আজকে ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মধুমতি ব্যাংক স্বাধীনতা দিবস ফুটবল টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সেমিফাইনাল খেলা। এতে মুখোমুখি হবে দেশের এক সময়ের সেরা দুই ফুটবল শক্তি, স্বনামধন্য ও ঐতিহ্যবাহী আবাহনী ও মোহামেডান। বিকাল ৫টায় খেলা শুরু হবে। আজকের বিজয়ী দল ফাইনালে ‘ফেনী সকার ক্লাব’র সাথে মোকাবেলা করবে।
এককালের দেশসেরা দুই ক্লাবের খেলা মনে করিয়ে দিল ছোটবেলার ফুটবল উন্মাদনার এক ভুলে যাওয়া অধ্যায়ের কথা। ৮০র দশকের শেষ দু’এক বছর থেকে ৯০দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। ফুটবল তখন এক মহা উন্মাদনার নাম। তখন আমরা স্কুলে পড়ি। দেশে তখন ফুটবলের পরাক্রমশালী দুটি ক্লাব ছিল (অন্যান্য ক্লাবগুলো তেমন একটা পাত্তা পেত না); প্রথমটি ঐতিহ্যবাহী ঢাকার মোহামেডান স্পোটিং ক্লাব আর অন্যটি আবাহনী লিমিটেড। সারা দেশে সমর্থক দুই দলে বিভক্ত ছিল। আমি ছিলাম মোহামেডানের কট্টর সমর্থক। সত্যি কথা বলতে কি সেসময়ে মোহামেডান ও আবহনী এ দুটি প্রধান দলের পেছনেই ছিল শতকরা ৯০ ভাগ সমর্থক। তাদের লড়াই ছিল খুব মর্যাদাপূর্ণ। দু’দলের সাফল্যের মূল নিয়ামক ছিল মর্যাদাপূর্ণ এই লড়াইয়ের ফলাফল। কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান অবস্থা। তখনকার ফুটবলারদের মানও ছিল অনেক উন্নত। মোহামেডান দলে তখন খেলতেন কায়সার হামিদ, বাংলার ম্যারাডোনা খ্যাত সৈয়দ রুম্মান বিন ওয়ালী সাব্বির, কানন, নকিব, জনি, জুয়েল রানা, মানিক, পনির সহ দেশবিখ্যাত সব খেলোয়ার। বিদেশী খেলোয়ারদের মধ্যে ছিল এমেকা, নালজেগার, নাসের হেজাজী, রাশিয়ান রহিমভ, ইরানিয়ান আর এক সুপারস্টার ভিজেন তাহিরি। এসব কুশলী প্লেয়ারদের ক্রীড়া নৈপুণ্য ছিল সত্যিই দেখার মত। ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত পরপর তিনবার অপরাজিত চ্যাম্পিয়ান হয়ে ”আনবিটেন হ্যাটট্রিক” করার অনন্য রেকর্ড স্খাপন করে সাদা-কালো জার্সিধারীরা। মাঝে ক‘বছর বাদ পড়লেও ১৯৯৩ সাল থেকে পুনরায় সাফল্য ধরা দিতে থাকে মোহামেডানকে। আর বিগত ফুটবল মৌসুমে মোহমেডানের সাফল্য ছিল দ্বিগুন। লীগ শিরোপা জয় করার পাশাপাশি তারা দ্বিতীয় জাতীয় ফুটবল লীগের শিরোপাও ঘরে তোলে।
ওদিকে আবাহনীতে তখন খেলতেন দেশ সেরা ডিফেন্ডার মোনেম মুন্না, দেশসেরা স্ট্রাইকার আসলাম, গাউস, রেহান, এফ আই কামাল, মহসিন, রুপুসহ আরও অনেকে। বিদেশী খেলোয়ারদের মধ্যে ছিলেন ইরাকের বিশ্বকাপ স্কোয়াডের দু খেলোয়াড় করিম মোহাম্মদ ও সামির সাকির, শ্রীলংকার লায়নেস পিরিচ, পাকির আলী, প্রেমলাল, রাশিয়ান দজমরাভ ইত্যাদি। তারা ৮৪, ৮৫ ও ৮৬ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন হয়ে হ্যাটট্রিক শিরোপা লাভ করে। ১৯৮৯-৯০ সালে ভারতের গেরিলায় নাগজি কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে এবং ১৯৯৪ সালে কলকাতায় চার্মস কাপ ইনভাইটেসন কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়। এছাড়াও আবাহনী ১৯৯১ সালে দুই বাংলার সেরা ছয় দল ভারতের ইস্ট বেঙ্গল, মোহনবাগান, মোহামেডান (কলিকাতা), বাংলাদেশের মোহামেডান, ব্রাদার্স, আবাহনী) নিয়ে অনুষ্ঠিত বিটিসি ক্লাব কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশের জন্য সম্মান বয়ে নিয়ে আসে।
