ধর্ম ডাকে। দেশ ডাকে।
'হেফাজতে ইসলাম' আন্দোলনের অণু-পরমাণুর ভিতরে বাইরে ভ্রমণে তাই স্বাগত।
৬ এপ্রিল বাংলাদেশের বুকের উপর আগুন জ্বালানোর হুমকি দিয়ে ভেঙে পড়ছে হেফাজতে ইসলামের নামে অচেনা এক আতঙ্ক । অথচ আমরা তার সঠিক পরিচয়টুকুও হয়ত অবগত নই। অবশ্যই, এই পোস্টের কোন মেধাসত্ত্ব বা কপিরাইট থাকছে না।
উল্লসিত জামাতের দুটি জাতীয় পত্রিকা । অন্যদিকে লুক্কায়িত জামাতি ব্লগ উল্লাসে তাদের অভিহিত করছে গড় নামে, ইসলামপন্থী। নামসর্বস্ব অনলাইন পত্রিকা জানাচ্ছে, গণজাগরণের সাথে বিন্দুমাত্র কথা নেই এই হেফাজতে ইসলামের। এবং আঞ্চলিক প্রণোদনা ।
কিন্তু এই মহাযজ্ঞের উৎস নিয়ে কথা থেকে যায় অপাঙক্তেয়। এমনকি মূলধারার অন্যান্য মিডিয়া পিঠ বাঁচাতে ব্যস্ত। ব্লগারমাত্রই কলঙ্কিত। বাঙালিমাত্রই দোষী। তার শাস্তি চাই! হুংকার দেশে-বিদেশে ।
পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ? এত শক্তি কি আসলেই সম্ভব? আর এই বিশাল বিস্তৃতির শক্তিটা কোথা থেকে এল?
আটটি ভাগে বিভক্ত এই গাণিতিক আলোচনায় আমরা আগামীকাল থেকে ভ্রমণ শুরু করব। হাজির হব শত বছরের অতীতে। খুঁড়ে আনব ইতিহাসের পাতা থেকে আধুনিক ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের চুলচেরা অলিগলি। তারপর, হয়ত, উঠব শিউরে।
প্রথম ভাগ: সাম্প্রতিক দৃষ্টি
৬ এপ্রিল কিছু মানুষ রওনা হচ্ছেন সারাদেশ থেকে। পিলপিল করে এগিয়ে আসছেন অনেক মানুষ। তাদের অনেকেই প্রকৃপক্ষেই ভাল মানুষ। ধর্মভীরু। কিন্তু তাঁরা জানেন না, কোন জাল বুনে যাচ্ছে সবার অলক্ষ্যে। গড়ে তুলছে ভয়ানক সংঘাতের পথ। তেরো দফার সরাসরি কিছু কোট ও তার বিশ্লেষণ থেকেই শুরু হোক,
৩. কথিত শাহবাগি আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয় নবী (সা.)-এর শানে জঘন্য কুৎসা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা।
৪. ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।
৫. ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা।
৭. মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা।
৮. জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে মুসল্লিদের নির্বিঘ্নে নামাজ আদায়ে বাধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ এবং ওয়াজ-নসিহত ও ধর্মীয় কার্যকলাপে বাধাদান বন্ধ করা।
১০. পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত এনজিও এবং খ্রিষ্টান মিশনারিগুলোর ধর্মান্তকরণসহ সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।
