বাইরে পড়তে আসা ব্যাপারটা অনেকের কাছে স্বপ্নের মত হলেও আমার কাছে এতটাও ছিলো না কিন্তু ব্যাপারটা স্বপ্নের মত করে ঘটে গেছে আর কি। কেননা আমি তখনও ওত উচ্চবিত্ত ছাত্র ছিলাম না যে বাইরে পড়ার মত কুয়ালিফাইড হয়ে যাব।
প্রথমত ইন্টারে থাকতে আমি সেসব কথিত মেধাবী লিস্টে ছিলাম না। তবুও কোন একভাবে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ টা হয়। তখনও আমার ভার্সিটির সাবজেক্ট সম্পর্কে ধারানা ছিলো না। এটা কাকতালীয় মনে হলেও এটাই সত্যি। কি সাবজেক্ট নেব এ নিয়েও তেমন চিন্তায় ছিলাম না।
বিভিন্ন রিভিউ গ্রুপে ঢুকে কয়েকটা সাবজেক্ট সম্পর্কে জানতে পারলাম। সবচেয়ে অবাক হলাম ওদের কে দেখে যারা এসব বিষয়ে বেশ জানে। তাদের নাকি প্যাশনই ছিলো অমুক তমুক সাবজেক্ট নিয়ে পড়ার।
এই প্যাশন শব্দটি শুনলে আমার খুব জ্বর এসে যায়। বর্তমানে এইটা নিয়ে তো অনেক আলোচনা সমালোচনা করা হয়। হয়ত কিছু সময় পিতা মাতা আমাদেরকে চাপিয়ে দেয় কেননা জেনারেশন গ্যাপ বলে যে জিনিস টা আছে তা আমাদেরকেও বুঝতে হবে। তারা আমাদের চেয়ে পৃথিবীতে অনেক আগে এসেছে, অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। হয়ত ভালোর জন্যই বলেছে। তবে আরেকটা কথা বলায় যায়, পিতামাতা যেমন সন্তানের ভালো বোঝে তেমন সন্তাকেও বোঝা উচিত। তবেই এসব আলোচনা আর হবে না আশা করি।
যাই হোক নিজের ইন্টারেস্টেড না থাকায় বাবাকে বললাম, ‘বাবা, সাবজেক্ট চয়েস দিতে হবে, কোনটা দিতে হবে বুঝছি না। যদি একটু বলে দিতে।‘’
-এতো বড় হয়ে গেছো নিজের কোন ইচ্ছা নাই?
- এতে আমার কোন ইচ্ছা নেই আবার উপায়ও নেই।
- আচ্ছা কালকে দিও।
-আচ্ছা।
পরের দিন বাবা আসে আমাকে সবাজেক্ট চয়েস টা ঠিক করে দিলেন। আমি সেই অনুযায়ী দিলাম। কিছুদিন পর রেজাল্টে দেখলাম প্রথমটা চলে আসছে। পরে সেটাতেই একটা ভালোবাসা তৈরী হয়ে গেছিলো।
ভার্সিটিতে প্রথম যাওয়ার ঘটনা মনে আছে। স্টেশনে যখন নেমছিলাম তখন রাত সাড়ে ৩ টা বাজে। এর আগেও কয়েকবার শহর ঘুরতে গেছিলাম কিন্তু সেবারের যাওয়াটা অন্যরকম ছিলো। পরবর্তী ৪ বছর থাকতে হবে সেরকমই একটা জিনিস গেঁথে গেছিলো মনের ভেতরে। যাওয়ার আগে বেশ কয়েকদিন মন খারাপ ছিলো। তারপর আবার ১৩ ঘন্টা জার্নি করে পৌছেছিলাম। স্টেশন থেকে বের হয়ে একটা রিক্সা খুঁজে রওনা দিয়েছিলাম এক বড় ভাইয়ের মেসের দিকে। তখনও আমি নিজের জন্য মেস ঠিক করি নি। রিক্সায় উঠেই হুড ফেলেদিয়েছিলাম, যদিও প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাস ছিলো সেদিন।
রিক্সাওয়ালা মামাকে বললাম, ‘কতক্ষন লাগবে?’
- ১৫ মিনিট।
- মামা মোবাইল আছে?
- আছে তো।
- -মোবাইলে গান আছে?
- কি গান?
