১ম জনঃ তবে আপনি বলছেন যে ভারসাম্য থাকতে নেই? তবে মানুষ জীবনযাপন করবে কীভাবে?
২য় জনঃ আমার ধারণা আপনি যা বলছেন তাকে সমন্বয় বলা যেতে পারে। যেমন ধরুন- আমাদের কথায় ও কাজে প্রায়শই বৈপরীত্যের যে প্রাবল্য দেখা যায়, তাকে সমন্বয়তার অভাব বলা যেতে পারে; চাঁচাছোলা ভাষায় তাকে দ্বিচারীতাও বলবে কেউ কেউ। কিন্তু ভারসাম্যহীনতা? আমি এভাবে দেখিনা। আমার মনে হয়, ভারসাম্য শব্দটি যাপনের বিবিধ ফাঁকি আড়াল করবার অজুহাত মাত্র। জীবনের বিবিধ সংকটপূর্ণ সময়ে নির্দিষ্ট কোন সবল অবস্থান নেওয়ার বদলে দুইদিকে দুলতে চাওয়া একটি আরামদায়ক প্রবৃত্তিকে আমরা ভারসাম্য বলে অভিহিত করি। যেনো শিশুকালে কোন দোলনায় দুলছি। কোন ঝঞ্ঝাপূর্ণ সময়ে এসকেপিজমের আশ্রয় নেওয়াকে ভারসাম্য বলার সুবিধা হলো; নার্সিসিজম বা আত্মপ্রেমের উপরে প্রলেপ দেওয়াটা তখন সহজতর হয়ে যায়। তখন আমাদের বিশ্বাস করতে সুবিধা হয় যে; আমরা দক্ষ হাতে জাহাজ সামাল দিচ্ছি। প্রকৃতপ্রস্তাবে আমরা তখন সকলকে ফাঁকি দিতে চেষ্টা করি। খোদ নিজেকেও।
১ম জনঃ মায়া, মমতা, ভালোবাসা ইত্যাদিকে আমরা যেভাবে ডিফাইন করি, সেরকম কি? মুখে, অভিব্যক্তিতে মমতার দেখনদারী, ভালোবাসার পরাকাষ্ঠা; কিন্তু ভেতরে ভেতরে অন্তর্গত ছুরির স্ফিত হয়ে উঠা?
২য় জনঃ একেবারে তাই। আমাদের অহমতাড়িত জীবনে যেই অন্তর্গত ছুরি স্ফিত হতে হতে একসময়ে খোদ নিজেদের কাটতে শুরু করে। তখন আমরা নিজেরা নিজেদের শত্রু হয়ে উঠি। কেনোনা, তখন আমাদের সেই ছুরির ধার পরখ করবার জন্য কেবল আমরাই অবশিষ্ট থেকে যাই। অনুভূতির বা বোধের সন্তরণ হতে পারে সত্য; কিন্তু তা তখনই আন্তরিক হতে পারে যখন তাতে আমরা ক্ষতবিক্ষত হবো। যেসকল অনুভূতির সন্তরণশীলতা আমাদের দগ্ধ করেনা; ধরে নেওয়াটা নিরাপদ, আমাদের সেসকল বোধকে আমরা ভোগের সামগ্রী হিসাবে মূল্যায়ন করে থাকি।
১ম জনঃ আমার এখন অনেক কিছু মনে হচ্ছে।
২য় জনঃ শুনবার জন্য অপেক্ষা করছি। আমি শুনতে চাই, আপনি বলুন।
১ম জনঃ(২য় জনের চোখের দিকে কিছুক্ষণ স্থির তাকিয়ে) আপনার কথা শুনে প্রথমে মনে হচ্ছিলো তবে মানুষ বাঁচবে কীভাবে? নিরেট যন্ত্র হয়ে তো মানুষ বাঁচতে পারেনা। কিন্তু এখন ভাবছি আসলে আমরা তো নিরেট যন্ত্র হবার জন্যেই প্রাণপণ যুদ্ধ করে যাচ্ছি। আমাদের জৈবিক সত্তার সাথে আমাদের জীবনের নিজস্ব কৃত্রিম নির্মাণের সংঘর্ষই কি শেষমেষ অনিবার্য হয়ে ওঠেনা? যেই স্ফিত ছুরির কথা বলছিলাম আমরা, তার জন্ম কি এই সংঘর্ষের গর্ভেই নয়? এখানে হয়তো প্রেক্ষিতের প্রশ্নটা বিবেচ্য। কিন্তু যেভাবেই দেখা হোক, দ্বন্দ্বমুখর এই সংঘর্ষের যে অনিবার্যতা; তা থেকে কীভাবে মানুষ নিশ্ছিদ্র থাকতে পারে? স্বয়ম্ভু ব্যক্তিত্বের প্রতি অপ্রতিরোধ্য মোহ যে সময়ে আরাধ্য; তখন তাতে বিলীন হয়ে যাওয়াটাই কি একমাত্র পরিণতি নয়?
