প্রথম পর্বের জন্যে এখানে ক্লিক করুন।
দ্বিতীয় পর্বের জন্যে এখানে ক্লিক করুন।
তখন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় নবাব সিরাজুদ্দৌলার রাজত্ব চলছে। সিরাজুদ্দৌলা ইংরেজদের উপর ক্রুব্ধ হয়ে কলকাতার কেল্লা গুঁড়িয়ে দিলেন। ইংরেজরা তখন সে জায়গায় ফোর্ট উইলিয়াম স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।
ওদিকে গোবিন্দপুরে পঞ্চাননের সময় বেশ ভাল যেতে লাগল। বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি তিনি মনে মনে আকৃষ্ট হয়ে গেছেন, তার ভ্রাতাও; সন্ন্যাসী বা নিছক রাঁধুনী ও পূজারী ব্রাহ্মণ হয়ে থাকার তাদের আর কোনো ইচ্ছে নেই। তখন গোবিন্দপুরে জাহাজ খাঁড়ি নির্মাণের কাজ চলছিল, তারা গভীর বিস্ময়ে সেসব দেখতে লাগলেন। সবদিকে যে বেশ একটা পরিবর্তনের জোয়ার চলছে, তা তাদের বুঝতে অসুবিধে হল না। এমন কি কয়েকজন ইংরেজকে খাদ্য গ্রহণের পর অতিশয় শীতল একধরনের চাকতি খেতে দেখেছেন, খাঁড়ির কাজ তদারক করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলে তারা সেসব খেয়ে একটু যেন চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। শ্রমিকদের কাছে জানতে পারলেন, ওই বস্তুর নাম বরফ। (কৃষ্ণনাথ কাপালানী তাঁর বইতে এরুপ ঘটনার কথা লিখলেও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে বরফের প্রবেশ এদেশে আরো পরে ঘটে। আমার যতোদূর মনে হয়, দুই ধাপে বরফের প্রবেশ এদেশে ঘটেছিল। তবে এ বিষয়টি সম্পূর্ণ স্পষ্ট নয়।)
গোবিন্দপুরের বেশিরভাগ মানুষই শূদ্র, তাদের অনেকেই ইংরেজদের খাঁড়ি নির্মাণে কাজ করে। খুব যে নিজ ইচ্ছেইয় করে তা না, ইংরেজদের অত্যাচারে বাধ্য কারণেই করে। তবে ধোপা-মুচির কাজের চেয়ে এ কাজে আয় কিঞ্চিৎ বেশি হয়, তাই অনেকে ইচ্ছে করেও পূর্বের পেশা ছেড়ে এ কাজে যোগ দিতে লাগল।
কিন্তু ইংরেজদের বিকৃত উচ্চারণ, ধমক-ধামকিতে তাদের বড় ভয়। তাই ইংরেজদের সাথে কথাবার্তার প্রয়োজন হলে তারা পঞ্চাননকে এগিয়ে দেয়। এই অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত, মার্জিত, সুদর্শন যুবকের সাথে কথা বলে ইংরেজরাও স্বস্তি বোধ করে। এমনকি অনেক সময়ই ঠিকাদারিও করতে বলা হয় তাদের দুই ভাইকে। বিনিময়ে পকেট কিছুটা ভারী হয়। পঞ্চাননও ইংরেজদের খুশি রাখার চেষ্টা করে ও এটাওটা শিখে নেয়। ধীরে ধীরে তারা অনেক কিছুই শিখে গেল।
অপরদিকে পূজো-আর্চার কাজও করতে লাগলেন এই দু জন। শূদ্রদের চোখে পানি আসার অবস্থা, এতো ভাল ব্রাহ্মণও দুনিয়ায় আছে! জাত-কূলতো অত্যধিক মানেই না, নিজের রান্নাও তারা গ্রামবাসীকে খেতে দেয়!
