রোস্ট, পোলাও , কালিয়া ভিনরুচির জন্যে বিরিয়ানি, টাটকা ফরমালিনবিহীন নদীর সোদা গন্ধমাখানো দানবাকৃতি মাছের পদ নানা সুখাদ্যের গন্ধে শুধু আঙিনা না পুরো গ্রামটাই ম ম করছে।সুলেখাগঞ্জের বহুদিনের চাওয়া নিজ মায়ের নামে আয়েশা মেমো' হাসপাতালটার ভিত্তিপ্রস্তর উন্মোচন করতেস্বয়ং মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী আসবেন বলে কথা, যে মন্ত্রী এমনকি ইলেকশনের ধুমধারাক্কা প্রচারের সময়ও এই গন্ড গেরামখানা একবারও শুভপদার্পন করার যোগ্য বলে মনে করেন নি। সোজা কথা তো না। খাতিরদারীর সাথে নানা সুবিধা , ব্যবস্থা বন্দোবস্ত কে জানে কত কি হতে পারে -সুপ্ত ইচ্ছা নিয়ে গৌরী সেনের অভাব ঘটে নি।
মন্ত্রী আসবেন , সাথে আরো ক'পাল লটবহর , আমলা , চামচা ছাত্র সংগঠনের ক্যাডার পাতি ডান বাম হাতেরাও থাকবে। সুতরাং এ-লা-হী আয়োজনই করা হচ্ছে।
কিন্তু এই স-ব কর্মকান্ড যেহেতু ভিভিআইপিদের জন্যে তাই রাধাবাড়ার কুটানো জোগান দেয়া পেটি কাজের কর্মী মর্জিনা বেগমের ঘুনসি বাধাঁ প্রায় দিগম্বর ছেলেটা আশে পাশে 'হাভাতে'র মত নজর দিয়ে থাকার 'অপরাধে ' বেজায় কড়া একটা ধমক খায় হারু মাতব্বরের কাছ থেকে। বার বার ইলেকশনে হেরে নমের এই হাল হলেও টাকা কড়ি মালপানির দিকে সে একটি গন্যমান্য মানুষ বটে। গলায় দাবড়ানি দেবার সাথে সাথে সে 'ইচুপ্যা'কে কে চড় চাপ্পর মারার ও অধিকার রাখে বৈকি। তাই দ্রুত কুশলতায় মর্জিনা ওকে সরিয়ে নেয় প্রবলের সামনে থেকে।
''হারাদিন মুখে তর লোল পড়তাসে।কেন বাড়িতে কি না খাইয়া থাহস নি? সব সুময় সব বড়লোকের খাবার দেখলে হাভাত্তা মত চাইয়া থাকন লাগে? ''
বলেই ছেলের অপুষ্ট রুষ্ট মুখের দিয়ে তাকিয়ে বুঝি একটু মায়াই হয় তার- , ''এই সব গরীবের লাইগ্যা নারে । বাড়িত ফিরনের সময় তর জন্যি সাদা ভাত নিয়া আসুম বাজান। আমগোর গরীবের পেট ঐসবেই ভালো , কপালে দুইবেলা জুটলিই বহুত, এইসব দামী খাবার খাইলেই কি পেটে আমগোর সইবো?''
