোড়িত করেনি। ইদানিং মাঝেমাঝে ভাবনা আসে, আমার শুক্রানুর দায়ভার তারা কখনো বহন করতে না চাইলে তাদের চাইতে স্বস্তি বেশী আমার হবে। অনাগ্রহ মেনে নিয়ে সামাজিক সমঝোতার প্রশ্নে অথর্ব সাফল্যের ক্লান্তি খুব লোভনীয় কিছু নয়।
২৯ আগষ্ট, ২০০৯
অনেকদিন পরে হাবিবের দোকানটায় গিয়েছিলাম। বাসার পুরনো রেডিওটা সারাতে দিতে। এখন আর ব্যবহার নেই, স্মারক হিসাবে রেখে দেওয়ার সম্মানটুকু কেবল দিতে পারি। ফিরে আসতে আসতে একঝলক মিতালীকে দেখলাম। বেশ মুটিয়েছে। শেষ তাকে দেখেছিলাম সাত বছর আগে। টানা তিনটা বছর সকলের অলক্ষ্যে তার সাথে যেই উদ্দামতায় কেটেছিলো, তার তুল্য কিছু হতে পারেনা বলে ভাবতাম। অনেক পরে উপলব্ধি করেছিলাম, নিজেকে রিলিজ করার প্রয়োজনীয়তাটুকু ছাড়া আমার কাছে তার ভিন্ন কোন প্রাসঙ্গিকতা তৈরী হবারই কোন সুযোগ ছিলোনা। মিতালী সম্ভবত অনেক আগেই সেই সত্য অনুধাবন করেই আমার থেকে সরে আসে। ওকে দেখে ভারবোধ কিংবা গ্লানি কোনটাই হলোনা। আমার ভোঁতা হয়ে যাওয়া মননের চিহ্ন।
আকমল হোসেন বেয়নেট মুছতে থাকেন। আগামীকালকের অপারেশনটা গুরুত্বপূর্ণ। সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারলে সপ্তাহ দুয়েক অন্তত কোন স্ট্রেস নিতে হবেনা। “আকমল ভাই, আমরা পারবো তো?” রাজিনের সংশয়াচ্ছন্ন জিজ্ঞাসা। ছেলেটা বাইরে যতো বীরত্বই দেখিয়ে বেড়াক, ভেতরে ভেতরে বেশ দুর্বলতায় ভোগে। নিরুত্তর আকমল হোসেন তার পিঠে হাত রাখেন। অভয়দানের সঙ্কেত প্রবাহিত হয়। নাজমুনের চেহারা চোখে ভাসে। মাতৃভূমিকে মুক্ত করার সংকল্পে এরকম কোন দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া কি ঠিক? আকমল হোসেন এ নিয়ে ভাবতে অপারগ। স্বাধীনতার সাথেই বরং প্রেমের সম্পর্কটা নিবিড় হওয়া উচিত। কিন্তু ঔচিত্যবোধের প্রশ্নটা সময়ে সময়ে প্রেমের অস্তিত্বমানতাকে খর্ব করে দিতে পারে। আকমল হোসেন আরেকবার বেয়নেট মোছেন। শৈশবে একবার আব্বার সাথে দাদাবাড়িতে গিয়েছিলেন। বনে পাখি শিকার করতে পছন্দ করতেন তার ছোট চাচা। নিঁখুতভাবে বন্দুক চালাতে জানতেন। সমগ্র মুখাবয়বে আশ্চর্যরকমের নিস্পৃহতা। ভয়ে শিউরে উঠেছিলেন। প্রথম যেই পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যা করলেন তার চোখেমুখেও তেমনটা লক্ষ্য করেছিলেন। গুলিটা খুব কাছ থেকে করার পর রক্ত ছিটকে তার মুখের ওপর পড়েছিলো। প্রথমবার বলেই সম্ভবত বারবার চোখেমুখে পানি দিয়েও নিশ্চিত হতে পারছিলেন না যে তার শরীরটা শত্রুর রক্তমুক্ত হয়েছে কিনা। শহরে রাষ্ট্রপতি এরশাদের আগমনের দিনে পাড়ায় সাজ সাজ রব পড়ে গিয়েছিলো। ঘৃণা কিংবা বিতৃষ্ণা কিছুই হয়নি তার। সেই সময়ে মেনে নেওয়ার প্রবণতার মাঝে দিনানিপাত করবার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। ইন্ডেন্টিঙের ব্যবসাটা তখন একটু একটু করে থিতু হতে শুরু করেছে। সামাজিক সমঝোতার আঙ্কিক হিসাবটা তখন সতর্ক সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে করতেন। ‘তোমার যুদ্ধ আসলে এখনো শেষ হয়নাই, মাঠটা কেবল বদলাইছে।’ জোরপূর্বক স্ত্রীসম্ভোগের পরে কাপড় সামলাতে সামলাতে তার দিকে উদ্দেশ্য করে জাহানারার ক্ষোভ। স্যাডিস্টের হাসি হাসতে হাসতে সিগারেটের প্যাকেটের দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন। ‘কী এতো সারাদিন আকাশ, পাখি এসবের কথা বলো? তোমার কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে যাই মাঝেমাঝে।’ শায়িতা মিতালীর উদ্দেশ্যে আকমল হোসেনের মৃদু বিরক্তি। মিতালী তখনো বাইরে তাকিয়ে আছে। সারাদিন শহরে ব্যাপক বোমাবাজি। গতোসপ্তাহে এলাকার সাধারণ মুসল্লীরা শহরে অনেক হইহল্লা করেছিলো। তসলিমা নাসরীনকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার দাবীতে। মিতালী ততোমধ্যে উঠে বসেছে। তার চোখের দিকে নির্ণিমেষ তাকিয়ে আছে। মিতালীর সাথে কথোপকথন কিংবা শারীরিক সংলগ্নতা, কোন সময়েই তার দিকে এভাবে চেয়ে থাকেননি আকমল হোসেন। মিতালী অনুসন্ধিৎসু চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘরের ভেতরে ক্রমশই বাইরের উত্তাপ বাড়তে থাকে। দুই একবার কাক ডেকে উঠে। দুপুরের নিস্তব্ধতা তাদেরকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে। আকমল হোসেন ঘুমিয়ে পড়তে পড়তেই টের পান, যাপিত জীবনের বিভিন্ন সময়কার দৃশ্যের কোলাজ তার সামনে এসে আবির্ভূত হয়েছে এটা কোন বিস্ময়কর ঘটনা নয়। এ ছিলো অনিবার্য। বাইরে অনেক আগেই ঝড় থেমে গেছে। আগামীকাল সকালেই কৌতূহলী মন নিয়ে সকলে অনতিক্রম্য ক্ষয়ক্ষতিকে পরিমাপ করতে যার যার ঘর থেকে বেরুবে। কিছু আলোচনা, অতঃপর কর্মোদ্যোগের তৃপ্তিতে নিজেদের ঘরে ফিরে যাওয়া। পরবর্তী কোন দুর্যোগের অপেক্ষায়।
ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে আকমল হোসেনের মনে পড়লো, পরশুদিন তার বাসায় বাতেন শিকদারের দাওয়াতের জন্য একবার বাজারে যাওয়াটা আবশ্যক।