১১ই ফ্রেব্রুয়ারী ২০১৯
স্টেশনে পৌছেই স্টেশন মাস্টারের রুম থেকে ট্রেনের খবর জেনে নিয়ে প্লাটফর্মের এক কোনে গিয়ে অপেক্ষা করতে ছিলাম। ১৫ মিনিট দেরিতে ট্রেন আসলো। নিজের পাসপোর্ট আর টিকিট নং আরেকবার চেক করে করে নিলাম। যদিও বয়স আমার বেশি নয় কিন্তু মনের বয়স টা ৭০ এর কাছাকাছি। নিজেকে বড্ড বৃদ্ধ মনে হয়। মাঝে মাঝে ভুলে যায়, স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়ারও অভিনয় করি।
যাই হোক ট্রেন আসলে উঠে বসলাম নিজের সিটে। ট্রেন গুলো কাঠামোগত ভাবে অনেক বদলে গেছে। গতবার গেছিলাম এমন ছিলো না। এমন এক কেবিনে ১৮ টা সিট ছিলো। এখন ৮ টা। একটা সুন্দর গোছানো ঘরের মত। আমার সিট টা একদম মাঝামঝি। সিটে বসে চারিদিকে খেয়াল করে নিলাম আর মুচকি হাসি দিয়ে বুঝে নিচ্ছিলাম যে তাদের কোন অসুবিধা হচ্ছে না। আমার এটা মনে হওয়া কিছুটা গুরুত্ববহ হলেও সবাই সবার মত ব্যাস্ত ছিলো।
সামনে ডান দিকের দু সীটে যে দম্পতি বসেছে তাদের সাংসারিক বয়সই আমার চেয়ে বেশি। আর বাম দিকে দম্পতিদের দেখে সদ্য বিবাহিতই মনে হচ্ছে। কেননা আচরন আর অঙ্গভঙ্গি দেখেও অনেক কিছু বোঝা যায়। আমার একদম বাম পাশের সিট টা ফাঁকা। হয়ত পরের স্টেশন থেকে উঠবে। আর বাকি দুজন সিঙ্গেল আছে।
ট্রেন ছেড়ে দেয়াতে আমি ব্যাগ থেকে আমার মোটা ডায়েরীটা আর শরতের একটা বই বের করে ডেস্কে রাখলাম। তারপর কিছুক্ষন এদিক ওদিক পর্যবেক্ষণ করলাম। নতুন সদ্য বিবাহিতদের চোখে মুখে স্বপ্ন যেন এখনো ভাঙ্গে নি। আর ঐ দিকে বয়স্ক দম্পতিতে যেন আর কোন নতুন স্বপ্ন আসে না। এই দেখে দুটো লাইন লেখার জন্য ডায়েরীটা খুলে
“এইযে প্রতিদিন চোখে কত ভালোবাসা কিংবা ভালোথাকার স্বপ্ন নিয়ে কত সংসার গড়ে উঠছে কিন্তু ভালোবাসার আসল তৃপ্তি টা কত গুলো দম্পতিতে আছে?”
এই লাইন লিখে বন্ধ করে দিলাম। লাইন টা আমাকেও কিছুটা স্মৃতিময় করে তুলল। আমিও একদিন কাউকে ভালোবাসতাম। তাহলে এখন কি ভালোবাসি না? জানিনা। ভালোবাসাকে চিরকালই আমার কাছে সবচেয়ে বড় ধোঁকাবাজ মনে হয়েছে।
২
জানালার দিকে মুখ দিয়ে কখন ঘুমিয়ে গেছিলাম জানিনা। ঘুম যখন ভাঙল তখন দেখি আমার পাশের সিটে একটা মেয়ে বসে আছে। এত ক্ষনে ২ টা স্টেশন পাড়ি দিলাম। এখন অনেক গুলো বাকি। ট্রেনে উঠলে শুধু এই প্লাটফর্ম গুলোর জন্য মায়া লাগে। একাকী কত রাত কত দিন অপেক্ষা করেই যাচ্ছে ট্রেনের আগমনের। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মনে হলো ভীষণ ঘুম। আমি ট্রেনের বাথ্ররুম থেকে চোখে হালকা পানি দিয়ে এসে আবার নিজের সিটে বসলাম।
এখনও ঐ সদ্য বিবাহিত দম্পতি আগের মত ক্লোজলি বসে আছে। আমি মাঝে মাঝে কয়েকবার আড়চোখে তাকাতেও ছিলাম। বোঝার চেষ্টা করছিলাম ওদের সিচুয়েশনটা। একবার একটু বেশি তাকাতেই পাশের সীট থেকে মেয়েটা বলে উঠল, “এসব ঠিক না।”
-মানে?
