আল্লাহ-তত্ত্বে হয়রান হয়ে যাই। দিশেহারা হয়ে যাই। দয়াময় রাসূল দ. আল্লাহর বিষয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা করতে নিষেধ করেন, এটাই চূড়ান্ত আল্লাহ-তত্ত্ব। কিন্তু আল্লাহ-তত্ত্ব এখানে থেমে থাকেনি। ধেয়ে গেছে দিগ্বিদিক।
আল্লাহ-তত্ত্ব নিয়ে আমরা জীবনের চলতিপথে যা শুনি, দেখি, তার ভিতর দিয়েই নাহয় আরো এক যাত্রা হয়ে যাক। কোনকিছু প্রমাণের চেষ্টা নেই, কোনকিছু প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নেই।
আল্লাহ নিয়ে কুরআনে তো কত কথাই আছে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে বলেন, যারা আল্লাহর মুখের দিকে চেয়ে থাকার আকাঙ্ক্ষা রাখে... (সেইসব বান্দা)।
কুরআনে দেখি, আল্লাহর হাত রাসূল দ,'র হাত। আবার তিনি মুখ ফেরান। তিনি মুখ ফিরিয়ে নেন কারো কারো কাছ থেকে। কুরআনে এমন অনেক কথাই আছে।
হাদীসে শুনি আল্লাহর শারীরিক গঠনের কথাও। বুখারী শরীফেও।
এইসব কথার উপর ভিত্তি করে যখন মুতাজিলা, সালাফি বা কিছু সূফিও আল্লাহর সদেহী হবার কথা বলেন, হয়রান হয়ে যাই। হয়রান হয়ে যাই মানুষ আল্লাহকে যে রূপে চিনত সেই রূপ দেখে অবশেষে চিনবে- একথা শুনে। হয়রান হয়ে যাই তিনি সরাসরি আসীন হবেন মহাবিচারকের আসনে। তখন সবাই তাঁকে দেখতে পাবে, একথা শুনে। বেহেস্তের সাতদিনের একদিন হবে সবার মিলনমেলা। সেদিন সবাই আল্লাহর সাক্ষাতও পাবে, অপরাপর বেহেস্তের অধিবাসীদেরও সাক্ষাত পাবে, শুনে আবারো দিশেহারা হই।
আল্লাহর সদেহী হবার তাত্ত্বিক আলোচনা থেকেই লাত-মানাত-উজ্জার ধারণার আগমন হয়ত। প্রাচীণ বা আধুনিক- কোন মানুষেরই কল্পনা বাঁধ মানে না। দেহধারীর দেহ উপজীব্য করতে গিয়ে তাকে সন্তানের সাথে সংশ্লিষ্ট করা মানুষের ভাবনারই ফলাফল। হয়ত প্রাচীণ মিসরে অন্ধকারের দেবতা সেথ রূপে পূজিত ছিল যে জন, আলোর দেবতার বিরোধী, অনুর্বর মরুর প্রতিভূ, তাকেই শস্যদেব করা হয় আবার তাইগ্রিস-ইউফ্রেতিসের সভ্যতায়, আর সেই মরু থেকে রক্ষার দেবতা (যে মিসরে মরুর দেবতা ছিল) শস্যদেব রূপে পূজিত হতে গিয়েই প্রাচীণ সেই ইরাক-ইরানের তখনো জন্ম না নেয়া ইহুদি সভ্যতায় স্রষ্টাবিরোধী কিন্তু প্রবল শক্তিরূপে পূজিত হয় ইব্রাহিম আ.'র কথিত পিতা, চাচা আজরের দ্বারা, তাদের গোত্রের দ্বারা। কুরআনে স্পষ্ট আছে, হে পিতা, আল্লাহর উপাসনা করো, যিনি তোমারও (স্বীকৃত) প্রতিপালক, আমারও। আর শয়তানের পূজা করো না, শয়তান তো প্রকাশ্য শত্রু।
হয়ত এই হল স্যাটানিক উপাসনার কাল্টের সর্বশেষ জানা কনফ্লিক্ট। হয়ত এখান থেকেই শয়তান উপাসনার শুরু।