কাজেকর্মে বাঁধাবিপত্তি শতেক- কোথা দিয়ে কোথা দিয়ে উটকা ছুটকা চলে আসে। এসব কাজে তো কথাই নেই ,বিনা নোটিশ অকস্মাৎ কালবোশেখীর প্রচন্ডতায় উদয় হয়।
রান্নারান্নার পাট চুকেছে অনেকক্ষন। মৌ মৌ আমেজ ছাড়া রসুয়েদের কোলাহল , খবরদারী, হাঁকডাক ,পঞ্চাশ পঞ্চাশটা বিশাল বিশাল তোরণের জন্য বাঁধাছাদা , গোছানো, সাজানো ছোট বড় ফুজুলে সিজনে কর্মীদলের অনেকের কাজ শেষ হয়ে গিয়ে একটু বেমানান শুনশান হয়ে যাওয়া জায়গাটায় অসময় তার পিনপতনের মাঝে ছন্দপতন ঘটে।
অসহিষ্ঞু ব্যস্ততার হাঁকডাক কমতি কিছু রাগান্বিত ক্রোধিত কন্ঠস্বরের নিচে চাপা পড়ে যায়। গন্ডগ্রামে তার বেতারের যতই অভাব থাক বাকবিতন্ডার খবরে তামাশা দেখতে যে দ্রততায় লোক জমায়েত হয় অধুনা প্রচারযন্ত্রে সামাজিক সাইটগুলো তাহরির স্কয়ারেও এতটা সাফল্য পায় নি এত তাড়াতাড়ি।
ছাত্রনেতার ধামাতোলা বছর চল্লিশের ধারঘেষা ফেলটুস বদি শেখ - সদ্য শহরফেরত -প্রায় বিলেত ফেরতের মর্যাদায় আসীন- কি একটা ব্যাপারে - সম্ভবত আসন বিন্যাস কিংবা খাবারের কত তম পালায় তার বরাদ্দ এই জাতীয় একটা বিষয় নিয়ে স্থানীয় মাতব্বর কাম সন্ত্রাসী উঠতি ভিলেজ পলিটিক্সের ভবিষ্যত মজিবুরের সাথে জড়িয়েছে। দুই পক্ষেরই তো পায়া ভারি তেমনি ভারী তাদের রাশ ঠাট বাট। কেন মজিবুর স্রেফ পাড়ায় গজিয়ে ওঠা দুপয়সার বিষফোড়া হয়ে শুদ্ধুমাত্র লোকাল পাবলিক হবার সুবিধা নিয়ে ফাঁকে তালে ' বনেদী' বদিশেখের আগের পঙ্কতিতে ঠেকাদারী বরাদ্দ পেয়েছে , আর এতে তার নিজের ইজ্জতের কি পরিমাণে ভরাডুবি হয়েছে বলে বদি শেখ হাহা কার , হা হুতাশ ,হুংকারের শেষ তারায় হুমকিতে পৌঁছে যায়।
মজিবুর এলাকার কোলে পিঠে ময়মুরব্বির দোয়ায় বেড়ে ওঠা এক খাঁটি দেশজ উৎপাদ। কিংবা গ্রামবাসীর কাছে সাক্ষাৎ উৎপাত। সেও কি ছেড়ে কথা বলাবার মনুষ্যসন্তান? তার শরীরে কি রক্ত নেই নাকি তার রং লাল নয়? নাকি সে প্রকৃত 'মরদের পোলা ' না?
কোথাকার ভূঁইফোর হঠাই আগন্তুক 'গায়ে মানে না আপনি মোড়ল' ইত্যাদি ইত্যাদি ভাবার্থিক বিশেষনে নিত্তান্ত বেরহম ভাবে 'ফেলটুস'র নাজুক জায়গাটায় সে আক্রমণ করে ফেলে।
আর যায় কোথা! এসব ঘটনার পানি কোথায় কোথায় গড়াতে পারে তা আগ বাড়িয়ে বলা যায় না।
কথায় কথা টানে। লুকানো জায়গার সব হিংসা বিদ্বেষ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, রোষ এমনকি ক্ররতা সব লুকোচুরি খাপখোলা তলোয়ার হয়ে ঝকমকিয়ে ওঠে। কার সাগরেদ কবে কাকে সালাম দেয়নি,কোন টেন্ডারের বখরা শুধু একার পেটের ভূঁড়িটার পরিধি জ্যামিতিক বাড়িয়েছে, কবে মজিবুরের লোক বদির জন্য আসন ছাড়ে নি - নানা বিস্তারের ডালপালা মেলে , সাথে খুন চড়ে মধ্যদুপুরের গন গনে আগুনে রোদ্দুরের মত করে।
দাঙ্গা হাঙ্গামায় চার চারটি জোয়ানের লাশ নেমে যায় যেন চোখের পলকে সময়ের বাস্তব হিসেবকে হার মানিয়ে। গুনিগুনতিহীন আহত, কিছু অস্থাবর জখম, প্রলয় ভাঙচুরের পর -খন্ডযুদ্ধের পরিত্যক্ততায় পড়ে থাকে শ্রীহীন বেওয়ারিশ ঘরদোর।