১১. রাসুলপ্রেমিক প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র ও তৌহিদি জনতার ওপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং গণহত্যা বন্ধ করা।
১৩. অবিলম্বে গ্রেপ্তারকৃত সব আলেম-ওলামা, মাদ্রাসাছাত্র ও তৌহিদি জনতাকে মুক্তিদান, দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং আহত ও নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণসহ দুষ্কৃতকারীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। বিজ্ঞপ্তি।
এই দফার এই ভয়ানক বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন, কোট থেকেই বলা হোক- ক. শাহবাগের আন্দোলন কথিত। এবং এর নেতৃত্বে আছে নাস্তিকরা। এবং যারা আন্দোলন করছে তাদের শাস্তি দিতে হবে।
খ. মোমবাতি জ্বালানো যাবে না।
গ. নারী পুরুষ রাস্তায় চলতে পারবে না।
ঘ. মসজিদে এর আগে তারা যা করেছে তা করতে দিতে হবে (দাবীটা আসলে তাই)।
ঙ. তাদের কাছে যা 'কথিত', আমাদের কাছে তা প্রাণের দাবী। শাহবাগের আন্দোলন জামাতে ইসলাম ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে।
চ. সংঘর্ষ ছিল জামাতের বিরুদ্ধে। তারা রাসূলপ্রেমী তৌহিদী জনতায় রূপান্তরিত। তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
ছ. আলেম ওলামা (সাঈদী, নিজামী, কাদের মোল্লা, মুজাহিদ- এদের নামের সাথে আছে আলেম ওলামা) দের মুক্তি দিতে হবে। মাদ্রাসা ছাত্র দের মুক্তি দিতে হবে (শিবিরের একটা বড় অংশ তামিরুল মিল্লাত, বিভিন্ন আলিয়ার ছাত্র)।
এবার আসুন, সাম্প্রতিক ফ্ল্যাশব্যাকে।
ক. জাতীয় পতাকায় আগুন, বিভিন্ন অগুণতি শহীদ মিনারে ভাঙচুর। শহীদ মিনারও যে তাদের চোখে ভাষ্কর্য তা স্পষ্ট। এই কাজটা যতটা শিবির করেছে তারচে বেশি করেছে প্রকাশ্যে এই 'হেফাজতে ইসলাম'। এই কিছুদিন আগে, 'কওমী' নাম নিয়ে। এই শফি সাহেবের অধীনেই। এই কওমী চেইন অভ কমান্ডের অধীনেই।
খ. জাতীয় মসজিদে কওমী সমাজ (টুপিতেই স্পষ্ট) সাম্প্রতিককালে তিনবার ভয়ানক জিঘাংসা চালায়, ১. জাতীয় মসজিদের খতিবের খবর পাবার পর। ২. খতিব নামাজ পড়ানো যেদিন শুরু করেন সেদিন জুতা নিক্ষেপ ও মারপিট। ৩. যেদিন কওমী আলিমরা ঘোষণা দিলেন, চার লক্ষ মসজিদ থেকে একযোগে মিছিল আসবে, সেদিন। আগুন সংযোগ, গুলি চলে সাংবাদিক ও পুলিশদের উপর অকথ্যভাবে জাতীয় মসজিদ থেকেই।
দ্বিতীয় ভাগ: কারা এই 'হেফাজতে ইসলাম'
হেফাজতে ইসলাম। আপাতদৃষ্টিতে নিরপেক্ষ একটা মোর্চা। কিন্তু আমরা কি সচেতন যে, সুনির্দিষ্ট এই এঁদেরই আছে-
* বাংলাদেশে অন্তত তিনটা রাজনৈতিক দল। একটা গত সরকারে, জামাতের শরীক।
* বাংলাদেশে ও সমগ্র উপমহাদেশে অন্তত তিনটা অ্যাক্টিভ জঙ্গী সঙ্গঠন। তার মধ্যে একটা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নামিয়ে এনেছিল বিপর্যয়।