শয়তানের আরাধনা কিন্তু ক্ষুদ্র কোন বিষয় নয়। স্বয়ং ক্রিয়েটিভ কমন্সের লোগোতে পর্যন্ত এই চিহ্ন রয়ে গেছে। 'এই জগতে শয়তান আমার ভাই ও মহাপ্রভু, এই জগতে আমি শয়তানের ভাই...' কতবড় শক্তিশালী, স্পষ্ট এবং ভয়ধরানো কথা! বিলজিবাব বা লুসিফার বা রাজিম (বিতাড়িত), ইবলিশ (অহঙ্কারী)... পপুলার কালচারে আমরা যে ভয়ানক ছাগলমাথার প্রাণী দেখি, সেটাও সরলার্থে শয়তান হিসাবে পূজিত। এমনকি ডিসি কমিকস বা সিনেমার হেলবয় এও। শয়তান নিয়ে যথা সময়ে আলোচনার আশা রাখি। মূলধারায় কথা হোক।
আবার খ্রিষ্টিয় ধর্মে আল্লাহ নিজেকে মানুষের প্রতি অ্যাপ্রোচেবল করার চেষ্টা করেন বলে নিজের সন্তানকে পৃথিবীতে পাঠান- এমন কথা বলা হলে মুসলিমরা বলে, ঈসা আ. বরং রুহুল্লাহ। রুহুল্লাহ- অনেক ভারি একটা শব্দ। আল্লাহর পক্ষ থেকে রূহ বা আত্মা।
আল্লাহর পক্ষ থেকে রূহ বা আত্মার ধারণা শুধু ঈসা আ. তে সীমাবদ্ধ নয়। কুরআনে অনেক ক্ষেত্রে দেখতে পাই, মানুষকে মাটি দিয়ে বানানো হচ্ছে। সেই বানানো মানুষটাতে আল্লাহ তাঁর থেকে ফুঁকে দিচ্ছেন। ফুঁকে দেবার পর সে এমনকি ফেরেশতাদেরও সিজদা পাবার মর্যাদায় আসীন হচ্ছে।
এক্ষেত্রে রাজারবাগ দরবারের পীর সাহেব দ্বিমত নিয়ে বলেন, প্রথম মানব মাটির তৈরি। পরবর্তীতে মাটি নয়, বরং মানুষ তার সৃষ্টি উপাদান জৈবিকতা থেকে তৈরি। এই কথারও দ্বিমত পাই, যখন মানুষকে কবরে শোয়ানোর সময় বলা হয়, মিনহা খালাকনাকুম,... এ থেকেই তৈরি করা হয়েছে, এতেই শেষ করে দেয়া হবে, এ থেকেই হবে পুনরুত্থান।
মুসলমানরা বলছেন পুনরুত্থান, কিছু কিছু ধর্মে বলছেন পুনর্জন্ম। বেশিরভাগ মুসলমান বলছেন, পুনরুত্থান হবে শেষদিনে। বেশিরভাগ উপমহাদেশীয় ধর্ম বলছে, পুনরুত্থান চলতেই থাকবে। যে পর্যন্ত না নির্বাণ হয়।
এই নির্বাণেরই আরেক ধারণা কুরআনেও পাওয়া যায়, কুল্লুমান আলাইহা ফা'ন। অনুবাদে আমরা পড়ি, সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। ওয়াজহু রাব্বুকা যুল জালালি ওয়াল ইকরাম। শুধুমাত্র আপনার প্রতিপালকের অস্তিত্ব থাকবে অবশিষ্ট।
কিন্তু প্রকৃত অনুবাদের অর্থ কি এমন হবার কথা? কুল্লু-সবকিছু, মান- যা অস্তিত্বশীল আলাইহা-হবে ফা'ন-তার মধ্যে বিলীন/ তার মধ্যে লয়প্রাপ্ত/ তার মাধ্যমে উচ্চতাপ্রাপ্ত... ওয়াজহু- অস্তিত্ববানভাবে প্রকাশিত থাকবেন রাব্বিকা- আপনার প্রতিপালক যুল-দুই জালালি-রূপের?
আল্লাহর কী সেই দুই রূপ? এক ক্ষমাশীল তো আরেক শাস্তিদাতা? সব লয়প্রাপ্ত হলে কাকেই বা তিনি ক্ষমা করবেন আর কাকেই বা শাস্তি দিবেন? অবশ্য সব লয়প্রাপ্তের পরই যে পুনরুত্থান হবে না তা তো বলা হয়নি। অস্তিত্বশীল-অনস্তিত্বশীল? তাইবা কীভাবে বলতে পারি?
