বাড়ির লনে দাঁড়িয়ে ৬৫ বছর বয়স্ক মি. এনজি সুই হোক তাঁর ৭০ বছর বয়স্ক বড়ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করছিলেন। দেখতে দেখতে তা হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গেল। ডান হাতে আঘাত পেলেন মি. হোক। দ্রুত তাঁকে বাড়ির ভেতর নিয়ে যাওয়া হল। কিন্তু তাঁর বৃদ্ধ হৃৎপিণ্ড বেশি উত্তেজনা সহ্য করতে পারলনা। তিনি স্ট্রোক করলেন।
পেনাং হাসপাতাল কাছেই, সেখানে নিয়ে যাওয়া হল মি. হোক কে। কিন্তু ডাক্তারদের সব চেষ্টা ব্যর্থ। তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হল। তখন দুপুর বারোটা।
দুপুর দুইটার দিকে মি. হোক-এর ছেলে ও স্ত্রী পুলিশের কাছে গেল ডেথ সার্টিফিকেট তৈরী করতে। সার্টিফিকেট তৈরী করা মাত্র শেষ হয়েছে, এই সময় পেনাং হাসপাতাল থেকে ফোন এল। মি. হোক বেঁচে উঠেছেন। এখনও জ্ঞান ফেরেনি, তবে শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক।
পড়ি কি মরি করে মা-ছেলে ছুটে গেল হাসপাতালে। সেখানে অতি চমৎকার দৃশ্য। যাঁকে ঘণ্টা দুয়েক আগে সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে মর্গে নেয়ার ট্রলিতে নেয়া হয়েছিল, তাঁকে পুনরায় আইসিইউতে নেয়া হয়েছে, বুক শ্বাস-প্রশ্বাসে উঠানামা করছে।
এনজি সুই হোক, হাসপাতালে জীবন ফিরে পাবার পর
কোন কল্পনা নয়। ‘মিরাকল’ বলা যেতে পারে। বিজ্ঞানের ভাষায়, ‘Lazarus Syndrome .’ এ সিন্ড্রোমের নামকরণ করা হয়েছে বেথেলহামের সাধু লাজারুস-এর নামে, যাঁকে মৃত্যুর চারদিন পর
অনেকটা এভাবেই পুনর্জীবন দান করেছিলেন যীশু।
গত একশ’ বছরে Lazarus Syndrome-এর মাধ্যমে পুনর্জীবন প্রাপ্ত মানুষের সংখ্যা ৩৯, যার সর্বশেষ উদাহরণ উপরের মি.হোক। এ ৩৯ টি ঘটনার মধ্যে ২৫ টিই ঘটেছে ১৯৮২ সালের পরে। এবং মি. হোক ছাড়াও এ বছরেরই ফেব্রুয়ারীতে মাইকেল উইলকিনসন নামক ২৩ বছরের যুবককে মৃত ঘোষণা করার আধঘণ্টা পর বেঁচে ওঠে। এছাড়া ২০০৬ সালে মিসৌরীতে ১৮ বছর বয়সী এক তরুণী আত্মহত্যার জন্যে প্রচুর ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল। ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করার ১৭ মিনিট পর সে চোখ খুলে জানায় তার ক্ষুধা লেগেছে। তার বাবা-মা হাসপাতালে পৌঁছে দেখেন তাঁদের ‘মৃতা’ কন্যা আধশোয়া হয়ে ব্রেড খাচ্ছে।
সেন্ট লাজারুস, যীশু পুনর্জীবন দান করেছেন মাত্র
Lazarus Syndrome-এর সুষ্ঠু কারণ বিজ্ঞানীরা এখনও বের করতে পারেননি। কোমা, কিংবা অন্যান্য প্রায়-মৃত সিন্ড্রোমের সাথে এর মূল পার্থক্য হচ্ছে, এক্ষেত্রে রোগীকে প্রায় মৃত নয়, মৃত বলেই ঘোষণা করা হয়। হৃৎপিন্ডের পাম্পিং বন্ধ হয়ে যায়, মস্তিষ্কে অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্রেনও মৃত্যুবরণ করে। অন্য একজন সাধারণ মৃত মানুষের সাথে তার কোন পার্থক্য থাকেনা।
Lazarus Syndrome-এর কিছু কারণ বিজ্ঞানীরা সনাক্ত করার চেষ্টা করেছেন, যদিও কোনটিই শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতামত হল, ভিক্টিমের বন্ধ হয়ে যাওয়া হৃৎপিন্ড কোনভাবে এপিনেফ্রিন হরমোনের প্রভাবে পুনরায় শক্তি অর্জন করে, এবং পাম্পিং শুরু করে। উল্লেখ্য, এপিনেফ্রিন হরমোন হৃৎপিণ্ডের পাম্পিং নিয়ন্ত্রণ করে, রক্তনালীর মধ্য দিয়ে এয়ার প্যাসেজ তৈরী করে ঠিকভাবে রক্ত চলাচলের জন্যে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই থিওরীর পর এ পর্যন্ত বহু মৃত মানুষকে তাদের পরিবারের অনুরোধে মৃত্যুর পর হেভি ডোজের এপিনেফ্রিন দেয়া হয়েছে, কিন্তু এভাবে কেউই পুনর্জীবন প্রাপ্ত হয়নি। অর্থাৎ এপিনেফ্রিনের মাধ্যমে Lazarus Syndrome ঘটে থাকলেও কৃত্রিমভাবে সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু অচল হয়ে যাওয়া ব্রেন নিজ থেকে কিভাবে এপিনেফ্রিন ক্ষরণের নির্দেশ দেয় হৃৎপিণ্ডকে সচল রাখার জন্যে, তাও ডাক্তারদের বোধগম্য নয়। তাছাড়া এ প্রক্রিয়া তো তাহলে সব মানুষের ক্ষেত্রেই হওয়ার কথা, শুধু হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যেই কেন?
