সন্ধ্যাব্যাপী ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে, এসে খালি চেয়ারটিতে বসতেই আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। আপাত কারণ হিসাবে আলোর কথা বলা যেতে পারে; তা অসঙ্গতিপূর্ণ এমনও নয়, কিন্তু জানি এটাই একমাত্র কারণ নয়। এমন একটা দিন আমার জীবনে অনিবার্য ছিলো। অনেকসময় অতিক্রান্ত হবার পরে তা বুঝেছি এবং, যতোটা সম্ভব নিরাসক্ত মনে, সেই অবশ্যম্ভাবীতার সঙ্কেতটিকে গ্রহণ করতে চেয়েছি।
বিকালের দিকে একটি রোড এক্সিডেন্ট প্রত্যক্ষ করতে গিয়েও করা হলোনা। পতনোন্মুখ পথচারীটি শেষ মুহূর্তে জীবনের মায়ার কাছেই ঝাঁপ দিলো। কিংবা এমনও বলা যেতে পারে, সেই মুহূর্তে সে ভেবেছিলো এখনো জীবনের কাছে কিছু সে আন্তরিকভাবেই আকাঙ্ক্ষা করে। হয়তো নিজের অন্তর্গত লোভকে সে চিনতে পেরেছিলো সেই মুহূর্তে, অনেকসময় পর। ট্রাকচালক তাকে গালাগাল করতে করতে সম্ভাব্য বিপদের কথা কল্পনা করেই সম্ভবত ব্যস্ত সড়কে যতোটা পারা যায়, ততোটা দ্রুতগতিতে চলে যেতে চাইলো। মৃত্যু এখানে কতোটা আশ্চর্যরকমের স্বেচ্ছাচারী! জীবনের সাথে সংযুক্ত থাকতে চাইবার অমোঘ আকর্ষণ কিংবা রিক্ত হৃদয়ে তা থেকে নির্বাসন নিতে চাওয়া; যে কোন অবস্থানের সাপেক্ষেই বোধকরি কথাটি সত্য। ভাবনাটিকে আরো বড় কোন প্রেক্ষিত থেকে বিচার করা যায় কিনা বিচার করা সম্ভবপর হলোনা। তিনটা ফাঁকা চেয়ারের পরের চেয়ারটিতে একজন ভদ্রমহিলা; খুব সম্ভবত তার স্বামীর উদ্দেশ্যেই হবে, দাঁতে দাঁত চেপেও ক্রোধ সংবরণ করতে ব্যর্থ হলেন। দুইবার বেশ জোরেই বলে উঠলেন- সিনিকাল, সিনিকাল।
শব্দটা যেখানেই শুনি, স্বগতোক্তি করে উঠি, কে নয়? আমার এক্সপ্রেশন সময়ে সময়ে অত্যন্ত চাপা ফলশ্রুতিতে তীব্র হয়ে উঠে। আমি আন্তরিকভাবে এই কথাটি বিশ্বাস করি যে আমাদের চিৎকার দিনের শেষে ভেজা ক্রোধে পরিণত হয়। জিঘাংসা কিংবা ভয়কে অগ্রাহ্য করতে চাইবার ভীরুতা; সম্ভাব্য কারণ হিসাবে উভয়কেই শনাক্ত করা যেতে পারে। কিংবা হয়তো আরো অনেক কারণই থাকতে পারে। কারণ তো দিনের শেষে প্রেক্ষিতনির্ভর ফলাফল। তবে আমি এ কথা জানি আমি চিৎকার করলে চারপাশের মানুষ তাকে সিরিয়াসলীই গ্রহণ করবে। প্রেক্ষিত, উপযুক্ত সময়, ন্যায্যতা – এসকল বিষয়ের যথার্থ সংমিশ্রণ মানুষের কন্ঠস্বরের মধ্যে ভিন্নতা এনে দিতে সক্ষম।
ইরা আমাকে দিনের পর দিন ধরে কনফিউজড করে দিতে চাইছে। মুহূর্তনির্ভর সুখের কাছে নিজেকে বন্দী রাখবার আকাঙ্ক্ষা এবং অন্যের ইচ্ছার সাপেক্ষে তার নিজস্ব বাসনাগুলো নির্মিত বলে। প্রীতি উৎসারিত যেসকল ভ্যাল্যুজকে আমি নিজের থেকে অবিচ্ছেদ্য বলে মনে করি; তাকেই সে ধরে নেয় জাগতিকতা থেকে আমার পলায়নপর প্রবৃত্তি হিসাবে। ভাবুক টার্মখানা সমাজের প্রায় সর্বত্র ব্যাঙ্গার্থে ব্যবহৃত হবার কার্যকারণ, উৎস এবং এর পেছনের মর্মান্তিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখি বলে তার সাথে এসকল বিষয়ে কথোপকথন পারতপক্ষে আমাকে দুঃখিত করেনা।
“তুমি ইনিশিয়েটিভ নিতে এতো পিছপা হও কেনো বলোতো? তোমার চারপাশের বন্ধুদের দেখো। তারা কেউই আর জীবনে পিছনে ফিরে তাকাবেনা। কিন্তু তোমার কোন হেলদোল নাই। এভাবে তো চলেনা।”