২য় জনঃ আলবাত। এই যে দেখুন- আমরা যে আলাপ করছি, ভাবছি আমাদের এই আলাপন কতোটাই না গুরুত্ববহ; যেনো পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমাদের এই কথোপকথনের উপরে। ভেবে আমরা ভেতরে ভেতরে পুলকিতও হয়ে উঠছি। কিন্তু এই আলাপনের নিনাদ যতোটুকু, তা একান্তই আমাদের অন্তর্গত। বাহ্যিকতা যখন প্রেক্ষিত; অনিবার্যভাবে তখন তা অপসৃয়মান।
১ম জনঃ আমাদের প্রাসঙ্গিকতাই যদি না থাকে তবে কেনো বেঁচে আছি? এতো এতো অনুভূতির সঞ্চারণ, তার প্রবাহমানতা- এসকল বিষয় এতো তুচ্ছ হয় কীভাবে? একেকটি মুহূর্তে যার স্পন্দন আত্যন্তিক; বেঁচে থাকা প্রতিটি সময়ে যার অনুরণন প্রশ্নাতীত, যার কেন্দ্রমুখী অবস্থানকে অতিক্রম করা যায়না- তা কীভাবে মরণশীলতার কাছে এতোটা ঠুনকো হতে পারে?
২য় জনঃ অপসৃয়মানতা মানেই যে মৃত্যু এমন তো নয়। ভেবে দেখুন, মানুষ সবচেয়ে বেশী প্রাসঙ্গিক ও জীবন্ত থাকে অন্যদের স্মৃতিতে। এটা অবশ্যই সত্যি যে প্রাসঙ্গিকতা পারতপক্ষে মোক্ষ হওয়াটা কাম্য নয়। ইতিহাস আমাদের শিক্ষক এই অর্থেও যে; দানবেরা অন্যের স্মৃতিতে কীর্তিমানদের তুলনায় কম জাগরূক নয়। কিন্তু দেখুন সাধারণ নিস্তরঙ্গ বিশেষত্বহীন জীবনপ্রবাহের দিকে; যেখানে জীবন কোন জাগতিক সাফল্য কিংবা কোন রূপ কৃতিত্বের সংস্পর্শে না এসেও অস্তিত্বশীল- একটি আলো মিলিয়ে আসা মন্থর ধীরগতির মফস্বলের বিকালের কথা চিন্তা করুন; তাকে কীভাবে মৃত হিসাবে আখ্যায়িত করবেন? বরং দৃষ্টিসীমা ক্রমশ বিস্তৃত হতে থাকলে দেখা যাবে, তার সজীবতার সাথে তুলনায় চোখ ধাঁধানো বিবিধ অত্যাশ্চর্য সাফল্য কিংবা যুগ যুগ ধরে স্মর্তব্য এমন অনেক কীর্তিকে ম্লান বলে মনে হবে। যাপনের চাপ অনস্বীকার্য, প্রতিযোগিতাপ্রবণ মন অবশ্যম্ভাবী রূপে আমাদের অন্ধ করে রাখে, আমরা পরাজিত হবো বিবিধ মোহের কাছে। কিন্তু কিছু মুহূর্তে সবচেয়ে আত্মকেন্দ্রিক মানুষটিও বেরিয়ে আসে তার সীমাবদ্ধ সত্তার নাগপাশ থেকে। তখন কিছু গূঢ় উপলব্ধির নুড়ি পাথর পাওয়া যায়। এর থেকে নিস্তার নেই কারো। মানুষ যতোদিন বেঁচে থাকবে, সেলফ-কনফেশনের কাছ থেকে তার মুক্তি নেই।
১ম জনঃ আপনি তবে বলতে চাইছেন যে অনিবার্য অপসৃয়মানতার পরেও আমাদের এই আলাপনের একটা গুরুত্ব আছে?
২য় জনঃ মৃত্যু কি জীবনের অস্তিত্ব অস্বীকার করে? কোনকিছু তখনই মিলিয়ে যেতে পারে যখন তা দৃশ্যমান হয়। আদিমযুগের অনেক প্রশ্নের উত্তর আজও আমরা খুঁজে ফিরছি। সময় তার নিজস্ব গতিতে যতোটাই অগ্রসর হোক, অনেক অনুভূতি উপলব্ধি প্রশ্ন বারবার ফিরে আসে। আসতে বাধ্য। কে বলতে পারে আজকে থেকে পঞ্চাশ বছর পরে দুইজন মানুষ এসকল বিষয় নিয়েই একে অপরের সাথে আলাপে বসবেনা যা নিয়ে আমরা এতোসময় ধরে আলাপ করছি? আমরা কেউ এমনও বলতে পারিনা যে আমাদের আগে কখনো কেউ এসকল বিষয় নিয়ে পরস্পরের সাথে আলাপ করেনি। প্রত্যাবর্তন সততই অনুভূত হয় বা দৃশ্যগ্রাহ্য হয় এমন নয়। অসচেতনভাবেও তার জন্ম হতে পারে। আমাদের জীবন বিবিধ ঘাত-প্রতিঘাতের পরেও জঙ্গম এটা যেমন সত্য; তেমনি এই সত্যও অনতিক্রম্য যে আমাদের জীবনপ্রবাহ; তার অন্তর্গত সকল অনুভূতি কী উপলব্ধি একটি সূক্ষ্ণ খাঁচার চারপাশে আবর্তিত।