১.
“ভিসি স্যার, আপনার উপর আল্লাহর গজব পড়ুক। আপনি এখনো আসছেন না কেন?”- কাঁদতে কাঁদতে মোবাইলে কথা বলছিলেন একজন সিনিয়র শিক্ষক।
২.
গুমোট, থমথমে, বেমানান একটি দিন। গতরাতে খাবারের নিম্নমানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে গন্ডগোলের পর সকলেরই মন ভাঙ্গাচোড়া। কুয়েটে সবাই ইঞ্জিনিয়ার হবার স্বপ্ন এবং প্রত্যয় নিয়ে পড়তে এসেছে, আন্দোলন করতে আসেনি।কিন্তু, দিনের পর দিন ছাত্রী হয়রানি, ইভটিজিং, রুমে ডেকে নিয়ে অথবা রুম থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে মারধোর, হলের সিট বেদখল, ফেসবুক স্ট্যাটাসের জন্য গভীর রাতে ধরে নিয়ে গিয়ে বেধরক পিটুনি…… আর কত সহ্য করা যায়? তাই তো শেষ পর্যন্ত বার্ষিক ফিস্টের খাবারের নিম্নমান নিয়ে প্রতিবাদ করল সাধারণ ছাত্ররা। তা না হলে, বছরের দু-একটা দিনের খাবার নিয়ে একজন হবু ইঞ্জিনিয়ারের কিছু এসে যায় না।
৩.
অশান্ত-ভাঙ্গাচোড়া মন নিয়ে কেউকেউ গিয়েছিল ক্লাশ করতে। ক্লাশ শেষে ফিরে এসেছে বেলা একটা দশে সেকেন্ড হাফের ব্রেকে। সবাই যখন হাত-পা ছড়িয়ে শুয়েছে বিছানায় কিম্বা বসেছে প্রিয় কম্পিউটারের সামনে। তখনই দলবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ছাত্রলীগ তার ভাড়া করা সন্ত্রাসীদের নিয়ে। ছাত্ররা টের পেয়ে তালা লাগিয়ে দিল কলাপসেবল গেটে। কিন্তু মূহুর্তেই ভেঙ্গে গেল সেই তালা ছাত্রলীগের মূহুর্মূহ রডের আঘাতে। নিমিষেই ছড়িয়ে গেল তারা হলের সবখানে। হাতে বাঁশের চেলা, রামদা, চাপাতি, চাদরের নিচে লুকানো আগ্নেয়াস্ত্রটা ঝিলিক দিচ্ছিল মাঝেমাঝে। কিচ্ছুক্ষণ পরেই শুরু হল পাশবিক চিতকার আর প্রবল আর্তনাদ। সেই চিতকারে-আর্তনাদে কোন সুস্থ মানুষ ঠিক থাকতে পারে না।
৪.
রাম দা এর ক্রমাগত আঘাত যখন থেতলে দিচ্ছে ছাত্রটির হাত-পা, ঝরাচ্ছে ঝরঝর করে রক্ত তখনো সে ভাবছে, কেন সে মার খাচ্ছে? কি তার অপরাধ? ধারালো দিক দেখিয়ে রাম দা হাতে উদ্যত ছেলেটি বলে “এই দিক দিয়ে মারব তোকে? এই দিক দিয়ে?” সিনিয়র ভাইটিকে মারতে মারতে বলে, “অনেকদিন 2k7 মারি না, এবার মারব শালা”। এসব শব্দের কোনটিই পৌঁছে না মার খেতে থাকা ছাত্রটির কানে। শুধু সর্বশেষে যখন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা তার বুকে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে রেখে যায়, যখন তার দম বন্ধ হয়ে আসে, তখন তার মনে হয় সে বুঝি আর বাঁচবে না।
যখন সম্বিত ফিরে আসে তখন সে দেখে রুমের সবাই রক্তাক্ত। সৌভাগ্যক্রমে কম মার খাওয়া কেউ তার ক্ষতস্থানে সেভলন লাগিয়ে দিচ্ছে। চোখ জ্বালা করে, বেরিয়ে আসে অশ্রু, শারীরিক আঘাতে নয়, কষ্টে, অপমানে। এই দেহের ক্ষতস্থান একদিন শুকিয়ে যাবে, ব্যাথা সেরে যাবে, কিন্তু এই অপমান, এই কষ্ট রয়ে যাবে বুকের মাঝে, এই পাশবিক স্মৃতি বয়ে বেড়াতে হবে আজীবণ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবণের শেষপ্রান্তে এসে অজানা অপরাধে জুনিয়রের কাছে মার খেতে হলো। শেষ কটা দিন কিভাবে হাঁটবে ক্যাম্পাসে? যখন সেই জুনিয়রের সাথে দেখা হবে কোথায় লুকোবে চোখ দুটো?
৫.
আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, গল্প শুনেছি। সেসব গল্প শুনেশুনে রাজাকার, আল-বদরের যে প্রতিকৃতি আমার মনে তৈরী হয়েছে তার সাথে হুবুহু মিলে যায় ছাত্রলীগের চরিত্র।
ফুলবাড়িগেট কিংবা বি এল কলেজের ছাত্রলীগের সাহস ছিল না কুয়েটে ঢোকার। আর তাদেরকেই কুয়েট ছাত্রলীগ একুশে হলে ঢোকায় আস্ত্রসহ ঠিক যেভাবে রাজাকাররা পথঘাট চিনিয়ে চিনিয়ে বাড়িবাড়ি নিয়ে যেত পাকবাহিনীকে।
বুদ্ধিজীবিদের মারতে যাবার আগে আল-বদর নাকি লিস্ট করেছিল দেশের সূর্যসন্তানদের। ঠিক একই রকমভাবে কুয়েটের মেধাবী, যাদের মনে হয় নেতৃত্ব দেবার মত বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন তাদের লিস্ট করেছে ছাত্রলীগ এক তারিখ রাতে। আর দুই তারিখ দুপুরে রুমে রুমে গিয়ে লিস্ট ধরে ধরে পিটিয়েছে ছেলেদের। যারা ফেরাতে এসেছে তাদেরও পিটিয়েছে।
শুনেছি কারো সাথে ব্যাক্তিগত বিরোধ থাকলে সেটাও রাজাকাররা মিটিয়েছে পাকবাহিনীর সুবিধা নিয়ে। এই কথাটাও মিথ্যা হল না যখন দেখলাম, নিজের বিভাগের বড় ভাইকে পেটানোর জন্য অন্য বিভাগের ছেলেদের রুমে ঢুকিয়ে দিল আর নিজে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে রাখল।
রাজাকার-আল-বদররা নাকি কাঙ্খিত ব্যাক্তিটিকে মেরে ফেলবার আগে “আল্লাহু আকবার” বলে তকবির দিত। শুভজিতকে যখন ছাত্রলীগের কুকুররা পেল তখন আর তাদের আনন্দ, তাদের পাশবিকতা দেখে কে? জামার কলার ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এল হলের মাঝখানে ফাঁকা জায়গায়। সবাই একসাথে ঘিরে ধরে “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু” স্লোগান দিল কিছুক্ষণ। তারপরই শুরু হলো সতঃস্ফূর্ত অমানুষিক নির্যাতন। আহঃ কোন মানুষ এভাবে মানুষকে মারতে পারে না। যখন এক পর্যায়ে জনি ফেরাতে গিয়ে বলল, “ভাই আর মারিস না, মরে যাবে”। তখন যেন তাদের চোখে ঝিলিক খেলে গেল। “অই তোর অত লাগে কেন?” বলে জনিকেও পেটাতে শুরু করল। পালিয়ে যাবার কোন উপায় ছিল না ওদের।
৬.
একজন একজন করে আহত ছাত্রদের আধমরা অবস্থায় বের করে আনা হচ্ছে। ভেতরে তখনো মারধোর চলছে, বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে যুগপত আর্তনাদ ও উল্লাসধ্বনি। নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে কয়েকজন শিক্ষকও মার খেয়েছেন, পুলিশ আসার কোন নাম নেই। কাঁদছে সবাই, ছাত্র-শিক্ষক সবাই কাঁদছে হাউমাউ করে। এমন পরিস্থিতিতে পশুছাড়া কেউ নিজেকে সংযত রাখতে পারে না। আমি ঠোঁট কামড়ে ধরি। চোখটা জ্বালা করে। “চোখটা এত পোড়ায় কেন? ও পোড়া চোখ সমুদ্রে যাও”
৭.
আমি বুঝি না, প্রকৌশলী হতে আসা একটা ছাত্র যখন চাপাতি হাতে তুলে নেয় তখন তার হাত কি একটুও কাঁপে না? বড়ভাইকে-শিক্ষককে মারতে যাবার আগে তার বিবেক কি এতটুকুও কাজ করে না? এরা কি পরিবার থেকে কিছুই শিখে আসেনি?
হে জননী, আপনার যে আদরের সন্তানকে পরমযত্নে, ভালবাসায় উচ্চশিক্ষিত করার আশায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন একবার কি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন কি অবলীলায় রাজনীতির বিষাক্ত ছোঁয়ায় সে মানুষ থেকে পশু হয়ে গেছে? সে এখন ছাত্র পেটায়, শিক্ষক পেটায়, সে এখন ত্রাস!
হে দায়িত্ববান পিতা, আপনি কষ্ট করে প্রতিমাসে যে টাকা পাঠান আপনার ছেলেকে সেই টাকা দিয়ে সে যে মদ গাঁজার নেশায় ডুবে থাকে, রাতভর জুয়া খেলে, আরো টাকার প্রয়োজনে ফিস্টের টাকা আত্নসাত করে, বাঁধা দিলে রামদা, চাপাতি দিয়ে কোপায় তা কি আপনি জানেন?