এসকল অভিযোগ কিংবা দীর্ঘমেয়াদী অর্থহীনতার সাথে ইতিবাচক কোন সংযুক্তি স্থাপনে দিনে দিনে অনাগ্রহ বেড়ে চলেছে আমার। তাই আমি নিরুত্তর থাকতে প্রেফার করি। এই বাস্তবতা সম্পর্কে আমি অবহিত যে সংশ্লিষ্ট দূরত্বটির গতিপথ প্রশস্ত। একে অপরের প্রতি আমৃত্যু; চাপা কিন্তু তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক মনোভাব ধরে রেখে জীবনের প্রাত্যহিকতার সাথে সঙ্গতি বজায় রেখে চলাটা হয়তো নিয়তিই হয়ে থাকবে বোধকরি।
“থেরাপিস্ট যা যা জিজ্ঞেস করে, সব গুছায়ে বলবি। কোন ভুল যেনো না হয়। কাগজটা হাতে রাখবি। কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবি যে বাবা হাতে রাখতে বলছে।” পেছন থেকে বেশ ভারি একটি কন্ঠস্বর শুনে তাকাতে বাধ্য হলাম। ষোলো-সতেরোই হবে বয়স, লম্বা গড়নের আত্মজের উদ্দেশ্যে অসন্তোষের ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে কিছু কাগজপত্র কোটের পকেট থেকে বের করলেন রাশভারি পিতা। লেখালেখির সাথে যুক্ত বলেই কিনা কে জানে, সাথে সাথে ভিজুয়ালাইজ করলাম। চিরাচরিত মধ্যবিত্ত ভাবাদর্শে নির্মিত একজন বাবা; একের পর এক অতিক্রম করে চলেছেন সমাজের সিঁড়ি, উপরের দিকে উঠছেন এবং নিচের দিক থেকে চোখ ক্রমশই দূরবর্তী হচ্ছে। তার জীবনের সাপেক্ষে সবচাইতে মানানসই শব্দটি হবার কথা উত্তরণ। আন্ডার সারফেস লেভেলে শর্ত তৈরী হতে হতে অবশেষে কোন চোরাগুপ্তা পথে পারিবারিক জীবনে বিপর্যয় এসে আবির্ভূত হয়েছে টের পর্যন্ত পাননি। বোধকরি নিঃসঙ্গও হয়ে থাকবেন, পরিবারের অবিসংবাদিত এটিএম মেশিন হবার সম্মানিত অবস্থান সংশ্লিষ্ট প্রেক্ষিতের কারণে তার সাম্প্রতিক মনোজগতে ভিন্ন কোন ভাবনাও হয়তোবা জাগিয়ে তুলতে পারে। ছেলেটির সিরিয়াল নাম্বার বেশ পরে আগেই চোখে পড়েছিলো। এখন চলছে বারো নাম্বার, আমার পনেরো আর ছেলেটির সম্ভবত উনিশ। পিতার দিকে চোখ তুলে পর্যন্ত তাকাতে পারছেনা। অপরাধী মুখে চারপাশ ঘুরে দেখতে চাইছে। এক প্রজন্মের অবিমৃষ্যকারীতার দায়ভার বহন করতে শুরু করেছে তার পরবর্তী প্রজন্ম, প্রশ্নাতীত ক্ষমাহীনতায়। চারপাশের আলোটা বড্ড বেশী চোখে লাগছে। সর্বত্রই এতো লাউড এম্বিয়েন্স, নেওয়াটা টাফ। ঔচিত্যবোধের প্রশ্ন যদি উহ্যও রাখি। অসন্তুষ্ট ভদ্রলোকটি এবারে সম্ভবত পানি খেতে উঠলেন। ছেলেটি এবারে কিছু সময়ের জন্য স্বস্তি পেয়ে থাকতে পারে। আমার সাথে চোখাচোখি হলে তার উদ্দেশ্যে অভয়সূচক হাসি ছুঁড়ে দিলাম। আশা করি কনভিন্সড হবে। আমার বয়স তেত্রিশ, তার দ্বিগুণ বয়সী একজন মানুষকেও মনোজগতের জটিলতাজনিত কারণে থেরাপিস্টের দ্বারস্থ হতে হয়; একমাত্র এই বাস্তবতাটুকুই এই পরিবেশে তার কমফোর্টের সহায় হতে পারে।
সেই দিনটায় বেশ গুমোট বাতাস ছিলো। বিকালে যখন মনঃস্থির করলাম শাদাবের অফিসে যাবো, দ্বিতীয়বার তা নিয়ে ভেবেছিলাম। তবু শেষমেষ যাবার সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম। প্রাত্যহিক রুটিরুজির ধারাবাহিক টানাপোড়েন দুঃসহ অবস্থায় চলে গিয়েছিলো। ইঁদুর দৌড়ে জয়লাভ করলেও শেষ পর্যন্ত ইঁদুরই থেকে যেতে হয় বটে, কিন্তু ‘পরথমে হইলো প্যাট তারপরে হইলো চ্যাট’ – এই আপ্তবাক্যটির বিকল্প আজও আবিষ্কৃত হয়নি। না, সমাজের সিঁড়ি একের পর এক অতিক্রম করে যেতে পারার অথর্ব অহমের প্রতি আকাঙ্ক্ষা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখেনা। কিন্তু কে ভেবেছিলো?