* আবার বাংলাদেশেরই সবচে বেশি নিরপেক্ষ মনোভাবের দাওয়াতী সঙ্গঠন, সবচে বড় সমাবেশ করার রেকর্ড।
* বিশাল একটা জনশক্তি, যারা না জেনে বা অর্ধেক জেনে এর পেছনে ছুটছেন। জামাত-শিবিরের মত জেনেশুনে বুঝে পাপ করা নয়। সবচে বেশি মসজিদের নেতৃত্ব, সবচে বেশি মাদ্রাসার বু্ৎপত্তি। এরাই অতি সম্প্রতি সরকার থেকে তাদের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য সব ধরনের সুবিধা আদায় করেছেন।
হ্যা।
দারুল উলুম (জ্ঞানের দরজা) দেওবন্দ থেকে এর শুরু। তাই তাঁদের দেওবন্দী বলা হয়। বলা হয় 'ক্বওমী', মাদ্রাসার দরুণ। তাদের মাদ্রাসা ব্যবস্থাপনা প্রচলিত অন্যগুলো থেকে ভিন্ন। বলা হয় 'তাবলিগ' কারণ দাওয়াতে তাবলীগ তাঁদেরই প্রতিষ্ঠান।
আল্লামা শফী সাহেব, যাঁর নামের সাথে দা.বা. (দা'মাত বারাকাতুহু) যুক্ত করা হয়, তিনি এই হেফাজতের নেতৃত্বে। এই হেফাযতের নাম নেয়ার আগে তিনিই নেতৃত্ব দিয়েছেন কিছুদিন আগের তান্ডবে, যেখানে অনেক অনেক শহীদ মিনার ভাঙা হয়, জ্বালিয়ে দেয়া হয় বাংলাদেশের প্রাণ, জাতীয় পতাকা; আগুন দেয়া হয় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররামে, জাতীয় মসজিদের ভিতর থেকে ইট পাটকেল গুলি ও বোমা ছুড়ে আহত করা হয় এক ডজন সাংবাদিক এবং অনেক অনেক পুলিশকে। তিনি এই ব্যবস্থার সর্ব্বোচ্চ আসনে আসীন। তাঁর অধীনে এই কওমী বা দেওবন্দী বা তাবলিগি- তিন নামে একই বিষয় পরিচালিত হয় এবং এখনো হচ্ছে হেফাজতে ইসলাম নাম নিয়ে।
তৃতীয় ভাগ: অতীত কথা বলে- ভয়ানক এক ইতিহাসের প্যাটার্ন
বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু। বাংলার মানুষ ধর্মপ্রাণ। বাংলাতে মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নিজের নিজের ধর্ম নিয়ে বসবাস করছে হাজারো বছর ধরে।
মতবাদ হিসাবে নাস্তিক্যও এখানে হুমকি বা বিষয় হয়ে ওঠে না।
কিন্তু ধর্মশ্লেষ বা ধর্মদ্বেষ সব সময়ই বাংলাদেশে বিষয়।
আর এই বিষয়টা ধামাচাপা পড়ে থাকে। এই বিষয় নিয়ে যারা অনলাইনে বা অফলাইনে অষ্টপ্রহর যৌক্তিক আলোচনায় প্রতিরোধে থাকেন, তাঁরাই হয়ে পড়েন গৌণ, হঠাৎ হঠাৎ এই কওমী শক্তি নেমে পড়ে মাঠে।
ঠিক কেন?
প্যাটার্নটা লক্ষ্য করুন। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম আন্দোলন করলেন। কোন ধর্মের বিরুদ্ধে নয়। ইসলামের বিরুদ্ধে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। তিনি আন্দোলন করলেন, শুধু তাঁর সন্তানদের, রুমি সহ ত্রিশলাখের জন্য ন্যায়বিচার চাইলেন।
কার বিরুদ্ধে চাইলেন?