হ্যাঁ, ঘরদোরগুলো তাদের মালিকগুষ্ঠী সক্ষম সব পুরুষের উধাও হয়ে যাওয়ার পরে একপাল নানা বয়সী নারী শিশুর বৃদ্ধের ভীত ''লাওয়ারিশ'' আচ্ছাদন হয়ে থাকে।
করিৎকর্মা পুলিশ আসে, কাজের বাইরে তাদের পারিশ্রামিকের ছককাটা হয়ত কিছু থেকেও থাকবে বা। কিন্তু এ যাত্রায় বিফলতার কলঙ্ক নিয়ে ফিরত মুখো হয় তারা। কি যে ঘটেছে তা কেউ জানেও না, কিছু দেখেনি , শোনেনি, বোঝওনি, গেলবার নির্বাচনে সশস্ত্র কেন্ত্র দখলের অন্ধ ভোটাভুটিতেও এরকম সর্বসম্মত বিজয় কোন পক্ষেরই হয়নি। কিন্তু এই ইস্যুতে এই প্রথমই সুলেখাগঞ্জের এরকম অভূত পূর্ব ঐক্যমত্য দেখা গেল।
একযোগে হিরোশিমার বোমার মত কালোজাদুগরী কিছুতে বুঝি তাদের ধুকপুকে হৃদপিন্ডটা ছাড়া আর সব ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে অদ্ভূত তেজস্ক্রিয়তায় বোবা কালা পঙ্গু করে ফেলেছে।
গ্রামের পান্ডা আজিজুল মোড়ল , মাথা অতি সফেদ শশ্রুমন্ডিত এনায়েত মিয়া, কিংবা চেয়ারম্যন মুন্সী গোলাম, একপাল পরিষদ সদস্য কাউকে জিঞ্জাসাবাদেও বিপুল উদ্যমী কর্মঠ পুলিশ বাহিনী কিছুই বার করতে পারলো না।'
''তার তারা ঘটনাস্থলে কেউ ছিলেন না। গোলাম মিয়া ছিলেন সদরে। এই গ্রামেরই নতুন সাঁকোটার তদ্বির করতে..জিজ্ঞেস করুন ঐ মোড়লকে , সে জানে, সেই তো পাঠিয়ে ছিল। গোলাম মিয়ার এসবে অনেক লোক হাতে ধরা , সে কাজ ঠিক উদ্ধার করে আনতে পারবে এই চিন্তা করেই তো তার উপর ভরসা।
মুন্সী নিজের বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন , তার বাড়ির সবাই সাক্ষ্য দেবে, মায় দোরের কাছে বাঁধা কালো গাইটাও।
'মোড়ল নিজের ক্ষেতে ছিলেন, গোলাম মিয়াকে শুধান , সে তো ঐ পথ দিয়েই সদরে গেল। নিজের চোখে তাকে মজুরদের তদারক করতে দেখে গেছে।'
সবাই তারা শুনেছেন বটে ''একটু'' কথা কাটাকাটি হয়েছে- হয়ে থাকতেও পারে , কাজকর্ম নানা হাঙ্গামের মধ্যে ''দুষ্ট'' মাথাগরম পোলাপাইন এমন এক আধটু করে টরেই থাকে। বদলোকে তিল কে তাল বানিয়ে তোলে। যেটা হল খুদে পিঁপড়া তাকে হাতি করে ফেলে। এইসবে কান দিবেন না দারোগা সাহেব।''
ঘটনার সময় সবান্ধব তারা উপস্থিতই ছিলেন কিন্তু পরিস্থিতি বেগতিক দেখে নিজ নিজ পিঠ বাঁচাতে পিঠটান দেন - একথাটা দারোগাকে মনে করে দেবার মত বুকের পাটা এখানে কার আছে?
সব পুলিশি হুজ্জত শেষ হলে এই খানেই এই সব মহাজনদের আশ্রয়েই তো বাস করতে হবে , নাকি?তাদের বিশাল জমিতে গ্রামের ভাতের জোগাড়, বিপদে পড়লে চড়া সুদের ধার আরো কত কোনা কাঞ্চিতে স্বার্থের টান পড়ে।
তাছাড়া বাঘ , পুলিশ এসব ছুঁলে বিনিদোষে 'ঘা ' খেতে হয় , অপঘাতও থাকতে পারে তেমন মন্দবরাতে। থানা আদালত উকিল..এসব ...না না সুলেখাগঞ্জের মানুষ বড় নির্বিবাদী , বড় শান্তিকামী। পাড়াবাসী নিজেদের ছেলেপুলেকে ও নিজেদেরকে অযথা অমন বিপদে ঠেলে দিতে ঘোর নারাজ।
পুলিশি গুঁতোগাতায় দুচারটা গ্রেপ্তার অবশ্যি হলো। এ না হলে মান থাকে ? না উপরি কিছুর আশা থাকে ?নাকি উপরমহলে দেখাবার বলবার মুখ দেখানো যায়?