ফুটবলের লড়াই মাঝে মাঝে গ্যালারিতেও নেমে আসত। গ্যালারি তখন হয়ে উঠত উন্মত্ত, রণক্ষেত্র। নিজ দলের পরাজয় হলে স্টেডিয়াম এলাকায় প্রায়ই প্রলয় ঘটে যেত। মারামারি, দৌড়ানিতে গোটা এলাকা রণক্ষেত্র হয়ে উঠত। সেই সময়ে ঢাকায় একটা গল্প প্রচলিত ছিল। গল্পটি হলো, কোন এক নতুন দর্শক-সমর্থক গ্যালারিতে বসে আরামসে খেলা দেখছেন। হঠাৎ প্রিয় দলের গোলে গলা ছেড়ে ‘গোওওওল’ বলে চিতকার করে পড়ে গেলেন মহাবিপদে। আসলে না জেনেই তিনি বিপক্ষ দলের গ্যালারিতে বসেছিলেন। ও হ্যা একটা কথা বলাই হয়নি, গ্যালারিও তখন দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ সাদা কালোর দখলে অন্য ভাগে আকাশীর দৌরাত্ব। ভুলক্রমে এর অন্যথা হলে বড়ই বিপদের ব্যাপার ছিল! শুধু কি তাই? তখন এই দুদলের দ্বৈরথ অন্য এক মাত্রা পেয়েছিল। যার প্রমাণ “আবাহনী আবাহনী মোহামেডান, কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমান সমান” গানটি। বাংলা সিনেমায়ও জায়গা করে নিয়েছিল এই দুলের প্রাণবন্ত, তুমুল উত্তেজনাময় খেলা। তবে এই প্রতিযোগিতা শুধুমাত্র ফুটবল কেন্দ্রীক ছিল না। কি ফুটবল, কি ক্রিকেট, কিংবা হকি সবখানেই এই দ্বৈরথ চলত সমানতালে।
দুদলের এমন মারমার কাটকাট অবস্থা কি শুধু মাঠে বা গ্যালারিতেই সীমাবদ্ধ ছিল? মোটেই না। এর বিস্তার ছিল সর্বত্র। যেমন আমাদের বাড়িতে। আমরা পাঁচভাই। তিনজন আবাহনীর সমর্থক আর আমিসহ অন্য একজন মোহামেডান সমর্থক। স্কোর বলছে ৩-২। উহু, এটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। তখন আমাদের বাড়িতেই থাকত আমার এক ফুফাত ভাই। সে আবার মোহামেডানের অন্ধ সমর্থক। তো এবার স্কোরলাইন ৩-৩। খেলা জমে গেল। আব্বা মোহামেডানের হওয়াতে আমরা এগিয়ে থাকলাম। দুইদল মাঠে খেলছে আর আমরা রেডিও নিয়ে খেলায় মেতে থাকতাম। মোহামেডান একটা গোল দেয় আর আমরা গলার সমস্ত জোড় দিয়ে বিপক্ষ দলের (!) কানের কাছে নানা কিসিমের পিত্তি জ্বালানী কথা বলে ওদের অস্থির করে তুলি। ওরাও কম যায় না যখন আমরা গোল খাই। এমন করতে করতে কতদিন যে ঝগড়া-ঝাটি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। আরও মজার ব্যাপার হল মোহামেডান আবাহনীকে হারালেই শুরু হয়ে যেত উত্সব। মনে পড়ে, খেলার আগের দিন থেকেই আমরা বাড়িতে পতাকা উড়াতাম। খেলার দিন স্কুল/কলেজ না থাকলে সকাল থেকেই বাড়ীতে সাজ সাজ রব পড়ে যেত। দিনের সকল কাজ দুপুরের আগেই শেষ করতাম। দুপুরের পরে কোন কাজে পাঠাতে চাইলে কোনক্রমেই যেতাম না; হুকুম যারই হোক। আসলে ওই রকম হুকুম দেয়ার কেউ ছিল না। কারণ সবাই যুদ্ধে নামার অপেক্ষায় থাকতেন। প্রিয় দল জিতলে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়া, আনন্দ মিছিল করা, পতাকা উড়ানো ইত্যাদি কাজ আমরা করতাম। তবে আবাহনীওয়ালাদের বিরক্ত করা ছিল সবগুলোর থেকে মজার কাজ। আর যদি হেরে যেতাম। সেদিন ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে কস্টকর দিন/রাত। সেদিন সন্ধ্যা হলেই আমাদের চোখে গভীর রাত নেমে আসত। পতাকা উড়ানো অবস্থায় থাকলে তড়িঘরি করে নামিয়ে বিচানায় শুয়ে চোখের পানি ফেলতাম। আমরা প্রানপন চেস্টা করতাম আবাহনীওয়ালাদের চোখের সামনে না পড়তে। কিন্তু ওরা নিজেই আমাদের চোখে ধরা দিত আর আমাদের রাতকে আরও কস্টকর ও দীর্ঘ করে দিত।
আজ সেই রামও নেই আযোধ্যাও নেই। এক সময়ের বহুল আকাংখিত ও প্রবল উত্তেজনাময় আবাহনী-মোহামেডান ফুটবল ম্যাচের আগের আবেদন এখন আর নেই। ঘরোয়া ফুটবলের প্রতি দর্শক নানা কারণে অনেক আগেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। পেশাদার লিগে গত কয়েক মৌসুমে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ হয়েছে নীরবে-নিভৃতে, দর্শকশূন্য মাঠে। এবারেও হয়ত তাই হবে। ফুটবলের সেই সুদিন কি আর ফিরবে???
আজকে অনেকদিন পর আবার ফিরে পেতে ইচ্ছে করছে ঐদিন গুলো। কেউ কি ফিরিয়ে দিতে পারবেন আমার সেই সোনালী সময়গুলো? জানি কেউ পারবেন না। সময়ের স্রোতে ও বাস্তবতার বিষক্রিয়াতে আমরা আক্রান্ত। আহারে ! কোথায় হারিয়ে গেল সেসব দিনগুলি!! এখনও মোহামেডান খেলতে নামলেই মনটা আনচান করে উঠে। অতোটা পেরেশান হয়ত হইনা। তবু জিতলে মন খুশিতে ভরে ওঠে। আর হারলে বড্ড ব্যথা অনুভব করি মনের গহীণ কোনে।
সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।
নোটঃ তথ্যগুলো স্বস্ব ক্লাবের ওয়েবসাইট থেকে নেয়া। আর ছবি গুগল থেকে ধার করা।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ১০:৫১