somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পরিচয়

১৫ ই আগস্ট, ২০১৭ ভোর ৫:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গতোকাল রাতে চাইলেই অনির্বাণ আগে আগে শুয়ে পড়তে পারতো। কিন্তু রাতেরবেলায় বাল্যবন্ধু কৌশিকের শেষ ফেসবুক স্ট্যাটাসে বিতর্কে জড়িয়ে পড়াতে ঘুমাতে ঘুমাতে তিনটা বেজে গেলো। বন্ধুকে তর্কে পরাজিত করতে পারার আনন্দ নিয়ে ঘুমাতে যাবার কারণেই সম্ভবত আজকে হুড়োহুড়ি করে অফিসে যেতে হবে। তাই রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগের আনন্দের লেশমাত্রও এখন আর অনুভব করা যাচ্ছেনা। বরং নাকে মুখে তাড়াতাড়ি কিছু গুঁজে দিয়েই বাসের উদ্দেশ্যে ছুটতে হবে। এর কোন মানে হয়?


প্রাতঃকৃত্য, গোসল এবং শেভ সেরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে অনির্বাণের পঁচিশ মিনিট লাগলো। পর্দা দুটো সরে যাবার কারণে ঘুম থেকে উঠবার আগে আগে চোখে আলো লাগছিলো। স্মিতা ছাড়া এই কাজ আর কে করবে? তবে আজকে স্ত্রীর উপরে এই কারণে প্রসন্ন হওয়ার অবকাশ পাওয়া যায়। পর্দা ঢেকে রাখতে রাখতে রান্নাঘর থেকে স্মিতা চেঁচিয়ে উঠে,

‘এই, অজিতের কান্না শুনতে পাচ্ছোনা? আমি রান্নাঘরে ব্যস্ত, ওর ঘরে গিয়ে কান্না থামিয়ে আসো।’


এমনিতেই ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গেলো। কোথায় দ্রুত রেডি হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে ছুটবে তা না, এখন গিয়ে দেড় বছর বয়সী পুত্রের কান্না থামাও, যত্তোসব! স্মিতাটা যে কি- তবে গতো পরশুদিন নিজের জীবনে স্মিতার অবদান নিয়ে ফেসবুকে এক হাজার শব্দের একটা বড় লেখা দিয়েছিলো। সাথে তাদের বিয়ের ছবিটাও ছিলো। সেই পোস্টে মানুষজনদের, বিশেষত ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা নারীবন্ধুদের বাঁধভাঙ্গা প্রশংসার কারণে স্ত্রীর উপরে খেঁকিয়ে উঠতে চাওয়ার বাসনাকে অনির্বাণ গলা টিপে হত্যা করে। তাই বলে বিরক্তিকে কি এতো সহজে চাপা দেওয়া যায়? বিয়ের পর থেকেই স্ত্রীকে সে দেখে আসছে। কোন এক অদ্ভুত ক্ষমতায় অনির্বাণের সবচেয়ে ইমার্জেন্সী সময়গুলাতেই স্মিতা এমন কিছু বলে বসবে কিংবা নির্দেশ দেবে যা শুনে পিত্তি জ্বলে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকেনা। কিন্তু কি আর করার? এমনিতে স্ত্রীর প্রতি বড় ধরণের কোন রাগের কারণ সে দেখাতে অক্ষম। বছর দুয়েক আগে যখন মৌলবাদীরা একের পর এক ব্লগারদের হত্যা করছিলো তখনো স্বামীকে ফেসবুক একাউন্টটি বন্ধ করে দেওয়ার কথা স্মিতার মুখ থেকে বের হয়নি। স্ত্রীর এই সহিষ্ণুতাকে অনির্বাণ এখনো পর্যন্ত খোলামনে প্রশংসা করে। কখনো তীব্র ঝগড়াঝাটির পরে তার মান ভাঙ্গাতে অনির্বাণের খুব কষ্ট হলে উচ্চকিত হয়ে স্ত্রীর এই অতীত উদারতার কথা স্মরণ করিয়ে দিলে মান অভিমানের কঠিন স্তর ক্রমশ গলতে শুরু করে। তবে আজকে আসলেই দেরী হয়ে গিয়েছে। তাদের শিশুপুত্র সব কথাই বলতে পারে। আর ডাক্তারেরাই একবার বলেছিলো যে ছেলেটা খুব শার্প মাইন্ডের হয়েছে। খুব দ্রুত নিজের মতো রেসপন্ড করতে পারে। এরকম একটা বাচ্চা কিছুসময় একা একা কাঁদলে তাতে পৃথিবী তো ধ্বংসের মুখে চলে যাবেনা। স্মিতা একটু কনসিডারেট হতেই পারতো। তা আর কি করা যাবে? একজন মানুষের কাছ থেকে তো আর সব পাওয়া যায়না। অনির্বাণ আগেও লক্ষ্য করেছে, স্ত্রীকে নিয়ে যখনই সে কোন ফেসবুক পোস্ট দেয়- শয়ে শয়ে লাইক আর কমেন্টের বন্যা বইতে আরম্ভ করে। ফেসবুকের কল্যাণে তাকে যতো মানুষ চিনেছে; তার পেছনে স্মিতার অবদানের কথা ভুলে যাবে- এতোটা অকৃতজ্ঞ স্বামী আর যেই হোক সে নয়! তাই অনির্বাণ হৃষ্টচিত্তে পুত্রের কান্না থামানোর পিতৃসুলভ দায়িত্ব পালন করে আসে।


