‘আব্বা, আসবো?’
অফিসে যাবার প্রাক্কালে অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার আশরাফউদ্দীনের ঘরে এসে রেজওয়ান বিনীত ভঙ্গিতে পিতার ঘরে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করে।
‘হ্যা আয়, এতো অনুমতির কি আছে?’ পুত্রের সাথে ঋজুস্বরে কথা বলতে অভ্যস্ত আশরাফউদ্দীনের কন্ঠ কফ জমানো বলে চিরাচরিত জাঁদরেল থাকতে ব্যর্থ হয়।
বুড়ো মনে হয় কফ নিয়ে ভালোই যন্ত্রণায় আছে। গতো কয়েকদিন ধরে সারারাত খকখক করে কেশেছে। গতোকাল রাতে সেই কাশির আওয়াজ নিজের ঘর থেকে শুনতে পায়নি বলেই কিনা কে জানে নাফিসার সাথে সঙ্গমে পূর্ণ তৃপ্তি পেলো অনেকদিন পর। এমনকি নাফিসাও অনেক অনেক দিন পরে তৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে গিয়েছিলো। আজকে সকালেও যখন তার জন্য বেড টি নিয়ে আসলো, স্ত্রীর সদ্য ঘুমভাঙ্গা ফোলাফোলা পরিতৃপ্ত মুখাবয়ব দেখে রেজওয়ানের বিয়ের পরপর প্রথম সময়কার কথা মনে পড়ে গিয়েছিলো। ধুরো, খকখক কাশিতে বিপর্যস্ত বুড়ো বাপের সামনে এসে এইসব সে কি ভাবছে? নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে রেজওয়ান যথাযোগ্য পুত্রের ন্যায় ঋজুস্বরে বলে,
‘না মানে নাফিসা বলছিলো আপনার চশমার ডাঁট ভেঙ্গে গেছে। আমাকে দিলে আমি বাড়িতে আসার আগে আজিজের দোকান থেকে ঠিক করে নিয়ে আসতে পারি। চশমা ছাড়া তো আপনার পড়তে বেশ কষ্ট হয়।’ বুড়ো এমনিতে কখনো শৌখিন স্বভাবের না হলেও নিজের ঘরের ব্যাপারে খুব সজাগ। সাদা-ছাই রঙের পরিষ্কার বিছানা, রেজওয়ানের প্রয়াত মায়ের প্রিয় বেগুনী রঙের পর্দা এমনকি বেডসাইড টেবিলে নিজের স্ত্রীর বিয়েপরবর্তী হাস্যোজ্জ্বল ছবিটা পর্যন্ত নিজের হাতে মুছে পরিষ্কার করে রাখে। ঘর মোছা ছাড়া কাজের লোক শরীফাকে নিজের ঘরে ঢুকতে পর্যন্ত দেয়না। এমনকি বাথরুমের দরজা হালকা খোলা বলে এয়ারফ্রেশনারের কল্যাণে তা লেবুর সুরভিতে সুরভিত তা পর্যন্ত বিলক্ষণ টের পাওয়া যাচ্ছে। অনেকদিন পরে বাপের ঘরে প্রবেশ করে রেজওয়ান চারপাশ খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে।
চশমা ব্যবহারের অপারগতার কারণে গতো দুইদিন ধরে আশরাফউদ্দীনের বেশ দুঃসময় যাচ্ছে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে দ্বিতীয় কারো স্পর্শ না করা পত্রিকা পড়া তার তিরিশ বছরেরও বেশী সময়কার অভ্যাস। এই দুইদিন তা করতে পারেনি বলে তার অস্বস্তির কোন সীমা নেই। এমনকি গতোকাল স্বাদ তেহারী ঘর থেকে আনা সুস্বাদু তেহারী দিয়ে সকালের নাশতা করেও তার মন ভরেনি। ইয়েমেনে সৌদি আরবের সাম্প্রতিক ভূমিকা নিয়ে আশরাফউদ্দীনের দুঃখের কোন সীমা নেই। কিন্তু এ নিয়ে দুই চারটা কথা বলতে হলেও তো পত্রিকা পড়া চাই। প্রতিদিন বিকালে রবীন্দ্র সরোবরে তাদের বয়সী কয়েকজন একত্রে আড্ডা দেয়। চশমার অভাবে দুই দিন ধরে সেখানে যাওয়াও সম্ভব হয়নি। তাছাড়া নিয়মিত পত্রিকা পড়ার