– এই যে লুকিয়ে লুকিয়ে ওনাদের দেখছেন? এই বুড়া বয়সে এসব কি?
এতদিন তো আমিই মন থেকে নিজেকে বৃদ্ধ বলতাম। আর সবাই আমাকে বয়স কম বলে অনেক বার আরেকটা বিয়ের কথা বলেছিলো অথচ এই মেয়ে আমাকে বৃদ্ধ বলল তাও সরাসরি মুখের ওপর।
-কি করলাম?
–কিছু না করলে এমন চমকে গেলেন কেন?
-অমনোযোগী ছিলাম। তাছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু আপনি কে যে এমন ভাবে বললেন?
–আগে আপনি বলুন?
-আচ্ছা তো! আপনি আগে আমাকে ডাকলেন আর আমিই আগে পরিচয় দিবো? যাই হোক, আমি আকাশ।
–আমি নীলা। কোথায় যাচ্ছেন?
-লাস্ট স্টপেজ।
–ওহ। আমিও ওখানেই যাব। যাক এই ২ দিনের জার্নিতে মাঝে মাঝে আপনার সাথে কথা বলা যাবে।
-আমি আপনাকে সঙ্গ দেব , এটা আপনার কেন মনে হলো?
–জানিনা তবে আপনার ডায়েরীটা দেখলাম। আমার উত্তরটাও লিখে দিয়েছি।
আমি কিছুটা অবাক হয়ে ডায়েরীটা খুলে দেখলাম ‘ ভালোবাসা সংসার গড়ার ক্ষুদ্রতম একক নয়। সংসার হতে কেবলই রক্তে মাংসে গড়া মানুষ দরকার।‘ উত্তর টা ভালো লাগল। কিন্তু কিছুটা পারসোনালিটি দেখানোর জন্য জিজ্ঞেস করলাম, বিনা অনুমতিতে হাত দেয়া উচিত হয়ছে কি?
আমাকে থামিয়ে দিয়ে নীলা বলতে শুরু করল, ‘ আপনি এখানে রেখে দিয়েছিলেন, আমি কার ডায়েরী এটা জানতে, খুলতেই লেখা টা চোখে পড়ল। আর এত লেম লেখা দেখে নিজেই বিরক্তি হয়ে গেলাম। হাও এ ম্যান ক্যান রাইট দিস টাইপ অফ শিটি কুয়োট? তাই উত্তর না দিয়ে পারলাম না।
মেয়েটার চেহারার দিকে তাকিয়ে কেমন মায়া মায়া কাজ করছিলো। ওর বয়স হয়ত আমার মেয়েটার মতই হবে। তাই আর কিছু না বলে চুপ হয়ে গেলাম। দ্রুতই ডায়েরীটা ব্যাগে আবার রেখে দিলাম।
হয়ত আপনি বিশ্বাস করবেন না এই ডায়েরীটা ২২ বছর আগে কেনা কিন্তু এখনো আছে। আমি সচারচার বের করি না। এই যে এই সময় সাথে করে নিয়ে যায়। আর মাঝে মাঝে দুএকটা লাইন লিখি। হয়ত যতদিন বেঁচে থাকব, রেখে দেব।
৩
ট্রেন তার গতিতে আগাচ্ছে। বেশ কয়েকটা স্টেশন পারি দিয়ে এসেছে। বেশ কিছুক্ষন পর খেয়াল করলাম মেয়েটা আসলেই ঘুমুচ্ছে। আমিও চুপ করে বসে রইলাম।
ঘড়িতে যখন ১১.৫০ তখন দেখি এক ছেলে এসে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু হয়ত বলবে। কিন্তু ঘুমাচ্ছে দেখে কিছু বলতে পারছিলো না। কেবিনেরর সবাই প্রায় ঘুমিয়ে গেছে। একমাত্র সজাগ ব্যক্তি আমি। তাই কোন উপায় না পেয়ে ছেলেটা আমাকে বলল, আঙ্কেল একটা কথা বলতাম?’
-জি বলেন।
-নীলা আমাদের ফ্রেন্ড। ওর কাল জন্মদিন। আমরা কয়েকজন আছি ওকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য। তো সবাই তো ঘুমাচ্ছে। যদি আমরা কেবিনের লাইট টা অফ করে দিতাম, কিন্তু সবাই কি রাজি হবে?