যেখানে তাঁর দেহময়তার কথা আসে, আমরা তাকে বড়জোর উপমা হিসাবে পাশ কাটাতে পারি। আবার একইসাথে কুরআনে তো এ কথাও আসে, কোন ধারণাই তাঁর ধারণা দিতে পারবে না।
তাঁর প্রকৃত পরিচয় কি এতে নিহিত যে, তিনি অমুখাপেক্ষী? তিনি আকার আকৃতিতে থাকার মুখাপেক্ষী নন- তিনি কোনকিছুরই মুখাপেক্ষী নন।
নিরাকার নিয়ে যখন কথা জমাট বাঁধে, মানুষ সেখানেই হতবিহ্বল। সেখানেই সে অধর ধরতে পারে না। নিরাকার এর অন্তত দুটা রূপ আমরা শুরু থেকে দেখি। আল্লাহ যখন মহান আলোক-দেব হিসাবে পূজ্য প্রাচীণ সব সভ্যতায়, তখন তাঁর একমেবাদ্বিতীয়ম্ প্রভূত্ব বারবার প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা দেখি আমরা সেই মিসরীয় সভ্যতায়, তারপর আরো কতশতবার! আর সব প্রভূকে প্রকটিত করা যাবে না। আর কোন প্রভূর অস্তিত্ব স্বীকার করা যাবে না। তিনি এক ও অদ্বিতীয় দেবতা, তিনিই একমাত্র পূজনীয়। তিনি সত্য-সুন্দর-আলোক-স্পষ্টতা।
কুরআনেই আমরা দেখি, তারপর মূসা আ. যখন এক আলো/আগুন দেখতে পেলেন, তিনি সেই আলোর/আগুনের দিকে ধেয়ে গেলেন। আর শুনতে পেলেন, হে মূসা আ.! আমিই আপনার প্রতিপালক!
কুরআনের এই কথাটুকুর অনুবাদ আমরা করি, ড. তাহির উল ক্বাদরীর সাথে সুর মিলিয়ে, যখন মূসা আ. নিজের ভিতর খোদাপ্রেমের আলো দেখতে পেলেন অথবা যখন তিনি সত্যি কোন আলো দেখতে পেলেন অথবা যখন তিনি সত্যের সন্ধান পেলেন। তিনটা অনুবাদই আমাদের কাছে চরম গ্রহণীয় হয়ে আসে, চরম যুক্তিগ্রাহ্য, সত্য, সুন্দর হয়ে আসে।
আর হাদীসে এর সমার্থকতা পাই, তাঁকে দেখার তাড়নায় মূসা আ. তূর পাহাড় জ্বালিয়ে দিচ্ছেন, কথিত সত্তর হাজার নূরের বা আলোর পর্দা থেকে একটা মাত্র সরানোয় সব যাচ্ছে জ্বলে।
মূসা মূর্ছা হল দেখে নূরে উজালা।
এই এক ও অদ্বিতীয় আলোর পথে হাঁটার জন্য যুলকারনাইন বা আল ইস্কান্দার বা সিকান্দার বা আলেক্সান্ডারের পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ঘোরা। এই আলোককেই একমাত্র উপাস্য হিসাবে বিবেচনা করে জরোআস্ত্রিয়ান বা জরথ্রুষ্ট ধর্মের আবহ দেখতে পাই। দেখি, জেন্দাবেস্তার মহান ধারক এর যত ছবি আছে, সব ছবিতে তাঁর মাথার চারদিকে আলোর বলয়। দেখি, সেই আলোর বলয় আস্তে আস্তে প্রকৃপক্ষে অগ্নিপূজায় পরিণত হয়। আর অগ্নিপূজায় পরিণত হবার পর কাইসার অথবা কিসরার প্রাসাদে আগুন জ্বলে 'হাজার' বছর যাবৎ। এবং দেখি, বাতিঘরের ধারণা মূলত আগুন পূজার ধারণা থেকে শুরু হয়। আবার শুনি, রাসূল দ.'র আগমনের পরপরই পারস্যের প্রাসাদের হাজারো বছরের আগুন যায় নিভে। আবার অখন্ড কল্যাণের ধারণা অগ্নিপূজার রূপ নিয়ে আমাদের উপমহাদেশের সনাতন ধর্মে প্রাবল্য পায়, সেখানেও অগ্নিকে প্রত্যক্ষ রেখে বিবাহের রীতি বা অগ্নিতেই লয়। অগ্নির সাথে আলোর যে মিল, সেই সূত্র ধরে দেবতারূপে অধিষ্ঠিত হয় সূর্যও। এসবের পিছনে পুরোটাই যে একেশ্বরের খোঁজ বা সেখান থেকে অপভ্রংশ, তা নাও হতে পারে। হতে পারে মানুষ সহজাত নিরাপত্তাবোধের কারণে আগুন-সূর্য-আলোক বন্দনায় রত।
