বাস থেকে নামার আগে সে ভুলেই গিয়েছিলো যে আজ দুপুরেও পায়ের ব্যথায় সে জেরবার হয়ে গিয়েছিলো। টনটনে যে ব্যথাটা তাকে কাবু করে ফেলেছিলো সেটা অফিস থেকে বেরোতে বেরোতে একটু কম অনুভূত হলেও বাস থেকে নামার সময়ে বাম পা মাটিতে রাখতে রাতে ফের তীব্র হয়ে উঠলো। কিন্তু তখন সেটা পরখ করে দেখবার কোন উপায় ছিলোনা। পেছনে একের পর এক বাস রাস্তা দিয়ে ধেয়ে আসছে। একটু এদিক-সেদিক হলেই শরীর চিড়েচ্যাপ্টা। নিরেট অথর্ব শরীর নিয়ে সে তখন মাটিতে শোকসন্তপ্তহীন পড়ে থাকবে।
রোড ডিভাইডার সন্তর্পণে পেরিয়ে সে ফাঁকা ফুটপাথে এসে পায়ের ব্যথাটা পরখ করে দেখলো। ডান পায়ের কাছটায় মোজার শক্ত দাগ হয়ে রয়েছে। কিন্তু ভেতরটা ব্যথায় টনটন করছে। তার ইচ্ছা করছে ব্যথার অংশটুকু কামড়ে শরীর থেকে বের করে নিয়ে আসে। সে একবার রাস্তার বিপরীত দিকের জনমানবহীন বাসস্ট্যান্ডটার দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকালো। রাত বেজে গেছে সাড়ে নয়টা। আশ্বিন মাসের রাত, হালকা মিহি বাতাস শরীরে স্মৃতির মতো সুখদায়ক মিহি বেদনা তুলে ফের মিলিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা থেকেই চাঁদটা অর্ধেক হয়ে আকাশের শরীরের উপরে ঝুলছে। সে ছোট চোখজোড়া নিয়ে একপলক তার দিকে তাকিয়ে নিরাসক্ত ভঙ্গিতে ডানপায়ে জুতাটা ফের গলিয়ে দিলো এবং বারো গজ সামনের এক রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। বাসায় গিয়ে খাওয়াদাওয়ার হাঙ্গামায় জড়াতে তার আগ্রহ হচ্ছেনা। এখানেই খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে ফেলে রিকশা করে সোজা বাড়ি চলে যাবে। হাতমুখ ধুয়ে জামাকাপড় পাল্টে দশ মিনিটের মতো সত্তর বছর বয়সী বৃদ্ধা মায়ের ঘরে গিয়ে বসবে। তারপরে ধীরে সেখান থেকে উঠে চলে যাবে রান্নাঘর বরাবর। সেখানে গিয়ে…… ইপ্সিত কল্পনায় তার চোখ চকচক করে উঠলো। সে শান্তমুখে ওয়েটারকে ডেকে খাবারের অর্ডার দিয়ে চামড়ার ব্যাগে একবার হাত বুলিয়ে ধবধবে ফর্সা বাতির দিকে চেয়ে রইলো।
আজকে অফিসে তার বড্ড ধকল গেছে। ডেলিগেশনের অফিসারেরা সারাদিন এসেছে আর গেছে। সে একের পর এক অশিক্ষিত গবেটদের হাসিমুখে সামলেছে আর সুযোগ পেলেই মনে মনে গালাগাল করেছে। এর যে সুখ, তার তুল্য কিছু হতে পারেনা। লাঞ্চের সময় হতেই সে ক্যান্টিনের দিকে গেছে। সচরাচর সে বাড়ি থেকেই দুপুরের খাবার নিয়ে আসে। কিন্তু সকাল সকাল বেরোবার তাড়ায় আজ একেবারে ভুলে গিয়েছিলো। তাই ক্যান্টিনে গিয়ে বিস্বাদ মুরগির সাথে স্বল্প ভাত খেয়েছে, তারপরে একটা পান মুখে দিয়ে চিবাতে চিবাতে ফের মন দিয়ে কাজ করতে উঠে গেছে নিজের ঘরে। তখন থেকেই সে একটা ফোনকলের প্রত্যাশা করছিলো এবং পায়ের ব্যথায় পর্যুদস্ত হয়ে যাচ্ছিলো, বাস থেকে নামতে নামতে ফের ব্যথাটা জেগে উঠলে তখনো তার প্রত্যাশিত ফোনকলটার কথা মনে পড়ে গিয়েছিলো।
