আমার প্রথম মেয়ে হওয়ার কথা আজও খেয়াল আছে। ডাক্তার একটা ডেট দিয়েছিলেন- যে অমুক দিন আমার আমার সন্তান হবে। আমি সেইদিন সহ আরও দুইদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিলাম। অযথাই ক্লিনিকে বসে থাকলাম- ঐ তিনদিনের মধ্যে কোন ঘটনা ঘটলো না। আমার ছুটি শেষ হওয়া মাত্রই আমার স্ত্রীর প্রসববেদনা শুরু হলো। অফিস পালিয়ে ক্লিনিকে এলাম- যাই হোক সে এক বিরাট ইতিহাস। বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে আমিই সবার আগে বিয়ে করেছিলাম- কাজেই সবার আগে আমি বাবা হতে যাচ্ছি- আমার অন্যসব বন্ধুরা খবর পেয়ে সদলবলে ক্লিনিকে চলে এলো। তারাও কিছুদিন পর বিয়ে করবে এবং তারাও বাবা হবে - কাজেই পুরো বিষয়টা নিয়ে তাদের আগাম একটা কৌতুহল থাকা স্বাভাবিক। আমার বন্ধুসংখ্যা আর শত্র“সংখ্যা সমান সমান , কাজেই ক্লিনিকের ওয়েটিং রুম লোকে লোকারণ্য। ( নানান কিছিমের বন্ধুবান্ধব। একজন বন্ধূ শান্তনু এসেছে - একটি স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতা সংগঠনের সাথে ও জড়িত। কাজেই সে একগাদা ডোনার নিয়ে এসেছে, যদি হঠাৎ রক্তের প্রয়োজন পড়ে । যেহেতু সে আমার স্ত্রীর রক্তের গ্র“প জানেনা - কাজেই এ বি সি - সব গ্র“পের একসেট করে ডোনার নিয়ে এসেছে। আমার বন্ধু কাম ছোটভাই মুনতাসির- যার স্বপ্ন ফিল্ম বানাবে - সে কী আনবে বুঝতে না পেরে কোথেথেকে একটা মুভি ক্যামেরা জোগাড় করে এনেছে- কিন্তু তাড়াহুড়োর সেই ক্যামেরার ব্যাটারি ভুলে রেখে আসায় সে কি করবে বুঝতে পারছে না। তবে তার তৎকালীন বান্ধবী বর্তমানে তার স্ত্রী সুমী- (তারা দুইজনেই এখন লন্ডন প্রবাসী- আহা কতকাল তাদের দেখি না) অসম্ভব কষ্ট করেছে সেই সময়।
যাই হোক, ডাক্তার আমার স্ত্রীকে দেখে বললেন, পেইন উঠেছে ঠিক আছে- তবে পেইনটা আরও জোড়ালো হতে হবে। তিনি আমার বউকে একটা ওষুধ দিলেন এবং হাটাহাটি করতে বললেন, এতে ব্যথা নাকি আরও বাড়বে। আমার স্ত্রী প্রথমবারের মতো মা হতে যাচ্ছে- সে বেচারি পুরোপুরি ভড়কে গেছে- আরও জোড়ালো পেইন হতে হবে - আরও জোড়ালো মানে কত জোড়ালো ? আমার স্ত্রী ওষূধ খেয়ে ক্লিনিকের করিডরে হাটাহাটি করছে - তাকে সাহায্য করার জন্য আমার মেজশালী তাকে ধরে হাটাচ্ছে ( তার আবার সব বিষয়ে অতি উৎসাহ!) । আধা ঘন্টা পরে শুনলাম আমার স্ত্রীর পেইন বাড়ার বদলে কিছুটা কমে গেছে- তবে আমার মেজশালীর পেটে চিনচিন ব্যাথা করছে। আমার সেই শ্যালিকার সবে বিয়ে হয়েছে - ব্যাপার শুনে তার হ্যাজবেন্ডের মুখ শুকিয়ে গেল- এমন তো হবার কথা নয়।
