১.
সেই কথোপকথন স্মৃতিতে আজও জাগরূক। গতোকাল গাছগাছালি দিয়ে ঘেরা প্রিয় রাস্তাটায় হাঁটতে হাঁটতে ফের সেটা উপলব্ধি করলাম। সেদিন তুমি উচ্ছ্বল ছিলে। তাও মনে করতে পারি, প্রেক্ষাপটসমেত। স্মরণীয় কথোপকথনের স্মৃতি মাত্রই কি ডিটেইলড দৃশ্যকল্পের পুনরাবির্ভাব? নয়তো তোমার হালকা সবুজ জামার কথাও স্পষ্ট মনে আছে কীভাবে?
২.
বুদ্ধিদীপ্ত কনভারসেশনে নাকি ভার্বের চাইতে নাউনের ব্যবহার বেশী হয়। ক্রিয়ার উপরে বিশেষ্যের প্রশ্নাতীত আধিপত্য। প্রথমে যখন শুনেছিলাম, মনে হয়েছিলো- নিজের বড় ভাবীর প্রতি তোমার লালন করা বিতৃষ্ণার ইঙ্গিতবহ কোন বার্তা? তার গসিপপ্রবণতায় তুমি নানা সময়ে জর্জরিত হয়েছো বলেই কী……… আমার ভাবনার অভিমুখ সম্পর্কে সম্যক ধারণা করাটা তোমার পক্ষে টাফ ছিলো- আমার মুখে প্রায়শই, আমার ভাবনার কোন রেখাপাত হয়না, এই কথাটা তোমার মুখ থেকেই শুনে শুনে, ধীরে ধীরে আমি নিজেই তা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি। কিন্তু তুমি নিজে থেকেই, অবহিত না হয়েও আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করেছিলে। তোমার বিশ্লেষণাত্মক মন, মতামতের সাথে তার যথার্থ ক্ল্যারিফিকেশনের উপরেও নির্ভর করতে প্রেফার করে। তোমার উপযুক্ত বাক্যাবলি এবং যুক্তির প্রিসিশনে আমিও একমত হয়েছিলাম যে মানুষের বিবিধ কর্মকান্ডের বিবরণের সাথে তার অন্তর্নিহিত কার্যকারণও যদি সেই আলাপের অন্তর্ভুক্ত হয়, তবে অনিবার্যভাবেই, ক্রিয়ার উপরে বিশেষ্যকে অগ্রাধিকার না দিয়ে উপায় নেই। তখন আমি মাত্র বাদাম খেতে শুরু করতে গিয়েও থেমে গিয়েছিলাম। আর যাই হোক তখন কোন ক্রিয়াকে অগ্রাধিকার দেওয়াটা কেমন কেমন জানি ঠেকছিলো!
৩.
ভালোলাগা আর ভালো না লাগার উপরে নির্ভরশীল হয়ে যাওয়াটা বেশ বিখাউজ এক রোগ। বিশেষত ভাবপ্রবণ মন হলে। হেডোনিজমের সূত্রপাত কি সেই চঞ্চলতার বাহুল্য থেকেই? সঞ্জীবের সাথে সপ্তাহখানেক আগে দেখা হয়েছিলো। বিয়ে করেছে প্রায় বছরখানেক হলো। অন্তর্গত পীড়নকে চমৎকারভাবে আড়াল করতে শিখে গেছে বলে মনে হলো। বউয়ের অশেষ অবদান? সঞ্জীবকে ফেসবুকে আনফলো দিয়ে রাখতে হয়েছে। প্রতিদিন বউয়ের সাথে খাওয়াদাওয়া আর নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াবার ছবি ছাড়া ওর প্রোফাইলে কিছু খুঁজে পাওয়া যায়না। এবং, ওর মুখের স্মিত পরিতৃপ্ত হাসিটি কনস্ট্যান্ট। সঞ্জীবের সাথে পুরনো সব স্মৃতি ঘাঁটতে ঘাঁটতে একবার মনে পড়লো- ভ্যারিয়েবল শব্দটা উচ্চারণে ওর বিশেষ কষ্ট হতো। তাই স্ট্যাটিস্টিক্স কোর্সে পুরা চারটা মাস কোর্সের স্যার আর আমাদের বিনোদনের কোন অভাব হয়নি! বিল পে করার সময়ে মানিব্যাগ থেকে ওর বউয়ের ছবিটা পড়ে গিয়েছিলো। তা ঢোকাতে ঢোকাতে, যেনো একটু উচ্চকন্ঠ হলেই কেউ শুনে ফেলবে এমন ভঙ্গিমায় বললো, সে এখনো অর্চিকে মিস করে। ওর পাঁচ বছর আগের এক্স।
৪.