‘আপনার কাঁচামরিচ লন।’ ওয়েটারের নিষ্প্রাণ কন্ঠে সাড়া দিয়ে সে কাঁচামরিচ প্লেটে তুলে নিলো এবং ভাত মাখতে মাখতে পুরনো অতীত স্মৃতির গন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো। তিন বছর আগে সেই দিনটায়ও এমন হয়েছিলো। সে তখন সবেমাত্র অফিস থেকে গভীর রাতে বাসায় ফিরেছে। হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে বসে ইলিশের গন্ধ শুঁকে কাঁচামরিচ প্লেটে নিতে যাবে, এমন সময়ে তার সদাস্বাস্থ্যবান ছোট ভাইয়ের ঘর থেকে আর্তচিৎকার শোনা গেলো। তড়িঘড়ি করে তারা সেখানে ছুটে গিয়ে দেখলো, হাসপাতালে নেওয়ার সুযোগটাও না দিয়ে তার ছোটভাই নিজের ঘরের মেঝেতেই নিথর পড়ে আছে। সে এক গ্রাস ভাত মুখে তুললো, স্মৃতিকাতর চোখে চারপাশটা দেখে নিয়ে ফের মনোযোগী হলো ভাতের সাথে ইলিশ মাছ মাখতে এবং তৎক্ষণাৎ সেই ছিপছিপে, বিদ্যুতের মতো নারীশরীর তার চোখের সামনে ভেসে উঠলে, মাঝেমাঝে তুফানের মতো ধেয়ে আসা সেই অপরাধবোধ তার উপরে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলো।
আমি নষ্ট। আমারই প্রিয় ছোটভাইয়ের বিধবা বউ তন্বী- তার থেকে আমি চোখ সরাতে পারিনা। ভাইটা আমার চোখের সামনে মরলো। তন্বী মেয়েটার চোখের পানি পর্যন্ত শুকালোনা- সেই তাকেই কিনা আমি স্বামীহারা হবার দুই মাসের মাথায় জোর করেছিলাম। সে ছিলো রান্নাঘরে। আমি সিগারেট খেতে বারান্দায় এসেছি। পেছন থেকে তার জ্বলজ্যান্ত মাপা শরীর চোখে পড়লো। মনে পড়লো, বউ ছেড়ে চলে যাবার পরে অনেকদিন নারীশরীরের কাছাকাছি যাওয়া হয়না। তারপরে সিগারেট আর খাওয়া হলো কই? রান্নাঘরে নিঃশব্দ চলে গেলাম। পেছন থেকে মেয়েটার কোমর জোর করে চেপে ধরলে, না- ভাসুরের মুখের দিকে হতম্ভব চোখে তাকিয়েও চিৎকার করে উঠতে পারেনি। এ বাড়িতে আর তো শুধু চোখে ভালোভাবে দেখতে না পাওয়া বৃদ্ধা শাশুড়ী, বাপেরবাড়ীতে ফেরত গেলেই তো সেই ভাই আর ভাবীদের মুখঝামটা। তার চাইতে মাঝেসাঝে ভাসুরের চাহিদায় সুযোগমতো সাড়া দিলে ঢের নিরাপদ জীবন। বোকাসোকা তো নয়।
আমি চরিত্রহীন- এই অভিযোগে আমার বউ পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে নিয়ে বাপেরবাড়ীতে থাকে। মাঝেমাঝে মেয়েটাকে আদর করতে ইচ্ছা করলে চোরের মতো সে বাড়ীতে যাই। অনেকটা সময় পার হলে বউ ঘরে ঢোকে। ডিভোর্সপেপারে কবে সই করছি, চোখমুখ শক্ত করে এই একটাই প্রশ্ন করে। তখন জবাব না দিয়ে মেয়েটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে বেশী ব্যস্ত হয়ে যাই। কিন্তু বউ আমার নাছোড়বান্দা। খুব বেশী রেগে গেলে ধারালো গলায় নাহিদাকে নিয়ে হুল ফোটায়। আমারই অফিসের মেয়ে। মেয়েটার জন্মের পরপর নাহিদার সাথে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। কাজেকর্মে, কথাবার্তায় সবেতেই খুব চটপটে। এমন মেয়েকে ফিরিয়ে দেওয়ার শক্তি আমার নেই। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিলো। শুধু একদিন তড়িঘড়ি করে জামাকাপড় বদলে ভাত খেতে গেলে, প্যান্টের পকেটে থাকা কন্ডমের প্যাকেটটা সরাতে ভুলে গিয়েছিলাম। সে রাতে হুলুস্থুল হয়েছিলো। বউ সারারাত কাঁদলো, পাশের ঘর থেকে আমার চোখে কম দেখতে পাওয়া মা চিৎকার করে জানতে চাইছিলো, কী হয়েছে। ছোট ভাই সে রাতে ছিলো তার শ্বশুরবাড়ীতে। পরদিন সকাল হতে না হতেই মেয়ে নিয়ে আমার বউ সোজা তার বাপেরবাড়ীতে। আজও তার চোখের দিকে আমি সরাসরি তাকাতে পারিনা। কিন্তু বউ আমার জেদী হলেও সরল আছে। নয়তো বুঝতো, আমার জীবন থেকে নাহিদা কতো আগেই সরে গেছে। তারপরে গল্প আরো কতোদূর গড়িয়েছে।
শরীর ও তার মাংস- এসব ছাড়া আমার আর কিছু ভালো লাগেনা। আমি গল্প করে আসর মাত করে দিতে পারিনা। শিল্পসাহিত্য কখনো শিখিনি। আমার শরীর জ্বলে ওসব নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুনলে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বই পড়েছি, ভালো চাকরী পেতে চাই বলে। মানুষজনের সাথে সদ্ভাব রাখি, কখন কোন সময়ে কে কাজে লেগে যাবে তা জানিনা বলে। মাঝেমধ্যে সব ছেড়েছুড়ে চলে যেতে ইচ্ছা করে, কিন্তু আমার কোথাও যাওয়া হয়না। বাসায় ফিরে আসি, খেয়েদেয়ে বারান্দায় গিয়ে পরপর তিনটা সিগারেট খেয়ে আসি- সময়সুযোগ বুঝে কখনো সখনো নাহিদার ঘরে উঁকি দেই; আমারই ছোট ভাইয়ের বিধবা বউ, যদি বুঝি তার মনমেজাজ ভালো তবে তার শরীরের উপরে কিশোরের উত্তেজনা নিয়ে উঠি। সেইসব রাতে অনেক দেরী করে ঘুমাতে যাই।
খেয়েদেয়ে, বিল মিটিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে সে হৃষ্টচিত্তে বেরুলো। তারপরে হেলতেদুলতে এগিয়ে গেলো ইলেকট্রিক খাম্বার পাশে জ্বলতে থাকা পান-সিগারেটের দোকানের দিকে। সিগারেট ধরিয়ে প্রথম টান দেওয়ার পরে সে অকস্মাৎ খুশীতে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। তার অকারণ শিশুসুলভ বিস্ময়ের সামনে পারিপার্শ্বিকতা ধরা দিলো উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হয়ে। সে দেখতে থাকলো; নিঁখুত পাকা রাস্তা, একের পর এক ধেয়ে আসতে থাকা পাবলিক বাস, ফাঁকা জায়গায় চলতে থাকা দ্রুতগতির রিকশা ও সেখানে লাল-নীল পোশাক পরে বসে থাকা যাত্রীদের। সারা শহরে বাতি জ্বলজ্বল