প্রথম পর্বের জন্যে এখানে ক্লিক করুন।
কামাল উদ্দিন ও জামাল উদ্দিনকে কথা মতো জায়গীর প্রদান করলেন পীর আলী। কিন্তু সমস্যা বাধল তাদের অপর দুই ভাই, রতিদেব ও সুকদেবকে নিয়ে। এরা কোনোভাবেই ধর্মান্তরিত হতে রাজি হল না। তারপরও এরা একঘরে হওয়া থেকে মুক্তি পেল না। আত্মীয়স্বজনেরা পরিত্যাগ করল। লোকে এদের আর সম্পূর্ণ ব্রাহ্মণ বলে স্বীকৃতি তো দিলই না, অনেকেই হিন্দু বলেও স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করল। এরা পরিচিত হল 'পীরালীর বামুন' বলে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে রতিদেব 'ভাব সাধনা' বা তাত্ত্বিক সন্ন্যাস গ্রহণ করে ঘরবাড়ি পরিত্যাগ করলেন। সুকদেব তা করলেন না। তার তিন কন্যা, কারোরই বিবাহ হয়নি, এমনকি দ্বাদ্বশবর্ষীয়া বোনের দায়িত্বও তার উপর। পরিবারে কলঙ্ক লেগে যাওয়ার ফলে এদের কারোরই বিয়ে হচ্ছিল না, এদের ফেলে সুকদেব কোথাও যেতে পারলেন না।
তবে তার ধন-সম্পত্তি এবং বিদ্যা-বুদ্ধির খুব অভাব ছিল না। তিনি বুঝলেন, কোনো সাধারণ ব্রাহ্মণই জাত-কুল হারানোর ভয়ে এদের বিয়ে করতে চাইবেনা। ওদিকে পীর আলী যে ব্রাহ্মণ ঘরের সন্তান, তারা যদিও পিরল্যার 'পীর আলী' তে রূপান্তর মানতে পারেনি, তাঁকে জাত-কূল ছাড়া করেছিল, ততদিনে বেশ নরম হয়ে এসেছে। অবশ্য নরম না হয়েও উপায় ছিল না, মানুষজন পিরল্যার কারণে তাদের ঠিক জাতছাড়া না করলেও ব্রাহ্মণের মর্যাদা আর দিত না। ধর্মান্তরিত পীর আলীই তাদের দেখভাল করত। এছাড়া মুসলমান হওয়ার পর পীর আলীর খ্যাতি, যশ, প্রশংসা তাদেরও গর্বিত করত। শত হলেও পিরল্যা তো তাদেরই পরিবারের সন্তান। পিরল্যার পরিবার নিয়ে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে রাখা দরকার। তাঁরা ছিলেন গৌড় রাজ্যের শুরুর দিকের বিখ্যাত রাজা, যাঁর নাম সম্ভবত আদিশূর, তাঁর বংশধর। পরবর্তীতে এই বংশই বন্দ্যঘটী বা বন্দোপাধ্যায় নামে পরিচিত হয়। এদের আদি নিবাস কুশ নামক গ্রামে ছিল বলে এরা দীর্ঘকাল কুশারী নামে পরিচিত ছিল। এই বিরাট ব্রাহ্মণ বংশ পরবর্তীতে অনেক শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হয়। এমনই এক প্রশাখা হল পিরল্যা, তথা পীর আলীর পরিবার। ততদিনে তাদের যশ-গৌরব অনেকাংশে হ্রাস পেলেও একেবারে হারিয়ে যায়নি।
বুদ্ধিমান সুকদেব এই তার হেরেমের চার কন্যার জন্যে পিরল্যার পরিবারের খোঁজ করলেন। কিন্তু তার তিন কন্যা দেখতে মোটেই সুশ্রী নয়, তাদের জন্যে পাত্র পাওয়া সহজ নয়। কুশারীরা এতো কুশ্রী মেয়েকে বধু হিসেবে বরণ করবেনা। অপরদিকে সুকদেবের বোন ছিল অতিশয় রূপসী। তার সাথে পিঠাভোগ গ্রামের আধুনিকমনা জগন্নাথ কুশারীর বিয়ে হয়ে গেল। সুকদেব তাদের প্রচুর উপঢৌকন প্রদান করলেন। তার অন্য তিন কন্যার বিয়ে সম্বন্ধে বিস্তারিত জানা যায় না, তবে সম্ভবত প্রচুর যৌতুকের বিনিময়ে এবং সহস্রাধিক ব্রাহ্মণের ভূরিভোজনের মধ্য দিয়ে তিনি তাদের কুলীন ব্রাহ্মণ ঘরেই বিয়ে দেন। এছাড়া যতোদূর মনে হয়, তিনি পিরল্যাদের বংশে তাঁর নিজ কন্যাদের বিয়ে খুব বেশি উৎসাহিত ছিলেন না। নইলে সেখানেই তিনি এরূপ ব্যয় করতে পারতেন। কুলীন ব্রাহ্মণই নিজ কন্যাদের জন্যে তাঁর পছন্দ ছিল।
