বুঝতে পারছেন তো কার কথা বলছি?
ঠিক ধরেছেন… হিজ নেম ইজ বন্ড, জেমস বন্ড।
এভাবেই বন্ডের প্রথম চরিত্রের জন্যে নিজের চরিত্রটিকে বর্ণনা করেছিলেন ইয়ান ফ্লেমিং । পরিচালক তেরেন্স ইয়াং নায়কের এমন বর্ণনা শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলেন। কোথায় পাওয়া যায় এরকম স্বপ্নপুরুষ! এর আগে ১৯৫৪ সালে বন্ডকে নিয়ে টেলিভিশন সিরিজটি ফ্লেমিং-এর বেশি পছন্দ হয়নি, তাই তিনি কঠোর হলেন সিনেমার ক্ষেত্রে।
অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর কিংবদন্তী নায়ক শন কনারির অভিনয়ের ১৯৬২ সালে মুক্তি পেল বন্ড সিরিজের প্রথম সিনেমা ‘ড.নো।‘
সেই ছিল শুরু। গত পঞ্চাশ বছরে একে একে বের হয়েছে বন্ড সিরিজের ২২টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত এই নায়ককে নিয়ে করা কোন চলচ্চিত্রই আজ পর্যন্ত প্রযোজককে হতাশ করেনি। তাই এতো দীর্ঘসময় ধরে বীরক্রমে সিনেমা জগত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ০০৭।
বন্ডের ২২টি মুভিতে এ পর্যন্ত অভিনয় করেছন ৬ জন নায়ক। যেহেতু এরকম রাফ এন্ড টাফ, আবার একই সাথে তীব্র ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রোমান্টিক একটা চরিত্র ফুটিয়ে তোলা খুব সহজ নয়, তাই অনেক নায়কই তাদের বন্ডের মানমর্যাদা ধরে রাখতে পারেননি।
এদের নাম বলতে গেলে বলতে হয় জর্জ লেজেনবি এবং টিমোথি ডাল্টনের কথা। লেজেনবি ১৯৬৯ সালে ‘অন হার ম্যাজেস্টি’স সিক্রেট সার্ভিস’ নামে তাঁর একমাত্র বন্ডের ছবিটি করেন। তাঁর গড়োন খেলোয়াড়ি হলেও নম্র-ভদ্র এ্যাপেয়েরেন্স বন্ড চরিত্রের সাথে ঠিক মানানসই ছিল না। যদিও বেশ মেজাজী লোক ছিলেন তিনি। তাই শন কনারির বিরতিতে সুযোগ পাওয়া এ অভিনেতা আর বন্ড সিরিজে কাজ করার সুযোগ পাননি। সুদর্শন, ৪৩ বছর বয়স্ক টিমোথি ডাল্টন হয়তো দুটোর বেশি ছবি করতে পারতেন, কিন্তু সময়ের ব্যাপারে উদাসীন এবং খামখেয়ালি এ অভিনেতা নিজের দোষেই তা পারেননি। অন্য দশটা চরিত্র থেকে যে জেমস বন্ড আলাদা, তা তিনি কখনোই সেভাবে উপলদ্ধি করেননি। তাই ১৯৮৭ সালে ‘দ্য লিভিং ডে-লাইটস’ এবং ১৯৮৯ সালে ‘লাইসেন্স টূ কিল’ সিনেমার মাধ্যমে তার ক্যারিয়ার শেষ হয়।
জেমস বন্ড সিরিজের আজ পর্যন্ত সবচেয়ে সফল নায়ক হচ্ছেন শন কনারি। ১৯৬২ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত একে একে ছয়টি বন্ড সিরিজে অভিনয় করেন তিনি। মাঝে তাঁর ব্যস্ততার দরুণই লেজেনবি একটি ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পান। তাঁর সম্বন্ধে বলতে গেলে বলতে হয়, বন্ডের কন্ঠস্বরের জন্যে তাঁর চেয়ে আজ পর্যন্ত যোগ্য কেউ পর্দায় আসেননি, তবে তাঁর মাথায় চুলের পরিমাণ আরেকটু বেশি হলে এবং চেহারা আরেকটু চৌকণা হলে পারফেক্ট বন্ড বলে তাঁকে চালিয়ে দেয়া যেত। তবে কিনা, বন্ডের নিষ্ঠুর চরিত্রটা তাঁর মধ্যে কম ফুটে উঠেছিল, যে কারণে পারফেক্ট বন্ড ফলে তাঁকে ভাবা একটূ কষ্টকর বৈকি।