রাজাকার, আল বদর, আল শামস, জামাত, শিবির, একাত্তরের মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামী'র বিরুদ্ধে।
চাইলেন শুধুই বিচার। নিষিদ্ধকরণ প্রক্রিয়া।
ঠিক তখনি নাস্তিক বিরোধী আন্দোলনের নাম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, অত্যন্ত কষ্টের সাথে আমাদের লক্ষ্য করতে হয়, কওমী হাই কমান্ড।
অথচ এই ন্যায়বিচারের আন্দোলন কখনোই কওমী বা আপামর মুসলিম বিরোধী নয়।
কওমী বা সামগ্রিক মুসলিম সমাজের উপর বিন্দুমাত্র কোন দাবি ছিল না। পরন্তু এই আন্দোলনে ধর্মপ্রাণ অগুণতি মুসলিম জড়িত ছিলেন, আছেনও। এমনকি কওমীও।
এবার হুবহু সেই মধ্য নব্বইয়ের দশকের পুনরাবৃত্তি।
আবারো, ঠিক কেন?
কওমীরাতো সুস্পষ্টভাবে জামাত বিরোধী। ঠিক কী কারণে জামাতের মত বাংলাদেশে সম্পূর্ণ অপাঙতেয় একটা সাংগঠনিকভাবে যুদ্ধাপরাধী দলের পিঠ বাঁচানোর জন্য এগিয়ে দেয়া হচ্ছে, লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে অতি সাধারণ কওমী মুসলিম সমাজকে?
চতুর্থ ভাগ: বেরুলো থলের বিড়াল-আকাশ পাতাল উলটপালট
কওমী'র সাথে ধর্মীয় বিধিনিষেধে অনেক পার্থক্য জামাতে ইসলামের। এটা আমরা জানি। তাহলে মিলটা কোথায় দেখে নেয়া যাক। কোথা থেকে ফণা তোলে সাপ।
আমরা জানি, প্রতিটা কওমী মাদ্রাসায় আগে রাখা হতো ইনকিলাব পত্রিকা। সেটার জায়গা করে নিয়েছে আমার দেশ। আমার দেশ পত্রিকা সুস্পষ্টভাবে স্বাধীনতার পায়ে ছোবল মারা শক্তির অর্থে ও সমর্থনে সৃষ্ট ও চালিত। এই পত্রিকা গণজাগরণের বিপক্ষে ভয়ানক মিথ্যাচার করে জনমত তৈরি করে। আর ইসলামের জ্ঞান শিখতে বসা দরিদ্র ও নিষ্পাপ তরুণ-শিশুরা সেই মন্ত্রে উজ্জীবীত হয় কওমী মাদ্রাসাগুলোয়।
আমরা জানি, সাঈদী নামে মানুষের বিরুদ্ধে, দেশের বিরুদ্ধে হত্যা লুন্ঠন জোরপূর্বক ধর্মান্তর ও ধর্ষণের কার্যক্রমে জড়িত, অপরাধী সাব্যস্ত এক ব্যক্তির কথা। ওই ব্যক্তি শুধুই জামাতে ইসলামের প্রতিনিধি। এর বেশি কিছু নন।
সৌদি বলয়ে কওমী মাদ্রাসার গ্রহণযোগ্যতা অত্যন্ত সীমিত। কিন্তু জামাতি গ্রহণযোগ্যতা খুবই বেশি। এই সাঈদীর বেলাতেই ফুঁসে ওঠে নিরীহ সরল ও ধর্মপ্রাণ কওমীদের (যাঁরা বিষয় কিছুই জানেন না, জামাতির মত সব জেনে পাপী নয়) হাইকমান্ড।
কারণ, অর্থ। কওমী মাদ্রাসা সিস্টেম মূলত চলে দানের উপর। দেশীয় দান যেমন আছে, তারচে কম নয় সৌদি বলয়ের দান। আর সেই টাকাটা শুধুমাত্র সাঈদী ও তাঁর বলয় হয়ে আসতে পারে। অর্থাৎ, কওমী মাদ্রাসা সৌদি বলয় থেকে যত টাকা সহায়তা পাবে, তার পুরোটা আসবে জামাতের হাত হয়ে। জামাত সেখান থেকে সুনির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ কেটে রেখে তারপর মাদ্রাসাগুলোতে দেবে।
