...‘আমাকে খাস রাজাকার বানিয়ে দাও’
সৈয়দ বোরহান কবীর
কবি শামসুর রাহমান ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’ কবিতায় পরম করুণাময়ের কাছে রাজাকার হওয়ার আকুতি জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশে এখন সব দেখে শুনে আমারও ‘খাস রাজাকার’ হওয়ার সাধ জেগেছে। এদেশে রাজাকার হলে অনেক সুবিধা, ভাগ্যের চাকা দ্রুত ঘোরে, শনৈ শনৈ উন্নতি হয়।
বাংলাদেশে রাজাকাররাই সবচেয়ে ক্ষমতাবান। দুই সপ্তাহ হলো যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইবুনাল গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ এক নিঃশ্বাসে অন্তত দশজন যুদ্ধাপরাধীর নাম বলতে পারে। কিন্তু এখনো একজনকে ট্রাইবুনাল কিংবা তদন্তকারী কর্মকর্তারা টোকাও দেয়নি, গ্রেফতার তো দূরের কথা! তারা এখন আগের চেয়ে বেশি জোরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। রীতিমতো চ্যালেঞ্জ করছে রাষ্ট্রকে। দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের আগেই তাদের গ্রেফতারের আয়োজন শুরু হয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে সিনেমা হলে বোমা হামলার (!) অভিযোগে গ্রেফতার হন শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন। এ আমলেও দেখি মোবাইল চুরি (!) মামলায় গ্রেফতার হন এহসানুল হক মিলন। কিন্তু জামায়াতের বেলায় অন্য অবস্থা। আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেও তারা গ্রেফতার হয় না। কী জাদু! তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকারের আমলে গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে বাপের বেটার মতো ঘুরে বেরিয়েছে মুজাহিদ। এখনো তার ব্যতিক্রম না। ইয়া মাবুদ, আমিও খাস রাজাকার হতে চাই।
রাজাকার হলে দেশত্যাগ করতে হয় না। ধর্মের অবমাননা করলে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিলে কোনো শাস্তি হয় না। নিজের মতামত প্রকাশ করে দেশত্যাগ করতে হয় আমাদের বোন তসলিমা নাসরিনকে। দাউদ হায়দারের মতো কবি এখনো তার প্রিয় স্বদেশে নিষিদ্ধ। কৈশোর-উত্তীর্ণ আরিফকে মেরুদণ্ডহীন সম্পাদক নিজে বাঁচার জন্য পাঠিয়ে দেন জেলহাজতে। কিন্তু মহানবীর সঙ্গে তুলনায় নিজামীর তো নয়ই তার শিষ্যেরও বুড়ো আঙুল কেউ ধরতে পারে না। আমি একজন চৌকস রাজাকার হতে চাই। তাহলে আমিও হয়ে যাব ধরাছোঁয়ার বাইরে এক ক্ষমতাবান মানুষ।
আদালত অবমাননার জন্য হরহামেশাই হাইকোর্ট রুল জারি করে। অনেককে তিরস্কারও করে। কোর্টে দাঁড় করিয়ে রাখে। কিন্তু রাজাকাররা যখন বিশেষ ট্রাইবুনালকে ক্যাঙ্গারু কোর্ট বলে (যে ট্রাইবুনালের প্রধান একজন হাইকোর্টের বিচারপতি) এই আদালতকে নানা অবজ্ঞা করে তখন আদালত কোনো সুয়োমুটো রুল জারি করে না। কারণ, তারা রাজাকার, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমিও তাই হতে চাই সাচ্চা রাজাকার।