কাছের মানুষদের মুখ থেকে নিয়মিত শুনছি, আমি নাকি দিনকে দিন সিনিকাল হয়ে পড়ছি। ঈর্ষাপ্রবণও। বেশ সারকাস্টিক মনে হয় আমার, তাদের অনেকের জাজমেন্ট। পরিপার্শ্বের প্রতি এতোটা ভক্তিপ্রবণ মন রাখা কতোটা সুস্থ্যতার পরিচায়ক? বিকারগ্রস্ততাকে; হোক সেটা প্রত্যক্ষ কী পরোক্ষভাবে, নরমালাইজ করা থেকেই কি এবসার্ডিটির সূচনা নয়? এরকম বিপন্ন সময়েই কি বিচারক আর বিচার্যের ভূমিকা মুহুর্মুহু বদলাতে থাকেনা? অন্তর্গত প্রীতিই যদি ন্যায়বোধের উপযুক্ত জননী হয়ে থাকে; তবে বাড়াস্য বাড়াদের উদ্বাহু আস্ফালনের সাথে সঙ্গতি না রাখাটাই তো অবশ্যম্ভাবী, নাকি? নাকি মূল্যবোধ ক্রমশ তেরো নাম্বার বাসের সাথে সিনোনিমাস হয়ে উঠছে? বিবিধ সামাজিক প্রপঞ্চরুপের ভীতির গর্ভে জন্মানো ক্রমবর্ধমান এডজাস্টমেন্ট? প্রান্তিকতায় না পৌঁছানোটাই যার একমাত্র সার্থকতা? তিনদিন আগে তাশরিকের সাথে দেখা হয়েছিলো। খেতে খেতে অনেক কথাই বললো। পরে বাসায় ফিরতে ফিরতে মনে হলো, পায়ে সাবলাইম এক শিকল পরে ঘুরে বেড়াচ্ছি- আমরা একেকজন মুক্তিপাগল সত্তা!
৫.
মধ্যরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে; প্রায়ই জানালার পর্দা সরিয়ে, পেছনের বিস্তৃতির দিকে তাকিয়ে থাকি। স্ট্রিটলাইটের কল্যাণে ঘরের জানালা থেকে তখন দেখা যায়; মাঠের মধ্যখানে সম্প্রতি গড়ে ওঠা ইটের ঢিবিটি, ক্রমশই দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ফ্লোরোসেন্ট আলোতে যদিও তার নিজস্বতা ম্রিয়মান।
ঘরটা বেশ সাদামাটাভাবে সজ্জিত। আমার নিজের অভিপ্রায়ে। জামাকাপড় রাখবার স্ট্যান্ড, তার পাশে একটা মাঝারি সাইজের বইয়ের তাক, পড়ার টেবিলে সরকারী চাকরীর বইপত্র স্তুপাকারে অবস্থিত। তার একটু পাশেই দেয়ালে একটা আয়না, ব্যাস এটুকুই। সীমাবদ্ধ এই পরিধিতে যখন হাঁপিয়ে উঠি, পর্দা সরিয়ে পেছনের মাঠের দিকে চেয়ে থাকা- কিছু সময় পরে মন প্রসন্ন হয়ে আসে। রামকৃষ্ণ পরমহংসের সেই বিখ্যাত উক্তিটিকে আজ নিতান্তই জেলো মনে হয়-
জন্মেছিস যখন একটা দাগ রেখেই যা।
আমাদের মনস্তত্বে কি সেই রক্তই অবিরাম ক্রিয়াশীল না? ফেসবুকের নিউজফিড মিনিট দশেক স্ক্রল করলেই বেশ মনে হতে থাকে কথাটা।
আমার ফ্রেন্ডলিস্টের কারোরও নিশ্চয়ই এমনটা মনে হতে পারে, আমার প্রোফাইলে ঢুঁ মারার পর!
৬.
সেই কথোপকথন স্মৃতিতে আজও জাগরূক। গতোকাল গাছগাছালি দিয়ে ঘেরা প্রিয় রাস্তাটায় হাঁটতে হাঁটতে ফের সেটা উপলব্ধি করলাম। সেদিন তুমি উচ্ছ্বল ছিলে। তাও মনে করতে পারি, প্রেক্ষাপটসমেত। তোমার পরনের সবুজ জামাটার স্মৃতি এখনো কী উজ্জ্বল, কী উজ্জ্বল!
আলো ফিকে হয়ে আসতে থাকলে; বুদ্ধিদীপ্ত সেই কনভারসেশনের শেষে, তুমি ফিউচার প্রস্পেক্টের কথা বলতে শুরু করলে। আমার মানসিক প্রস্তুতি ছিলো। তোমার প্রতি যারপরনাই কৃতজ্ঞ আমি। ন্যাকা কনফেশনাল মাইন্ডেড নও বলে। তবে সঙ্গত কারণেই; সেই প্রথম এবং সেই শেষ, হেডোনিজমের কাছে তোমার অবনত মস্তকের গল্পটা আমার জানতে হয়েছিলো। আমার লেসবিয়ান ছোট বোনটার প্রেমিকার প্রতি আমার জৈব আকর্ষণের ইতিবৃত্তান্ত তোমার জানা ছিলো। কিন্তু তা মুহূর্তনির্ভর ভোগের কাছে বন্দী নয়। তাই তোমার নিজের রাস্তা বেছে নিতে চাইবার প্রাতিস্বিক সেই ভঙ্গিমাকে এপ্রিশিয়েট করতে দ্বিধা বা জড়তা কাজ করেনি। সেই পরিস্থিতিতে আমরা যুগপৎভাবে বিচারক এবং বিচার্য ছিলাম। আমরা দুইজনেই কথাটা জানি এবং বিশ্বাস করতে চাই যে, মানি।
৭.
আজকাল প্রায়ই, মধ্যরাতে তোমাকে অনলাইনে দেখায়। তোমার অফিস একটু দুপুরেই শুরু হয় জানি, তবুও তোমার ঘুম পর্যাপ্ত সময় ধরে হয়না তা জানা কথাই।
তোমার জেগে থাকা দেখে আরো যা জানি তা হলো-
ইউ হ্যাভ এমব্রেসড এ কফিন এট ইউর ঔন পেরিল!
তোমার বিবিধ ক্রিয়ার অন্তর্নিহিত কার্যকারণ সম্পর্কেও আমি আমার সংবেদনকে জাগরূক রাখতে চাই। ক্রিয়ার উপরে বিশেষ্যের প্রভাব।