যাই হোক এইরকম নানান ঘটনার পর আমার কণ্যার জন্ম হলো। মেয়েকে এক নজর দেখলাম, আমার মানব জন্ম স্বার্থক হল। এ সময়ে আযান দেবার নিয়ম। আমি এতটাই আপ্লুত ছিলাম যে, আযান দেয়ার জন্য বন্ধুদেরকে অনুরোধ করলাম। সবাই সেই অনুরোধে একযোগে সাড়া দিল। লেগে গেল তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। বিশেষ করে কে আজান দেবে এই নিয়ে আমার দুই বন্ধুর মধ্যে তীব্র বাকযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, এদের একজন আবু হানিফ, ব্যাংকার- আরেক জন বিখ্যাত-লেখক- পর্যটক মুসা ইব্রাহিম।
আমার কণ্যার জন্ম হয়েছিল জানুয়ারির পঁচিশ তারিখ- মাসের শেষের দিকে। ছোট চাকরী করি- কাজেই হাতে টাকা পয়সা নেই। একজনের কিছু টাকা ধার দেবার কথা ছিল- সে টাকা দিতে একটু দেরীই করেছিল- বিল মেটানোর জন্য টাকা নিয়ে ক্লিনিকে উপস্থিত হয়ে শুনি আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে টাকাটা দিয়ে দেয়া হয়েছে। এমনতিতেই প্রেমের বিয়ে- তারপর এই অবস্থা- আমার বড়শালী সেই সময় আমাকে অতি জ্ঞানগর্ভ একটি লাইন বললেন- বাবা হওয়া এতো সহজ না। কথাটি ভীষণ তিতা হলেও সত্য- আর তাছাড়া ছোটবেলা থেকে চিরতার পানি খেয়ে অভ্যাস আছে বলে খোটাটি হজম করতে আমার কোন কষ্টই হল না।
মেয়ে আর মেয়ের মাকে নিয়ে বাসায় এলাম। আমার ছোট্টু তুলতুলে মেয়েটি বিছানায় শুয়ে থাকে, খিদা লাগলে হাতপা ছুড়ে কাঁদে। খাবার পেলে ঘুমিয়ে পড়ে- পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কি আছে? তখন আমার মনে হল মেয়েটার একটা ছবি তুলে রাখা দরকার। এবং তখন আবিষ্কার করলাম আমার কোন ক্যামেরা নেই, এতদিন ছবি তুলতে স্টুডিওতে যেতাম, কিন্তু এতো ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে তো স্টুডিওতে যাওয়া যায়না। লজ্জায় কারও কাছে ক্যামেরা চাইতেও পারিনা। সেইসময় বিচ্ছুতে কাজ করতো কার্টনিষ্ট রকি। ওর বাসা আমার বাসার কাছেই। একদিন মিনমিন করে ওকে বললাম, একদিন বাসায় এসে আমার মেয়ের কয়েকটা কার্টুন একে দিয়ে যেও তো। ও তো হেসেই খুন।
আমার মেয়ের জন্মের সময় হাত মুঠো করা ছিল। মুরুব্বীরা বলেছিলেন, ওই হাতের মুঠোতে রবির জন্য সৌভাগ্য নিয়ে এসেছে। ব্যাপারটি সত্যি বলে ভাবতে ভালো লাগে কেননা- ওর জন্মের এক বছরের মধ্যে আমি হুট করে ইটালি যাবার সুযোগ পেয়ে যাই। আমার জন্য এটি ছিল অনেক বড় ব্যাপার- কেননা তখন পর্যন্ত আমার বেড়ানোর দৌড় ঢাকা টু মানিকগনজ। মানিকগনজ আমার হোম ড্রিস্ট্রিক। ইটালি পৌছানোর পর কয়েকটা দিন মহা আনন্দে কাটলো- তার পর হঠাৎ খেয়াল হল -কয়েকদিন পরে আমার মেয়ের প্রথম জন্মদিন। প্রথম বিদেশ ভ্রমনের আনন্দে চট করে চলে এসেছি, ব্যাপার মাথায় ছিলনা। ইটালি আসার পর মেয়ের জন্মদিন এটেন্ড করার জন্য পাগল হয়ে গেলাম। খেয়াল আছে- আমি এক ইটালিয়ান বন্ধু নিয়ে শীতের সন্ধ্যায় ফ্লোরেন্সের প্রায় প্রতিটা ট্রাভেল এজেন্সি ঘুরেছি- একটা টিকিটের জন্য- যেভাবে হোক আমাকে পঁচিশ তারিখের আগে ঢাকায় থাকতে হবে। কোন এক কারণে সব ফ্লাইট তখন ওভার বুকিং। একটা টিকিট পেলাম- ঠিক পচিশ তারিখেরই। তাতেই উঠে বসলাম। আমার মেয়ের প্রথম জন্মদিন আমাকে পালন করতে হলো মাটি থেকে ত্রিশ হাজার ফুট উচ্চাতায়।