এই অর্থ যাবে জামাতের ফান্ডে। আমরা জানি, দারিদ্র্য ইসু, প্রযুক্তি ইসু, প্রাকৃতিক দূর্যোগ ইসুর মত মাদ্রাসা শিক্ষা ইসুতেও সৌদি বলয়ের টাকা আসে শুধুমাত্র জামাতি ব্যাঙ্ক হয়ে এবং জামাত নিজের সম্ভাব্য মত অর্থ সেখান থেকে সাংগঠনিকভাবে কেটে রেখে বাকী সম্ভাব্য অর্থ মূল ক্ষেত্রে অনুদানের রূপে প্রকাশ করে।
এই নিয়ে অনেক বিতন্ডা, অনেক দ্বিমত, এমনকি মাদ্রাসা পর্যায়েও রয়েছে।
পঞ্চম ভাগ: উপমহাদেশীয় কানেকশন্স-আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান
তালিবান। আপাত নির্দোষ একটি আরবি-ফার্সি-উর্দু-পশতু শব্দ। ত্বালিব অর্থ সন্ধানী, অনুসন্ধানী, অনুসন্ধিৎসু। প্রচলিত অর্থে ত্বালিব/ তালেব/ তালেবুল এলেম অর্থ জ্ঞান সন্ধানী। আরো প্রচলিত অর্থে তালেব মানে মাদ্রাসার ছাত্র এবং তালেবান মানে মাদ্রাসার ছাত্রগণ।
পাকিস্তানি জেনারেল জিয়াউল হক ক্ষমতা নিলেন। কওমীর আরেক নাম জমিয়াত উল উলেমা'র সাথে সোভিয়েত আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য ভবিষ্যত তালেবানের নেতা মোল্লা ওমর সহ ট্রেইন করালেন এক লক্ষ পাকিস্তানি-আফগান মুজাহিদকে। পরিণত হলেন ইসলামের নামে ভীতি সঞ্চারক বৈশ্বিক জিহাদের গ্র্যান্ড ফাদারে।
তিনি তখনো জানতেন না, কোন্ দানব সব পোড়ানোর পথে এগুচ্ছে গুটিগুটি পায়ে।
তিনি তখনো জানতেন না, বিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকার লোভে এবং আদর্শের কথায় চেতনালুপ্ত যে মানুষগুলো রওনা দিল বার্মা-আরাকান-বাংলাদেশ-ভারত এবং মূলত পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানের পথে, তাঁরা ঠিক কোন প্রত্যাঘাত নিয়ে আসবে পুরো মুসলিম কমুনিটির পাশাপাশি পুরো দক্ষিণ-মধ্য এশিয়া এবং ফলত পুরো পৃথিবীতে।
সৌদিদের পক্ষ থেকে যুক্ত হল আল ক্বায়িদাহ্ বা ঘাঁটি নামের এক ভবিষ্যত শক্তির প্রধান, ওসামা বিন লাদেন। আদর্শিক দিক দিয়ে যাঁদের পার্থক্য অনেক, কিন্তু ভবিষ্যতে এই একটা একক লড়াইর ক্ষেত্র তৈরি করবে এক ভয়ানক অ্যালায়েন্স, পুড়ে ছাই হবে সব।
১৯৯১ সাল। জমিয়াত উলামা ই ইসলাম তথা কওমী ঘরানার হাত ধরে জন্ম নিল তালিবান । এর মূল নেতৃত্বে ছিল মোল্লা ওমরের হাত। আর তার সঙ্গী অজস্র আফগানফেরত কওমী যোদ্ধা।
মোল্লা ওমর, পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ যা বর্তমানে খাইবার পাখতুনওয়ার প্রদেশ নামে পরিচিত, সেখানটার বিশাল মাদ্রাসা দারুল উলুম হাক্কানিয়া বা জামিয়া হাক্কানিয়া'র ছাত্র। সরাসরি দেওবন্দের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার মত করে গঠিত জামিয়া হাক্কানিয়া'র গঠন, কাজ ও সবকিছুই কওমী তথা দেওবন্দী।