আমি একটু চিন্তা করে বললাম, আচ্ছা সমস্যা নেই। আপনারা ম্যানেজ করেন আমি এদিকে সবাইকে ম্যানেজ করব।
-ধন্যবাদ আঙ্কেল। তবে আপনি আমাদেরকে তুমি করে বলতে পারেন। আমরা আপনার ছেলের বয়সী।
এবার আসলেই মনে হচ্ছিলো আমার শুধু মনের নয় শরীরের বয়স টাও বেড়েছে।
হঠাত করেই কেবিনের লাইট টা অফ করে দিলো ওরা। মোবাইলের টর্চ জালিয়ে একটা কেক নিয়ে আসল আর একটা মোমাবতি জালিয়ে দিলো। ঠিক যখনই ওরা নীলাকে ডেকে তুলবে তখনই ওদের কাজ টা করে করে দিলো সদ্য বিবাহিত দম্পতি টা। হাজব্যান্ড টা কেন জানি চেচিয়ে উঠে ওর বউকে ডাকতে ছিলো। হয়ত ভয় পেয়ে। তখনই নীলার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আর ঘুম থেকে উঠতেই সবাই মিলে হ্যাপি বার্থডে টু ইউ নীলা বলে উঠল। আমি বলব কিনা বুঝতে পারলাম না, তাই শেষে আর বলা হল না।
মোটামুটি সবাই একটু বিরক্ত হয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত সবাই খুশি হলো। সবাই ভালোভালো কথা শোনাচ্ছিলো। মেয়েটাকে কেন জানি খুব আপন মনে হচ্ছিলো। সময় থাকলে কিছু গিফট দিতাম।
কেক কাটা শেষে সবাই মিলে কেবিন থেকে বের হলে আমি আমার ব্যাগ থেকে ডায়েরীটা বের করে ভাবলাম ঘটনাটা লিখে রাখি। কিন্তু তখনই মনে পড়ল আজ ১২ তারিখ। আমার মেয়টারও তো জন্মদিন। জানিনা কেমন আছে? ও কি কখনো আমাকে অপরাধী ভাববে? জানিনা। হয়ত ভালো আছে।
৪
জন্মদিনের কথা টা ডায়েরীতে লেখার জন্য বের করেছিলাম কিন্তু আবারো ওভাবেই ডায়েরীটা রেখেই ঘুমিয়ে গেছিলাম। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখি নেই। চারিপাশে সব জায়গাতে দেখি নেই। ভালো করে সব চেক করলাম কিন্তু পেলাম না। তাহলে কি হারিয়েই ফেললাম? তখনই মনে হলো নীলা নিয়ে যায় নি তো?
উঠে গিয়ে অন্য কেবিনের দিকে যেতেই দেখি ট্রেনের দরজায় বসে আছে নীলা। হাতে আমার পরিচিত সেই ডায়েরীটা। আমি পেছন থেকে ডাকলাম, নীলা ? এবার কি তুমি ঠিক করেছো? বিনা অনুমতিতে আবারো ডায়েরীতে হাত দিয়েছ?
–আসলে তখন পড়ার লোভ টা সামলে নিতে পারিনি।
-যে কোন কিছুতেই লোভ ভালো না।
–তা ঠিক। কিন্তু নীতু কোথায়?
-কেন সবটা পড়তে পারোনি?
–আচ্ছা নীতু কেমন ছিলো?
-জানিনা আমি। আর জানাতেও চাই না।
ডায়েরীটা হাত থেকে নিয়ে চলে আসতে ছিলাম। ঠিক সেই সময়েই নীলা বলে উঠল, ‘ গল্পটা শুনতে চাই? শোনাবেন? ‘
আমি কঠোর ভাবে না বলে চলে আসলাম। মেয়েটা আমাকে অবাক করে দিয়ে কাঁদতে লাগলো। আমি কান্না দেখে আর কিছু বলতে পারলাম না।
–তখন আমি ক্যাম্পাসে একবছরের সিনিয়র এবং সবে মাত্র জুনিয়র ব্যাচ এসেছে। পহেলা ফাল্গুনের দিন বন্ধুরা মিলে ক্যাম্পাসের গেটে বসে আড্ডা দিতে ছিলাম। তখন আমার সামনে দিয়ে নীতু হেটা যাচ্ছিলো। অন্য প্রেমিকদের মত আমার মনে আলোড়ন সৃষ্টি হয় নি। কারন জানিনা। জীবনে কোন মেয়েকে টিজ না করলেও কেন জানি বলে ফেললাম , বন্ধুরে আমার সিগনাল এতো দুর্বল কেন? ঐ টাওয়ার পর্যন্ত কি পৌছায় না?