সুবাদে আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে তার অপরিসীম জানাবোঝা ও সচেতনতার কারণে সেই আড্ডার মধ্যমণি হতে তাকে বিশেষ একটা বেগ পোহাতে হয়নি। তাছাড়া চাকরী থেকে রিটায়ার করার পরে আশরাফউদ্দীনের কথা বলাও বেশ বেড়ে গেছে বলে গুছিয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করবার ব্যাপারে তার সচেতনতা আগের চাইতে এখন অনেক বেশী প্রখর। এমনিতে পুত্রের সাথে কখনোই বিশেষ একটা মাখামাখি না করে থাকলেও তার চশমা ঠিক করে দেওয়ার বিষয়ে পুত্রের তীক্ষ্ণ সজাগ দৃষ্টি তাকে সন্তুষ্ট করে। আগামীকাল থেকে রবীন্দ্র সরোবরে আন্তর্জাতিক রাজনীতির হালচাল নিয়ে ফের সমবয়সীদের তাক লাগিয়ে দেওয়া যাবে এই আনন্দে অসচেতনভাবেই পুত্রের প্রতি তার কন্ঠস্বর আর্দ্র হয়ে আসে,
‘ঠিক আছে। তাহলে আজকে বাড়িতে ফেরার আগে মনে করে চশমাটা ঠিক করে আনিস।’
মাথা নাড়তে নাড়তে পিতার ঘর থেকে বেরিয়ে রেজওয়ান মনে মনে এক চোট হেসে নেয়। চশমা নিয়ে বুড়ো যে মহাযন্ত্রণায় আছে এই কথা তার থেকে ভালো আর কে জানবে? পত্রিকা তো পড়তে পারছেই না এমনকি ধানমন্ডি লেকে গিয়ে সমবয়সীদের সাথে আড্ডাবাজি পর্যন্ত বুড়োর বন্ধ হয়ে আছে। চশমার অভাবে ঘরের পাশে লাগোয়া যে বারান্দা আছে রাতে ঘুমাবার আগে বুড়া সেখানে পর্যন্ত বসেনা। এই যে রিটায়ারমেন্টের পরে কোন প্রয়োজন পড়লেই পুত্রের উদ্দেশ্যে তার মমতামাখানো ভেজা স্বর বেরিয়ে পড়ে তা কি এমনি এমনি? নিজের বাপকে কি রেজওয়ান জন্মের পর থেকেই দেখে আসছেনা? আরে বাবারে বাবা, দুই পুত্রের উপরে তার সে কি আধিপত্য! সকালে উঠে কয়টার সময়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরোবে তা থেকে শুরু করে সন্ধ্যায় কয়টার মধ্যে খেলার মাঠ থেকে বাসায় ফিরে আসবে পর্যন্ত সবেতেই বাপের কথার বিরুদ্ধে তাদের দুই ভাইয়ের একটা কথা বলার সুযোগও ছিলোনা। তার ছোট ভাই জাফরান তো সুযোগ পেয়েই চলে গেলো আমেরিকা। সেখান থেকে বাপকে একটা চিঠিও লেখে কিনা সন্দেহ। রেজওয়ানের কাঁধে পড়ে গেছে বলে পিতার দেখাশোনা করবার দায়িত্ব থেকে সে বিচ্যুত হবার কোন কারণ খুঁজে পায়নি। তাছাড়া বুড়ো এখনো পর্যন্ত বেঁচে আছে বলেই তো যখন তখন নাফিসাকে নিয়ে এদিকসেদিক নিশ্চিন্তে ঘুরে আসা যায়। ঘর নিয়ে কোন আতংকে থাকতে হয়না। তবে বয়সকালে বুড়োর তেজ ছিলো সাংঘাতিক। নিজের মতামতের বাইরে দ্বিতীয় কারো মতামত কখনো গ্রাহ্য করতোনা। রেজওয়ানের এখনো স্পষ্ট মনে আছে ক্লাস ফাইভের ফাইনালে অংক পরীক্ষার আগেরদিন বাপের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিকালে ক্রিকেট খেলে বাড়ি ফিরে জ্বর বাঁধিয়ে ফেলেছিলো। পরে আর কি? অবধারিতভাবে ফেইল। আশরাফউদ্দীন রেজাল্টের পরে তা জানতে পারলে একদিন সন্ধ্যায় ঘরে বেঁধে পুত্রকে বেধড়ক পিটিয়েছিলো। এমনকি নিজের স্ত্রীর হাজারো অনুনয়-বিনয় পর্যন্ত শোনেনি। তবে বাইরে থেকে বুড়োকে দেখলে মনে হবে স্ত্রীর প্রতি কখনোই লোকটা ভাবেনি। কেয়ার করেনি। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পরে রেজওয়ান আবিষ্কার করেছে যে আশেপাশের মানুষদের সামনে স্ত্রীর প্রতি মমতা প্রদর্শনের বেলাতে বুড়ো ভালোই ভান করতে জানে। এই যে চার বছর আগে তার স্ত্রী হঠাৎ আসা জ্বরে তাদের সকলকে হতভম্ব করে দুম করে এক রাতে মরে গেলো এর পর থেকে পরবর্তী প্রতিটা বছরের একই তারিখে বুড়ো কখনো রোজা রাখতে ভোলেনি। একবার কি মনে করে কাজের মেয়ে শরীফা বুড়োর ঘরে ঢুকে বেডসাইড টেবিলের পাশে রাখা রেজওয়ানের মায়ের ছবিটা মুছে পরিষ্কার করতে শুরু করলে তা দেখে বুড়োর সে কি রাগ! পারলে তখনই শরীফাকে কুপিয়ে হত্যা করে। সেদিনের পর থেকে রেজওয়ান বুঝেছে নিজের মৃতা স্ত্রীর বিষয়ে বুড়োকে তার মতোই যা করার করতে দিলে ভালো। তাছাড়া বুড়ো এককালে দুই ছেলের উপরে প্রচুর ছড়ি ঘোরালেও যখন তাদের বয়স হয়েছে তখন থেকে একটু একটু বদলেছে। এই যে নাফিসার পরিবার থেকে বিয়ের জন্য তাকে প্রচুর চাপ দিচ্ছিলো বলে তাকে এক প্রকার নাটক করেই বিয়ে করেছিলো- তারপর কাচুমাচু ভঙ্গিতে সদ্য স্ত্রী হওয়াকে নাফিসাকে সামনে নিয়ে নিয়ে এসে রেজওয়ান এই সাত বছর আগেও থরথর করে কাঁপছিলো; কই বুড়ো কিছু বলেনি তো। শান্ত ভঙ্গিতে সব শুনে স্ত্রীকে নিজে থেকে উপদেশ দিলো পুত্রবধুকে বরণ করে নেওয়ার জন্য। গুরুগম্ভীর স্বভাবের স্বামীর প্রত্যক্ষ অনুমোদনের কারণেই রেজওয়ানের পক্ষে নাফিসার ব্যাপারে মাকে পটিয়ে ফেলাটা আরো সহজ হয়ে গিয়েছিলো।
রেজওয়ান নিচে গিয়ে ড্রাইভার বরকতকে গাড়ি বের করতে বলবে তার আগে নাফিসা এসে সামনে দাঁড়ালো।
‘শুনো।’
‘হ্যা বলো।’ গতোরাতের তৃপ্ত সঙ্গমের স্মৃতি পুনরায় রেজওয়ানের চোখের মণিতে আবির্ভূত হলে সে হৃষ্টচিত্তে ধবধবে সাদা শার্টের উপরে গাঢ় নীল রঙের টাইয়ের নটটা একবার ঘুরিয়ে ঠিক করে।
‘আজকে অফিস থেকে ছুটি শেষেই বাড়ি ফিরতে পারবা? তাইলে টুকটাক কিছু কেনাকাটা করে ম্যাডশেফ থেকে ডিনারটাও সেরে আসলাম।’ বাঁধা চুল পুনরায় একবার ঠিক করে নিয়ে নাফিসা মিষ্টি করে হাসে।
স্ত্রীর এই মিহি অনুরোধ শুনে রেজওয়ান ঈষৎ বিরক্ত হয়। নাফিসা কি আজকাল সবকিছুই চটজলদি ভুলে যায়? নাকি স্বামীর প্রতি মনোযোগে তার ভাটা দেখা দিয়েছে? রেজ়ওয়ানের অফিসে তার একটা প্রমোশন নিয়ে বেজায় কথা চলছে। হায়ার্কি তার সাম্প্রতিক সার্ভিসে বেশ তুষ্ট। এমনকি উপরমহলের দুইজন হাইলী ইনফ্লুয়েনশিয়াল লোক র্যাকিট কোম্পানীর ঢাকা ব্রাঞ্চের জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে তার নাম রেকমেন্ড করবে এমন কথা অফিসে জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। এই সময়ে কিনা রেজওয়ান অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে স্ত্রীর সাথে হালকা কেনাকাটা সেরে অতঃপর ম্যাডশেফ থেকে ডিনার সেরে আসবে? নাফিসার আসলেই