রাজাকারদের বিচার করা যাবে কিনা, তার জন্য ‘পাকিস্তানের’ সম্মতি নিয়ে উল্লসিত আমরা। যে পাকিস্তানি হানাদারদের এই রাজাকাররা ‘প্রভু’ মানত। যাদের সঙ্গে যোগসাজশে বাংলাদেশের ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করা হয়েছে। জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। অসহায় মানুষের আর্তনাদ নদীর কলতানকে ছাপিয়ে দিয়েছে, সেই পাকিস্তানিরা যারা তাদের অপকর্মের জন্য এতটুকু অনুতপ্ত নয়। ক্ষমা প্রার্থনা করেনি, আমাদের পাওনা ফেরত দেয়নি। পাকিস্তানিরা আমাদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সমর্থন করল না বিরোধিতা করল, তাতে কী আসে যায়? পাকিস্তানি ‘সার্টিফিকেট’-এ আমরা এত বিগলিত কেন? (ভাগ্যিস ’৯১-এর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে যেমন রাষ্ট্রপতি দুই প্রার্থী নরঘাতক গোলাম আযমের দোয়া নিতে গিয়েছিলেন, এবার কেউ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গোলাম আযমের সমর্থন নিতে যায়নি!)। রাজাকারদের প্রভুরা অনেক উঁচুতে অবস্থান করে, এত উঁচুতে যে তাদের অপরাধের বিচারে তাদেরই ‘অনাপত্তি সার্টিফিকেট’ প্রয়োজন হয়। তাই আমিও একজন শক্ত-সামর্থ্য রাজাকার হতে চাই।
বড় রাজাকাররাই নয় বাচ্চা বাচ্চা রাজাকাররাও এখন বাংলাদেশে সুখেই আছে। প্রশাসনে, ব্যবসায় সর্বত্র তারা জাঁকিয়ে বসেছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সিরাজগঞ্জে কিশোরী পূর্ণিমার সম্ভ্রমহানি ঘটে। ’৭১-এর স্টাইলে মেয়েটি নির্যাতিত হয় বিএনপি-জামায়াত ক্যাডারদের হাতে। ঢাকার প্রেসক্লাবে পূর্ণিমার আহাজারি এখনো কানে বাজে। পূর্ণিমার ঐ ঘটনা ধামা-চাপা দেয়ার জন্য নোংরাভাবে যে ব্যক্তিটি কাজ করেছিল, তিনি হলেন ঐ সময়ের সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক। তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনেছিলেন পূর্ণিমার পরিবার। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারে অঙ্গীকারাবদ্ধ বর্তমান সরকারের আমলে তার পদোন্নতি হয়েছে। সরকারি পরিবহনের কর্ণধার তিনি। আকাশে বাতাসে শোনা যায়, তার আরো পদোন্নতি হচ্ছে। আমি সুবিধাবাদী রাজাকার হতে চাই। রাজাকার হলে সব আমলেই ভালো থাকা যায়।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম পিন্টুর নিকটাত্মীয় এখন প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের কমিশনার তিনি। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির এন্তার খবর প্রকাশের পরও তিনি রাজসিকভাবেই আছেন। আমিও এমন চাটুকার, দুর্নীতিবাজ রাজাকার হতে চাই। রাজাকার হলে কারো কাছে জবাব দিতে হয় না।
বেগম মতিয়া চৌধুরী ২০০১-এর নির্বাচনকে বলেন ‘সালসা বাহিনীর নির্বাচন’। ঐ নির্বাচনে বিচারপতি লতিফুর রহমান কী করেছেন তা সবাই জানেন। যেই লতিফুর রহমানের সহকারী একান্ত সচিব, এখন দুর্দান্ত ক্ষমতাশালী আমলা। ২৫০ জনকে ডিঙ্গিয়ে তার পদোন্নতি দেয়া হয়। যুগ্ম-সচিব হয়েও তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জেলা প্রশাসক। আমি এমন রং-বদলের রাজাকার হতে চাই। তাহলে সব ঋতুই হবে আমার মধুমাস।
ঠোঁটে লিপস্টিক দেয়া এক আমলা ওয়ান ইলেভেনের সময় দুর্নীতিবিরোধী রোড শো করেছিলেন। দুদক চেয়ারম্যান হাসান মশহুদের সঙ্গে গলা ফাটিয়ে রাজনীতিবিদদের শাপ-শাপান্ত করেছেন। তিনি এখন প্রশাসনের সর্বোচ্চ এক পদে, ক্ষমতাসীনদের খুবই আস্থাভাজন। আমিও এমন আস্থাভাজন রাজাকার হতে চাই।
চারদিকে যা হচ্ছে এসব তার খুবই ক্ষুদ্র চিত্র। এসব দেখে শুনে আমিও কবি শামসুর রাহমানের মতো বলতে চাইÑ ‘ও সর্বশক্তিমান, আপনি আমাকে/ এমন তৌফিক দিন যাতে আমি/ আপাদমস্তক মনে-প্রাণে একজন খাস রাজাকার/ হয়ে যেতে পারি রাতারাতি’ঃ।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত