ইতালি কেন যাচ্ছো, এটা কেউ জানতে চাইলে আমি খুব চাল মেরে বলি, একটা ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে ওরা আমাকে ইনভাইট করেছে। আমার যাওয়ার ইচ্ছা নাই। কিন্তু আমি না গেলে ওদের কনফারেন্স মাটি হয়ে যাবে। তাছাড়া বিদেশ যেতে আমার একদমই ভালো লাগে না, দেশ-পরিবার খুব মিস করি।
(পাঠক ভুলে যাবেন না, এটাই কিন্তু আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমণ।)
এ সময় আমি মুখে দুঃখবোধ ফুটিয়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করি।
অবশ্য ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স - শব্দটা যত ভারি শোনায়, ব্যাপারটা আদৌ ততটা জোড়ালো কিছু না। খুলেই বলি।
সেটা খুব সম্ভবত ২০০৪ সাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে রাত্রিবেলায় পুলিশ ঢুকে পড়ে এবং অকথ্য নির্যাতন চালায়। সারা বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে উত্তাল অবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও আমি এই উত্তাপ থেকে অনেক দূরে। সেই সময় আমি যুগান্তরে ফিচার বিভাগে কাজ করি। কীভাবে জাতিকে হাসানো যায়, সেই চিন্তায় চোখের জল, নাকের জলে একাকার হই।
সেই তুমুল ছাত্র আন্দোলনের সময় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি একা পুরো এলাকা কাভার করতে পারছে না। এ সময় যুগান্তরের চিফ রিপোর্টার আমাকে ডেকে পাঠান। বলেন, তুমিও তো ঢাবির ছাত্র, যাও তো রিপোর্টিং করে আসো। কখন কি ঘটে সেটা আমাকে জানাবে।
আমি আনন্দে আত্নহারা হয়ে বললাম, চিন্তা করবেন না সাইফুল ভাই। একদম অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করে ফেলবো। ঘটনার গভীরে ডুব দিয়ে একদম তরতাজা খবর তুলে নিয়ে আসবো।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মহান ব্রত নিয়ে আমি ইউনিভার্সিটিতে গমন করি। আন্দোলনকারীদের সাথে মিশে যাই। এবং এক পর্যায়ে নিজেই আন্দোলনকারীদের একজন হয়ে উঠি। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে সম্পূর্ণ ভুল দিকে দৌড় দিয়ে কীভাবে যেন পুলিশের সামনেই চলে আসি, এত জায়গা থাকতে টিয়ারসেল ঠিক আমার সামনেই ফাটে, স্লোগান দিতে দিতে গলা ভেঙ্গে ফেলি, বিশাল কাহিনী। খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে নিজেই নিউজ আইটেম হয়ে যাওয়ার দশা। (এ বিস্তারিত কিছু বললাম না। )
ফলে সেই যে আমি সকালবেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম, টানা ৩/৪ দিন সেখানেই থাকি। বাসায়ও ফিরি না, অফিস তো দূরঅস্ত। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা তখন কুয়াশার চাদরে মোড়া। শীতের কুয়াশা না, টিয়ার গ্যাসের। আমার অনেক বন্ধুদের বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ ঘটেছে কার্ল মাক্স, মাও সেতুং, রেড বুক ইত্যাদি পড়ে। আমাকে কষ্ট করে কোনো তত্ব পড়তে হলো না, পুলিশের টিয়ারগ্যাসের ঠেলায় এমনিই আমার বৈপ্লবিক চেতনার বিকাশ ঘটলো।
