ঝরে যাওয়া খসখসে পাতাসমূহের উপরে পা দিতেই সে চমকে উঠলো। স্নায়ু অবশ মনে হলো তার। অথচ সে পূর্ণস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়েই পেরিয়ে যাচ্ছে সমগ্র জায়গাটুকু। নির্জনতম কোন স্থানের চাইতেও যা বেশী নির্জনতর। স্নায়ু অসাড় করে দেওয়া এই অনুভূতিকে ব্যাখ্যা করতে কোন শব্দই কি যথেষ্ট? সকল ভাষার অভিধানই কি মুখ থুবড়ে পড়েনা এমন কোন অপ্রত্যাশিত লগ্নে?
সে তবু নিজেকে নিজের কাছে সংকুচিত করে সামনে আগাতে থাকে। আশেপাশে বারবার তাকায়। না কেউ নেই। কোথাও, কেউ নেই। খুব অশুভ একটি বোধ, সমগ্র শরীরকে পেঁচিয়ে ধরে যেনো তার কন্ঠনালী পর্যন্ত চলে আসতে চাইলো। তবু তার গতিবিধি স্তিমিত হলোনা। ভয়, শব্দটাকে নিতান্তই খেলো মনে হলো তার। কোন একটি নির্দিষ্ট বোধকে যথার্থভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে ব্যর্থ হওয়াটা সময়ে সময়ে সাফোকেশনবর্ধক হয়ে দাঁড়ায়। সময়-পরিস্থিতি-যাপন সাপেক্ষে তা সংবেদনের উপরে উপর্যুপরি আঘাত হানতে উদ্যত হতে পারে। মেতে উঠতে পারে অস্তিত্বকে প্রতিনিয়ত ছোবল দিতে দিতে জীবন্মৃত করে তোলার সেই অদ্বিতীয় স্যাডিস্টিক খেলায়। খেলাটা স্যাডিস্টিক এবং শ্রেণীনিরপেক্ষ। কোটিপতি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে মুটে, ভিক্ষুক, বেশ্যার দালাল- এমনকি কঞ্জিউমার মধ্যবিত্ত শ্রেণীটি পর্যন্ত যে কোন সময়ে খেলাটির ভিকটিম বনে যেতে পারে।
তখন; তখন, চারপাশে জন্ম নেয় এমন একটি সময়ের- যখন স্নায়ুর প্রতিটি কোষ সেই ব্যাখ্যাতীত অশুভ বোধের ইঙ্গিত ছড়ায়। পরাক্রান্ত দৃশ্যগ্রাহ্য সভ্যতাকে সেই বিরল সময়ে সন্ত্রস্ত থাকতে দেখা যায়।
সেই রাতে আগে আগে শুয়ে পড়লেও তার ঘুমাতে বেশ দেরী হয়। একগুচ্ছ বিক্ষিপ্ত ভাবনা তার মস্তিষ্কে অনবরত বিচরণ করতে থাকে। এমনটা ঘটে থাকে আধুনিক মানুষের। আধুনিক মানুষ নিজের ঘরে একা থাকাটাও ঠিকভাবে শেখেনি- এমনটাই অভিমত ছিলো কবি রিলকের। এই সন্ত্রস্ত, আতঙ্কিত সময়ে ভাইরাসই তো শুধু নয়- যে প্রাত্যহিক অভ্যস্ত দৈনন্দিন জীবন বিভিন্ন অনিবার্য ভাবনাকে নিকটে আসা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে; শোধ নেওয়ার সুযোগ তারা ছাড়বে কেনো? অতঃপর তারা চেতনার অভিমুখী হবে এবং ব্যক্তিমানুষকে ভয়ে আক্রান্ত করে তুলবে। একটু থিতু হলে এমন একটি চিত্র ভেসে উঠতে পারে-
ক্ষমতার নিরঙ্কুশ বলয়ের ভিশিয়াস সাইকেলটি কিছু সময়ের জন্য আনপ্রেডিক্টেবল হয়ে উঠেছে। কখন, কোথায়, কীভাবে, কার বরাবর সে ছোবল বসাতে পারে- কোনভাবেই ঠাহর করা যাচ্ছেনা। ক্ষমতাবানদের জন্য সময়টি যখন বিপদসঙ্কুল; সেই বিপদের পরিসর ক্রমশ বিস্তৃত হতে থাকে। তখন আনথিঙ্কেবল এবসার্ডিটিকেই চূড়ান্ত নরমাল বলে মনে হতে থাকে। একটি মরণঘাতী ভাইরাস; পৃথিবীর সর্বত্র যা অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করছে- কখন কাকে কীভাবে ঘায়েল করে ফেলছে তার ঠিকঠিকানা নেই, ইন্টারনেট-ফেসবুক-এন্ড্রয়েড ফোনের সৌজন্যে মুহূর্মুহ তথ্যের ভারে ব্যক্তিমানুষ ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে, তারা তখন কানাকানি করছে; যেহেতু তারা তখন হৃদয়ের কথা কহিতে আরো বেশী ব্যাকুল। ফলে, তারা আনন্দে আতঙ্ক বিনিময় করছে, প্যাসিভ ম্যাসোকিজমের উৎপাদন করে চলেছে। সময়ে সময়ে ছিটকে বেরিয়ে পড়ছে বীভৎস সব বাসনা। বাইরে না বেরুলেই নয় এমন গরিবগুর্বো মানুষদের ধরে ধরে আর্মি-পুলিশের পেটানোয় মর্ষকামী সেই চেতনা সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে। ফেসবুকে ছবি শেয়ার হয়; ডাণ্ডারবাড়ি ছাড়া বাঙ্গালীর ভবিষ্যৎ নেই এমন ‘প্রাজ্ঞ’ রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান করে এক দঙ্গল মানুষ লাইক-কমেন্ট-শেয়ার-সহমতভাই চক্রে ঘুরতেই থাকে আর ঘুরতেই থাকে। কোয়ারেন্টাইন শব্দটি কারণে অকারণে মিনিটে মিনিটে উচ্চারিত হয়; এবং আমাদের সেলফ-আইসোলেটেড যাপনকে সম্মোহিত করে। সম্ভবত কিছুটা অন্ধকারে রেখেই। নয়তো, হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভবপর হতো; এই এনফোর্সড সেলফ-আইসোলেটেড যাপন প্রকৃতপ্রস্তাবে সিল মারা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। আমাদের বসবাস বহুকাল আগে থেকেই; সেলফ- আইসোলেটেড। সংবেদন, মূল্যবোধ, সমন্বিত যাপন- এই ত্রয়কে লম্বা সময়ের ছুটি দিয়ে না থাকলে স্থূল উৎসবমুখরতায় ব্যাপৃত হওয়া যেতোনা। কিংবা অনিবার্যভাবে চোখের সামনে মূর্ত হয়ে উঠতো কথাটি- আধুনিক মানুষ তার ঘরে একাকী থাকাটাও ঠিকভাবে শেখেনি।
তদুপরি, লোনলিনেসকে গিফট হিসাবে চিহ্নিত করতে না শেখা ব্যক্তিমানুষ যত্রতত্র কোয়ারেন্টাইন শব্দটি উচ্চারণ করে তৃপ্তির হাসি হাসতে পারতোনা।
পরেরদিন দুপুরে ঘুম ভাঙ্গবার পরে; ফ্রেশ হতে হতে সে মনঃস্থির করলো, নিজের ঘরের জন্য এবারে বড় দেখে একটা আয়না কিনবে।