দেখি, মহামতি বুদ্ধের মাথার পেছনে আলোর থালা। দেখি শেষবুদ্ধ মেত্তেয় বা মৈত্রেয়র চারপাশেও আলোকমালার বাতাবরণ। হ্যাভেলস লাইটের একটা অ্যাড মনে খুব দাগ কেটেছিল। এক বাচ্চা ছেলে বই পড়ছে, বৌদ্ধিক পোশাক আর শুভ্রতা তার চারধারে। মাথা ও শরীরের উর্দ্ধাংশ থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে আলো। সবাই তাকে স্বাগত জানানো শুরু করে সাষ্টাঙ্গে। পরে দেখা যায়, ছেলেটার পিছনে হ্যাভেলস লাইট জ্বলছে। এইযে মেত্তেয়র জন্য প্রতীক্ষা এবং মেত্তেয়র আলোকময়তা- আমাদের আপ্লুত করে।
কুরআনে আল্লাহ বহুবার নিজেকে আলো বলেছেন। বহুবার নিজেরটুকুকেও আলো বলেছেন। নিজের প্রেরিত পুস্তককেও আলো বলেছেন। নিজের প্রেরিত নবী-রাসূলদের আলো বলেছেন। নিজের প্রেরিত ধর্মকে আলো বলেছেন। ফেরেশতাদের তো আলোক বলেছেনই।
আল্লাহু নূরুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ্ব- আল্লাহ আকাশ সমূহ এবং জমিন সমূহের আলোক। কতবড় কথা! এতবড় কথাকে লিটারালি নিতে গিয়েই কি চারশো বইয়ের লেখক মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবী বলে বসলেন, আল্লাহ সর্বব্যাপী! একটা পর্যায়ে সূফিরা বলা শুরু করলেন, বা আগে থেকেই বলছেন, লা মাওজুদা ইল্লাল্লাহ। কতবড় কথা! আল্লাহ ছাড়া কোনকিছু অস্তিত্বশীল নয়... তাহলে যা দেখি আর যা দেখি না তার সবই কী করে তিনি হন? এই ধারণা প্রাচীণ নানা ধর্মে নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে। প্রাচীণ সনাতন ধর্মেও এর দ্যোতনা প্রতিভাত হয়।
আবার সনাতন- কোন প্রতিমা তার ধারণাকে ধারণ করতে পারে না। এবং তিনি নিরাকার, এই দুই ধারণার সাথেও হুবহু মিলে যায় কুরআনের দুই আয়াত। বাইবেলের লেট দেয়ার বি লাইট তো কখনো ভোলার উপায় নেই।
আল্লাহ- এই একটা শব্দের মধ্যে স্রষ্টা বা ক্রিয়েটর, প্রতিপালক বা নারিশার-চেরিশার সহ ন্যায় বিচারক ও সমস্ত গুণ নিহিত রয়। এমনকি বিসমিল্লাহর যে বি-ইসমি, এই ইসমি বা নামও নাকি তাঁরই নাম।