বন্ড সিরিজের সবচেয়ে বেশি ছবির নায়ক হলেন রজার মুর। ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত তিনি অভিনয় করেন বন্ড সিরিজের সাতটি মুভিতে। প্রতিটিতেই বন্ড হিসেবে তাঁর যোগ্যতা প্রমাণিত হয়েছে। তবে তাঁর সবকিছুই ছিল বলা যায় “ভাল।“ বন্ডের জন্যে যে এক্সট্রা অর্ডিনারি একটা ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন ছিল, সেটার কিছু অভাব সম্ভবত তাঁর মধ্যে ছিল। তাই শন কনারি যে ইমেজটা তৈরি করে গিয়েছিলেন বন্ডের, সেটা থেকে তিনি উপরে উঠতে পারেননি। তাঁর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা অতি রোমান্টিক অ্যাপিয়েরেন্স। তাই তাঁর পরবর্তী নায়ক টিমোথি ডাল্টনকে বন্ড চরিত্রের মূলভাব উদ্ধার করতে পরিচালককে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।
কনারির “সমান হয়েছিলেন” বলা যায় অতি সুদর্শন আইরিশ অভিনেতা পিয়ার্স ব্রসনান। ১৯৯৫ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ‘গোল্ডেন আই’, ‘টুমরো নেভার ডাইজ’, ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ নট এনাফ’ এবং ‘ডাই অ্যানাদার ডে’ নামক ব্লকবাস্টার চারটি সুপারহিট ছবিতে তিনি বন্ড হিসেবে অভিনয় করেন।
এবার আসা যাক বর্তমান বন্ড, যিনি কিনা বন্ড সিরিজের সবচেয়ে খাটো নায়ক(৫’৯”) ড্যানিয়েল ক্রেগের কথায়। ‘টম্ব রাইডার’ সিনেমায় অ্যাঞ্জেলিনা জোলির বিপরীতে দারুণ অভিনয়ের সুবাদে তিনি পর্দায় সুনাম অর্জন করেন। তবে বন্ড চরিত্রে অভিনয় ছিল তাঁর স্বপ্নেরও অতীত। বিরাট ঝুঁকি নিয়েই তাঁকে দিয়ে বন্ডের চরিত্রটি করিয়েছিলেন ‘ক্যাসিনো রয়াল’এর পরিচালক মার্টিন ক্যাম্পবেল। একে তো বন্ডের গঠনের সাথে ক্রেগের গঠনের মিল কম, কন্ঠও কিছুটা কর্কশ, আবার মাথায়ও চুলের পরিমাণ কম। সবচেয়ে বড় কথা, বন্ড চরিত্রে এর আগে যেসব নামী-দামী নায়ক অভিনয় করেছেন, তাঁদের তুলনায় ক্রেগ সাধারণ এক উঠতি অভিনেতা! 'ক্যাসিনো রয়্যাল'-এর শুটিং্যের সময় তাঁকে বন্ড হিসেবে মিডিয়া এতোই ঠাট্টা করতো যে 'মিরর' ম্যাগাজিন ক্রেগকে ব্যঙ্গ করে লিখেছিল প্রচ্ছদ রচনা "দ্য নেম ইজ ব্ল্যান্ড, জেমস ব্ল্যান্ড।"
কিন্তু প্রমাণ করে দিলেন ড্যানিয়েল ক্রেগ। বন্ডের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যবসাসফল ছবি ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’-এ অভিনয়ের জন্যে ক্রেগ বাফটা অ্যাওয়ার্ডের জন্যে মনোনীত হন এবং এম্পায়ার বেস্ট অ্যাক্টর অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। তাঁর সব দুর্বলতা তিনি কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অভিনয় দিয়ে দূর করে দিয়েছেন। যে কারণে বন্ড সিরিজের সর্বশেষ সিনেমা ‘কোয়ান্টাম অফ সোলেস’-এও তিনি সফলভাবে উত্তীর্ণ। বন্ডের পরবর্তী ছবি, যা ২০১২ সালে ‘বন্ড ২৩’ নামে মুক্তি পাবে, তাতেও তিনি নায়ক হিসেবে অভিনয় করছেন। তবে সিনেমাটির প্রোডাকশন কোম্পানী এমজিএম ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ায় ‘বন্ড ২৩’-এর কাজ বেশ পিছিয়ে গিয়েছে।
সাধারণ সরকারী চাকুরে ক্রেগ বন্ড মুভির সুবাদে আজ ইউরোপের সর্বাধিক পারিশ্রমিক পাওয়া অভিনেতা।

উপরে বাঁ থেকে ডানে- শন কনারি , জর্জ লেজেনবি , রজার মুর , টিমোথি ডাল্টন , পিয়ার্স ব্রসনান , ড্যানিয়েল ক্রেগ