আমার মেয়ের দ্বিতীয় জন্মবার্ষিকীর আগেই আমার আরও কিছু উন্নতির লক্ষণ দেখা দিল। দাম বেড়ে যাওয়ায় দুই টাকা দামের সিগারেট আড়াই টাকায় খাওয়া শুরু করলাম, আরেকবার ইটালি ঘুরে এলাম, এবং সবচে বড় কথা আমার ছোটভাইয়ের কাছ থেকে একটা ডিজিটাল ক্যামেরা উপহার পেলো আমার মেয়ে। ও ছোট বলে ক্যামেরাটা নষ্ট করে ফেলতে পারে- এমন একটা সহজ যুক্তিতে আমার মেয়েকে কাবু করে অচিরেই ক্যামেরা দখল করে ফেললাম। চললো সারাদিন ফটোসেশন- আমার দুই বছরের মেয়ে বুঝে গেল ছবি তোলার সময় কখন হাসতে হবে, কথন চোখের পাতা ফেলা যাবে না, কখন স্টিল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
আমার মেয়ের আড়াই বছরের মাথায় আমার স্ত্রীর গর্ভে আমাদের দ্বিতীয় সন্তান এলো। এসময় মেয়েদের মেজাজ মর্জি এমনিতেই খারাপ থাকে। একদিন অতি তুচ্ছ একটা কারণে আমাদের তুমুল ঝগড়া হল। রাগ করে আমার স্ত্রী সকণ্যা বাবার বাড়ি চলে গেলেন। আমার শ্বশুর তখন সবে সরকারী চাকরী থেকে রিটায়ার করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করবেন বলে জমানো টাকা নিয়ে মাঠে নেমে গেছেন, তার মেজাজমর্জি হয়ে গেছে পুরোপুরি রাজনৈতিক নেতাদের মতো আপোষহীন। তিনি ঘোষণা করলেন, কোন অবস্থাতেই আমি তাদের বাড়ির ত্রিসীমানায় যেতে পারবো না। মেয়েকে দেখতে হলে কোর্ট থেকে অর্ডার নিয়ে আসতে হবে। আমাদের ডিভোর্স হয়নি, কাজেই কোট থেকে বাবা হিসেবে আলাদা করে অর্ডার আনতো কীভাবে। আবার আমার স্ত্রী সবে দ্ ুমাসের অন্তসত্তা, এসময় ডিভোর্সও অসম্ভব। খুব সম্ভবত: একেই বলে পটিক্যাল প্যাঁচ, আমার শ্বশুরের ভবিষ্যত খুবই উজ্জ্বল। ঘটনা ক্রমেই জটিল হল। মাস পার হয়ে যাচ্ছে আমি আমার মেয়েকে দেখিনা, আমার মেয়েও আমাকে না। একদিন টিকতে না পেরে সরাসরি চলে গেলাম শ্বশুরবাড়িতে। দরজায় আমার গলা শুনে মেয়েটা আমার দৌড়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো আমাকে, আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে , মেয়েটা আমাকে ছাড়ছেই না। কিছুক্ষণ বাদেই আমার শুশ্বর এলেন এবং একটি ভয়াবহ কান্ড করলেন। মেয়েটাকে ছিনিয়ে নিলেন। আমার মেয়ের সর্বশক্তি নিয়ে আমাকে আকড়ে ধরে ছিল কিন্তু সে অতটুকু মেয়ে বলে নয়, দীর্ঘদিন বাবাকে না দেখার শোকে কিংবা বাবা মার সমস্যার মাঝখানে পড়ে ওর মারাত্বক স্বাস্থ্যহানি ঘটেছিল- ও শুকিয়ে কাঠি হয়ে গিয়েছিল- কাজেই শক্তিতে সে নানা বাড়ির লোকদের সাথে পেরে ওঠেনি। আর আমিও কোন জোর খাটাইনি, সেটা করলে ও আরও কষ্ট পাবে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ঐ দিন ছিল বিশ্ব বাবা দিবস।
( গত বছর লিখেছিলাম পত্রিকার পাতায়)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০০৯ রাত ১২:৪৪