অনেকে অবশ্য মনে করেন কার্ডিও-পালমোনারী রিসাসিটেশনের কারণে হার্টে যে চাপ সৃষ্টি হয়, তার ফল হিসেবেই এটি হয়ে থাকে। যদিও এ রিসাসিটেশন প্রয়োগ করা হয় তৎক্ষণাত হার্টবিট বৃদ্ধি করার জন্যে, মৃত্যুর পর পুনরায় সেটা শুরু করার জন্যে নয়। তাই এ ব্যাখ্যাও কিছুটা অচল, কারণ মানুষের শরীরে এমন কোন রিজার্ভার নেই, যা রিসাসিটেশনের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক পালস সংরক্ষণ করে রাখতে পারে। তাই তাঁদের ব্যাখ্যটা অনেকটা এরকম দাঁড়ায়, ‘রিসাসিটেশনের ফলে যে বৈদ্যুতিক চাপ হৃৎপিণ্ডে পড়ে, তা-ই কোনভাবে মৃত্যুর পূর্বমুহুর্তে শরীর সংরক্ষণ করে রাখে। পরবর্তীতে সেই চাপ প্রয়োগ করে হৃদপিণ্ডকে পুনরায় প্রসারিত করা হয়, যার ফলে হার্টবিট শুরু হয়, মানুষ জীবন ফিরে পায়’। তবে 'কি' চাপ প্রয়োগ করে, তার কোন উত্তর নেই।
১৯৪৮ সালে মিশিগানের একটি হাসপাতালে কার্ডিও-পালমোনারী রিসাসিটেশন(CPR) দেয়া হচ্ছে, এই রোগী পরবর্তীতে বেঁচে উঠেছিলেন
এছাড়া এখানেও সেই একই সমস্যা। এক্ষেত্রেও যাদের উপর রিসাসিটেশন প্রয়োগ করা হয়, তাদের সবারই জীবন ফিরে পাবার কথা! কিন্তু সেটা কখনোই হয়না। তাছাড়া এতো মাত্র বিশ-ত্রিশ বছর আগের প্রযুক্তি, এর আগে যারা Lazarus Syndrome-এর মাধ্যমে জীবন ফিরে পেয়েছেন, তাদের ব্যাখ্যা কি?
