সুজন ঘরে এসে ছিটকিনি লাগিয়েছে বুঝতে পেরেই আফসারউদ্দীন চিৎকার করতে শুরু করলেন।
‘শুয়োরের বাচ্চা, তোকে এতোবার করে বললাম পর্দাগুলা ঢেকে দিতে। কোন কথা কানে যায়না? হারামজাদা কোথাকার। খালি খাওয়া আর নবাবের বাচ্চার মতো ঘুমানো। তোদেরকে লাথি মেরে ঘর থেকে বিদায় করে দিবো।’
সতেরো বছরের কাজের লোক কালামকে উদ্দেশ্য করা আফসারউদ্দীনের গালাগাল কালামকে আদপেই স্পর্শ করেনা। এইটা তার আর সাহেবের বেশ পুরনো একটা খেলা। পুত্র সুজন বাসায় আসলেই আফসারউদ্দীন এরকম চিৎকার শুরু করেন। প্রথম প্রথম বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পেরে কালাম নিশ্চিন্ত হয়েছে। এই খেলায় সে এখন বেশ আগ্রহ নিয়ে অংশগ্রহণ করে।
পর্দাগুলো সরিয়ে আবার ঢেকে দিতে দিতে কালাম হাসলো। সুজন ভাই নিশ্চয়ই এখন এই ঘরে এসে ঢুকবে।
সুজন আফসারউদ্দীনের ঘরে এসেই পিতার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
‘আব্বা কেনো এতো চিৎকার করছেন? এই কালাম তুই ঘর থেকে যা তো। ঘরে খাওয়াদাওয়া কি আছে দেখ।’
আফসারউদ্দীন পুত্রের প্রশ্নের কোন জবাব দিলেন না। কালামের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্য অবলোকনের দিকে মনোযোগী হলেন। কালামকে পেছন দিক থেকে দেখেও তিনি নিশ্চিত জানেন ঘর থেকে বেরুবার সময়ে কালাম দাঁত বের করে হাসছে। প্রথম যেদিন তাকে খেলাটা সম্পর্কে বুঝিয়ে বলেছিলেন তারপর থেকে কালাম সানন্দে এই খেলায় অংশ নিচ্ছে। এতো গালাগাল খেয়েও তাই রাতে ঘুমাবার আগ পর্যন্ত তার সাথে বসে বসে টিভি দেখে।
সুজন পিতার সাথে দ্বিতীয় কোন কথা না বলে আবারো নিজের ঘরে ফিরে গেলে আফসারউদ্দীন মনে মনে গজগজ করতে থাকেন। আজকে সুজনের মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। ছেলেটা কি মাকে পুরাপুরিই ভুলে গেলো? খুব সকালবেলায় ছেলেকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলেন। কোথায় যাচ্ছে সেই প্রশ্ন করতে গিয়েও করেননি। জবাব তো দেবেই না বরং কাটা কাটা কথা শুনিয়ে দিতে পারে। আজকাল তার ধৈর্য বেশ কমে গেছে। মানুষজনের ত্যাড়া কথাবার্তা সহ্য করতে পারেননা। ছেলেটার আসল সর্বনাশ যা করবার তার মা করে গেছে। যতোদিন বেঁচে ছিলো আদর করা ছাড়া কিছু বুঝতোনা। কতোদিন স্ত্রীকে এই নিয়ে ধমকেছেন।
‘এতো আদর দিয়ে দিয়ে ছেলেকে মাথায় তুলোনা। আমাকে তো বটেই একদিন তোমাকেও ভুলে যাবে।’
‘ভুলে গেলে কি আর করা? জোর তো আর করতে পারিনা। আমি আমার মতো আদর করবো। তুমি এর মধ্যে নাক গলাবেনা।’
স্ত্রীর অনুরোধ মেনে নেওয়াটাই আসলে তার ভুল হয়েছে। এই যে তার এতো বয়স হয়েছে, প্রায় সাতষট্টি হতে চললো- ছেলে এখনো তার সাথে সহজ হলোনা। শরীরের কথা থেকে শুরু করে পত্রিকার কথা পর্যন্ত যখন জিজ্ঞেস করে আফসারউদ্দীনের মনে হয় একজন যন্ত্রের সাথে কথা বলছেন। মাস ছয়েক হলো একটা চাকরী পেয়েছে। কোন এক মোবাইল কোম্পানীতে। আফসারউদ্দীনের পেনশনের টাকার সাথে ছেলের বেতন মিলে সংসারটা বেশ ভালোই চলে যাবে। কিন্তু তারপরেও দেখো, সংসারে শান্তি বলে কিছু নেই। রোবটের মতো এক ছেলের জন্ম দিয়েছেন যে কিনা মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে পর্যন্ত বাপের সাথে ঠান্ডা স্বরে কথা বলে। দুই একটা গৎবাঁধা কথা বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