তড়িঘড়ি করে বাসের জন্য রাস্তায় এসে অনির্বাণ দেখলো যতোটা ভিড় হবে ধারণা করেছিলো তেমন নয়। দুই একজনের সাথে হালকা ধাক্কাধাক্কি করে সহজেই বাসে উঠতে পারলো। রাতেরবেলাতে বেশ বৃষ্টি হয়েছিলো। তাই সকালে ঝকঝকে রোদের পরেও রাস্তা ভিজে ভিজে। তবে সিটে বসতেই বাসের ভেতরকার পরিবেশ উত্তপ্ত আছে টের পেলো। আজকে কোন বৈদেশিক কূটনৈতিক বিকালবেলাতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করবেন এই নিয়ে বাসযাত্রীদের উদ্বিগ্ন হতে দেখা গেলো। তাদের দুশ্চিন্তার প্রধান কারণ দুপুর থেকে শহরের বিভিন্ন রাস্তায় দুঃসহ ট্রাফিক জ্যাম দেখা যাবে। পেশাগত কাজে বাইরে বেরুনো থেকে শুরু করে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত নাভিশ্বাস উঠবে এই কঠোর বাস্তবতা নিয়ে বেশ কিছু বাসযাত্রী নিজেদের মধ্যকার অসন্তোষ অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিলে অনির্বাণ অফিস ব্যাগ থেকে একটা ম্যাগাজিন বের করে অতিরিক্ত মনোযোগ দিয়ে তা পড়তে আরম্ভ করে। অফিসে বসে সুযোগ পেলেই ফেসবুকে ঢোকে। এমনকি অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসে গোসল, রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে নেওয়ার পরেই ফেসবুকে বসে পড়ে। সেখানেও মানুষের যতো অসন্তোষ, রাগ দেখা যায় তার সবই তো পিওর রাজনৈতিক। অনির্বাণ নিজেও কি যোগ দেয়না? তিন বছর আগে ফেসবুক একাউন্ট খুলেছিলো। ছয় মাসের মধ্যেই সে বুঝেছিলো মানুষের নানাবিধ রাজনৈতিক অসন্তোষ নিয়ে তাদের মনস্তত্ব বুঝে লেখালেখি করলে নতুন নতুন অনেক মানুষের সাথেও সখ্যতা গড়ে উঠে আবার তার সীমিত সাধ্যের মধ্যে যতোটা রাজনৈতিক সচেতনতার দায়িত্ব পালন করা যায় সেটাও সম্ভবপর হয়ে উঠে। সারাদিন অফিসের ঝুটঝামেলা মোকাবেলা করে দেশের প্রতি এর চাইতে বেশী কর্তব্য পালনের সুযোগ তার কই? এখন বাসের মধ্যেও যদি সে রাজনীতি নিয়েই আগ্রহী হয় তাহলে বিষয়টা বড্ড বেশী মনোটোনাস ঠেকে। তাই বাসের ভেতরকার এই আপাত রাজনৈতিক বিক্ষোভের চেয়ে বাইরের ইলেকট্রিক পোলে দাঁড়িয়ে থাকা একটা শালিকের দিকে অনির্বাণ মনোনিবেশ করলে পাখিপ্রেমের বদৌলতে শরীর বাসের ভেতরে অবস্থান করলেও হৃদয়ের কোন সংযোগ স্থাপন হয়না।