এরই মধ্যে খাঁড়ির ঠিকাদার গেট্টি সাহেব ভেদবমিতে ভয়াবহ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। শয্যা ছেড়ে উঠতে পারেন না। কিন্তু খাঁড়ির কাজ তো থেমে থাকতে পারে না। তাই পঞ্চাননকে তিনি সম্পূর্ণ দায়িত্ব দিলেন খাঁড়ির ঠিকাদারির জন্যে। শূদ্র শ্রমিকরা তাদেরই ধর্মের ঠিকাদার পেয়ে আরো উৎসাহের সাথে কাজ করতে লাগল। দেখতে দেখতে নির্দিষ্ট দিনের বেশ আগেই খাঁড়ির কাজ শেষ হয়ে গেল। ততদিনে পঞ্চানন ও তার ভাইও বামুনগিরি ঝেড়েঝুড়ে সবার সাথে চমৎকারভাবে মেলামেশা শুরু করেছেন।
মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসলেন গেট্টি সাহেব। পঞ্চাননের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন তিনি। নবাবের ভেঙ্গে ফেলা কেল্লার স্থানে ফোর্ট উইলিয়াম স্থাপনার কাজ শুরু হচ্ছে, তাদের সেখানে নিয়ে গেলেন। ঠিকাদারের সহকারী হিসেবে নিয়োগ পেলেন পঞ্চানন ও তার ভাই। নিজেদের দেশীয় লোক দেখে শ্রমিকরাও আগের চেয়ে উৎসাহী হয়ে কাজ করতে লাগল।
এই দুই ঠাকুরই কলকাতার সর্বপ্রথম ভারতীয় স্টিভেডর ও কণ্ট্রাক্টর। বর্গীর হামলা থেকে রক্ষার জন্যে নবাব যখন মারহাট্টা পরিখা খনন করেন, তখন এই দু জন ঠিকাদার হিসেবে কাজ করেন। এছাড়াও কোম্পানীর বিভিন্ন বাড়িঘর নির্মাণে তাদের ডাক পড়তে লাগল। কলকাতায় থাকা উচ্চবর্ণের হিন্দুরা অনেকেই ইংরেজদের সাথে এরূপ ওঠাবসা দেখে “কলিযুগ আসন্ন” বলে তাদের গালিগালাজ করতে লাগলেও দুই ঠাকুরের পকেট ততদেন কাঁচা পয়সায় বেশ ঝনঝন করছে, তারা কেন ওসব শুনতে যাবে! নিজেদের কাজ মনযোগ দিয়ে করতে লাগলেন পঞ্চানন। তবে তাদের স্বাগত জানাল, এমন হিন্দুও নেহাৎ কম নয়। এই দু জনকে দেখেই কিনা কে জানে, ইংরেজরা কোম্পানীর জন্যে মাঝেসাঝে ভারতীয় কর্মচারী নিতেও দ্বিধা করল না।
ফোর্ট উইলিয়াম (১৮০৭)
গোবিন্দপুর ছেড়ে মেছোবাজারের পাথুরিঘাটায় চলে এলেন ঠাকুররা। বিয়ে করে সংসারী হলেন, অভিজাত সমাযে ঠাঁই করে নিলেন। উত্তরোত্তর তাদের ধন-সম্পত্তি বৃদ্ধি পেতেই লাগল। দ্রুত তাদের জমির সংখ্যা বাড়তে লাগল। পঞ্চানন প্রায় একশ বছরের কাছাকাছি বেঁচে ছিলেন।
পঞ্চাননের দুই পৌত্র দর্পনারায়ণ ও নীলমণি। দর্পনারায়ণ জমিদারী দেখাশোনা করেন ও সংসার সামলান, নীলমণি কোম্পানীতে বেশ উঁচু পদে চাকরী করেন। সম্ভবত তিনিই ছিলেন তখন কোম্পানী তদ্রূপ পদে চাকরীরত একমাত্র ভারতীয়। প্রবল ব্যক্তিত্ব, অতিশয় সুন্দর গৌরবর্ণ, গ্রীক দেবতাদের মত গড়ন, ইত্যাদির কারণে নেটিভ হওয়ায় সত্ত্বেও ইংরেজরা তাঁকে বেশ কদর করত। রাজা রামমোহন রায়ের পূর্বে তিনিই ভারতীয় হিসেবে এরুপ সম্মান পেয়েছিলেন। তবে তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের চেয়ে বেশ ধার্মিক ছিলেন। ব্রাহ্মণত্ব বজায় রেখেছিলেন, চাকরীসূত্রেও যথাসম্ভব হিন্দুয়ানী বজায় রাখার চেষ্টা করতেন। অবশ্য দর্পনারায়ণ ছিলেন ঠিক উলটো। মদ ও নারী নিয়ে সে বেশ ব্যস্ত ছিল, পূজো করার তার সময় কোথায়!