কামলাখাটা নিরীহ জামালুদ্দি আর ছাদেককে কোমড় তোলা রশিতে নিয়ে যাবার সময় তেমন সমস্যা হয়নি। ভিন গাঁয়ের মানুষ, এই সময়ে জনমুজুর খাটতে এসেছে, নির্রথক নির্দোষ ধরা পড়লেও কান্নাকাটি দেন দরবার করার তো কেউ নেই। তবে মনে হয়, এই ধান কাটার মরশুমের সব মুজুরী এবার ত'বিলেই জমা পড়বে নিশ্চিত।
ঘর ময় মারামারি কান্ডে ভাঙা হাড়ি কুড়ি। ছিন্ন প্যান্ডেলের টুকরা টাকরা অবশেষ, দুমড়ানো সাজ, কোথাও কয়েক ফোটা রক্ত লঙ্কাকান্ডের নীরব সাক্ষী হয়ে আছে। মহার্ঘ সেই দুমনা থেকে আনা খাঁটি ঘিয়ে রান্না পোলাও, টাঙ্গাইলের চমচম, মাতৃভান্ডারের রসগোল্লা , কালিয়া মাংসের ঝোল সব ফেলে ছড়িয়ে যে সম্মিলিত 'পদের' সৃষ্টি হয়েছে মেঝেতে আঙিনাতে অতিবড় দুস্বপ্নেই বোধকরি কোন রাধিয়ের তা কল্পনায় ভাবা সম্ভব।
নাহ, খাবারগুলো কিন্তু নষ্ট হয়নি শেষমেষ। কোথ্থকে একপাল কাক এসে আশেপাশে ওড়াওড়ি লাগিয়েছে। একপাল ঘেয়ো নেড়ি হতশ্রী কুকুরের দল মাংস মুখে নিয়ে টানাটানি করে চলেছে। বাড়ির ধুঁকতে থাকা চোর চোর স্বভাবের মিনিটাও, গায়ের উপর চুরির অপরাধে ছুঁড়ে মারা নির্মম গরম ফ্যানের আঘাতে গায়ে যার দাগড়া দাগড়া ছোপছাপের বাহার- পুকুর থেকে তুলে আনা টাটকা মাছোর মুড়োটা নিয়ে আরামে চোখ বুজে চিবোতে ব্যস্ত। কতকাল ক-ত-কা-ল ওর এরকম জোটে নি। তামাশা দেখার জন্য লোকজমায়েত যেমন গতি্তে বিনা ঢেন্ডরা পিটিয়েই হয়ে গিয়েছিল তেমনি এই বিনা নেমন্তন্নের মেহমানেরও।
যাক , মানুষের পেটে না হোক , যাদের সৃষ্টি খাবার হিসেবে অন্তত মনুষ্য দুপেয়ে না হোক প্রাণীকুলের হাতে গিয়ে ওগুলোর একটা সদগতি তো হল!
নিরাশ মর্জিনা বেগম যাবার সময় একবার আকাশের দিকে তাকায়। আজ যে অবস্থা, বলা বাহুল্য উপাসই কপালে আছে।ছাওয়ালটাকে কি দিয়ে যে ঠান্ডা করবে..??
আকাশ কালো করে আরো কাক আসছে। কা কা শব্দে কান পাতা দায়।খাবারের লোভ, আজকে ওদের মহাভোজ হবে যে।
তাকিয়ে তাকিয়ে সারাদিনের পরিশ্রান্ত অবসন্ন মর্জিনার অনেক হিবিজিবি চিন্তা মনে আসে - কাকগুলো এই স্বাদু খাবারগুলো অন্তত চেখে দেখতে তো পারছে, সে বা তার ইসুপ মানুষ হয়ে তা পারবে না।
কেন যেন অকারনে তার মনে একটানা বিষাদ জেগে ওঠে।
রেজওয়ানা আলী তনিমা
২৯ জুন,১৪ ইং।