আমি দিনটির জন্য অপেক্ষা করে ছিলাম। অবশেষে আগামীকাল তার মুখোমুখি হবো।
সমাজের সাথে আমার সাংঘর্ষিক সম্পর্ক। বহুদিন ধরে। দিনতারিখ গুনে বলতে পারবোনা। কেবল এটুকু বলতে পারি, আমি মনেপ্রাণে একটি চূড়ান্ত পরিণতি চাইছি। দম আটকে যাওয়া যাপনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি।
আব্বার ঘরের বড় ঘড়িটা সবসময়েই জোরে বেজে উঠে। আমি বেশ অন্যমনস্ক থাকি। তাই চমকে যাই। আর চমকে যেতো আম্মা। আম্মার কথা যতোবারই ভাবি, বিস্মিত হই। একজীবনে অগুনতিবার বিস্মিত হতে দেখেছি তাকে। আমার বড় ভাই মায়ের স্বভাব পেয়েছে। লোকে এমনটাই বলে। লোকের অবশ্য বলার শেষ নেই।
গতো দুইদিন ধরে অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছে। এমনটা শেষ কবে দেখেছি বলতে পারিনা। পাড়ার বয়োঃবৃদ্ধ কালো কুকুরটিকে কিছুদিন হলো দেখছিনা? সেও কি………
মনে আছে সেদিনও বেশ বৃষ্টি হচ্ছিলো। আমি বাইরেই জুতাজোড়া খুলে রাখছিলাম। ঘরে ময়লা জুতা নিয়ে ঢুকলে আমার শান্তশিষ্ট আম্মা বাড়ি মাথায় তুলতে সময় নিতোনা। জুতাজোড়া রাখছিলাম, একটি অস্ফুট শব্দ কানে আসলে কৌতূহলী হয়েছিলাম।
পরিচিত বন্ধুবান্ধদের যতোটা সম্ভব এড়িয়ে চলি। দুই বছর হয়ে গেলো। নিজে থেকে শেষ দেখা করেছিলাম শাফায়েতের সাথে। তার বাসায় গিয়েছিলাম। অনেক কথা হয়েছিলো। বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে হচ্ছিলো, শরীর জুড়ে কেউ হাজার হাজার আঁচড় কেটে দিয়েছে। তারপর থেকে নিজের ঘরকে অবলম্বন করে বেঁচে আছি। আর কিছু বইপত্র। সরকারী চাকরীর।
ম্যাট্রিক পরীক্ষা পর্যন্ত ছোট কাকা আমাদের সাথে থাকতো। গমগম করে হাসতো ছোট কাকা। যেনো সমগ্র পাড়ার সকলের হাসি সে একাই হাসছে। ছোট কাকার সাথে আব্বার বনিবনা হতোনা কখনো। ছোট কাকা বড় ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধার কার্পণ্য করতোনা। কিন্তু নিজস্ব মূল্যবোধের ব্যাপারে অনড় ছিলো। ছোট থাকতেই তা বেশ টের পেতাম। কাকা তার প্রতিটা খাতায় একটা কথা লিখে রাখতো। ‘চন্দ্রবিন্দুর সম্মানের প্রতি সকলে আকৃষ্ট হয়না।’
বাইরে বৃষ্টি একটু থেমেছে। ফ্যানের সুইচ বন্ধ করে দিলাম। পাশের ঘর থেকে আব্বার কাশির শব্দ আসছে। ইদানিং বেশ কষ্ট পাচ্ছেন লক্ষ্য করেছি। নিজে থেকে কিছু বলতে যাইনা। পরিষ্কার বুঝতে পারি টানা দুই বছরের স্বেচ্ছানির্বাসন আমাকে পর্যাপ্তভাবে নিষ্পৃহ করে তুলেছে। কিন্তু উপায় কী? চন্দ্রবিন্দূর সম্মানের যেই উত্তাপ, তাকে আমি অগ্রাহ্য করতে পারিনি।
শম্পা বেণী দুলিয়ে প্রাণ খুলে হাসতো। লালবাগের কেল্লায় এখান থেকে সেখানে হাঁটতে হাঁটতে সে গলা খুলে হাসতো। পরিপার্শ্বের প্রতি আমার বিব্রত স্বভাবকে সে তোয়াক্কাই করতোনা। মাঝেমাঝে চিন্তা করতাম, স্বার্থপর বোন আর লম্পট দুলাভাইয়ের সাথে বসবাস করেও সে এতোটা প্রাণোচ্ছল থাকে কীভাবে? শম্পার হাসিতে আমি আমার ছোট কাকাকে দেখতে পেতাম। চারপাশের অসহনীয়তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজের মতো করে বাঁচতে চেষ্টা করে যাওয়া। চন্দ্রবিন্দুর সম্মানের কাছে বশ্যতা স্বীকারের স্বচ্ছস্ফটিক অনীহা।
আম্মার সাথে ছোট কাকার দূরত্ব ছিলো। কিন্ত আম্মা ছোট কাকাকে প্রশ্রয় দিতো। দিব্যি বুঝতে পারতাম। বড় ভাই, বাবার আদর্শে বড় হওয়া মানুষ। ঔপনিবেশিক মধ্যবিত্তের মূল্যবোধে দীক্ষিত। নিয়ম-শৃঙ্খলা, সামাজিক প্রতিষ্ঠার সিঁড়িগুলো একের পর এক অতিক্রম করে যাওয়া, পরিচিত মহলে শ্রদ্ধেয় হবার প্রাণহীন জড় পরিণতিকে আলিঙ্গন করে নেওয়ার মাঝে যেই মূল্যবোধ সাফল্যকে চিহ্নিত করে।