চট্টগ্রাম, উড়িষ্যা, উত্তর কলকাতা ইত্যাদি স্থানে চাকরীসূত্রে যাওয়া-আসা করতে লাগলেন নীলমণি। দু হাতে কামাইও করতে থাকলেন। কিন্তু নিজে ছুটোছুটির উপর থাকেন, তাই বেশি অর্থ নিজের কাছে রাখতেন না। বেশিরভাগই ছোট ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। দর্পনারায়ণের বৈভবও বিশাল থেকে বিশালতর হতে লাগল।
এক পুজোর ছুটিতে বাড়ি আসলেন নীলমণি। সেখানে তাঁর জন্যে বিরাট অশান্তি অপেক্ষা করছিল। ছোটভাই দর্পনারায়ণ তাঁকে এই মারে তো সেই মারে। সে দাবী করল নীলমণি এতোদিন তার সাথে যোগাযোগ রাখেনি, এখন তার কষ্টার্জিত উপার্জনে ভাগ বসাতে এসেছে।
নীলমণি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তাঁর আপন ছোটভাই তাঁর সাথে এমন করতে পারে, তাঁর কল্পনায়ও আসেনি। ছোটভাইকে টাকা পাঠাচ্ছেন, তাই টাকা-পয়সার হিসেব বা কোনোরুপ দলিলও রাখার প্রয়োজন মনে করেননি।
শেষে নীলমণি তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে যে সম্পত্তি পাওয়ার কথা, তা দাবী করলেন। গৃহদেবতা নারায়ণ শিলা, স্ত্রী-সন্তান এবং নগদ এক লক্ষ টাকা হাতে নিয়ে পাথুরিঘাটা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। সর্বপ্রথমে গেলেন তাঁর দীর্ঘদিনের ইংরেজ অফিসার জোনাথন হল্যাণ্ডের কাছে। কিন্তু হল্যাণ্ডের সাথে নীলমণির চাকরীর সম্পর্ক, চাকরী সূত্রে প্রয়োজন বলেই তিনি নীলমণির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক করেছেন। কোনো নেটিভকে কয়েকদিনের জন্যে আশ্রয় দিবেন, অথবা মামলার কাজে সাহায্য করবেন, এটা তার কল্পনারও অতীত! নীলমণিকে বলা যায় অপমানই করলেন হল্যাণ্ড। প্রচণ্ড হতাশ হলেন নীলমণি। রাগে-দুঃখে তিনি কোম্পানীর চাকরীই ছেড়ে দিলেন।
এমন সময় তাঁকে আশ্রয় দিলেন তৎকালীন বিখ্যাত ধনী শেঠ বৈষ্ণবচরণ। জোড়াসাঁকো নামে চমৎকার একটি অঞ্চল তখন গাছপালা সরিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে। পূর্বে এ অঞ্চলের সামনে একটি বেশ বড় ঝিল ছিল, যে কারণে ওখানে যাওয়া সহজ ছিল না। সহস্রাধিক মুদ্রা ব্যয় করে বৈষ্ণবচরণ গায়ে গা লাগানো দুটি সাঁকো তৈরী করেন ঝিলের ওপর, একটি ব্রাহ্মণদের জন্যে, অপরটি অন্যদের জন্যে। এখান থেকেই জোড়াসাঁকো নামের উৎপত্তি। তারপর ওপাশের গাছপালা সাফ করে প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরী করেন। উল্লেখ্য, সম্পূর্ণ জোড়াসাঁকো অঞ্চল তিনি ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন।
নীলমণি তাঁর বেশ প্রিয়পাত্র। বন্ধুকে উপকারের পাশাপাশি ব্রাহ্মণকে জমিদানের পূণ্যের আশায় জোড়াসাঁকোর বেশ বড় একটি এলাকা তিনি নীলমণিকে দান করেন। এছাড়াও ঐ নির্জন অঞ্চলে থাকার কারণে তিনি বেশ একাকীও বোধ করতেন, নীলমণি আসায় তাঁর একাকীত্ব দূর হল।
বৈষ্ণবচরণ যে ব্যবসা করতেন, তার দিকে আকৃষ্ট হলেন নীলমণি। হিন্দুদের যে কোনো কাজেই গঙ্গার পানি প্রয়োজন হত, কি বিবাহ, কি পূজো-আর্চা, কি মৃতের শ্রাদ্ধ। বৈষ্ণবচরণ মুখবন্ধ মাটির হাঁড়িতে গঙ্গাজল সরবরাহ করতেন। দূর-দূরান্ত থেকে জমিদার, রাজারা বিভিন্ন উপলক্ষে গঙ্গাজল নিয়ে যেতেন তাঁর কাছ থেকে। গঙ্গাজলের অপর এক ব্যবসায়ী, বৈষ্ণবচরণের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী চণ্ডিপ্রসাদের এক গঙ্গাজলের হাঁড়িতে একবার ব্যাঙ পাওয়া যায়। অমনি তার বিক্রি একেবারে বন্ধ হয়ে যায়, লোকমুখে রটে যায় চণ্ডীপ্রসাদ কুয়োর জলকে গঙ্গার জল বলে চালান। তাই বৈষ্ণবচরণ একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ পেয়ে একেবারে ফুলে-ফেঁপে ওঠেন। কামরুপের রাজা একদা দেড় লক্ষ গঙ্গাজলের পাত্র তাঁর কাছ থেকে ক্রয় করেন বলে শোনা যায়।
বৈষ্ণবচরণের সহযোগিতায় চণ্ডিকাপ্রসাদের স্থান দখল করে নেন নীলমণি। বৈষ্ণবচরণও তাঁকে প্রতিযোগী ভাবতেন না, সহযোগী ভাবতেন। বুদ্ধিমান নীলমণি মাটির হাঁড়ি ও কাপড়ের ঢাকনার পরিবর্তে টিনের পাত্র ও টিনের ঢাকনা ব্যবহার শুরু করেন, এতে পাত্র হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ার কিংবা পানি কাপড় ভেদ করে গড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকত না। মানুষজন নীলমণির এ গঙ্গাজল হুড়োহুড়ি করে কিনতে লাগল।
বর্তমানে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি
ক্রমে বৈষ্ণবচরণের প্রাসাদের পাশে আরেকটি মনোরম, অভিজাত প্রাসাদ তৈরী হল। পনেরো লক্ষাধিক মুদ্রা ব্যয় করে নীলমণি এ প্রাসাদ নির্মাণ করেন, যার নাম হয়ে যায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি।
পরের পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১১ রাত ৯:০২