তো এই আলোকের ধারণা যখন আরো দৃঢ় হয়, তখন আমরা দেখি, আ'লা হজরত আহমদ রেজা খান বেরলভী তাঁকে নূর বলছেন, নূর বলছেন অতি প্রাচীণ সূফিরাও। তাঁকে নূর বলা হচ্ছে অসংখ্য হাদীসেও। আবার নূরের বিষয়ে সাবধানতাও দেখি। ড. তাহির উল ক্বাদরী যেমন আল্লাহকে সরাসরি নূর বলতে সাবধান, তেমনি সাবধানতা গভীর তাত্ত্বিক জ্ঞানের কাল্ট রাজারবাগে। আল্লাহ নূর হওয়া থেকে পবিত্র, কেননা, নূর একটা সৃষ্টি। তিনি সৃজিতর মত হওয়া থেকে পবিত্র।
আল্লাহ আবার সুস্পষ্টভাবে বলছেন, তোমরা সময়কে গালি দিও না, কারণ আমিই সময়। তিনিই সময়! এর মাত্রিক ব্যাখ্যায় দেখতে পাই, মাত্রাসমষ্টি যে মাত্রার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়, সেটাই ওই মাত্রাসমষ্টির জন্য সময়। অন্যভাবে বলতে গেলে, সময়কে আল্লাহর প্রকাশ হিসাবে দেখলে যা কিছু ঘটে তা তাঁর সক্রিয় অথবা নিষ্ক্রিয় অনুমোদনের ভিতর দিয়ে ঘটে।
আল্লাহ নিয়ে ভাষাগত অদক্ষতায় ভুলভ্রান্তিরও সীমা নেই। আল্লাজী- শব্দটা প্রখরভাবেই উপমহাদেশে প্রচলিত।
হাসন রাজার আমি না লইলাম আল্লাজীর নামরে, আমি না করলাম তার কাম... এই কথাটার সাথে কি আল্লাজি/আল্লাজিনাহুম এই ধরনের শব্দের কোন মিল আছে? থাকতেও পারে। ভুল অর্থ। লালনশাস্ত্রে কুল্লিশাইয়িন ক্বাদির, কুল্লিশাইয়িম মুহিত এর মানে করা হয় এরকমভাবে, সকল সাইখরা আল্লার ক্ষমতাবলে ক্ষমতাবান, সকল সাঁই বা শাইখরা তার ক্ষমতাবলে সর্ববেষ্টনকারী।
এতো ভুল অনুবাদ। সঠিক অনুবাদেও আমরা হয়রান হই। দেখি, কুল্লি সাইয়্যিম মুহিত এর মানে দাঁড়ায় সর্ববেষ্টনকারী। আল্লাহ যদি সর্ববেষ্টনকারী হয়েই থাকেন, তাঁকে সর্বত্র উপস্থিত মানতে সমস্যা কোথায়। তাঁকে সর্বত্র উপস্থিত মানার জন্য অবশ্য আরো আয়াত রয়েছে। বান্দার ধমনী থেকেও আল্লাহ অধিকতর নিকটে অবস্থান করেন। আয়াত রয়েছে, আল্লাহর রাসূল দ. মুমিনের প্রাণ থেকেও নিকটে অবস্থান করেন। আয়াত রয়েছে,
আল্লাহর নূরের উপমা এমনি, যেমন এক দীপাধার (যাকে খলিফা উমার রা. বলছেন বুক, আমরা অনেকেই অনুভব করছি বুক বা দেহ হিসাবে।) এর ভিতরে এক ফানুস, মুক্তার মত জ্বলজ্বলে (হার্ট।) এর তেল যা নিজে জ্বলে না অপরকে জ্বালায় (অক্সিজেন), এই তেল আসে এমন যাইতুন/অলিভ গাছ থেকে যা প্রাচ্যেও পাওয়া যায় না, প্রতীচ্যেও না (বৃক্ষাকৃতির ফুসফুস) এবং সেই হার্টের ভিতরে, সেই জ্বালানীর মাধ্যমে যে নূর জ্বলে, সেটাই আল্লাহর নূর।
আল্লাহর ফুৎকার যে রূহ রূপে আদমকে প্রজ্বলিত করে, তা তো আমরা দেখিই। সেই একই কথার দ্যোতনা এখানেও।
আলো বা নূর এর ধারণা ইসলামেও প্রখর। তাই বুখারী শরীফে রাসূল দ. কে বলতে শুনি, হে আল্লাহ, আমার ডানে নূর দান করুন, বামে নূর দান করুন, সামনে নূর দান করুন, পিছনে নূর দান করুন, উপরে ও নিচে নূর দান করুন। নূরে নূরান্বিত করুন।
কিন্তু সব আলোই কি তিনি?