বেজায় খেয়ালী স্বভাবের থেকে গেলো। আরে স্বামীর প্রমোশন মানে তো তোমার নিজেরও উন্নতি নাকি? এই প্রমোশনটা কনফার্মড হলে তারা দুইজনে পনেরোদিনের জন্য থাইল্যান্ডে ঘুরতে যাবে এমন একটা ভাবনা রেজওয়ানের মাথায় কয়েকদিন যাবত ঘুরপাক খাচ্ছে। স্ত্রী হিসাবে সে একটু ধৈর্য ধরতে পারলে ম্যাডশেফ থেকে ডিনার তো কোন ছার, আরো বড় আনন্দ যে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে তা দেখবে। তবে এই সময়টা খুব ক্রিটিকাল। সামান্য দাম্পত্যকলহের প্রভাবও তার পেশাগত দায়িত্বে বড় হয়ে দেখা দিতে পারে। তাই স্ত্রীর উপরে হালকা অসন্তুষ্ট হলেও তাকে ঝেড়ে ফেলে রেজওয়ানের পরিমিত কন্ঠস্বর জবাব দেয়,
‘না অফিসের প্রমোশনের ব্যাপারটা তো তোমাকে বলছিই। কখন কি খবর আসে কে জানে। আজকে থাক।’
গাড়িতে বসে রেজওয়ান প্রকৃতির দিকে গভীরভাবে মনোনিবেশ করতে সচেষ্ট হয়। আকাশের উপরে হালকা হালকা মেঘের আস্তরণ, কাঁচ বন্ধ বলে বাতাসের সংস্পর্শে না এসেও সে বুঝতে পারে দুপুরের দিকে বৃষ্টি হবার বেশ ভালো সম্ভাবনা আছে। তার জন্য এই সময়টা খুবই ক্রুশিয়াল। যতোটা সম্ভব মেজাজ ঠান্ডা রাখতে হবে। কিন্তু চাইলেই কি তা সম্ভব? এই যে বাইরের দিকে তাকিয়েই দেখো! একটা ইলেকট্রিক পোলের গা জড়িয়ে ধরে এক বয়স্ক পাগল দেশ, জাতির বিরুদ্ধে অবিরাম শাপশাপান্ত করে চলেছে। তার এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখে দুই কলেজগামী ছাত্র প্রতিক্রিয়ায় কেমন দাঁত কেলিয়ে কেলিয়ে হাসছে। ছয় কি সাত বছরের এক টোকাই প্যান্টের কোন গুপ্ত পকেট থেকে একটা ছোট্ট আকৃতির ইট বের করে পাগলের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে মারলো। পাগল যথাসময়ে মাথা সরিয়ে ফেলতে পারলো বলে পোলের মাথায় ধাক্কা খেয়ে ইটের টুকরা গিয়ে পড়লো মাঝরাস্তায়। সেখানে এই সাত সকালেই এক যুগল চারপাশের প্রতি থোড়াই কেয়ার করে কেমন হাসিমুখে রিকশায় চলেছে। আরেকটু হলেই ইটের টুকরার আঘাতে তাদের কেউ আহত হতে পারতো। দুই পাশের রাস্তা প্রাত্যহিক যানযটের কারণে ব্লকড। এর মধ্যেই ডিভাইডারের অপরদিকের রাস্তা বরাবর একজন মধ্যবয়স্ক লোক প্রায় উন্মাদের মতো রাস্তা পার হতে গেলো। একটা মাইক্রোবাস তার শরীর ঘেঁষেই চলে গিয়েছিলো। একটু উনিশ-বিশ হলেই শ্যামলা রঙের দেখতে লোকটার শরীর সদ্য ঢালাই করা রাস্তার সাথে মিলেমিশে কালচে লাল রঙের হয়ে যেতে পারতো। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে রেজওয়ান এই তো কয়েকদিন আগেই বেশ লম্বা একটা লেখা ফেসবুকে পাবলিশ করেছিলো। ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা কম বেশী সকলেই তার সেই লেখাটা বেশ এপ্রিশিয়েট করেছিলো। কিন্তু কি হবে লিখে যদি মানুষজন নিজেদের স্বভাব না পাল্টায়? সড়কে নিরাপদ যাতায়াতে জনসচেতনতার অভাবে বিমর্ষ রেজওয়ান তাই নিজের এপ্রিশিয়েটেড লেখাটির কথা বিস্মৃত হতে মনোযোগী হয়!
