তারপরে রকিবুল সন্ধ্যার দিকে নির্ণিমেষ চেয়ে রইলো।
দিনের শেষ আলো বিদায় নিয়েছে ঘন্টা দুয়েক আগেই। তখন কিছুই খেয়াল করেনি। শরৎকালের শেষ বিকাল যে রঙ ধারণ করে; তা থেকে যে বিষণ্ণ অন্তিম আলো বিচ্ছুরিত হয়, সেই আলোর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলে শ্বাসরুদ্ধকর যে হাহাকার জেগে উঠে – এর সবকিছু থেকেই সে দূরে থাকতে চেয়েছে। অনেকদিন ধরে।
তবু সে বিগত হতে যাওয়া সন্ধ্যার দিকে নির্ণিমেষ চেয়ে আছে। কারণ অনেকদিন পরে বুকের ভেতরে সে পুরনো এক স্পন্দনকে আলোড়িত হতে দেখছে। এর সাথে তার সুদীর্ঘ পরিচয়। এই স্পন্দনের কাছে গেলে নিরাশা ছাড়া দ্বিতীয় কোন আশ্রয়ের খোঁজ পাওয়া যায়না। আবার যার আকর্ষণ সন্দেহাতীতভাবে অমোঘ। মানুষ স্বভাবতই পতনোন্মুখ; এমনটা সে বহু আগে থেকেই মনে করে। কিন্তু তার দিকে ধাবিত হওয়াটা সবসময়ে সচেতন নাও হতে পারে। সিগারেট শেষ হলে ডাস্টবিন বরাবর লক্ষ্য করে তা ছুঁড়ে ফেলতে চাইলো। কিন্তু তা পড়ে গেলো ফুটপাথের মধ্যভাগ বরাবর।
রকিবুল ফের বিষণ্ণ হয়ে সন্ধ্যার দিকে তাকালো। রেস্টুরেন্টের আলো বাইরেও কি তীব্রভাবেই না ছড়াচ্ছে। এভাবে একদিন শিউলী তার জীবনকে আলোকিত করতে এসেছিলো। প্রথম প্রথম কতো কথা; কতো রকমের মিষ্টি বাক্যমালা, সেই একেকটা মুহুর্তে রকিবুলের মনে হতো চেনা পৃথিবীর মাঝে সে এক ধরণের উপপৃথিবী গড়ে নিয়েছে- যা কিনা মূলের চাইতেও অনাবিল, অম্লান, অক্ষয়।
বলাই বাহুল্য ভেসে যাওয়ার যে অনিবার্য ফলাফল; অর্থাৎ তীব্র ব্যথায় মাটিতে ভূপাতিত হয়ে চোখে অন্ধকার দেখা, তাকে আলিঙ্গন করতে হয়েছিলো সে বজ্রকঠিন বাস্তবতা। নিজের পিতা ছাড়া দ্বিতীয় কোন বজ্রকে রকিবুল এর আগে কখনো ভয় পায়নি। এমনকি স্কুলে থাকতে; তখন ক্লাস নাইন হবে- অন্য পাড়ার এক বেশী বয়সী ছেলের সাথে তুমুল মারামারি করার সময়ে যখন উন্মত্ততার চূড়ান্তে পৌঁছে গিয়ে তার চোখ বরাবর চিমটা নিয়ে এগিয়ে আসতে উদ্যত হয়েছিলো প্রতিপক্ষ, তখনো তার ক্রোধান্বিত চোখের দিকে চেয়ে ভয় পায়নি। এমনই দুঃসাহসের মাঝে তার অজস্র দিন কেটে যেতো। এমনকি সেই রাতে পিতার কানে খবরটা যেতে তার মুখোমুখি হবার সময়তেও রকিবুল ভয় পায়নি। তার স্পষ্ট মনে আছে, পুত্রের সংকোচহীন চোখের দিকে তাকিয়ে সেই প্রথম তার পিতা তার উপরে চড়াও হবার সাহস দেখাতে পারেনি। কেবল রাগ করে রাতে ভাত না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। রকিবুলের মা সেই প্রথম স্বামীকে এহেন অভিমান করতে দেখে তাকে শাপশাপান্ত করে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। নিজেকে সে দীর্ঘদিন যাবত অপরাজেয় বলে মনে করতো।
কিন্তু তার সেই আত্মবিশ্বাসে আঘাত হানলো শিউলী। অন্তর্গত সকল কপটতা এবং অপমান নিয়ে।
প্রথম আলাপের তিন মাস পরেই তাদের প্রেম শুরু হয়েছিলো। টানা দেড় বছর ধরে রকিবুল আকাশের দিকে চেয়ে থেকে চলেছে। পাড়ার দোকানে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া হোক কি বাড়িতে অসুস্থ বাপের দেখাশোনা করা- সবেতেই সে হয়ে উঠেছিলো সর্বেসর্বা। কাছের মানুষরা আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলো তার এই রুপান্তর দেখে। এতোদিন যাবত তারা একরোখা, বেপরোয়া রকিবুলকেই দেখে এসেছে। কিন্তু এ এক অন্য রকিবুল। তাদের চেনার পরিধির বাইরে। তাদের জানার চাইতেও অনেক বেশী বিস্তৃত এই রকিবুল। তার দায়িত্বশীলতায় মুগ্ধ হয়ে সকলেই নানা কথা বলাবলি করতো।
‘সত্যিই, রকিবুল যা হয়েছে না। ওর তুলনা ও নিজেই।’
‘রকিবুল আমাদের পাড়ার গর্ব হয়ে উঠবে দেখে নিও। ওর মতো ছেলে গোটা পাড়ায় আর একটাও খুঁজে পাওয়া যাবেনা।’
‘রকিবুলের স্ত্রী কি যে ভাগ্যবতী হবে। ইশ, যদি আমাদের তানিয়াটার সাথে ওর বিয়ে দিতে পারতাম!’