তা নয় বলেই হয়ত এই আয়াত, নূরুন আলা নূর।
আলোকের উপর উচ্চতাপ্রাপ্ত আরো আলোকমালা রয়েছে।
যে ঈশ্বর প্লেটো থেকে আইনস্তাইন পর্যন্ত বিশ্বাসী বিজ্ঞানীদের কাছে নিষ্ক্রিয় পর্যবেক্ষক ও সংঘটনের উৎস, সেই ঈশ্বরই রবীন্দ্রনাথের কাছে পূর্ণ অস্পৃশ্য। তাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, এমনকি অনুভবও করা যায় না। শুধু নয়নে নয়নে রয়। নজরুলের কাছে আবার তিনিই বিরাট এক শিশু। আনমনে খেলতে থাকা। লালনের কাছে তিনি এমনি এক পড়শী, যাকে একদিনও দেখা যায় না। নিজের প্রতিকৃতির আয়না-শহরে লুকায়িত। আবার এই লালনেই তিনি কত না রূপে প্রতিভাত! কখনো ইলাহাল আলামীনগো আল্লাহ বাদশা আলমপনা তুমি! তুমি ডুবায়ে ভাসাতে পার। ভাসায়ে কিনার দাও তারো। রাখো মারো হক তোমারো। তাইতে তোমায় ডাকি আমি! আবার এই নিরম্বু আল্লাহকে যখন লালন ধরতে পারছেন না, তখনি আশ্রয় নিচ্ছেন মাধ্যমের। আইন ভেজিলেন রাসূলআল্লাহ, মনরে পড় সদায়, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। লা শারিক জানিয়া তাকে, পড় কালাম দেলে মুখে। মুক্তি পাবে থাকবে সুখে। দেখবিরে নূর তাজাল্লা। তাই ইলাহাল আলামীন রূপে লালনের আল্লাহকে আমরা পাই চরম প্রতাপশালী রূপে যার কাছে অসহায় সমর্পণ ছাড়া কিছু করার নাই। আবার সেই অননুভবীয় আল্লাহকে তিনি যখন রাসূলাল্লাহর স্রেফ আদেশ রূপে পান, সেখানেও হয়রান হয়ে যাই। এই দুইটা রূপেই ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহকে চিনি। সুপ্রিম মহাপ্রভু। যিনি বর্ণিত হন প্রেরিতর মাধ্যমে। তারপরও লালনের মেটে না। অচিন পাখির কনসেপ্টে নিজেকে তার সাথে যুক্ত করেন। পারলে তিনি শেকল দিতেন পাখির পায়। পারলে রূপটা দেখে নিতেন।
আবার যখন তিনি তুমি আপনি আল্লা ডাকো আল্লা বলে! কে জানে তোমার অপার লীলে! বলেন, তখন সব চুরমার হয়ে যায়। ভয় পেয়ে দগদগে বেপরোয়া আগুন থেকে মানুষ যেভাবে পালায়, আমরাও এই কথা, এই ধারণা থেকে পালাই। কত সহজেই লা মওজুদা ইল্লাল্লাহর সড়গড় বয়ান দেয় মানুষ, যত কল্লা তত আল্লা বলে। যত কল্লা তত আল্লা সুস্পষ্ট অংশীবাদীতা- যদি এর অংশীবাদীতা ভিনে অন্য কোন ব্যাখ্যা অতি স্পষ্টভাবে না থেকে থাকে।
কোথায় অংশীবাদ আর কোথায় খোদায়ী রহস্য তা অভেদরূপে দৃষ্ট হয় রূমীর নারী পুরুষ তো বাহানামাত্র, খোদা স্বয়ং নিজেই নিজের সাথে প্রেমলীলায় মত্ত- এই আজব বয়ানিতে। এই আজব বয়ানি আবার সেই সর্বেশ্বরবাদে নিয়ে যায়, সর্বভূতে বিরাজমানতায় নিয়ে যায়, অথবা নিদেনপক্ষে ব্রহ্মার স্বপ্নের বালুচরে সমুদ্রের জলরাশিতে ভাসতে থাকা মায়ায় অথবা নজরুলের বিরাট শিশু, আনমনে তে নিয়ে যায়।
আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম, আমাকে খাওয়াওনি। আমি বিবস্ত্র ছিলাম, বস্ত্রাবৃত করোনি। এই কথামালায় অথবা মুমিন আল্লাহর নূর দিয়ে দেখে আর আরিফ আল্লাহর চোখ দিয়ে দেখে। আরিফের হাত আল্লাহর হাত হয়ে যায় আরিফের পা আল্লাহর পা হয়ে যায়- এইসব কথায় যত না আক্ষরিকতা পাই, তারচে বেশি পাই প্রতীকতা।
শেষপর্যন্ত আল্লাহকে, আল্লাহর বর্ণনাকে স্রেফ প্রতীকতায় পর্যবসিত করতে হয়। যেমনভাবে বৃহদ কুলবৃক্ষ পরিণত হয় সমগ্র সৃষ্টিজগতে... তেমনিভাবে আরশিল্লাহ, কুরসি, লওহ কালাম পরিণত হয় অঘ্রাণিত ধারণায়।
আর আল্লামা ইকবালের মুহাম্মাদের প্রতি যদি সানুরাগ আনুগত্য করে থাক তো আমি তোমার, এই সৃষ্টিজগত আর কীইবা? লওহ-কলম তোমার... এই কথার দ্যোতনায় সেই অব্যাখ্যাত আল্লাহর রহস্য মুহাম্মাদি চাদরে, মুহাম্মাদি জবানিতেই লুক্কায়িত।
এই কারণেই কি প্রতিনিধির বাক্যই প্রভুর বাক্যে পরিণত?