অফিসে ঢুকে একটু ধাতস্থ হয়ে বসতে না বসতেই আইটি সেকশনের সিদ্দিক সাহেব এসে অনির্বাণের ঘরে ঢুকলো।


‘অনির্বাণ সাহেব, ঘটনা কিছু শুনছেন?’


‘না। আমি তো কিছু শুনিনি।’ অনির্বাণ সতর্ক হলো। এই অফিসে সে জয়েন করবার ছয় মাস পরে সিদ্দিক সাহেব এসে জয়েন করেছিলেন। মহা ঘাঘু লোক। সিদ্দিক সাহেবের আড়ালে তার সহকর্মীরা তাকে ‘এজেন্ট সিদ্দিক’ বলে ডাকে। অফিসের টপ লেভেলের বস কোন কাঁচাবাজার থেকে শাকসবজি কেনেন এই তথ্য থেকে শুরু করে অফিসের বুড়ো পিয়ন জব্বার কেনো তার স্ত্রীকে এখনো পান থেকে চুন খসলেই ধরে ধরে পেটায় সব খবরই তার নখদর্পণে। তাছাড়া লোকটা বেশ সাম্প্রদায়িক। সুযোগ পেলেই হিন্দুদের নিয়ে এমন সব রসিকতা করে যে নিজে ধর্মপালনের ধারেকাছে না থাকলেও অনির্বাণেরই মাঝেমাঝে মেজাজ চড়ে যায়। তবে সিদ্দিক সাহেব তার সামনে কিংবা অফিসের অন্য তিনজন হিন্দু স্টাফদের সামনে কম্যুনাল কথাবার্তা কখনো বলেননা। সবমিলিয়ে লোকটাকে পছন্দ করতে পারাটা বেশ মুশকিলের। তবে খাতির ভালো রাখা কলিগদের প্রমোশন কি অন্যান্য ছোটখাটো সাহায্য-সুবিধা করে দেওয়ার ব্যাপারে লোকটা অদ্বিতীয়। কথাটা মনে পড়ে গেলে লোকটাকে কেনো অপছন্দ করে এখন সেই নিয়ে মাথা না ঘামানোটাই ভালো এই সিদ্ধান্তে অনির্বাণ স্মুথলীই উপনীত হতে পারে।


‘হায় হায়। আপনি তো দেখতেছি কিছুই খবর রাখেন না। রাকিব সাহেব আছে না? উনি তো শেষমেষ অফিসে নারীঘটিত কেলেঙ্কারী ঘটায়েই ছাড়লেন।’ রাকিব সাহেবের এই সৌভাগ্য তার কেনো হলোনা এই ভেবে সিদ্দিক সাহেবকে কিঞ্চিত বিমর্ষ দেখায়।


এখন উত্তেজনা দেখালে চলবেনা। প্রমোশনের ব্যাপারে সিদ্দিক সাহেব ক্রুশিয়াল হলেও লোকটা যে সুযোগ পেলে কোন ক্ষতি করবেনা সে কথা কে বলতে পারে? নিজের উপরে নিষ্পৃহতা আরোপ করে অনির্বাণ মিহি সুরে বলে উঠে ‘আমি তো কিছু শুনিনাই। কবে হইলো?’