এই সেই হাক্কানিয়া মাদ্রাসা, যার দেয়ালে দেয়ালে ট্যাঙ্কের ছবি আঁকা ছিল ত্রিশ বছর আগে থেকেই। আজো এর দেয়ালে দেয়ালে একে ফোর্টি সেভেনের চিত্র। ত্রিশ বছর যাবৎ সত্যসন্ধানী সরল ছাত্র জামিয়া হাক্কানিয়া মহাবিদ্যালয়ে পড়তে এসে বড় হয় যুদ্ধের ট্রেনিং পেয়ে। তারপর তারাই পরিণত হয় তালিবানের উচ্চতম নেতায়।
তালিবান, এর প্রতিটা লিডারের উত্থান জামিয়া হাক্কানিয়া থেকে। তালিবানের প্রত্যেক ছাত্র কওমী মাদ্রাসার সরলপ্রাণ মানুষ। যারা একটা পদ্ধতিতে পড়ে গিয়ে পরিণত হয় মানুষ হত্যার দানবে।
১৯৯১ সাল। মাত্র ৫০ জন ছাত্র নিয়ে তাদের সম্মানিত শিক্ষক মোল্লা ওমর গঠন করেন ছাত্রবৃন্দ, তালেবান। তারপর মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবথান। ১৯৯৬। অনেক স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিক্যাল আর বাজুকা, কালাশনিকভ রাইফেল নিয়ে বিদ্ধস্ত কাবুল দখল করে তালিবান। তখন তার যোদ্ধাসংখ্যা সহস্র সহস্র। মাত্র পাঁচ বছরে।
এ শুধু ভিনদেশের আজব ইতিহাস নয়। এ এক অশনিসংকেত।
আসুন, শিউরে উঠি। তালিবান ক্ষমতা দখল করেই হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যা করে, তাদের অভিযুক্ত করে, নাস্তিক হিসাবে।
ঠিক এখনকার হেফাজতে ইসলামের মত করেই, মূর্তি ধ্বংসে মেতে ওঠে। কী দোষ ছিল পাহাড়ে আঁকা বৌদ্ধমূর্তির? দেশ দখল করলেই অন্য ধর্মের প্রতীক ধ্বংস করতে হবে?
ঠিক এদের মত করেই, ঘোষণা করে, নারী রাস্তায় বেরুতে পারবে না। বোরখা পড়েও না। বেরুলে গায়র মাহরুম পুরুষের সাথে বেরুতে হবে। অসংখ্যবার দেখা যায়, নারীর উপর চাবুকের আক্রমণ।
ঠিক একইভাবে, নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে পারবে না।
দেশে ভিন্নমত ও ভিন্নধর্ম থাকতে পারবে না।
সবাই মসজিদে যেতে বাধ্য, সবাই পূর্ণ দাঁড়ি রাখতে বাধ্য। আমাদের রাসূল দ. কখনো দাঁড়ি রাখতে বাধ্য করেছেন কি? বা তাঁরা সম্মানিত সাহাবা রা. গণ?
এই ফিরিস্তি শেষ হবার নয়। প্রকাশিত। সবার জন্য উন্মুক্ত।
২০০১। নাইন ইলেভেন। এরপর আক্রমণের প্রস্তুতি কাবুলে। আফগানিস্তানে নেমে এল নরক। লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ শিশু মৃত। পুরো একটা জাতি ফিরে গেল প্রস্তরযুগে, ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অত্যাধুনিক আক্রমণে একটা দেশ পরিণত হল পাথর আর বালির সাথে হাড় মিশ্রিত নরকে।
অবাক হয়ে দেখি, এর প্রতিবাদ যতটা না, তারচে বেশি অন্য কথা। এর প্রতিবাদ হওয়াই ছিল সমীচীন। কিন্তু বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বুকে অকল্পনীয় শ্লোগান,
আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান।
এই ঘোষণা কি একদিন হয়েছিল?