পুনর্জীবনের শুরুতে যে লক্ষণগুলো দেখা যায় তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে হাঁটুর কাঁপুনি, ঘাড় ও বাহুর লোম দাঁড়িয়ে যাওয়া অর্থাৎ Goosebump। ভিক্টিমের হাত বিছানার ওপর থাকলে সাধারণত তা আপনাতেই উঠে বুকের ওপর আড়াআড়ি ভাবে থাকে, এরপর খুব ধীরে ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাস দেখা যায়। এ পর্যন্ত Lazarus Syndrome এর লক্ষণ দেখে অন্তত ষোলজন নার্স এবং দুজন ডাক্তার জ্ঞান হারিয়েছেন, অন্তত তিনজন মহিলা ভয়ের আধিক্যে স্ট্রোক করেছেন। অস্ট্রিয়ায় এক গ্রামে একজন ভিক্টিমকে জীবন ফিরে পাবার পরও জোর করে মাটি চাপা দেয়া হয়েছিল, কারণ গ্রামবাসীর ভাষ্যমতে, শয়তান মৃতদেহ দখল করেছিল। জোর করে এভাবে পুনর্জীবন প্রাপ্তদের মেরে ফেলার ঘটনা গত শতাব্দীতে অন্তত পাঁচবার ঘটেছে। তবে যখন থেকে মেডিকেল সাইন্স একে একটি Syndrome বলে আখ্যা দিয়েছে, তারপর থেকে এরকম অপ্রত্যাশিত ঘটনা তেমন ঘটেনি। বরং গত পঞ্চাশ বছরে এমন প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই রোগীকে দ্রুত আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়েছে।
Lazarus Syndrome-এর ব্যাপারটা যে আজকে নতুন নয়, তার প্রমাণ অসংখ্য। ধারণা করা হয়, প্রাচীন মিশরে এ সিন্ড্রোমের কয়েকটি ঘটনার কারণেই পিরামিডে মৃতকে মমি করে রাখার ব্যাপারটা শুরু হয়। এমনকি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনও এ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন, যে কারণে তিনি আদেশ দিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর অন্তত দু সপ্তাহ পরে তাঁকে দাফন করতে। ১৮৯০ সালে পেনসিলভেনিয়ায় একটি বিশেষ ধরনের কবরস্থান তৈরী করা হয়েছিল, যার প্রতিটি ভল্টের সাথে ‘Escape Hatch’ ছিল, যাতে মৃতরা কোনভাবে পুনর্জীবন প্রাপ্ত হলে তাদের ফিরে আসতে কোন অসুবিধা না হয়!
Escape Hatch সহ কবরস্থান
একজন ভিক্টিম কতো সময় পর বেঁচে উঠবে, কিংবা পরবর্তীতে কতোদিন বেঁচে থাকবে, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায়না। এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ছয়দিন পর একজন মানুষ বেঁচে উঠেছিলেন, যাকে হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছিল। এবং Lazarus Syndrome-এ আক্রান্ত হওয়ার পর সর্বোচ্চ এগারো বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকার রেকর্ড পাওয়া গিয়েছে।। তবে এটা ঠিক, পুনর্জীবন প্রাপ্তরা পরবর্তীতে তেমন সুস্থভাবে জীবন কাটাতে পারেননি।
শুধু মানুষ না, অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব আরও বিস্তৃত, যা Lazarus Taxon নামে পরিচিত। Lazarus Taxon হল সেই প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে বহু বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া কোন প্রাণী পুনরায় আবির্ভূত হয়। যেমন- La Palma Giant Lizard নামক টিকটিকি ১৫০০ সালে বিলুপ্ত হয়েছিল বলে ধরা হয়েছিল, কিন্তু ২০০৭ সালে এসে এদের পুনরায় আবিষ্কার করা হয়। শুধু প্রাণীই না, অনেক গাছপালাতেও Lazarus Taxon দেখা যায়।
একবিংশ শতাব্দীত শুরুতেই Lazarus Syndrome-এর তিনটি ঘটনা বিজ্ঞানীদের আরও কোতূহলী করে তুলেছে। আর ২০১১ সালে পরপর এমন দুটি ঘটনায় তো রীতিমতো হইচই পড়ে গিয়েছে। এ ব্যাপারেও বিজ্ঞানীরা একমত, যে কাগজে-কলমে হিসাব ছাড়াও প্রতি বছরে পৃথিবীতে অন্তত একবার Lazarus Syndrome-এর ফলে মানুষ পুনর্জীবন ফিরে পাচ্ছে। বেশিরভাগ সময়ই সেসব চাপা পড়ে যায় ভীতি, কুসংস্কার, হিংসা, লোভ ইত্যাদি ঘটনায়। যেমন- মৃত বাবা পুনর্জীবন লাভ করার পর সম্পত্তির লোভে তাঁকে জোর করে মেরে ফেলার ঘটনা অন্তত চারবার ঘটেছে।
বর্তমানে এ ব্যাপারে সব ডাক্তার, বিজ্ঞানীরাই একমত, Lazarus Syndrome-এর কারণ সঠিকভাবে আবিষ্কার করতে পারলেই মানুষ অমরত্ব লাভের পথে অনেক বড় ধাপ এগিয়ে যাবে। তাই বাঘা বাঘা সব জীববিজ্ঞানী, ডাক্তাররা উঠেপড়ে লেগেছেন এর সমস্যা সমাধানে। তাঁদের পথ চেয়েই তাহলে আমরা বসে থাকি, অনেকদিন বেঁচে থাকার আশায়!!
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:৫১