সেই চেতনার আলোকে, এই ঘটনা থিতিয়ে আসার পর আমি এবং কয়েকজন মিলে ''ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মানবাধিকার সংঘ'' গড়ে তুলি। আমাদের যুক্তি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিবেটিং ক্লাব আছে, ট্যুরিজম ক্লাব আছে, এমনকি চাঁদপুর সমিতিও আছে। কিন্তু আসল জিনিসটা নেই। ঢাকা ইউনিভার্সিটির পোলাপান পুলিশের হাতে মার খাচ্ছে, পলিটিক্যাল পার্টির হাতে জিন্মি হয়ে আছে, এদের জন্য একটা মানবাধিকার সংস্থা করা খুব দরকার, যারা ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কথা বলবে। আমি তখন চলে গেছি অন্য জগতে। অফিসে যাই না, বাসায় ফিরি গভীর রাতে, আজিজ মার্কেটে পত্রিকা বিছিয়ে সমমনা বিপ্লবীদের সাথে শলা করি। একদিন মধুর ক্যান্টিনে একটা সংবাদ সম্মেলনও করে ফেললাম। এর ফল হলো দারুন।
ছাত্রদল, ছাত্রলীগ এমনকি ছাত্রইউনিয়নও আমাদের বাঁকা চোখে দেখা শুরু করলো। আমরা সব মিলিয়ে জনা দশেক ছিলাম। গুণে গুণে প্রত্যেকে - বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান চিপায় চাপায় হালকা মারধোর খেলাম। বাদ ছিলাম আমি নিজে।
একদিন তৎকালীন ভিসি আমাদের ডেকে পাঠালেন। ভিসি আনোয়ারের বিদায়ের পর আ. ফ. ম ইউসুফ হায়দার তখন নতুন ভিসি হয়েছেন। তিনি চিবিয়ে কথা বলেন। পান চিবান না চুইংগাম, সেটা পরিষ্কার বোঝা যায় না। বললেন, তোমরা যে নতুন ব্যানারে মাঠে নামছো, তোমাদের পেছনে ব্যাকআপ কে দিচ্ছে?
আমরা বললাম, কেউ না।
শুনে তিনি পান অথবা চুইংগাম চিবাতে চিবাতে দারুন আফসোস করলেন। বললেন, তাইলে তো মহাবিপদ।
আমি বললাম, স্যার, আপনি আমাদের ভিসি। আমরা বৈধভাবে আন্দোলন করছি। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। আমাদের কিসের বিপদ?
শুনে শ্রদ্ধেয় ভিসি স্যার এবং তার পারিষদ হেসেই খুন।
ইউসুফ হায়দার আবারও বললেন, বিপদ, মহাবিপদ।
মিটিং শেষ হওয়ার পরেই ''মহাবিপদ'' টের পেলাম। মিটিং শেষে বন্ধুদের বিদায় করে মহসিন হলের পেছন দিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় চারজন যুবক আমাকে ঘিরে ধরলো। পকেট থেকে একটা অস্ত্র বের করে ওরা জিজ্ঞেস করলো, এইটা কি চিনোস?
আমি তো রীতিমতো কাঁপছি। আমতা আমতা করে বললাম, এইটা রাইফেল না?
ঠাস করে গালে একটা থাপ্পর মেরে ওরা বলল, এখনো কোনটা রাইফেল, কোনটা পিস্তল এইটাই চিনোস না, আইছোস রাজনীতি করতে?
বলে ওরা হেসে একে অন্যের গায়ে হেলে পড়লো। ঠিক একটু আগে ভিসি এবং তার পারিষদ যেভাবে হেসে ছিলেন।
চড় নয়, আমাকে মুষড়ে দিয়েছিল, ওদের হাসাহাসি।