কারণ তাঁর অনুভূতি ধারণ করা অবাস্তব, অগ্রহণযোগ্য...
এই কারণেই কি-
কালিমের (মূসা কালিমউল্লাহ) কামনা নয়,
নয় তূরে সিনা'য় উচ্চারিত বাসনা (আল্লাহকে এ লোকেই স্বচক্ষে দেখার সাধ),
আমার কামনা মুহাম্মাদ,
আমার প্রতীক্ষিত আবাসস্থল মদীনা?
কথিত খোদারহস্যভেদী মানবসকল বা আরেফিন বা আরেফগণ বা নির্বাণপ্রাপ্ত সাধুগণ বা কামিল বা ফানাফিল্লাহ বাকাবিল্লাহগণের বিষয়ে এই কথা,
ইন্দাহা জান্নাতুল মা'ওয়া... সেই মহা বড়ইবৃক্ষ সিদরাতুল মুন্তাহার পাশেই আছে জান্নাতুল মা'ওয়া। এমন এক বেহেস্ত, যা পৃথিবীতেই আছে? কারণ সিদরাতুল মুন্তাহাই তো সৃষ্টিজগত হওয়ার কথা। সিদরাতুল মুন্তাহা বহুশাখাবিভক্ত। বহু তার ফল। ঠিক যেমন সৃষ্টিজগত। সিদরাতুল মুন্তাহা পেরুতে পারে না জিব্রাইল, কারণ কি এই যে, সৃষ্ট সৃষ্টি পেরুতে পারে না? এই কারণেই কি রাসূল দ. কে বলতে শুনি, আমার ঘর আর আমার মসজিদের মিম্বর, এই দুই ও তার মধ্যবর্তী অঞ্চলই জান্নাতুল মাওয়া? এই কারণেই কি আমরা বলি, জান্নাতুল মাওয়া মদীনা? এরই আরো অতুল সমাধান দেন গাউসে আজম আবদুল ক্বাদির জিলানী রা. এই বলে যে, আরিফ বা খোদাতত্ত্বজ্ঞাত মানুষ যে অবস্থানে থাকে, তার সেই মানসিক অবস্থানই জান্নাতুল মাওয়া। যা এই পৃথিবীতেই প্রাপ্য?
