"আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে, আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই।" আজ যারা আমরা সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে যে যার অবস্থান থেকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, আগামীতে সে জায়গা থেকে সরে দাঁড়াতে হবে সময়ের নিয়মেই, জায়গা করে দিতে হবে নতুন প্রজন্মকে। শিশুদের হাতে নতুন ভবিষ্যত বাংলাদেশ কেমন হবে তা নির্ভর করছে শিশুদের আমরা কতটা সুযোগ দিয়ে বড় করছি তার ওপর। একটা চারা কতটা যত্নে বড় করছি তার উপরই ফল নির্ভর করে। শিশু তো সেই চারা তাকে কতটা যত্ন দিয়ে বড় করা হবে ভবিষ্যৎ ফলাফল সে মাফিক পাওয়া যাবে।
সাজানো বাগানের কথা বলছি আমাদের শিশুদের জন্য, আসলে কি আমরা এখনো নিশ্চিত করতে পেরেছি শিশুদের জন্য শিশুবান্ধব একটি পরিবার? সমাজ ও রাষ্ট্রকে দায়ী করব পরে। পরিবারই তো শিশুর প্রথম আশ্রয়স্থল। সে পরিবারেই কি নিরাপদ আমাদের শিশু? দেশে যতটা শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে তার সিংহভাগই পরিবারের সদস্য দ্বারা ঘটে। শিশু পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে রাস্তায় আসা থেকে শুরু করে আইনের সংস্পর্শে আসা, অপরাধের সাথে যুক্ত হওয়া এবং ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের সাথে যুক্ত হওয়ার পেছনে দায়ী তার পরিবার। দেশের মোট জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ শিশু, সে শিশুদের অন্ধকারে রেখে আমরা উন্নয়নের বাজনা যতই বাজাই দেশ পিছাবে বৈ এগুবে না।
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের সাধারণ দর্শন গঠিত হয়েছে মূলত চারটি মূলনীতির উপর ভিত্তি করে।
# বৈষম্যহীন অবস্থা (অনুচ্ছেদ -২)
#শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ (অনুচ্ছেদ-৩)
#বেঁচে থাকা ও বিকাশের অধিকার (অনুচ্ছেদ-৬)
#শিশুর মতপ্রকাশের অধিকার (অনুচ্ছেদ-১২)
প্রতিটি বয়সেরই সুনির্দিষ্ট কাজ রয়েছে। সমাজে প্রৌঢ়, প্রবীণ, তরুণ ও যুবকদের জন্য কাজের ক্ষেত্রে রয়েছে পার্থক্য, তেমনি রয়েছে পেশাভিত্তিক শ্রম বিভাজন। প্রশ্ন উঠতে পারে শিশুরা কি তবে কোন কাজ করবে না। অবশ্যই করবে। আর শিশুর প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে স্কুলে লেখাপড়া। সে সাথে খেলাধুলা, বিনোদন, ছবি আঁকা এগুলোও শিশুর অন্যতম কাজ। রাষ্ট্রও সাংবিধানিক এবং আইনগতভাবে সকল শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতীজ্ঞাবদ্ধ।
শিশু কারা আসলে ! শিশুর সত্যিকার বয়সও আমরা অনেকেই জানি না। বিভিন্ন সেমিনার থেকে উঠোন বৈঠকের অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে বলতে পারি অনেকের ভাষ্যমতে শিশু হচ্ছে তারাই, যারা এখনো মায়ের দুধ পান করে, যারা হাঁটতে পারে না, কথা বলতে পারে না এবং যাদের বয়স সাত বছরের নীচে ইত্যাদি ইত্যাদি।
"জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ, জাতীয় শিশু নীতি ২০১১ এবং জাতীয় শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী ০ থেকে ১৮ বছরের নীচে সকল মানব সন্তানকে শিশু বলা হয়। "
প্রশ্ন আসতে পারে- '০' টা কী! শিশু যখন ভ্রূণ অবস্থায় থাকে তখন থেকেই গর্ভবতী মায়ের বাড়তি যত্নের দরকার হয় শিশুর সঠিক বিকাশের জন্য। তার মানে গর্ভাবস্থায় শিশুর অধিকারপ্রাপ্তির প্রক্রিয়া শুরু। ওই ভ্রণাবস্থা-ই মূলত '০'।
১৮ বছরের নিচে সকল মানব সন্তানই শিশু।তার কারণ এই সময়ে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে একজন শিশু পরিণত বয়সের মানুষের সমান দায়িত্ব পালনে সমর্থ নয়। তাই অপরিণত বয়সে শিশুদের শ্রমে নিয়োগ করা হলে তা কেবল শিশুর জন্যই ক্ষতিকর নয়, ক্ষতিকর পিতামাতা, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্যও। এই ক্ষতির দায়ভার সকলকেই বহন করতে হয় জীবনভর।