–টাওয়ার বলতে কি মেয়েদের মাথার ফুল লাগানোকে বুঝিয়েছিলেন?
-হ্যাঁ।
–তারপর?
–আমি ভেবেছিলাম কিছুই হবে না। মেয়েটা যে অভাবে রিয়্যাক্ট করবে আমার জানা ছিলো। তবে ভাগ্য ভালো পুলিশে দেয় নি। আমার কথা শুনে কাছে এসে আমাকে বলে,’’ চল সোনা, সিগনাল পৌছে গেছে। ‘’
এই বলে কলার ধরে টানতে টানতে আমাকে রেজিস্ট্রারের রুমে নিয়ে গেল। গিয়ে অভিযোগ দিলো - স্যার এ আমাকে টিজ করেছে। আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। আপনি ওর বাসায় থেকে সবাইকে আসতে বলতে বলেন। স্যার তো অবাক। অনেক কথা বলে বুঝিয়ে সেদিনের মত বেঁচে গেছিলাম। কিন্তু স্যারের রুম থেকে বের হয়েই ও যা করল তা বলার ছিলো না।
–কি?
–আমাকে টেনে নিয়ে চুমু খাওয়া শুরু করল। আর বলল, এভাবেই রোজ চুমু খেতে চাই।
এই যাহ, তোমাকে কি সব বলে ফেললাম।
–না ঠিক আছে। আমিতো গল্প শুনতে চেয়েছি। এটা কোন ব্যাপার না।
–পরে আমি চিন্তায় পড়ে গেছিলাম মেয়েটার চরিত্র নিয়ে। কি করব ভাবতে ভাবতেই আমাদের প্রেম টা হয়ে গেলো। তবে ঐ কথা বললেও বিয়ের আগে আমাকে আর চুমু খেতে দেয় নি।
এর পর প্রতিদিন ক্যাম্পাসে বিকেলে হাঁটতাম। ওর একটা গুন ছিলো , রান্না করতে ভালবাসত। ক্লাস কিংবা ল্যাবের চিন্তা না থাকলে ভালো মন্দ রান্না করে খাওয়াতো। আমাদের ভালোদিনগুলোর মাঝে ওকে সামলানো সবচেয়ে কঠিন হয়ে পড়েছিলো যেদিন ওর বাবা মারা যায়। আমি খবর টা শুনে কি করব বুঝতেও পারি নি। ওর সাথে যাব নাকি আলাদা যাবো, ওকে ওর কোন বান্ধাবীর সাথে পাঠাবো ভেবে না পেয়ে শেষে নিজেই ওর সাথে গেলাম। এর পরে বেশ কয়েক মাস ওকে কখনও হাসতে দেখিনি। তবে প্রতিদিন ওকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলাম। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এই মেয়েকে আমি আর কষ্ট দেবো না। যে কোন মুল্যে এর মুখে হাসি ধরে রাখতে হবে। শত রাগ হলেও কখনও বকা দিতাম না। জানিনা কেন হয়েছিলো, হয়ত কিছুটা করুণা করে ফেলেছিলাম।
একাডেমিক অসফলতার কারনে আমার আগে ও ক্লিয়ারেন্স নিয়ে বের হয়ে গেলো। আমার বের হয়ে চাকরী পেতে পেতে ও ২ বছর চাকরী করে ফেলেছে। নিজের বিয়ের খরচ নিজেই গুছিয়েছে। শেষ পর্যন্ত একটা ছোট খাট চাকরী নিয়ে বিয়ের ময়দানে বসেছিলাম। অন্যান্য মেয়েদের মত নিজের বাড়িতে কান্না কাটি না করে এসে কান্না শুরু করল বাসর ঘরে এসে। বলা শুরু করল, ‘মায়ের কাছে যাব’। আমি পড়লাম ভীষণ বিপদে। অনেক বুঝিয়ে সেদিনের মত রাত টা পার করে দিলাম।
বিয়েরপর নীতু আর আমি আমাদের স্বপ্ন গুলোকে নতুন করে ভিত্তি দিয়ে তৈরি করতে শুর করলাম। সেদিনগুলোর কথা আর না বলি।
–তারপর কি হলো?