অফিসে নিজের ঘরে এসে পুরনো কিছু ফাইলে চোখ বুলাতে বুলাতে সহকর্মী কাম বন্ধু আলভি এসে হাজির হলো।
‘বস, লেটেস্ট খবর সম্পর্কে আপডেটেড?’
রেজওয়ান বিরক্ত হয়। আলভিটা আর বদলালোনা। এমনিতে মানুষ ভালো। দিলদরিয়া স্বভাবের। মাঝেমাঝে ফূর্তির খায়েশ উঠলে রেজওয়ানকে সাথে করে বারে গিয়ে চার কি পাঁচ পেগ ভদকাও খাইয়ে দেয়। কিন্তু বড্ড সাসপেন্স রেখে কথা বলে। গুরুত্বপূর্ণ কোন খবর থাকলে সরাসরি তা কোনভাবে বলতে পারেনা।
‘তা জনাব যদি মুখ খোলেন তাইলে এই অধম আপডেটেড হতে পারে।’ বিরক্তির আভাসকে পুরোপুরি নস্যাৎ করে দিতে রেজওয়ান রসবোধের দ্বারস্থ হলো।
‘পুরা কথাটা তো আগে শুনবি। এইটিন্থ ব্যাচের যেই স্যাম্পল ওষুধগুলা আছে সেইগুলা এক্সপায়ার্ড ডেটেড। সাব্বির আছে না? ফাইলে গড়বড় দেখে লিয়াকত ভাই তাকে গতোকাল নিজের ঘরে ডেকে পাঠাইছিলো। সিচুয়েশন বেশ ক্রিটিকাল। সাব্বিরের চোখমুখের অবস্থা দেখে তাই মনে হইলো। তুই তো একটু আগে বের হয়ে গেছিলি তাই বোধহয় কিছু জানোস না।’ অন্তর্গত সকল সাসপেন্স ঝেড়ে ফেলে আলভি সিরিয়াস হলো।
অফিস জুড়ে একটা বাজ পড়লেও রেজওয়ান সম্ভবত এতোটা বিস্মিত হতোনা। সকাল সকাল এসে তাকে আলভি এ কি সংবাদটা দিলো? গুডনেস গ্রেশিয়াস মি! আলভি কি বুঝতে পারছে যে সে কি প্রকান্ড এক বোমা এসে ফাটিয়ে গেলো? রেজওয়ানের মুখের মাংসপেশীতে সামান্য আতংক জমাট বাঁধে। চোখের পাতা অটোমেটিকালী কয়েকবার মুহূর্মুহ পিটপিট করে। তার ডান হাতের তিনটা আঙ্গুল টাইয়ের নটটা দুইবার ঘোরায়। কপাল চাপড়াতে পারলে সত্যিই শান্তি পেতো। কিন্তু কারো উপস্থিতিতে এতোটা প্রতিক্রিয়া দেখানো তার স্বভাবের বাইরে। আলভি আজ বন্ধু আছে। বলা তো যায়না কখন এই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এখন যদি রেজওয়ান খুব বেশী রিএকশন দেখিয়ে বসে তবে তার এই প্রতিক্রিয়ার কথা যে সে মনে রেখে দেবেনা এবং সময় সুযোগ মতো তারই বিরুদ্ধে কখনো ক্যাশ করবেনা তার কি গ্যারান্টি আছে? কিন্তু রেজওয়ান ভেবে পায়না যে এতো বড় একটা ভুল সে কিভাবে করলো? সেভেন্টিন্থ, এইটিন্থ আর নাইনটিন্থ ব্যাচের স্যাম্পল ওষুধগুলা রেজওয়ান নিজে ফ্যাক্টরীতে গিয়ে চেক করে এসেছিলো। ফ্যাক্টরীর ইনচার্জ কামরুল তাকে নিশ্চিত করেছিলো যে ওষুধগুলো সম্পূর্ণই নিরাপদ। কোন প্রকারের ডিফেক্ট খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারপরে এখন যদি এরকম কথা শুনতে হয় তবে অন্য কেউ দূরের কথা, নিজের উপরেই তো রেজওয়ান আস্থা রাখতে পারেনা। দুই মাস আগে একদিন ফ্যাক্টরীতে গিয়ে ওষুধগুলো চেক করে গিয়েছিলো। কামরুলের উপরে রেজওয়ানের আস্থা সীমাহীন। অফিসের বাইরেও তাদের চমৎকার সম্পর্ক। কামরুল তাকে ফাঁসিয়ে