শম্পার কথা ইদানিং অনেক কম মনে হয়। আমি বুঝতে পারছি, দিনে দিনে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছি। সমাজের সাথে দোস্তি করার পথে ক্রমশই উন্নতি করছি, বেশ টের পাই। রিটেন পরীক্ষা দিয়ে যখন এক্সাম হল থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম, নিশ্চিত ছিলাম ভাইভায় আমার ডাক পড়বেই। আম্মা ছাড়া আমার প্রতি এতো আস্থা আর কারোর ছিলোনা। বউ-সন্তান নিয়ে বাসা ছেড়ে যেওয়ার সময়ে আমার প্রতি বড় ভাইয়ের চাহনী আজীবন ভুলতে পারবোনা। যেনো আমার কপালে অসম্মানিত হবার পরিণতি চিরকালের জন্য মোহরাঙ্কিত।
সেই দিনটির পর থেকে আমি কোন অস্ফুট শব্দ শুনতে পেলেই চমকে উঠি। যেনো কোন বিপদ আমার পথে ওত পেতে রয়েছে। বৃষ্টিস্নাত ময়লা জুতাজোড়া বাইরে রেখে ধীরে ধীরে ঘরে আসছি। অস্ফুট শব্দটা এবারে পরিষ্কার। আব্বার কন্ঠস্বর চিনতে কখনোই ভুল হতোনা আমার। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তার বন্ধ ঘর থেকে নারী কন্ঠের সংকোচপূর্ণ হাসি শোনা যাচ্ছিলো। আম্মা সদ্য বিধবা হওয়া বোনের বাড়িতে গিয়েছিলো। নারী কন্ঠটি শুনতে পাবার পরে পা টিপে টিপে রান্নাঘরে গিয়েছিলাম। অজস্র ময়লা বাসনকোসন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ঘর মোছার বালতির সাথে আরেকটু হলে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতাম। গ্যাসের চুলা নিভিয়ে দিয়েছিলাম।
এই ঘটনার এক মাসের মধ্যে আম্মা কোত্থেকে এনড্রিন যোগাড় করেছিলো কে জানে। নাকি সিদ্ধান্তটা অনেক আগেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিলো? কেবল এক্সিকিউশনে বিলম্ব? বলতে পারিনা। আম্মার ডেডবডির পাশে আব্বার শূন্য চোখ দেখে আপ্লুত হবার কোন কারণ ছিলোনা। কতোটা সঠিক ছিলো আমার অভিব্যক্তি তা দিন পনেরো পরে ঠিকই বুঝেছিলাম। পানি খেতে রান্নাঘরে যাবো, দরজা ঠিকভাবে খুলতে না খুলতেই দেখি সদ্য ঘরের কাজে যোগ দেওয়া আঠারো বছর বয়সী মেয়েটির সাথে আব্বা ইঙ্গিতপূর্ণ ভঙ্গিমায় কথা বলছে।
আগামীকাল এক নতুন ইঙ্গিতের সূচনা হবে। আমি ঠিক করে রেখেছি, ছোট কাকার যে হাতঘড়িটা এতোদিন ধরে পরে এসেছি তা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে ঘড়িহীন অবস্থাতেই ভাইভায় যাবো। ব্যাপারটা সিম্বলিক। চন্দ্রবিন্দুর সম্মানকে আমি অগ্রাহ্য করতে পারিনি। এমন একটি অনিবার্য দিনে কিভাবে ছোট কাকাকে নিজের সাথে বহন করি?
না, আমি খোদ নিজেকে কেন্দ্র করে বাঁচতে চাই। মৃত আম্মা, দ্বিচারী আব্বা, আত্মকেন্দ্রিক বড় ভাই, লম্পট দুলাভাইয়ের সাথে ইলোপ করা ডিসিভিং শম্পা, দীপ্যমান হয়ে এতোকাল ধরে স্মৃতিতে জাগরূক হয়ে থাকা অসফল কিন্তু দৃঢ়চেতা ছোট কাকা- এদের সকলকে আমি অতিক্রম করে যাবো। অক্ষর হিসাবে চন্দ্রবিন্দুকে অতোটাও আর অকিঞ্চিৎকর মনে হয়না।
বাইরে আবারো বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পাশের ঘর থেকে আব্বার কাশির দমক ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আধশোয়া ছিলাম। ঘুমাতে যাবার আগে আয়নায় নিজেকে দেখে নিলাম। জানালার পেছনে হাত দিতে শক্ত কী একটা পেলাম।
আয়নাটা ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেলে মনে হলো, আগামীকাল থেকে চন্দ্রবিন্দুকে অবলম্বন করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবো। নিঃসংকোচে।