- এই পথ যদি শেষ না হয় ….।।
- জানিনা, এ লন মোবাইল। খুইজা লন।
- প্লে লিস্টে থেকে গান টা বের করে ছেড়ে দিলাম।
সেই একটা পরিবেশ তৈরী হয়ে গেছিলো। ঠিক তখনই বাসার কথা মনে হচ্ছিলো। ট্রেনে কত জনকে কত জনের বাবা মা রাখতে এসেছে। অথচ আসার আগের দিন যখন মা কে বললাম কালকে ভার্সিটিতে যাওয়া লাগবে।
সাথে সাথে মা বাবাকে বললেন, কাল ছেলেকে রেখে এসো।
- কোথায়?
- অমা তুমি জানো না? ওর যে দুইদিন পর ক্লাস শুরু।
- কেন তোমার ছেলেকি চিনবে না? নিজে কোন সাবজেক্টে পড়বে এটাও জানেনা। শোনো বেশ বড় হয়েছে। ওকে নিজেকে একাই যেতে হবে। আমি বরং টাকা রেখে যাচ্ছি। ওর নিজের মত প্রিপারেশন নিতে বলো।
আমি তো এতোও স্বাধীনতা চেয়েছিলাম না। যাই হোক নিজে নিজে চলার মধ্যে আলাদা ব্যপার আছে। উপস্থিত বুদ্ধির চর্চা করা যায়।
১৫ মিনিট পর ভার্সিটির মোড়ে যখন নেমেছিলাম। বেশ কিছু দোকান খোলা ছিলো। বড় ভাইকে ফোন দিবো কিনা বুঝছিলাম না। যদিও সে বলেছিলো যখনই আসিস ফোন দিস।
একটা চায়ের টং দেখে গেলাম। দুইজন মাত্র কাস্টমার। আমি একটা চায়ের অর্ডার করে আরেক বেঞ্চে বসে পড়লাম। ভাবলাম চা হতে হতে ভাইয়াকে ফোন দিবো।
চা খেতে খেতে ভাইয়াকে ফোন দিলাম। ভাইয়া বসতে বলল। আমার সামনে বসা দুই জন তারা এবার আমার দিকে তাকালো।
একজনের মুখ ভর্তি দাড়ি। মাথার চুল গুলোও বড় বড়। এক হাতে সিগারেট। এটিটিউড দেখে কেমন গম্ভীর টাইপ মনে হচ্ছিলো। আর পাশের জন পুরোই বিপরীত।
প্রথমজন আমার দিকে তাকালো। আমিও তাকালাম। আমাকে জিজ্ঞেস করল, কি নতুন ব্যাচ নাকি? ‘
- জি ।
- কি নাম?
- আকাশ।
- আজকেই আসলি নাকি?
- জি।
- কোথায় উঠছিস?
- এখনো মেস ঠিক করি নি । এক ভাই আছে পরিচিত। ওনার কাছে থাকব এই মাসের কয়দিন। তারপর নতুন মেস।
এর মধ্যেই ভাই চলে আসল। এসেই ওনাদের দেখে সালাম দিলো। ভাইয়ের নাম রনি।
-তুই একে নিতে এসেছিস?
-হ্যাঁ ভাই।
- একটু ম্যানার শেখাস। আর তুই সহ কালকে ওকে আমার রুমে নিয়ে আসিস।
-ঠিক আছে ভাই।
-এখন যা রেস্ট নিতে বল। কাল ১ টাই নিয়ে আসবি।
এরপর ওখান থেকে চলে আসার পর রনি ভাই বলা শুরু করল, ‘ কিরে তুই কি ম্যানার জানিস না? বড় ভাইদের সাথে কি বিহ্যাভ করছিস? উনি অনেক আগের ব্যাচ। কিছু কোর্সে ক্লিয়ার হয়নি তাই এখনো আছে।‘’
আমি তখন মনে মনে ভাবলাম আমি তো প্রথমেই চিনতাম না। আবার ম্যানারের কি হলো। রাতভর বাইরে বসে থাকলে তো ফেইল আসবেই।
যাই হোক রাতে ঘুমিয়ে রেস্ট নিয়ে রনি ভাইয়ের সাথে ঐ ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেলাম হলে। যখন রুমে প্রবেশ করলাম তখন ১ টা বেজে ১২ মিনিট। নক করে ভিতর ঢুকতেই দেখি ভাই টেবিলে বসে ল্যাপটপ পাশে নিয়ে কি যেন কাজ করছে। আমাদের প্রবেশ দেখে ভাই বললেন, ‘কি রে লেট কেন?’