দিতে উৎসাহী হয় এমন কোন সম্ভাবনা সে নিজেই কখনো তৈরী করতে দেয়নি। আলভির কাছে এখন সব কথা শুনে সাব্বিরের উপরেই সন্দেহ হচ্ছে। ছেলেটা বরাবরই একটু কম কথা বলে। চুপচাপ শান্ত স্বভাবের। তাকে অর্ডার করা হয় বিনা অভিযোগে তাই পালন করে। মুখ দেখে আঁচ করাটা কঠিন যে মনে কি চলছে। এখন এরকম মুখচোরা ছেলের মনস্তত্ব নিয়ে রেজওয়ানের প্রেডিকশনের দৌড় আর কতোটাই বা এগোতে পারে? পড়লো তো পড়লো তাও কিনা লিয়াকত ভাইয়ের কাছে। লিয়াকত ভাইকে কি সে কম সময় ধরে চেনে? এক নাম্বারের ঘোড়েল লোক। কাজে কোন প্রকারের ত্রুটি কি গাফিলতি পেলে সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলবেনা। কিন্তু ঠিকই মনে করে রেখে দেবে। পরে সময় মতো এমনভাবে ধরবে যে কালপ্রিট কাঁদতে শুধু বাকি রাখবে। তাছাড়া এই কথা তাদের অফিসের কে না জানে যে বিদেশী কনসালটেন্ট মিঃ রিচার্ডের সাথে লিয়াকত ভাইয়ের গলায় গলায় খাতির। রিচার্ড বেটা যখনই বাংলাদেশে আসে লিয়াকত ভাই অন্তত একদিনের জন্য হলেও নিজের বাসায় তাকে ডিনারে আমন্ত্রণ জানাবেই। একবার তার বাসায় এসে ভাত, সর্ষে ইলিশ আর বেগুনভাজা খেয়ে সাহেবের কি উচ্ছ্বাস লিয়াকত ভাইয়ের কাছ থেকে অফিসের স্টাফেরা কমপক্ষে দশবার হলেও সেই গল্প শুনেছে। শুধু কি ইলিশ মাছ? বিদেশী সাহেবের এম্যুজমেন্টের সুবন্দোবস্তের প্রতিও লিয়াকত ভাইয়ের মনোযোগ একচুল এদিকওদিক হয়না। গেলোবার যখন রিচার্ড বাংলাদেশে এলো তখন দশদিনের মতো ছিলো। লিয়াকত ভাই কিভাবে কেউ বলতে পারেনা, তাদের অফিসের সদ্য জয়েন করা রিসেপশনিস্ট নাবিলাকে পরপর তিনদিনের জন্য রুপসী বাংলা হোটেলে রিচার্ডের সাথে অন্তরঙ্গ সময় কাটানোর ব্যবস্থা করেছিলো। নাবিলা মেয়েটা ছয় মাসের মতো হলো তাদের অফিসে জয়েন করেছে। অন্তরঙ্গ সময় তো অনেক পরের কথা, অফিসের মেইল কলিগরা তার সাথে নূন্যতম নির্দোষ লেভেলের ফ্লার্ট করলেও এমন চোখে তাকাবে যে ফ্লার্টকারীদের ভয়ে আত্মারাম ছেড়ে যায় যায় অবস্থা। অথচ এমন জাঁদরেল একটা মেয়েকেও কি অনায়াসে বশ করে লিয়াকত ভাই রিচার্ডের বিছানার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলো। ডান হাতের চেটো দিয়ে নাকের ডগায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছতে নেবে এমন সময়ে প্যান্টের ডানদিকের পকেটে ভাইব্রেশন টের পেলে রেজওয়ান সেলফোন বের করে দেখে। নাফিসা এসএমএস পাঠিয়েছে। তার শ্বশুর, অর্থাৎ রেজওয়ানের অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার পিতা আশরাফউদ্দীনের চশমা যেনো সে বাড়ি ফেরার পথে ঠিক করে নিয়ে আসে তার রিমাইন্ডার। এসএমএসটা ছেলের বউকে বুড়োই পাঠাতে বলেছে এই বিষয়ে রেজওয়ানের কোন সন্দেহ নেই। এই