নিজের চেয়ারে দোল খেতে খেতে শাদাব পিএসকে ডাকলে সে যখন সামনে এসে আবির্ভূত হয়; বন্ধুকে নিজের সমৃদ্ধি দেখাতে পারার গর্বে শাদাবের গর্বিত মুখ, তার পিএসের সটান সাবলীল সংকোচহীন ভঙ্গিমা- সবমিলিয়ে নিজের উপরে সন্দেহ হলো। মাংসল জীবন তার দাঁতমুখ নিয়ে যে কোন সময়ে বেরিয়ে আসতে পারে; যার কাছে নিমেষে উন্মূল হয়ে পড়বার সম্ভবপরতার ভেতরেই সকল মহাচেতনাকে অগ্রসর হতে হয়। কোন সে পটভূমি, যা মোহের মুখোমুখি হবার পর তার সৎকার না করেই সদর্পে এগিয়ে যেতে সক্ষম? তখন খুব মন দিয়ে বিস্কুট খেতে শুরু করেছিলাম। শাদাবের দিকে চোখ না তুলে। বন্ধুর অফিস থেকে বের হবার পরে উপলব্ধি করেছিলাম, নিজের সাথে উপযুক্ত বোঝাপড়ার প্রয়োজনেই আমার সাহায্যের প্রয়োজন। স্ববিরোধীতা সময়ে সময়ে ব্যক্তিমানুষের সীমাহীন সম্ভাবনার ঐশ্বর্যকে যেমন প্রস্ফুটিত করে, তেমনি তাকে নগ্ন করে স্বনির্মিত আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে স্পষ্ট করে স্বীয় সীমাবদ্ধতাসমূহকেও দেখিয়ে দিতে জানে। মোহ মানুষের প্রথম সার্বক্ষণিক শত্রু। একে অস্বীকার করা চলেনা, কোন কল্যাণমুখী বৃহৎ চিন্তাকে যান্ত্রিকভাবে গ্রহণ করে তাকে নস্যাৎ করে দিতে চাওয়াটা বালকসুলভ মূঢ়তা, সর্বোচ্চ তাকে নিয়ন্ত্রণে রেখে এগিয়ে যাওয়া যায়। সেটাও মোহের অমোঘ প্রভাবকে স্বীকৃতি দিয়েই। আর আট-দশজন মানুষের মতো আমার জীবনও সম্ভবত শিল-পড়া আমের মতোই, পাকেও না পঁচেও না।
তাই সেদিন আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আজকের মতো একটি অনিবার্য দিবসকে গায়ের জোরে ঠেকিয়ে রাখাটা অর্থহীন। সম্ভবত প্রবাহকে তখনই অবলোকন করাটা সম্ভবপর, যখন তার অনিবার্যতাকে গ্রহণ করে তার জন্য অপেক্ষা করা যায়।
পনেরো নাম্বার সিরিয়ালের ডাক পড়েছে। ধীরস্থির ভঙ্গিমায় সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। টেনশন কিংবা কৌতূহল থেকে নয়; ওসব আমার অবচেতনের কাছেই থাক। ইরা বারবার বলে আমাকে, তোমার সমস্যা হইলো তুমি এনজয় করতে জানোনা। এনজয় দা মোমেন্ট। খোদ মোমেন্টকে ত্যাগ করতে পারাটাই যে আমার আরাধ্য; ইরাকে কখনো না জানালেও থেরাপিস্টকে আমি স্পষ্ট তা জানিয়ে দিতে চাই। আমি ধীর পায়ে এগোতে থাকলাম।