আফসারউদ্দীন রাগে গজগজ করতে করতে পাশ ফিরে শুয়ে পড়েন। বাতি নেভানো সেই অন্ধকার ঘরে কেউ তার পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করা দেখতে পায়না।
সুজন আজকে ইচ্ছা করেই বেশ তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরেছে। অফিসে তেমন কাজের চাপ ছিলোনা। সামান্য কিছু কাজ ছিলো যার দায়িত্ব মুহিবকে বুঝিয়ে দিয়ে রাস্তায় বেশ কিছুক্ষণ হেঁটেছে। দুপুরের দিকে বেশ খানিকক্ষণ বৃষ্টি হয়েছিলো। সে অফিস থেকে বেরোতে বেরোতেই ঝলমলে রোদ। আজকাল খুব বেশী সময় ধরে হাঁটলে তার শায়লার কথা মনে হতে থাকে। শায়লার কথা খুব দ্রুত ভুলে যেতে পারলে তার জন্য ভালো হয়। একই বিষয় নিয়ে আর কতোকাল ধরে সে ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে থাকবে? বাসার কাছাকাছি যখন এসেছে তখন ভাবনার বিষয় শায়লা থেকে মৃত মায়ে বদলে গিয়েছে। এই দিনটাও সুজন যতোটা পারে ভুলে থাকতে আগ্রহী। এই দিন চলে আসলে বাবাকে অসহনীয় মনে হতে থাকে। বেঁচে থাকতে লোকটা তার মায়ের উপরে অত্যাচার বড় কম করেনি। সুজন শৈশব থেকেই দেখে আসছে মায়ের যা কিছু পছন্দ, ভদ্রলোক ঠিক বেছে বেছে সেগুলোর প্রতিই বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ করে এসেছেন। এই যে আজকে তার স্ত্রীর মৃত্যুবার্ষিকী- এই নিয়েও বুড়োর কোন মাথাব্যথা নেই। দিব্যি কালামকে পর্দা ঢেকে রাখা নিয়ে গালাগাল করে গেলো। রাতেরবেলা খাওয়াদাওয়া শেষে বুড়ো নিশ্চয়ই তাকে সাথে নিয়ে আরাম করে টিভিও দেখবে।
কালামকে রাতের খাওয়াদাওয়ার ফরমায়েশ দিয়ে এসে সুজন নিজের ঘরে ঢুকে ঘর অন্ধকার করে চুপচাপ শুয়ে রইলো। এই সময়ের মধ্যে যতোটা পারে মায়ের কথা ভেবে নেওয়া যায়। আচ্ছে মায়ের যেনো কোন রঙ পছন্দের ছিলো? কি আশ্চর্য, তার মনে পড়ছেনা!
রাতেরবেলা খাওয়ার টেবিলে পিতার সাথে সুজন কথাবার্তা বিশেষ একটা বললোনা। মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী নিয়ে তো প্রশ্নই আসেনা। তারা দুইজনেই এমন ভাব করে খেয়ে গেলো যেনো আজকের দিনটা আর আট দশটা সাধারণ দিনের মতোই। টেবিলে খেতে খেতে বেশ ঘুম ঘুম পাচ্ছিলো। কিন্তু খাওয়া শেষে ঘরে ঢুকে সুজনের ঘুম আসলোনা। অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করলো। কিছুতেই কিছু হলোনা।
পানি খেতে সুজন ঘর ছেড়ে বেরুলো। রান্নাঘরের দিকে এগোতে এগোতে আফসারউদ্দীনের ঘর থেকে মৃদু শব্দ শুনলো। বুড়ো তো এতো রাত পর্যন্ত জেগে থাকেনা। টিভি দেখা শেষ করে বিছানায় শুয়ে পড়তে না পড়তেই ঘুম। তবে এতো রাতে শব্দ কিসের? পানি খেয়ে পা টিপে টিপে পিতার ঘরের দরজার সামনে গিয়ে সুজন কান পাতলো।
পানি খেয়ে ঘরে ঢুকবার পরেও সুজনের বারবার মনে হতে লাগলো তার গলা শুকিয়ে আসছে। আবারো কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করলো। কিছুতেই ঘুম এলোনা। তার ঘরের সাথে লাগোয়া ছোট্ট বারান্দা। সেখানে অনেকক্ষণ সে বসে রইলো। তবু ঘুম এলোনা।
মৃতা স্ত্রীকে স্মরণ করে বুড়ো যখন ফোঁপাচ্ছিলো তখন এক গ্লাস পানি নিয়ে আসবার ছুতায় বুড়োর ঘরে সে ঢুকে পড়লে কি এমন ক্ষতি হতো?