লোকটা হঠাৎ হঠাৎ এমন অবিবেচক আচরণ করে বসে, অসহ্য! আজকে সকালেই রেজওয়ান নিজে থেকে তার ঘরে গিয়ে চশমার ডাঁট ঠিক করে দেবে বলে বলেছে। বুড়ো এর মাঝেই সব ভুলে গেলো? যতো দিন যাচ্ছে বুড়োর চোখে নিজের ছাড়া অন্য কারো সুখ দুঃখ ধরা পড়েনা। না আসলে ভুল বলা হলো। বুড়ো বরাবরই এরকম আচরণ করতো। যতোদিন মা বেঁচে ছিলো তাদের দুই ভাইয়ের উপর দিয়ে বাপের এইসব যন্ত্রণা তেমন একটা যায়নি। বুড়োটা বেশ কচ্ছপ প্রবৃত্তির আছে বটে। একবার সহজে কিছু ধরলে ছাড়তে চায়না। তখন রেজওয়ান পড়তো ক্লাস টেনে। সামনেই টেস্ট পরীক্ষা। এক শুক্রবার সকালে বুড়ো বাজার করে এনে মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলো। মাগুর মাছ থেকে শুরু করে আলু কি নেই? কি ব্যাপার, বুড়োর শখ হয়েছে মাগুর মাছ, আলু আর ধনেপাতা দিয়ে দুপুরের আহার সারবে। তো বুড়ো নিজের স্ত্রীর হাতে বাজারপত্র বুঝিয়ে চলে গেলো মসজিদে। বুড়ো সেই সময়ে নিয়মিত জুম্মার নামাজ পড়তো। মসজিদে চলেও যেতো বেশ আগে আগে। যেনো বসবার জন্য পছন্দসই জায়গা বেছে নিতে পারে। তো কি হলো? সেদিন নামাজ সেরে বাসায় ফিরে দেখে যেভাবে সে দুপুরের রান্নাটা চেয়েছিলো সেভাবে হয়নি। সামান্য চেঁচামেঁচিও করলোনা। কিন্তু পরের শুক্রবারে যখন ফের সকালে বাজার করে বাড়ি ফিরে স্ত্রীর কাছে বাজার বুঝিয়ে দিলো; কিভাবে রান্না করলে সেই দুপুরের রান্না বুড়োর মুখে রুচবে, কাগজে কলমে তা পয়েন্ট আউট করে দিয়ে মসজিদে নামাজ পড়তে চলে গেলো। এরকম অজস্র ঘটনার মধ্য দিয়ে বুড়োর কচ্ছপ স্বভাবের সাথে তাদের মা, দুই ভাইকে পরিচিত হতে হয়েছে। কাছের মানুষরাই যদি এতোটা কান্ডজ্ঞানহীন হয় তবে অফিসের এতো রকম হাড় বদমাইশদের রেজওয়ান দোষারোপ করবে কিভাবে?
প্রমোশনসংক্রান্ত দুশ্চিন্তায় রেজওয়ান দুপুরে লাঞ্চ পর্যন্ত ঠিকঠাক করলোনা। প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশী নিবিষ্ট হয়ে পুরনো ফাইলগুলোর কাজ কমপ্লিট করে অফিস থেকে বেরুতে বেরুতে ছয়টা। আজকে সারাদিন লিয়াকত ভাই সাব্বিরকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে দীর্ঘসময় বসিয়ে রাখলো অথচ তাকে একবার ডাকলো পর্যন্তও না। ব্যাপারটা বেশ ফিশি। তাহলে কি রেজওয়ানকে অন্যভাবে ধরবে? হতে পারে তাকে ধরাশায়ী করতে লোকটা কাগজপত্র সব গুছিয়ে রাখছে। এইটিন্থ ব্যাচের স্যাম্পল ওষুধগুলোর যাবতীয় কাগজপত্র ফ্যাক্টরী থেকেই আনিয়ে নেওয়া যাবে। তারপরে সেইগুলার যথার্থ কম্পাইলেশনে একদিন রেজওয়ানের কাছে মেইল চলে যাবে। এইটিন্থ ব্যাচের স্যাম্পলগুলো এক্সপায়ার্ড ডেটের হবার পরেও রেজওয়ান কি বুঝে সেগুলো স্যাংশন করলো ইত্যাদি ইত্যাদি। রেজওয়ান এই প্রশ্নের কি জবাব