‘আরে গতোকাল সন্ধ্যার ঘটনা। জব্বার আমাকে এসে বললো। আমরা সবাই তো সাড়ে পাঁচটার সময়তেই বের হয়ে গেলাম। রাকিব সাহেব তারপরেও অফিসে ছিলো। জব্বার ঘরদোর পরিষ্কার করতে করতে হঠাৎ দেখলো রাকিব সাহেবের ঘর থেকে সুমাইয়া বলতে গেলে দৌড়ায়ে বাইর হইলো। জব্বার বললো মেয়েটার নাকি আউলাঝাউলা চুল ছিলো। আর পরার শাড়িটারও যা তা অবস্থা। এই নিয়ে অফিসে সারাদিন খুব হইচই। সুমাইয়া মেয়েটা এখনো অফিসে আসেনাই। এদিকে শুনতেছি রাকিব সাহেবের বউ সরাসরি চেয়ারম্যানের কাছে কমপ্লেইন করবে।’


সিদ্দিক সাহেব তারপরে আরো অনেক কিছুই বলে গেলেন তবে সেসব কথা শুনে অনির্বাণ মগজে ধরে রাখতে সফল হলোনা। সুমাইয়া মেয়েটা মনে হয় তার দিনটাই মাটি করে দিলো। বেশীদিন তো হয়নি, দেড় বছর হলো মেয়েটা এই অফিসে চাকরী করছে। তিন মাসের পর থেকেই তার দিকে অনির্বাণ চোখ ফেরাতে পারতোনা। অজিতের জন্মের পরে বেশ একটা লম্বা সময় স্মিতার কিছু সিভিয়ার ফিজিকাল কমপ্লিকেশনের কারণে স্ত্রীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের কোন সুযোগ ছিলোনা। সেই সময়ে স্লিভলেস ব্লাউজ পরে অফিসের কাজ করা সুমাইয়া রাতেরবেলায় অনির্বাণের কল্পনাশক্তির জন্য এসেনশিয়াল ছিলো। তারপরে একদিন মেয়েটার ফেসবুক আইডি খুঁজে পেয়ে রিকোয়েস্ট দিয়ে এক্সেপ্টেড হলে ধারাবাহিকভাবে মেয়েটার প্রোফাইল অনির্বাণ দেখে গেছে। তাকে দেখেই তো ফেসবুকে নারীর অধিকার নিয়েও লেখালেখি করা যায় এবং মানুষজন সেই সোশাল এক্টিভিজমকে এপ্রিশিয়েটও করে- এই বাস্তবতার সাথে সে প্রথম পরিচিত হয়েছিলো। তার সাথে অফিসে খুব একটা কথা যদিও বলেনা কিন্তু অনির্বাণের নারী অধিকার বিষয়ক লেখাগুলাতে সুমাইয়া এসে নিয়মিত নিজের সহমত জানিয়ে যেতো। অনির্বাণ আসলে একটা নির্বোধ। কি থেকে কি ধরে নিয়েছিলো। আচ্ছা এমনও তো হতে পারে যে সিদ্দিক সাহেব যা বলছেন সেটা আসলে গুজব, কিংবা অর্ধসত্য। হ্যা, খুবই সম্ভব। পিয়ন বুড়ো জব্বার মিয়ার দৃষ্টিশক্তির প্রশংসা করা যায় এমন কোন কথা তো