ছিপছিপে দুটি পা নিয়ে সায়েন্স ল্যাবের ফুটওভার ব্রিজে উঠে মশিউর নিঃশ্বাস নেয়।
তৃপ্তির নাকি ক্লান্তির সে বুঝে উঠতে পারেনা।
এই যে এখন সে রাস্তায় চলাচলকারী প্রত্যেকের চেয়ে অনেকটা উপরে থাকতে পারছে এই প্রাপ্তিই বা কম কিসের?
হ্যা প্রাপ্তিই বটে, কেননা অন্য কোন উপায়ে এতোটা উঁচুতে সে কখনো উঠতে পারবেনা। তার সেটা হয়ে উঠবেনা।
বাল্যবন্ধু গালিব থেকে শুরু করে প্রাক্তন হবে হবে করছে প্রেমিকা বুশরা, মশিউরের ঘনিষ্ঠজনেরা প্রত্যেকেই তার ব্যাপারে এই সত্যটুকু জানে। মশিউর কখনোই চূড়ায় উঠতে পারবেনা। না সাফল্যের, না বেদনার। সে আজন্মই মিডিওকারদের গোত্রভুক্ত।
সারাদিনের ভ্যাপসা গরমে মশিউর বিপর্যস্ত। বাজেভাবে বিপর্যস্ত।
তিন বছর আগে পরলোকগত পিতার কথা মনে পড়লো তার। ভদ্রলোক গ্রীষ্মকালে “উফ কি গরম, জীবনটা শেষ হয়ে গেলো” কাতরধ্বনি উচ্চারণ করতে ব্যাপকভাবে ব্যাপৃত থাকতেন।
আবার শীতকাল চলে এলেই “এবারে অসহ্য রকমের শীত পড়েছে। আগে কখনো দেখিনাই।”
বলাই বাহূল্য একটা আধা অন্ধকার নিভু নিভু দেখতে স্যাঁতস্যাঁতে ঘরের দেয়াল, জীর্ণ অবয়বের কারনে যাকে দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ বললেই শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হবে – ব্যতীত আর কেউই আবহাওয়ার তিক্ততা নিয়ে তৎকালীন জীবিত বর্তমানে মৃত সেই ব্যক্তির কথার সামান্যতম কর্ণপাতও করতোনা।
মশিউর, বিনা কোন কারনেই নিজের বাইসেপসগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখে। চারপাশে কোন নারীকে দেখা যাচ্ছেনা তবুও।
কাউকে নিজের সৌন্দর্য দেখানোর বিষয়টিতে নার্সিসিজমের কিছুমাত্র থাকেনা। বড়জোর ক্যানভাসারসুলভ এক ধরণের শিশুতোষ আচরণ প্রস্ফুটিত হয়।
মশিউর গতো এক বছর হলো এমনটা মনে করে। বুশরাকে দেখে দেখে সে এই সিদ্ধান্তে এসে উপনীত হয়েছে।
এই যেমন নিচে, রুক্ষ শক্ত বাস্তব মাটির পিচে চিরাচরিত গতানুগতিকতা নিয়ে নিরস মুখে চলাচলকারীদের স্বপ্ন, ভালোবাসা, বিবমিষা, প্রতারণা, মিথ্যাচার, সবকটি নির্ভেজাল আবেগকে মধ্যমা দেখিয়ে কেমন ডাঁটের সাথে এই ফুটওভারব্রিজ থেকে উজ্জ্বল হয়ে দেখা দিচ্ছে ল্যাবএইড হাসপাতালের সাইনবোর্ড।
সাইনবোর্ডটিকে বড্ড শিশুতোষ দেখাচ্ছে। অন্তত মশিউরের কাছে।
কথাগুলো নিজের কাছে রেখে দেওয়াই ভালো। অন্য কেউ শুনলে মনে করে থাকতে পারে ষোলো কোটি মানুষের কিলবিল করা সইতে না পেরে মশিউর বুঝি পাবনাগামী হতে চলেছে।
এমনটা যে সে কখনো ভাবেনি তা নয়। কিন্তু প্রতিটি ভাবনারই বাস্তবায়ন থাকতে হবে এমনটা সে মনে করেনা।
আজকে আসলেই অসহ্য গরম পড়েছে। মশিউর যথেষ্টই ধৈর্য্যশীল, বিশেষত আবহাওয়ার আবহমান সার্কাস নিয়ে। কিন্তু এখন, এই ‘কিছুই অনুভূত হচ্ছেনা’ মুহূর্তে আসলেই সে পেরে উঠছেনা।
যেই তড়িৎ স্পৃহায় ফুটওভার ব্রিজে উঠেছিলো তার চাইতেও দ্রুতগতিতে প্রাত্যহিকতার মাঝে নেমে মিশে গেলো মশিউর।