ইতিহাসের সব বিখ্যাত চরিত্রের সাথে বন্ড চরিত্রের একটা বড় পার্থক্য আছে, যা মানুষকে আরও বেশি আকর্ষণ করে। তা হল বন্ডের ব্যক্তিত্ব, যা একেবারে ধোয়া তুলসী পাতা নয়। মদ, নারী, মৃত্যু- এই তিন নিয়েই যেন বন্ডের সব খেলা। অন্যসব চরিত্রের দিক দিয়ে এখানেই তিনি ব্যতিক্রম। শার্লক হোমসের ছিনা কোন নারীলিপ্সা, এরকুল পোয়ারোতো শুধু ধাঁধাঁ সমাধান করেই দিন পার করতেন। ব্যাটম্যান, সুপারম্যান, স্পাইডারম্যানে ফ্যান্টাসির পরিমাণই বেশি, বাস্তবতার পরিমাণ নিতান্তই কম। কিন্তু বন্ড রক্তমাংসেরই গড়া এক মানুষ, যার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র মগজ। এই বন্ডের আদলেই গড়ে উঠেছে আমাদের দেশের বিখ্যাত সিরিজ মাসুদ রানা।
আমার মতো যারা মুভি এবং বইয়ের অন্ধভক্ত, বন্ড তাদের জন্যে অন্যকিছু। মাসুদ রানার বইয়ের শুরুতে একটা কথা লেখা থাকে, যেটা আমার মনে হয় আসলে বন্ডের উদ্দেশ্যেই, “টানে সবাইকে, কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না।“ তাই বন্ড চরিত্রের প্রতি আমারও দুর্বার আকর্ষণ। শার্লক হোমসের পরেই এই চরিত্রটিকে আমি সবচেয়ে ভালবাসি।
ব্যক্তিগতভাবে আমার বন্ডের নায়ক হিসেবে সবচেয়ে ভাল লাগে পিয়ার্স ব্রসনানকে। ড্যানিয়েল ক্রেগও মন্দ নয়। এবং আমার চোখে এ পর্যন্ত সেরা বন্ড গার্ল হচ্ছেন ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’-এর ইভা গ্রীন।
ইয়ান ফ্লেমিং বৃটিশ গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি করেছিলেন, যার সুবাদে অপরাধবিজ্ঞান সম্বন্ধে তাঁর বেশ ভাল ধারণা গড়ে উঠেছিল। সেটাকেই কাজে লাগিয়ে, তাঁর বন্ধু 'জেমস হফম্যান বন্ড'-এর নামের প্রথম আর শেষটুকু ধার করে, আরেক বন্ধু স্যার উইলিয়াম স্টিফেনসনের চরিত্রের আদলে লেখা শুরু করেছিলেন জেমস বন্ড। 'এম১৬' নামক গোয়েন্দা সংস্থার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য স্পাই জেমস বন্ড '০০৭' কোডনেম নিয়ে প্রথম আবির্ভূত হয় ১৯৫৩ সালে 'ক্যাসিনো রয়্যাল' উপন্যাসের মাধ্যমে। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর বন্ড তার খালা চারমেন বন্ডের কাছে বড় হয় এবং ইটোন কলেজ থেকে থাকাকালীন মাত্র ষোল বছর বয়সেই তাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয় নারীঘটিত ঝামেলার কারণে। এরপর এডিনবার্গের একটি কলেজ এবং জেনেভা ইউনিভার্সিটী থেকে পড়াশোনা শেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বন্ড যোগদান করে বৃটিশ নেভিতে। বিশ্বযুদ্ধের শেষে তার কমান্ডিং অফিসার 'এম'-এর পরামর্শে সে যোগদান করে বৃটিশ সিক্রেট সার্ভিসে।
বন্ডের সাথে ইয়ান ফ্লেমিং্যের বেশ ভাল মিল ছিল কয়েকটা বিষয়ে। অবশ্য সে বিষয়গুলো বন্ডকে মহান করলেও ফ্লেমিংকে করতে পারেনি। যেমন- অত্যধিক মদ্যপান এবং ধূমপান। এরই কুফলে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে ১৯৬৪ সালের ১২ আগস্ট পুত্র ক্যাস্পারের জন্মদিনে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন এই মহান লেখক। এর ১১ বছর পর তাঁর পুত্র ক্যাস্পারও অত্যধিক মাদক সেবন করে আত্মহত্যা করে। তাকে তার বাবার পাশেই কবর দেয়া হয়।

ইয়ান ফ্লেমিং
তবে নিজের এরূপ জীবন নিয়ে কোন আফসোস ছিল না ফ্লেমিং-এর। নিজের অমর সৃষ্টি বন্ডের মতোই তিনিও জীবনটাকে হালকাভাবেই নিয়েছিলেন। যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ তাঁর কবরের উপর পাথরে খোদাই করা এপিটাফ-
"I have always smoked and drunk and loved too much. In fact I have lived not too long but too much. One day the Iron Crab will get me. Then I shall have died of living too much"