একবার?
এই ঘোষণা যাঁরা দিয়েছেন, তাঁরা কি ঢাকার বুকে, বাঙালি ছিলেন না?
এই ঘোষণা যাঁরা দিয়েছেন, তাঁরা কি আজো বাংলাদেশের মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমামের ছদ্মবেশে লুকিয়ে নেই? কোথায় গেছেন তাঁরা?
আমরা অপেক্ষায়, ৬ এপ্রিলের লংমার্চের জন্য।
ষষ্ঠ ভাগ: ইতিহাসের খেরোখাতা
Maulvi Rashid Ahmad Gangohi states: "The followers of Mohammad Ibne Abdul Wahab are called “Wahabis”, their beliefs were excellent."(FATAWA-E-RASHIDJA - Vol. 1- Page 111) সৌদি অদ্ভুতুড়ে আদর্শ, ওহাবী আদর্শ হল আল ক্বায়িদাহ্ সহ অন্যান্য নেটওয়ার্কের মূল উপজীব্য বিষয়। মূলধারার মিলিট্যান্ট সেক্ট সালাফী বা আহলে হাদিস বা ওহাবী (তিনটা একই নাম) এর সাথে সবচে বেশি সাযূয্য রয়েছে জামাতে ইসলামীর। কিন্তু জামাতের সাথে এবং অন্যান্য আল কায়েদা ধরনের সংগঠনের সাথে কওমীর এই সম্পৃক্ততা আজকালকার নয়। কওমী ধারার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী, যিঁনি তাবলীগ জামাত নামক ফেইজেরও প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর কথাতেই বিষয়টা স্পষ্ট।
এই সূক্ষ্ণ যোগসূত্রেই আল কায়েদা তথা সৌদিপন্থী (ওহাবী) মিলিট্যান্ট দলগুলোর সাথে (আল কায়েদা ও সকল মৌলিক মিলিট্যান্ট গ্রুপের পাশাপাশি সেমি-মিলিট্যান্ট গ্রুপ তথা হিজবুত তাহরীর, মুসলিম ব্রাদারহুড, জামাতে ইসলামী,) কওমী/তাবলিগ/ দেওবন্দী ঘরানার মিলিট্যান্ট দলগুলোর (তালেবান/ হাক্কানী নেটওয়ার্ক/ সিপাহ এ সাহাবা রা.) সাযূয্য বিদ্যমান যা প্রয়োজনমাত্র মূলধারার কওমী নেতৃত্ব ও চেইন অভ কমান্ডের সহযোগে প্রকাশিত হয়।
এই ভাগটা বিশাল আলোচনার দাবী রাখে বলেই একেবারে সংক্ষিপ্ত রাখা হল।
কার্যকারণে তালিবানের সাথে আল কায়িদার সম্পর্ক সবচে ঘনিষ্ঠ।
আর এখন প্রকাশ্যদৃষ্ট যে, জামাতের সঙ্কটে পথে 'হেফাজতে ইসলাম' নামে কওমী হাইকমান্ডের উপস্থিতি বারবার ইতিহাসের দিকে আঙুল তোলে।
সপ্তম ভাগ: শুধু তালেবান নয়
আলোচনার স্বার্থে শুধুই ভ্রমণের সংযোগায়ন ইউকিপিডিয়ার সাথে- সিপাহ এ সাহাবা (রা.)। মহান রাসূল দ.'র সঙ্গীগণের সিপাহি নাম নিয়ে উপমহাদেশের আরেক কওমীসৃষ্ট আতঙ্ক। এবং হাক্কানী নেটওয়ার্ক। জামিয়া হাক্কানিয়ার সাথে যার ওতপ্রোত সম্পর্ক। এই উভয় সংঘই বাংলাদেশের সাথে যুক্ত, তা আমরা ভালমতই জানি।
জানি, বছর কয়েক আগে এই পাঁচই এপ্রিল বলা নেই, কওয়া নেই, সারা পৃথিবীতে সবচে বড় দেওবন্দী-কওমী মাদ্রাসাগুলোর অন্যতম এবং বাংলাদেশে প্রধান সমন্বয়ক প্রতিষ্ঠান হাটহাজারী মাদ্রাসা বা আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মইনুল ইসলাম থেকে হরতাল ডাকা হয়েছিল।