সুকদেব ও তার কন্যাদের প্রতি সমাজের অস্পৃশ্যতা কমে গেলেও জগন্নাথের পরিবারের প্রতি তাদের কোনো দয়া হল না। তারা হলেন জাত-কূল ত্যাগী, ধর্ম বিনাশী একঘরে। বেশ কয়েক প্রজন্ম তারা সমাজের এ রোষানলে ছিলেন, যদিও জগন্নাথের উত্তরসূরীরাও তার মতোই সমাজকে ''থোড়াই কেয়ার'' করতেন।
পঞ্চানন কুশারী, যিনি সম্ভবত জগন্নাথের প্রপৌত্র, তাঁর কুটুমবাড়ির এক ভ্রাতার সাথে সন্ন্যাস গ্রহণ করে একদা দেশ ভ্রমণে বের হলেন। পঞ্চানন তার পিতা-পিতামহদের চেয়ে বেশ সনাতনী ছিলেন। কুটুমবাড়ির ভ্রাতাটিরও চিন্তাভাবনা তদ্রুপ। তবে ব্রাহ্মণ, তদুপরি সন্ন্যাসী হওয়া সত্ত্বেও তাদের সাজপোষাকে কমতি ছিল না। মাথায় টিকি, পট্টবস্ত্র পরিধানকারী, কপালে চন্দনের ফোঁটা, গায়ের রঙ গৌরবর্ণ - সুদর্শন এই দুই তরুণ সন্ন্যাসীকে পথেঘাটে মানুষ শ্রদ্ধা করতে লাগল। তারা খুলনা পার হয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করলেন এবং গোবিন্দপুর পৌঁছলেন। উল্লেখ্য, খুলনায় তারা বেশ কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন, এবং কোনো এক খ্যাতনামা ব্রাহ্মণ রাঁধুনীর কাছ থেকে চমৎকার রান্না শিখেছিলেন। ব্রাহ্মণ তো আর যে কারোর রান্না খেতে পারে না, তাই পঞ্চানন ও তার ভাইকে নিজের খাদ্য নিজেদেরই প্রস্তুত করতে হত। সেই ব্রাহ্মণ পাচকের সংস্পর্শে এসে তাদের রান্নার হাত অতি চমৎকার হয়েছিল। লোকজন তাঁদের আপ্যায়ন করাতে চাইলে তারা শুধু উনুন ও তেল, লবণ ইত্যাদি চাইতেন, তারপর নিজেরাই রান্না করতেন। অন্যান্য ব্রাহ্মণদের উলটো আপ্যায়ন করাতেন। সাধারণ মানুষদেরও দিতেন। সকলেই তাদের রান্না খেয়ে সাধু সাধু করতে লাগল।
ঠাকুর শব্দটি তখন অতি অভিজাত ব্রাহ্মণদের, কিংবা দেবতাদের বোঝাতে ব্যবহার করা হত। যেমন শিব ঠাকুর, গণেশ ঠাকুর ইত্যাদি। আবার ভাল ব্রাহ্মণ পাচকদেরও লোকে "ঠাকুরের ভোজ প্রস্তুতকারী" খ্যাতি দিত।
গোবিন্দপুর আসতে আসতে এই দুই ভাইও ঠাকুর উপাধি পেলেন। একেতো অতি কুশলী পাচক, তারওপর উচ্চ বংশের ব্রাহ্মণ, ঠাকুর উপাধি পাওয়ার পাশাপাশি তাদের নাম-যশ মোটামুটি ছড়িয়ে পড়ল।
তবে গোবিন্দপুর এসে যখন পৌঁছলেন, তখন দুই ভাই-ই শ্রী চৈতন্যের বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি বেশ আকৃষ্ট হলেন। এক পর্যায়ে নিজেদের কুশারীর পরিবর্তে "ঠাকুর" কিংবা "বন্দ্যঘটি" পরিচয় দিতে তারা বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে লাগলেন।
পরের পর্ব