অফিসে কেউ শোনেনি। কি দেখতে কি দেখেছে আর সুযোগ মিলতেই সিদ্দিক সাহেবের কানে এসে ঢেলেছে। পিয়ন হলে কি হবে জব্বার মানুষ চিনেছে জব্বর। আর কেউ না, সিদ্দিক সাহেবকে এসেই বলেছে। যে কিনা অফিসে গুজবের থলি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। না না, সুমাইয়ার উপরে এখনই বিরুপ হবার কোন যুক্তি সে খুঁজে পায়না। অনির্বাণের মনে পড়লো বিশ দিন আগেই কর্মস্থলে মেয়েদের হ্যারাসমেন্ট এবং তাদের পেশাগত দক্ষতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে নারীদের খাটো করে দেখা পুরুষরা কি কি করে সে নিয়ে সে বিস্তারিত লিখেছিলো। আজকাল তার স্মৃতিশক্তি বেশ খারাপ হয়ে গেছে। বিশ দিন আগের লেখা পর্যন্ত সে ভুলে যায়। আরে সেই ফেসবুক লেখার কথা মনে করতে পারলেই তো এতো তাড়াতাড়ি সুমাইয়ার ব্যাপারে হতাশ হবার কোন অবকাশ ছিলোনা। নিশ্চয়ই কোন একটা ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। তাছাড়া মেইন যে কালপ্রিট রাকিব সাহেব, তার আপত্তিকর লেভেলের ওম্যানাইজিং বিহেভিয়ার সম্পর্কে অফিসের সকলেই অবগত। দুই বছর আগে, তখন সুমাইয়া মেয়েটা অফিসে জয়েনও করেনি- আইটি সেকশনে সিদ্দিক সাহেবেরই এক সাবঅরডিনেট মালিহার সাথে রাকিব সাহেব ইনএপ্রোপ্রিয়েট আচরণ করেছিলো। সেই লজ্জায় মালিহা মেয়েটা দশ দিনের মাথাতে চাকরী ছেড়ে দিলো। কাজেই এমন সম্ভাবনাই বরং অনেক বেশী যে রাকিব সাহেবের সাথে সুমাইয়ার যা হলো সেখানে মেয়েটার আদপেই কোন কনসেন্ট ছিলোনা। যদি সিভিয়ার কিছু হয়েও থাকে তবে তা একতরফা এবং সুমাইয়ার উপরে ফোর্সফুলী হয়েছে। এইতো, এইতো মাথায় ঠিকঠাক যুক্তি খেলছে। সারাদিন মাটি হয়ে গেলো এই ভাবনাটা তাহলে ভুল। ঘটনাটির সম্ভাব্য যৌক্তিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর সক্ষমতায় অনির্বাণ নিজের ধীশক্তির উপরে এতোটাই সন্তুষ্ট হলো যে তার জোরেই লাঞ্চ আওয়ার পর্যন্ত খুব নিষ্ঠার সাথে পেশাগত দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হলো!