তখন হরতাল করতে গিয়ে পথে বসে পড়ে মাদ্রাসার ছাত্ররা কুরআন নিয়ে। এবং তখন খুব অবাক করে যে বিষয় তা হল, তারা ভয়ানক দক্ষতার সাথে মার্শাল আর্ট নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশের উপর। হতভম্ভ হয়ে পড়ে পুলিশ।
ঠিক কোন সময়ে সেই হরতাল ছিল, আমরা গোল্ডফিশ মেমোরি, ভুলেই গেছি। ভুলে গেছি তার কার্যকারণও।
অষ্টম ভাগ: বাংলাদেশ
আমরা ভুলে যাই, ইমাম ওইক্য পরিষদ, ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি, খেলাফত আন্দোলন, তৌহিদি জনতা, ঈমান সংরক্ষণ, ইত্যাদি নাম নিয়ে এই এক ও অভিন্ন চতুর পক্ষ হাজারো বার বাংলাদেশের মাটিতে লাঠিসোঁটা নিয়ে সশস্ত্র আক্রমণ করে নানা ধরনের ভিন্নমতের উপরে।
আমরা ভুলে যাই,
বাংলাদেশে এই কওমীর প্রধান ছিলেন জনাব হাফেজ্জী হুজুর, যিনি আর তাঁর নেতৃত্বে 'দুষ্কৃতী' তথা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ও পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার জন্য মিছিল করেন। সেই ছবি ক্যাপশন সহ ছাপা হয় একাত্তরের দালাল পত্রিকায়। আমরা যেহেতু ভুলেই যাই, তাই তাঁর নামে হয় রাজপথের নামকরণ।
ভুলে যাই, জনাব হাফেজ্জী হুজুরের জামাতা গ্রেনেড হামলার সাথে নানাদিকে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যিঁনি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে সরকার গঠন করেছিলেন।
ভুলে যেতে চাই শফী সাহেবের হাটহাজারি মাদ্রাসার জন্য অনুদান গ্রহণের খতিয়ানগুলোর কথা। মাদ্রাসায় পুলিশ প্রবেশের চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হবার কথা। মাদ্রাসার ভিতরে থাকা অজস্র অস্ত্রের গুলতানি।
আমরা রানওয়ে সিনেমাকে স্রেফ সিনেমা মনে করি। মাটির ময়নাকে মনে করি মাটি দিয়ে বানানো পুতুল এক। গালগল্প।
তাই বাংলাদেশের দুর্গম চরাঞ্চল, সীমান্তবর্তী দুর্ভেদ্য এলাকা, নানা প্রান্তে নানা আলিমের নামে তৈরি হওয়া মাদ্রাসা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে হওয়া শত শত ট্রেনিঙের কথা আমাদের ভুলতেই হবে। সামনে আরো হাজারো সমস্যা রয়েছে চোখের সামনে দৃশ্যমান।
এবং, যেহেতু এই 'হেফাজতে ইসলাম' এর মতই তাদের ব্যানার থাকে ভিন্ন ভিন্ন, আড়ালে রয়ে যায় সব সময় কওমী হাই কমান্ডের লিগ্যাসি।
আর, হায় সেলুকাস, আমরা খুঁজে বেড়াই, কারা এই হেফাজতে ইসলাম?
প্রস্তর নগরী কান্দাহার। বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা আর অগুণতি লাশ হয়ে ভেসে ওঠে চোখের সামনে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০১৩ ভোর ৪:৫৮