তখন থেকেই আমি বদলে যেতে শুরু করলাম। ততদিনে আমি শিখে গেছি, কীভাবে উড়ন্ত টিয়ারশেল কাগজ দিয়ে ধরে আবার পুলিশের কাছে ফেরত পাঠাতে হয়। পুলিশ উত্তর দিক থেকে দৌড়ানি দিলে, সোজাসুজি দক্ষিণে না ছুটে পূর্ব বা পশ্চিমের কোনো চিপায় ঢুকে পড়া অনেক নিরাপদের-ইত্যাদি। আমার সঙ্গীসাথীদের বললাম, এভাবে ভদ্রলোকের আন্দোলনে কাজ হবে না, বুঝছো। আমাদের মেশিন লাগবে। মাওসেতুং বলেছেন, তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো। মাওসেতুং কস্মিনকালেও এই কথা বলেন নি। উত্তেজনার বশে এই ভুল কোটেশন আমি ব্যবহার করে ফেলেছি। ভুল হোক বা শুদ্ধ হোক, কোটেশনটা দারুনভাবে অন্যদের উজ্জীবীত করলো। শুধু একজন বলল, ভাই, এখনই মাথা গরম কইরেন না। দেখি আমি কি করতে পারি।
সেই ছেলে আমাদের একদিন নিয়ে গেল ড. কামাল হোসেনের কাছে। কামাল সাহেব আমাদের অনেক সময় দিলেন। নিজেও অনেক কথা বললেন। তার কোনো কোনো কথায় আমার একটু খটকা লাগলো। মনে হলো, ড. কামালের জগত বোধহয় একটু আলাদা। যেমন উনি বললেন, টিএসসির মোড়ে মোড়ে, হলে হলে, দেয়ালে দেয়ালে, সিসি ক্যামেরা বসাতে হবে, যাতে পুলিশ বা অন্য কেউ -সাধারণ ছাত্রদের নির্যাতন করলে, সেটা ভিডিও-তে ধরা পড়ে।
আমার খটকার জায়গা হলো, এই সিসি ক্যামেরা পাহাড়া দেবে কে? এর মধ্যে বিবিসি বাংলা বিভাগের এক তরুণ সাংবাদিক আমার ইন্টারভিউ নিলেন। মনের ক্ষোভে অনেক কথা বললাম। বলাবাহুল্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল কাহিনীগুলোই বলে বসলাম। আমাদের টক শো'র বক্তারা কখনো ঝেড়ে কাশেন না, এদিকওদিক দিয়ে কথা বলেন। আমি ঝেড়ে কাশলাম। এতে লাভের মধ্যে যেটা হল, আমি যেন আরো নজরবন্দী হয়ে গেলাম।
আইইআরে তখন ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ডিপার্টমেন্টে এসে আমার সম্পর্কে খোঁজ খবর করে গেছে। কাগজপত্রের ফটোকপি নিয়ে গেছে। আমার ম্যাট্রিক ইন্টারমিডিয়েটের মার্কশিট তাদের কি কাজে আসবে, আল্লাই জানে।
ক্যান্টিনে গিয়ে যখন বসি, তখন ওয়ারল্যাসওয়ালা এক লোক পাশে বসে থাকে। বলি, ভাই, আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চান? আমার ব্যাপারে কিছু জানার আছে?
সেই লোক এক গাল হেসে বলে, আরে ভাই, ছি ছি কি বলেন। আমি আসি আপনাদের ক্যান্টিনের পুড়ি খাইতে। এরা পুড়িটা দারুন বানায়।
আমি ভ্রু কুচকে চায়ের কাপে চুমুক দেই। আমাদের ক্যান্টিনে পুড়ি হয় না, চা, সিঙ্গারা আর সমুচা।
সে এক দারুন অস্থির সময়।
অতএব আমিও পাল্লা দিয়ে বদলাতে শুরু করলাম। মেশিন দরকার, মাসল দরকার, দরকার কিছু ক্যাডার, এই হলো আমাদের ধ্যানজ্ঞান।
আজও যে আমি মেশিন চিনি না, রাইফেল কিংবা পিস্তল আলাদা করতে পারিনা, মাসল নেই, সাথে ক্যাডারও নেই -এর জন্য দায়ী এক ইতালিয়ান যুবক, তার নাম পাওলো ভিকি।
পাওলো ভিকির হাতেই আমার পূনজর্ন্ম । দেশ এবং পৃথিবীকে নতুন করে দেখার শুরু তার হাতেই। পাওলো একজন ইতালিয়ান তরুণ, তিন বছর ডাক্তারি পড়ে তার মনে হয়েছে, কি লাভ ডাক্তার হয়ে, তারচে কিছু একটা করি। পড়ালেখা ছেড়ে সেই থেকে পাওলো মাঠে নেমেছে। পাওলোর পাল্লায় পড়ে আমারও মনে হল, কি হবে লেখাপড়া করে, চাকরি করে। পথে নামি। পথে নামলাম।
সেই পথ দারুন আনন্দের, নিদারুন বেদনার।
প্রথম পর্ব