করছে। সে আলোতে আশেপাশের অফিসগুলোর সাইনবোর্ডগুলো যেনো ঝলসে উঠেছে। দুইটা কালো কুকুর পাশাপাশি পথ চলছে, একটা কিশোর তাদের উত্যক্ত করতে নিঁখুতভাবে তাদের দিকে ঢিল ছুঁড়লো। সামান্য একটু চিৎকার করে উঠলেও কুকুর দুটি ফের পাশাপাশি চলতে শুরু করলো। এদিকে বাসস্ট্যান্ডের পেছনে যে ম্যাগাজিনের দোকানটা আছে তা পুরোদস্তুর ফাঁকা। সেদিকে চোখ যেতেই সে আবিষ্কার করলো, সিনেমার ম্যাগাজিনগুলা উন্মুক্ত পোশাকের নায়িকাদের ছবিসমেত বিক্রি হবার নিমন্ত্রণ জানিয়ে পাশাপাশি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে।
সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ম্যাগাজিনের দোকানটির সামনে এসে দাঁড়ালো। দোকানদারের চোখে সরাসরি চোখ রেখে কয়েকটি ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে দাম মিটিয়ে বাসায় যাবার উদ্দেশ্যে প্রবলপ্রতাপে রিকশায় উঠে বসলো। তার চোখে তখনো বিস্ময় ঝকঝক করছে। রিকশায় উঠে বসে ম্যাগাজিনগুলোর দিকে হালকা চোখ বুলাতে বুলাতে তার শরীর জর্জরিত হলো। সে ঠোঁট টিপে নিজের মনে সামান্য হেসে উঠলো এবং টের পেলো, পায়ের ব্যথাটা ততোমধ্যে অন্তর্হিত।
ফুরফুরে মন নিয়ে বাসায় ফিরে জুতামুজা খুলে পায়ের ব্যথাটা যখন সে ফের পরখ করছে; তখন সেই অপরিবর্তিত বিদ্যুত শরীর নিয়ে, তন্বী, তারই ছোটভাইয়ের বিধবা- তার সামনে এসে দাঁড়ালো।
‘আজকে আম্মা সন্ধ্যায় মাথা ঘুইরা পইড়া গেছিলেন। আমি তারে অনেক কষ্টে ঘুম পাড়াইছি। এখন আপনি উনার ঘরে গেলে ঘুম ভাইঙ্গা যাইবো। খাইতে চাইলে ফ্রিজ থেইকা নিয়া গরম কইরা খাইয়া নেন।” সে অনুভব করলো, কন্ঠস্বরটা বেশ কর্তৃত্বপূর্ণ এবং গম্ভীর।
‘আমি খাইয়া আসছি। গোসলটা সাইরা নিয়ে তোমার ঘরে আইসা কথা বলি।’ গমগমে পরিবেশটা নস্যাৎ করতেই সে তরল স্বরে বলে উঠলো।
শোনামাত্রই শরীর ঘুরিয়ে মেয়েটা নিজের ঘরে যেতে উদ্যত হলো। দৃশ্যটা দেখতে দেখতে সে চামড়ার ব্যাগ থেকে ম্যাগাজিনগুলো বের করে নিতে না নিতেই সেই কন্ঠস্বর এবারে চাপা গলায় বলে উঠলো,
‘এতো রাত কইরা বাড়ী আসলেন। খাওয়াদাওয়াও করে আসছেন দেখতেছি। কাউরে পাইছেন মনে হয়। আমি পুরানা হইয়া গেছি , না?’
হাত ঘুরিয়ে মেয়েটার গলায় সপাটে চড় মারতে পারলে তার শান্তি হতো। দিনের পর দিন ধরে নিজের কাছেই সে নষ্ট হয়ে রয়েছে। একা একা নিজের ঘরে শুতে গেলে অনেক রাতেই তার ঘুম হয়না। বউমেয়েকে ফিরিয়ে এনে ফের সাজিয়েগুছিয়ে সংসার করবার বাসনা আজও তার মনে বেঁচে আছে। তবু, নিজেকে সমর্পণ করে সে বললো,
‘আরে ধুর, কী যে তুমি কও। তোমার জন্য এই দেখো কত্তগুলা সিনেমার ম্যাগাজিন আনছি। আমি গোসলটা সাইরা আসি, তুমি এইগুলা ঘরে নিয়া দেখতে থাকো।’