এমনই সব উচ্ছ্বল প্রশংসার ভিড়ে রকিবুলের গর্বিত দৃপ্ত পদচারণা ছিলো। কিন্তু শিউলীর সাথে প্রেম যখন দেড় বছরের মাথায় তুঙ্গে উঠেছে তখনই শিউলীর মাঝে ধীর পরিবর্তন দেখা দিলো।
‘তুমি যে নিজেকে কি মনে করো, অসহ্য!’ প্রেমঘন মুহূর্তে রকিবুলের সামান্য কোন নির্দোষ রসিকতায় হাত সরিয়ে নিতে নিতে শিউলীর মুখ বেঁকানো সরব প্রতিবাদ।
‘রকিবুল তোমাকে আমার অসহ্য লাগে এখন।’
‘কেনো? কি হইছে তোমার?’ উন্মুখ রকিবুল কৌতূহলী কন্ঠস্বরে জিজ্ঞেস করতো।
‘জানিনা। এতোকিছু তোমাকে বলতে পারবোনা। আর শুনো, আগের মতো সপ্তাহে তিনদিন চারদিন করে দেখা করতে পারবোনা। বাসায় আমার কাজ অনেক বেড়ে গেছে। মুনিয়ার পড়াশোনা, বাবুলের দেখাশোনা সব আমাকেই করতে হয়। আম্মা আগের মতো এতো পেরে উঠেনা। দুইদিন পার হইলেই আমাকে দেখা করার জন্য এতো জোরাজুরি আর কইরোনা, লাভ হবেনা।’ শিউলীর স্পষ্ট কথার মাঝেও রকিবুল দ্বিধা কি সংশয় খুঁজে নিতে চাইতো। তবে সেই আশাবাদের স্থায়িত্ব থাকতো ক্ষণিকের।
ক্রমশ অদেখা কি দেখতে না চাওয়া চিত্র রকিবুলের কাছে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে থাকে। রকিবুলের সাথে সপ্তাহে মাত্র একদিন দেখা করা নিয়েই যে শিউলীর চরম অসন্তোষ সেই তাকেই নিয়মিত বিলাতফেরত মাহিনের সাথে ঘুরতে দেখা গেলো। অনেকেই তা দেখে। কিন্তু আগ বাড়িয়ে রকিবুলকে কিছু বলতে যাবে সেই সাহস তাদের হতোনা।
কোন ঝগড়াঝাটি নয়, মান-অভিমান নয়- রকিবুল নীরবতার আশ্রয় নিয়েই শিউলীর কাছ থেকে সরে গেলো। তাকে প্রতিস্থাপন করা মাহিনের উপরে মন কখনো প্রতিশোধস্পৃহ হয়নি এমনটা বললে মিথ্যাই বলা হবে। তবে সেই জিঘাংসাকে প্রশ্রয় দেওয়ার পেছনে রকিবুল কোন কারণ খুঁজে পায়নি। তাছাড়া জীবনের অমোঘ যে ইঁদুরদৌড়- তা থেকে সে বেশ ছিটকে পড়েছিলো। ধীরে ধিরে নিজেকে গুছিয়ে আনলো। একসময়ে আবিষ্কার করলো খুব কঠিন কিছু নয়। শক্ত মাটির উপরে দাঁড়িয়ে নিজেকে আবিষ্কার করবার কাজটায় সে ভালোভাবেই সফল হবে।
তারই ফলশ্রুতিতে কৃষি মন্ত্রণালয়ে সরকারী চাকরীটা পেয়ে গেলো। তিন মাসের ট্রেইনিঙে তার মিরপুরে আসা। শেষ হলে আবারো ফিরে যাবে জন্মস্থান রাজশাহীতে। অসুস্থ আব্বা, তার বিয়ের চিন্তায় কাতর মা আর ছোট ভাই জামিউলের মাঝে নিজেকে দেখলে বুকে মত্ত হাতির শক্তি ফিরে পায় রকিবুল।
কিন্তু আজকে এই ক্রমশ বিগত হতে থাকা সন্ধ্যা তার মাঝে জাগিয়ে তুলেছে পুরনো সেই স্পন্দন। যা একবার প্রভাবিত করতে শুরু করলে সহসা মুক্তি পাওয়াটা সম্ভবপর হয়ে উঠেনা।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসা আলোর দিকে তাকিয়ে রকিবুল একটা ফোন করলো। তার বাবার বুকের ব্যথাটা কয়েকদিন হলো বেশ বেড়েছে। মায়ের কাছ থেকে আপডেটেড হয়ে ফোনটা রেখে দিয়ে একটা সিগারেট ধরালো রকিবুল। তৃতীয় টান দেওয়ার সময়ে অসাবধানবশত তার ধবধবে ফর্সা শার্টের বুকপকেটের উপরিভাগে কিছু ছাই পড়ে গেলো। ছাইসমূহের সেই পতনের দিকে চেয়ে রকিবুল হেসে ফেলবার পরে আচমকা দূরবর্তী রাস্তা থেকে একটা করুণ আর্তনাদের ধ্বনি ভেসে আসলো। খুব সম্ভবত কারো কিছু ছিনতাই গেছে। এমন নতুন কোন ঘটনা নয়। এ জায়গায় হরহামেশাই ছিনতাই হয়।
তখন রকিবুল খুব সন্তর্পণে; শার্টের উপরিভাগ থেকে ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে, একবার বাম হাতের তুড়ি বাজিয়ে ভাবলো- পতন তো পতন, খোদ ঊত্থানই দিগন্তহীন।