ছুটির পরে সন্তুষ্ট হৃদয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে অনির্বাণের মেজাজ খিঁচড়ে উঠলো। বৈদেশিক কূটনৈতিকের ঢাকা সফরের ফলাফল বিলক্ষণ টের পাওয়া যাচ্ছে। অফিস থেকে বিশ পঁচিশ গজ পশ্চিমে সারি করে রিকশাওয়ালারা প্যাসেঞ্জার তোলার জন্য রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আজকে তার সামান্যতম সুযোগও নেই। চারপাশে ট্রাফিক জ্যামে রাস্তা ব্লকড। প্রাইভেট কার থেকে রিকশা, প্রতিটা যানবাহনের যাত্রীরা অনড় অচল রাস্তায় বসে নিজেদের দুর্ভাগ্যকে অভিশম্পাত করে। এদিকে ট্রাফিক সার্জেন্টকে দেখো। সিগনাল অতিক্রম করবার ধৃষ্টতা দেখানো রিকশার হাওয়া শূন্য করে, রিকশাওয়ালাকে চড়থাপ্পড় মারা শেষে কি আরামসে মুখে খিলি পান ঢুকিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে! চ-বর্গীয় একটি গালি দেওয়ার জন্য জিভের অগ্রভাগ উন্মুখ হলেও শৈশবের মাতৃস্নেহের স্মৃতি মস্তিষ্কে আবির্ভূত হলে নিজের জিভের উপরে অনির্বাণের স্বায়ত্তশাসন চলে আসে। যখন তখন মাতাসম্পর্কিত গালি দেওয়ার বাসনা দূর করতে হবে। দুই সপ্তাহ আগেই তো মায়ের জন্মদিন গিয়েছে। বিশাল স্মৃতিকথা লিখে ফেসবুকে পোস্ট করবার আগে মায়ের পুরনো ছবি খুঁজতে গিয়ে স্মিতাকে ঘুম থেকে তুলে ফেলেছিলো। হালকা ঝগড়াও হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু শেষমেষ মায়ের পুরনো ছবি খুঁজে পেয়ে ফেসবুকে সেই পোস্ট আপডেট করার পরে সকলের আবেগভরা প্রশংসা দেখে মাতৃপ্রেম পুনরায় উত্থিত হলে স্ত্রীর সাথে সেই কলহের কথা কিছুমাত্র মনে রাখেনি। কুৎসিত ট্রাফিক জ্যামকে মাথা থেকে বাইপাস করতে একের পর এক বাল্যকালের স্মৃতিকে তুলে এনে অনির্বাণ মায়ের প্রতি ভালোবাসা জাগ্রত রাখতে সচেষ্ট হয়।



বাসায় ফিরতে ফিরতে আটটা বেজে গেলো। জুতামোজা গুছিয়ে রাখতে রাখতে ড্রয়িংরুম থেকে জোর হাসাহাসির শব্দ শুনে সেই উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়ে অনির্বাণ দেখে অজিতকে কোলে নিয়ে লোফালুফি করছে প্রবীর। তার ছেলেটারও কি হাসি দেখো! নরম কোমল দাঁতগুলো রীতিমতো ঝলসে বেরিয়ে পড়ছে।


‘তোকে তো বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। জ্যামে সাফার করার আফটার ইফেক্ট?’



তা শালা তোমার মতো সারাদিন গাড়ি মারানোর সুযোগ থাকলে আমিও ঠিকই নায়ক সেজে বন্ধুর ছেলেকে আদর করতে পারি। কিন্তু অনির্বাণের মুখ থেকে সম্মতিসূচক অপ্রতিভ বাক্য বেরিয়ে আসে। ‘হ্যা আর বলিস না। দাঁড়া ফ্রেশ হয়ে আসি। আর তুই রুপন্তিকে সাথে আনলিনা ক্যান?’



‘ও গেছে নিজের বাপের বাড়ী। আরো তিন চারদিন থাকবে।’ অজিতকে কোলে নিয়ে লোফালুফি করতে করতে প্রবীর জবাব দেয়।



ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হতে অনির্বাণের স্বাভাবিক সময়ের চাইতে একটু বেশী সময় লাগে। চেহারা বলো কি স্বাস্থ্য বলো প্রবীরের সাথে তারা কোন বন্ধু পাল্লা দিয়ে পারবেনা। কে বলবে তার বয়স সাইত্রিশ? এখনো দিব্বি ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। প্রবীর বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে প্রথমে স্মিতার বন্ধু ছিলো। পরে অনির্বাণের সাথে পরিচয় হয়ে তাদের বন্ধুত্বটাই বরং বেশী গাঢ় হয়ে উঠে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছরেই স্মিতাকে সবার সামনে অপ্রস্তুত করে প্রপোজ করে বসেছিলো। তবে স্মিতার তরফ থেকে কোন ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। তাদের প্রেম হবার পরে অনির্বাণ ধীরে ধীরে সেসব গল্প স্মিতার কাছ থেকে বিস্তারিত শুনেছে। স্ত্রীর প্রতি সন্দেহপ্রবণ এমন মানসিকতার পুরুষ অনির্বাণ মনেপ্রাণে ঘৃণা করে। বিশেষ করে ফেসবুকে সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব হবার পর থেকে। কিন্তু প্রবীর এলেই স্মিতার খাতির-যত্ন একটু বেশীই বেড়ে যায় এই ব্যাপারটা চাইলেও মাথা থেকে অনির্বাণ মুছে ফেলতে পারেনা। আগেও লক্ষ্য করেছে যে প্রবীর বাসায় এলেই দ্রুত সময়ের মধ্যে নিজের হাতে কিছু না কিছু স্ন্যাকস বানাতে স্মিতা তৎপর হয়ে উঠে। আজকেও দেখো, সে বাসায় ঢুকতেই স্মিতার খিলখিল হাসি শুনতে পাচ্ছিলো। এই কথা ঠিক যে অসাধারণ রসবোধের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই প্রবীর তাদের মধ্যে বিখ্যাত কিন্তু তার নিজের রসবোধও তো খুব একটা মন্দ নয়। অফিসে মানুষজন তার রসিকতায় বেশ হাসে। ফেসবুকেও তার রসাত্মক পোস্টগুলো আশেপাশের মানুষদের যথেষ্ট বিনোদন দিতে সক্ষম। কিন্তু স্মিতার মুখে কদাচিৎ সে হাসি দেখেছে। প্রবীরটাও দেখো। যখনই বাসায় আসে কোন না কোন ছুতায় নিজের স্ত্রীকে নিয়ে আসেনা। আজকেও কি অনায়াসে স্ত্রীকে বাপের বাড়ী পাঠিয়ে দিলো। অনির্বাণের কোন সন্দেহ নেই যে পুরাটাই বানোয়াট। স্ত্রীসহ এই বাড়ীতে আসলে প্রাগৈতিহাসিক আমলের হলেও-হতে-পারতো-প্রেমিকার খিলখিল হাসির সাথে সাথে নিজের হাতে বানানো স্ন্যাকস থেকে বঞ্চিত হবার একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়! চোখমুখ পরিষ্কারভাবে ধোয়ার পরে অনির্বাণ গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবীটা গায়ে চাপিয়ে দিলো। স্মিতা বেশ কয়েকবারই বলেছে এই পাঞ্জাবীতে তাকে দারুণ দেখায়।