দেবে? ফ্যাক্টরীর কামরুলের উপরে সন্দেহ করতে পারে এমন কোন গ্রাউন্ডের কথা তার মাথায় আসছেনা। বাকি থাকলো সাব্বির। রেজওয়ান কিভাবে কাজটা হ্যান্ডেল করেছে ছেলেটা তা ভালোভাবে জানে। কিন্তু ছেলেটা কি তাকে রেসকিউ করবে? নাকি ব্যাকআউট করবে? রেজওয়ান তো সাব্বিরের সম্ভাব্য কর্মের বিষয়েও অজ্ঞাত। এমতবস্থায় আল্লাহর দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া সে আর কিই বা করতে পারে? ড্রাইভার বরকতকে এসি বন্ধ করে বলে সে গাড়ির কাঁচ অর্ধেকেরও বেশী নামায়। দেখে হালকা বৃষ্টিতেই রাস্তা কেমন আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয়েছে। রেজওয়ান সকালে মনে মনে যা প্রেডিক্ট করেছিলো তাই হয়েছে। দুপুরের দিকে বেশ খানিকক্ষণ বৃষ্টি হয়েছে। তবে আকাশের উপরে ভেসে থাকা মেঘমালা দেখে দুই চোখের উপরে শান্তি নেমে আসছে টের পাওয়া যায়। বৃষ্টি হয়েছে বলেই কিনা কে জানে রাস্তাঘাটে মানুষজনের চলাফেরা কম। সে কারণে সিগনাল ছাড়া ট্রাফিক জ্যামের কারণে বেশী সময় নষ্ট হলোনা। সারাটাদিনের টেনশনে দুপুরে ভালো মতো লাঞ্চটাও করলোনা। ক্ষিধা তাই পেটের উপরিভাগ জুড়ে সরবেই নিজের জানান দিচ্ছে। ড্রাইভারকে বিজয় সরণীর রাস্তা ধরে বাড়ি ফিরবার ইনস্ট্রাকশন দেবে এমন সময়ে ফের প্যান্টের ডানদিকের পকেটটা ভাইব্রেট করে উঠলে ড্রাইভার বরকতকে রেজওয়ানের কিছু বলা হয়ে উঠেনা। সাহেবের কাছ থেকে রুট সম্পর্কে কোন আদেশ না পেলেও বরকত বিজয় সরণীর রুটই বেছে নিয়েছে দেখে আশ্বস্ত হয়ে রেজওয়ান ফোনকল রিসিভ করে। কথা বলতে বলতে একবার সে টাইয়ের নট সামান্য শিথিল করে, দুইবার কপালের ডানদিকের উপরিভাগে নিজের বাম হাত রাখে এবং টানা তিনবার পা নাচায়। ফোনে কথা বলা শেষে নিজের মুখ বাইরে বের করে একবার শহরটার দিকে ভালোভাবে চেয়ে রেজওয়ান টাইটা সম্পূর্ণই খুলে ফেলে।
বাড়িফেরত স্বামীকে দেখে নাফিসার নির্ভার নিশ্চিন্ত মুখকে পাশ কাটিয়ে রেজওয়ান তার পিতা, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার আশরাফউদ্দীনের ঘরের দিকে এগোয়। বাইরে থেকে দেখে তো মনে হচ্ছে ঘরের আলো নেভানো। বুড়ো কি চশমার শোকে এই বিকালে ঘুমিয়েই পড়লো? দুইটা দিন পত্রিকা পড়তে না পারাতে আর রবীন্দ্রসরোবরে গিয়ে আসর মাত করার সুযোগ না পাওয়াতেই বুড়োর এই হাল? চেয়ারের হাতলে ব্লেজার আর ব্রিফকেস রেখে পিতার ঘরে এগোতে এগোতে সে ঘরের আলো জ্বলে উঠে। বুড়ো তাইলে ঘুমায়নি। সম্ভবত বাথরুমে গিয়েছিলো।
‘আব্বা, আপনার জন্য একেবারে নতুন চশমা আনলাম।’ র্যাকিট কোম্পানীর ঢাকা ব্রাঞ্চের সম্ভাব্য জেনারেল ম্যানেজার রেজওয়ান আহমেদের প্রমোশনের-সংবাদে-উদ্বেলিত-কন্ঠস্বর পিতৃপ্রেমে একটু লাউড শোনায়।