ঘড়ির দিকে তাকি দেখলাম মাত্র ১২ মিনিট লেট। রনি ভাই বলল, ‘ভাই মাত্র ১২ মিনিট। সরি ভাই।‘
ভাই যেন ২২ শে শ্রাবনের ডায়লগ টা রেডি করে রেখেছিলো। এই ১২ মিনিটে কত কিছু ঘটে গেছে তোর ধারনা আছে।
কোন মতে ঝারি খেয়ে রনি ভাইকে বিদায় করে দিয়ে আমাকে থাকতে বললেন ভাই।
আমি থাকলাম।
- বস।
- জি ভাই।
- থাকার জায়গা ম্যানেজ করছিস?
- না ভাই।
- আচ্ছা।
- বাসা কোথায়?
আমি এমন যাবতীয় কিছু প্রশ্নের জবার দিয়েছিলাম। অনেকে যেটাকে র্যাগিং বলে থাকে।
- দুপুরে খাইছিস?
- -না ভাই।
- চল যাই খেয়ে আসি।
এখানে এসে প্রথমেই এমন একটা পরিবেশ তৈরী হয়ে যাবে তা ভাবাছিলো না। পরে খেতে খেতে অনেক কথা হয়েছিলো। জানলাম ভাইয়ের কি অবস্থা। আমি বেশ ইম্প্রেসড হয়ে গেলাম। কেন জানি তখন ভাইয়ের মত হতে মন চাইছিলো।
খাওয়া শেষে যখন রুমে এসে ভাইয়ের জগত টা দেখলাম, তখন মনে হচ্ছিলো আমিও যদি এসব নিজে কাজ করতে পারতাম।
সেদিনের মত বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় দেখলাম ভাইয়ের পাশের বেড টা খালি। আমি বেশ কোতুহল নিয়ে তাকাতেই ভাই বলল, তুই চাইলে এখানেও উঠতে পারিস।
কিছুদিন পর সিদ্ধান্তে নিয়ে ভাইয়ের পাশের ঐ বেডে উঠলাম। তখন থেকে ভাইয়ের কাছে প্রথম ইঞ্জিনিয়ারিং এর আমার সাব্জেক্টের রিলেটেড কাজ শুরু হয়। নতুন নতুন চিপ ডিজাইন বানানো, প্রোগ্রামাবল ডিভাইস তৈরি হয়ে গেছিলো নেশার মত।
তবে সত্যি ছিলো ভাইয়ের মত আমি একাডেমিক পর্যায়ে বেশ পিছিয়ে পড়েছিলাম। তাই দেশে কোন ভালো চাকরী হত না। তাই ভাই যখন ক্লিয়ার করে চলে গেছিলেন তখন আমাকে এই বিদেশে আসার পরামর্শ দিয়ে ছিলেন। দেশে থাকতে ভাইয়ের সাথে কো-অথোর হিসেব ৪ টা পেপার পাবলিশ করেছিলাম। তবে আমাকে কাজ তেমন করা লাগেনি। আমি শুধু ভাইয়ের ট্যালেন্ট দেখেই মুগ্ধ হতাম সব সময়।
যাই হোক শেষে আর দেশের ভেতরে চাকরীর আশা না করে বিদেশে চলে আসি। আমাকে ফুল ফান্ড পাইয়ে দিতে আর সাথে ভালো প্রফেসর পাইয়ে দিতে অনেক হেল্প করেছে, কেননা ততদিনে ভাই যে স্যারের আন্ডারে পিএইচডি করছিলো তাকে ইম্প্রেসড তৈরি করছিলো বলেই সেখান থেকেই আমি রিকমেন্ডেশন পাই। পরে এখানে এসে ভাইয়ের সাথে ১ম দুই বছর ছিলাম। যাহ ভাইয়ের নাম বলতেই ভুলে গেছেই। ভাইয়ের নাম ছিলো লিঙ্কন। ভাই তো আর থেমে থাকেনি। এগিয়ে চলেছে।
আমিও ছুটে চলেছি তার দেখানো পথে। নিজের ব্যাসার্ধকে বাড়ানোর চেষ্টায়।
২য় পর্ব
আগের পর্বের লিঙ্ক
১ম পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:৪৯