বাংলাদেশে শিশুশ্রম একটি স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে বিবেচিত। মানুষ শিশুশ্রম দেখতেই অভ্যস্ত। ব্যস্ততম ট্রাফিক সিগনাল বা সড়কদ্বীপ থেকে শুরু করে নিভৃতে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক কারখানা পর্যন্ত সবখানেই শিশুশ্রম দৃশ্যমান। দরিদ্র মাতাপিতা সংসার চালাতে কোমলমতি শিশুকে শ্রমের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন স্বেচ্ছায়। অথচ শিশুশ্রমলব্ধ এই আয় পরিবারের অবস্থা উন্নয়নে কোন কাজেই আসে না। কিন্তু পরিবারে তাৎক্ষণিক অর্থ প্রাপ্তি বড় হয়ে দেখা দেয়। অন্যদিক বিবেচনায় শ্রমে নিয়োজনে শিশুরা সহজলভ্য, সাশ্রয়ী ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য। তাই নিয়োগকর্তারা ঝুঁকিপূর্ণ ও ঝুঁকিহীন সব ধরণের কাজে শিশুদের নিয়োগে উৎসাহী। তারা বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে শিশুদের নিয়োগের নানা ওজুহাতও দাঁড় করান।
বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর তৃতীয় অধ্যায়ের ধারা ৩৪ অনুযায়ী ১৪ বছরের নিচে কোন শিশুকে শ্রমে নিয়োগ নিষিদ্ধ। আইনে দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় ১৪ বছরের ঊর্ধে শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ নয় এমন কাজে নিয়োগের বিধান আছে। ১৪ বছরের নিচে শিশুরা বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করবে।
প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক বলছে সরকার, কিন্তু কত শত শিশু পরিবারের হাল ধরতে নরম হাত জট পাকিয়ে শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করছে তার হিসেব আপনার আমার কাছে কতটা আছে ?
এক শ্রেণির পিতামাতা ভাবছে শিশুর শিক্ষার পেছনে ব্যয় করা অলাভজনক এবং অর্থহীন । তার কারণ তাদের অশিক্ষা এবং অসচেতনতা। তারা মনে করেন স্কুলে পাঠানোর'চে শিশুটিকে শ্রমে নিয়োজিত করে কিছুটা সচ্ছলতা আনা যায় পরিবারে। আর নিয়োগদাতাদের হিসেব অন্য। শিশুদের সহজে বাগে আনা যায় এবং বড়দের চেয়ে শিশুশ্রম সহজলভ্য ফলে এক শ্রেণির অসাধু কর্মদাতা শিশুদের নিয়োজিত করছে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে। যেখানে ন্যূনতম বিনোদনের সুযোগ নেই, শিক্ষার সুযোগ নেই, স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্তির সুযোগ নেই সেখানে ঘানি টেনে চলছে কোমলমতি হাজার হাজার শিশু শ্রমিক। আর আমরা তাদের ঠকিয়ে, তাদের শ্রমের টাকায় অট্টালিকা বানিয়ে শুয়ে থাকি।
নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত সমাজ বাসায় এবং অন্যত্র কর্মরত শিশুর ব্যাপারে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে নির্বিকার। রাষ্ট্রীয় আইনে অগ্রহণযোগ্য শিশুশ্রম সমাজের কাছে গ্রহণীয়, নেই আইন ও নীতিমালার যথাযথ প্রয়োগ। ফলে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের মর্মমূলে প্রোথিত শিশুশ্রম বিষয়ক বিশ্বাস, রীতি ভেঙে ফেলা সত্যিকার অর্থেই কঠিন কাজ।
সেসব শিশুদের হাতে বই থাকার কথা ছিল, রঙিন ঘুড়ি আর নাটাই থাকার কথা ছিল। কথা ছিল তারা বিনোদনসহ বেঁচে থাকার সকল অধিকার পাওয়ার। এমন অনেক শিশুর সাথে কথা বলেছি যারা বড় হয়ে কী হবে সে স্বপ্নের কথাও বলতে পারে না। তারা আজ স্বপ্ন দেখতেও যেন ভুলে গেছে দারিদ্র্যেরর কষাঘাতে। জীবনের মত জং ধরে গেছে তাদের স্বপ্নেও।
রাষ্ট্র বলছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়ে গেছে, তবে এই সমৃদ্ধ বাংলাদেশে শিশুদের এরকম অবস্থা থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। মোট জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশকে অন্ধকারে রেখে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলা একধরনের বাতুলতা। প্রয়োজন শিশুশ্রম নিরসনে জনমানুষের মধ্যে কর্তব্যবোধ জাগিয়ে তোলা। তা না হলে দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা দিনদিন বাড়তেই থাকবে।
আজ বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। সকল শিশুর মুখে হাসি ফুটুক। সকল শিশু তার অধিকার নিয়ে বাঁচুক এই প্রত্যাশা করি। আমাদের অনেক অক্ষমতার মধ্যে একটা সক্ষমতা, আমরা শত হতাশার মাঝেও আশা জিইয়ে রাখি। প্রত্যাশা করতে তো দোষ নেই !
রিমঝিম আহমেদ
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০১৬ রাত ১০:৩১