–হঠাত একদিন রাতে কি হলো কিছুই বুঝলাম না। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার চেকাপ করে বলল, প্যারালাইজড। মুখের পেশি গুলো অকেজো হয়ে গেছে। আমি শুনে নিজেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। ডাক্তার এও বলল, ও নাকি কনসিভ করছে। তখনও কোন কিছু বিশ্বাস হচ্ছে না। ও কি আর কখনই কথা বলতে পারবে না? আর এমনই বা কেমন করে হলো? কোন দিন শুনি নাই যে ওর ব্লাড প্রেশার হাই হইছে বা হার্ট প্রবলেম যে কোন কারনে স্ট্রোক বা হার্ট ফেইলর হয়ে প্যারালাইজড হবে। জানিনা অন্য কোন কারনে প্যারালাইজড হয় কিনা।
-তারপর?
-বাসায় নিয়ে এসে, চাকরী থেকে একমাস ছুটি নিয়ে ওর সেবা করলাম। আমাকে এক্সট্রা কেয়ারও নিতে হত।
–তাহলে এই ডায়েরী?
– ও যখন একটু সুস্থ হলো, তখন এই ডায়েরীটা কিনেছিলাম। ওর সাথে আমার এটাই ছিলো কথপোকথন এর উপায়। ও একটা লাইন লিখত, আমি উত্তর লিখে দিতাম। মাঝে মাঝে খুব বিরক্তও লাগত। মানুষ হিসেবে যত আপনই হোক সে, যদি অসুস্থ হয়ে দীর্ঘদিন থাকে তাহলে সে বিরক্তের কারন হবে। আমারো তাই হয়েছিলো। এই বিরক্তিই যে আমার কাল হয়ে যাবে তা ভাবি নি।
-মানে?
-তখন আমাদের সন্তান ওর পেটে, ৮ মাস। নীতুর মা সেদিন চলে যাবে আর আমার মা আসবে। আমিও এদিকে ছুটি নিতে পারছি না। কেননা প্রাইভেট জব, এমনিতেই এক মাস কাটিয়েছি। কোন ভাবেই হচ্ছিলো। আমি ভাবলাম অন্তত আমি চলে আসব কারন নীতু মা চলে যাবে ২ টার বাসে। এদিকে আবার আমার মায়ের আসার কথা ছিলো ২ টার আগেই। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা হয়ত সেদিন সময় নিয়ে খুব খেলছিলেন।
-কেন? তারপর?
-অফিস থেকে বের হওয়ার সময়ই একটা ফোন পাই। কিন্তু কোন আওয়াজ নেই। কষ্ট হলেও চিৎকার দিতে না নীতু তখন যে প্রচন্ড কষ্ট পাচ্ছিলো তা ফোনের অপাশে নিঃশব্দ দেখেই আর বুঝতে বাকি ছিলো।
আমার বাসায় পৌছাতে পৌছাতে দেখি মা ও চলে এসেছে। দুজন মিলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার কিছুটা সময় নিলো।
নিজের ওপর সেদিন খুব রাগ হচ্ছিলো। আসলে কাকে দেব। দোষ ঐ সৃষ্টিকর্তার, যে মাঝে মাঝে বড় নিষ্ঠুর খেলায় মত্ত হয়। তবুও আমি সৃষ্টি তাই স্রস্টাকে ভালোবাসি।
-ডাক্তার পরে কি বলেছিলো?
-সরি।
-কেন সরি কেন?
–আমি নয়। ডাক্তার বলেছিলো, সরি।
-কিহ?
-কিভাবে সেটা বলার মত আমার শক্তি নেই। তবে অপারেশন করা লাগছিলো। শেষ সময়ে ও আমাকে একটা চুমু খেতে চেয়েছিলো ইশারায়। যেভাবেই সম্পর্কের শুরু সেভাবেই হয়ত শেষ করতে চেয়েছিলো।
–শেষে এজন্যই কবিতা লিখা? কবিতাটি পড়লাম।
‘মৃত্যুতে শেষ হয়ে গেছে অধিকার
যে চুমুতে বেড়েছে সম্পর্কের ভ্রূণ
সে চুমুতেই জায়গা নিয়েছে ছেড়ে যাওয়া নিশ্বাস
তবুও নিজের করে নিয়েছি তোমার হারিয়ে যাওয়া সময়।
-কবিতার লেখার তারিখ টা খেয়াল করেছো?
-হুম। ১৩ই ফেব্রুয়ারী।
– আমাদের সম্পর্ক টাও সেদিন শুরু আর সেদিনই শেষ।
-এখন কোথায় যাচ্ছেন?
– ওর সমাধিতে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১:৩৩