প্রবীরের সাথে আড্ডা দিয়ে রাতের খাওয়া সারতে সারতে দশটার মতো বেজে গেলো। খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে ছেলেকে নিয়ে স্মিতা এগারোটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু আজকে বেশ দেরী করছে। পৌনে বারোটা বেজে গেছে এখনো পাশের ঘর থেকে অনির্বাণ স্ত্রীর গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। ঘুমপাড়ানি গান শুনে পুত্রের চোখ ঝেঁপে যদি ঘুম নেমে আসে সেই প্রচেষ্টা। ছেলেটাও দেড় বছরে যতোটা সেয়ানা হওয়া যায় তার চাইতে বেশীই সেয়ানা হয়েছে। আংকেলের আদর খেয়ে আজকে ঘুমাতেই চাইছেনা। আচ্ছা স্মিতার উৎফুল্ল কন্ঠের পেছনে আরো কিছুর সংযোগ থাকতেই পারে। অনির্বাণ সেই ক্ষেত্রে কি আর করতে পারে? বউ-ছেলের পেছনে সে সময় তো কম দেয়না। অফিস ছুটি হতেই বাড়ির উদ্দেশ্যে সে বেরিয়ে পড়ে। ধারাবাহিকভাবে ওভারটাইম অফিস করলে তার কি আরো কয়েকটা প্রমোশন হতে পারতোনা? আলবৎ পারতো। নিজের আত্মত্যাগের কথা খেলোভাবে যখন তখন স্ত্রীকে মনে করিয়ে দিতে তার রুচিতে বাঁধে। নাহ, আর কয়েকটা মাস যাক। এরপর থেকে সে ওভারটাইমই করবে। অফিসে কতোজন ঘরপরিবারকে তোয়াক্কা না করে, সামাজিক সম্পর্কগুলোকে তুড়ির মতো উড়িয়ে দিয়ে ওভারটাইম করে করে ক্যারিয়ার গুছিয়ে নিচ্ছে- সে পিছিয়ে থাকবে কি যুক্তিতে? তাও যদি এর কোন ইতিবাচক ফলাফল সে ভোগ করতে পারতো। তার কপালে তা থাকলে তো? এইসব বঞ্চনার চাইতে অফিসে ওভারটাইম করাটা ঢের ভালো। তাছাড়া সে লক্ষ্য করেছে ইদানিং সুমাইয়া অফিস থেকে বেশ দেরীতেই বেরোয়। সম্ভবত রাকিব সাহেবের জন্যেই। তা একসাথে ওভারটাইমে কাজ করলে তার উপরে অনির্বাণ তো আর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাবেনা। কাজ করতে করতে টুকটাক কথাবার্তা, দুই চারটা রসিকতা এর বাইরে তার আর কিই বা চাওয়ার থাকতে পারে? তাছাড়া মেয়েটার সেন্স অব হিউমার বেশ চমৎকার। হিউমার এপ্রিশিয়েট করতে পারে। এদিকে স্মিতার সাথে রসিকতা করলে কোন সাড়াই পাওয়া যায়না। তবে হ্যা, রঙ্গ-রসিকতার বাইরে সুমাইয়া মেয়েটার সাথে আর বেশী দূরে না যাওয়াটাই ভালো। এমনকি ফেসবুকেও না। যদিও এতো সুন্দর সুন্দর প্রোফাইল ছবি আপডেট করে যে রোমান্টিক কিছু একটা লেখা থেকে বিরত থাকতে তাকে বেশ সংগ্রাম করতে হয়। অফিসে রাকিব সাহেবের প্রভাব অনস্বীকার্য। এমনকি সামনে যেই প্রমোশনের জন্য অনির্বাণ অপেক্ষা করছে তার জন্যেও রাকিব সাহেবের কাছেই তার বেশ কয়েকবার ধর্ণা দিতে হবে। নারীসঙ্গের বাসনায় পেশাগত সাফল্য থেকে বঞ্চিত হবার কথা তার কাছে অচিন্তনীয়। আসন্ন কর্মপরিকল্পনার একটা নির্দিষ্ট ছক মাথায় গেঁথে নিতে পারলে চোখে ঘুম নেমে আসতে অনির্বাণের তাই আর দেরী হয়না।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ৮:২২
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মত প্রকাশ মানে সহমত।

লিখেছেন অনুপম বলছি, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৭

আওয়ামী লীগ আমলে সমাজের একটা অংশের অভিযোগ ছিলো, তাদের নাকি মত প্রকাশের স্বাধীনতা নাই। যদিও, এই কথাটাও তারা প্রকাশ্যে বলতে পারতেন, লিখে অথবা টকশো তে।

এখন রা জা কারের আমলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্নমর্যাদা!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৩

রেহমান সোবহান একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার। রেহমান সাহেব এমন একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন যা খুব নির্জন এলাকায় অবস্থিত এবং সেখানে যাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাঁঠালের আমসত্ত্ব

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

কাঁঠালের কি আমসত্ত্ব হয় ? হয় ভাই এ দেশে সবই হয়। কুটিল বুদ্ধি , বাগ্মিতা আর কিছু জারি জুরি জানলে আপনি সহজেই কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানাতে পারবেন।
কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানানের জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। অ্যাকসিডেন্ট আরও বাড়বে

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



এরকম সুন্দরী বালিকাকে ট্র্যাফিক দায়িত্বে দিলে চালকদের মাথা ঘুরে আরেক গাড়ির সাথে লাগিয়ে দিয়ে পুরো রাস্তাই বন্দ হয়ে যাবে ।
...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×