খোদার পরিচয় বিষয়ে, খোদার রহস্য বিষয়ে যার মন শান্ত হয়, যার সমস্ত তৃষ্ণা মিটে যায়, তাকেই কি সবচে প্রশান্ত বলা যায়? আর জান্নাতের কনসেপ্ট তো শান্তিরই কনসেপ্ট। এই কি এই পৃথিবীতেই শান্তিতে থাকা... হয়ত।
শেষ পর্যন্ত আমি শুধুই আল্লাহ বলতে এক মহামহিম প্রভু আছেন যার কোন অংশী নেই এবং যিনি সর্বক্ষমতাবান তার দাস আমি ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, এই কনসেপ্টে বিশ্বাস রাখি।
একটু শান্তি পাই শুধু সেই ভাবনায় যে, আমার করে ফেলতে হবে না। আমার হাতেই সব নয়। নাটাই অন্য কারো হাতে।
এই লেখাটা ক্লান্ত হয়ে নিজের জীবন থেকে পালানোর আরেকটা প্রয়াস। শুধুই ভাবনার প্রকাশ। প্রথম পোস্ট শেষ। এবার দ্বিতীয়টা। 'কবিতা'য় কুঞ্চিত হই। কুণ্ঠিত হই। লজ্জিত এবং চিন্তিত হই। তারপরও মাঝে মাঝে লিখে ফেলি। ফেলে দিতে চা্ই, মায়া লাগে। কবিতার জন্য আলাদা পোস্ট রাখতে বিব্রত লাগে। উপরের বিষয়টা নিয়ে মন্তব্য করলে ভাললাগবে। কৃতজ্ঞ লাগবে। আর কবিতাটা নিয়ে কিছু বললেও সলজ্জ কৃতজ্ঞতা রইবে। যেকোনকিছু। নিজের ভিতর থেকে টেনে টেনে অক্ষর বের করলে এক ধরনের শান্তি লাগে। নিজের কাছ থেকেই পালানো যায়। পলায়নের দ্বিতীয় কিস্তি:
অরিন্দমের সাতকাহন
আমি সকল সম্ভাবনাকে এলিমিনেট করেছি,
ছোট ছেলেকে এলিমিনেট করার সময় সে
ইনিয়ে বিনিয়ে ট্রাফিক পুলিশের হাত ধরে
কী যেন বলছিল!
ছি! মাঝরাস্তায়?
তবু এটার ছিরিছাঁদ ভালই-
বড়টাকে তো চেনাই যেত না।
পথে পথে ঘুরত।
না তারে, না সে কাউরে চিনত।
বড় দয়া করেছি। ওটাকেও।
মারিয়াকে এলিমিনেট করেছি নিতান্ত বাধ্য হয়ে।
এ কাজটা আমাকে কষ্ট দিয়েছিল খুব।
তবু। ভবিতব্য বলে কথা!
মারিয়া মানুষটা ভালই ছিল।
শান্তমুখে উল-বোনা উল-বোনা নাম তার।
তবু। মেয়েতো! দিলাম এলিমিনেট করে।
হুহু। বহুকষ্টে ভবিতব্যকে এলিমিনেট করেছি।
জানি তো। ভবিষ্যত হল একটা-
অ্যাবোমিনেশন। মাইগ্রেন।
জানিনা আবার? ভবিতব্য হল অনেক সময় ধরে-
প্রস্ফুটিতব্যর জন্য প্রতীক্ষা। তারপর-
অতি অল্প সময়ের জন্য সেই প্রতীক্ষিত ক্ষণ আসা।
তারপর অতি দ্রুত ক্ষয়। জড়তা। হায় পাখি!
তোর ভবিতব্যে তীব্র ওড়াওড়ি-
ছিল মাত্র দিন কতকের, পালক ধূসর, পাখি বুড়ো, যায় ওড়ার কথা,
সেও পঁচে সার হয়ে রয় মাটির তলায়?
কুল-জাম হয়ে জন্মায়? জানিতো। এইজন্যই
আমি ভবিতব্যকে এলিমিনেট করেছি।
সকল সৌন্দর্য ক্ষণস্থায়ী
সকল সৌকর্যের প্রতীক্ষা দীর্ঘস্থায়ী
সকল সৌম্যের পচন চিরস্থায়ী
হ্যালিলুইয়া!
তাই প্রত্যাশা আর সুখকে গলাটিপে এলিমিনেট করেছি!
ওরা অপেক্ষা করায় অনেক বেশি,
দেয় সামান্যই,
আর চলে যায় অপ্রত্যাশিতভাবে
যাবার সময় একটা গর্ত কোথায় যেন রেখে যায়। অমোচনীয়।
আমি সবকিছুকে এলিমিনেট করেছি-
শুধু দুইটা স্বচ্ছ্ব ডানা নিয়ে একটা কী যেন নেচে বেড়ায় সামনে।
শুভ্র। ছোট্ট। বেপরোয়া।
উৎসর্গ:
আল্লাহতত্ত্ব- রাফাত নূর, ঘুড্ডির পাইলট। প্রিয় ঘুপাভাই।
অরিন্দমের সাতকাহন- হাসান মাহবুব। হামাভাই। অন্তর্যাত্রার যাত্রী।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ৯:২৮