৮.
আমার জীবণের প্রথম ভোটটি দিয়েছিলাম আওয়ামিলীগকে। সেই আওয়ামিলীগ ক্ষমতায় এসে আমাদের চিনিয়েছে নব্য রাজাকার, নব্য আল-বদর। একদিন বুয়েটে, পরেরদিন কুয়েটে, তারপরের দিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যলয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, তারপরের দিন রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এভাবে প্রতিদিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের অত্যাচার চলছেই।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন তো আমাদের বলেন, আমরা পড়াশোনা ছেড়ে দিই। আমাদের ইঞ্জিনিয়ার হবার স্বপ্নকে আমরা গলা টিপে হত্যা করি, আমাদের প্রয়োজেন নেই। এরচেয়ে দাদার রেখে যাওয়া জমিতে গিয়ে কৃষিকাজ করি গিয়ে। অবশ্য সে ব্যবস্থাও তো রাখেন নি আপনি। কখনো সে জমিতে বানাতে চেয়েছেন এয়ারপোর্ট, কখনো আর্মি ট্রেনিং সেন্টার, কখনো তার বুক চিঁড়ে দিতে চেয়েছেন ট্রানজিট, কখনোবা বানিয়েছেন মরুভূমি। তারচেয়ে বরং, পরেরবার ছাত্রলীগ পেটাতে আসার আগে তাদের হাতে তুলে দেবেন আধুনিক কিছু অস্ত্র, যেন আমাদের ধুকধুকে মরতে না হয়, একেবারেই মরে যাই। কি আর করা, আমাদের মৃত্যুই আমরা কামনা করি।
৯.
শুনেছি এই সরকারের আমল শেষ হলে আমাদের ভিসি ডঃ আলমগীর তার কুয়েটের চাকরী ছেড়ে দেবেন। ভিসি থাকাকালীন সময়ে তার বিভিন্ন বানিজ্যে উপার্জিত কোটি কোটি টাকা দিয়ে চাঁদপুরে গিয়ে নির্বাচনে দাঁড়াবেন। নির্বাচিত হয়ে গেলে হয়তো কোন মন্ত্রী-টন্ত্রী হয়ে যাবেন নিশ্চয়ই। কুয়েট নিয়ে তার এত মাথাব্যাথার সময় কোথায়? তাছাড়া তিনি তো কুয়েটর ছাত্রও ছিলেন না কখনো। কুয়েটের ভাল তিনি চাইবেন কেন? যার পা চাটলে তার লাভ তার পা-ই তো তিনি চাটবেন।
আমার বড়ভাইদের কাছে আমার প্রশ্ন, এই ভিসি কর্তৃক আয়োজিত কনভোকেশনে আপনারা আসবেন? এই রক্তাক্ত কুয়েট চেয়েছিলেন আপনারা? এই অমানুষ ভিসির সাথে হাত মেলাতে আপনাদের এতটুকু বাঁধবে না? আমাদের দেহ যখন ক্ষত-বিক্ষত, আমাদের রুমময় ছড়িয়ে আছে জানালার ভাঙ্গা কাঁচ আর টপটপে রক্তের ফোঁটা তখন কি আপনারা মাততে পারবেন সমাবর্তনের আনন্দে?
আমাদের ধারণা পারবেন না। যদি না পারেন তবে আমাদের অনুরোধ, আপনারা এগিয়ে আসুন এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে, উচ্চকন্ঠে প্রতিবাদ করুন, বর্জন করুন কনভোকেশন। আজ কুয়েটের বড় প্রয়োজন আপনাদেরকে। কুয়েটের পাশে দাঁড়ান, আমাদের, আপনাদের প্রিয় শিক্ষকদের পাশে দাঁড়ান। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ ঘোর অমানিশা কাটতেই হবে। নয়তো সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
১০.
ভিসি ও ছাত্রকল্যাণ পরিচালক আপনারা কে কার চেয়ে কত খারাপ তার হিসাব আমরা মেলাতে পারব না। আমাদের খারাপের মাপকাঠির সীমা আপনারা অনেক আগেই পেরিয়ে গেছেন।
ছাত্ররা যখন পাশবিক নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে তখন আপনি পুলিশ পাঠান নি। কি চমতকার, আপনি পুলিশ পাঠালেন তখন যখন ছাত্রলীগের ধ্বংসা মহড়া শেষ হলো। সেই পুলিশ দিয়ে সাধারণ ছাত্রদের পেটালেন আপনি। অথচ, আগের রাতে কি অবলীলায় বলেছিলেন যে, সক্ল সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের দায়িত্ব নাকি আপনার।
আজকে এই ঘটনা ঘটত না যদি ভিসি হবার প্রথম দিনেই আপনি সেই দুই কুখ্যাত ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে বহিষ্কারাদেশ তুলে না নিতেন, যদি মুক্তবুদ্ধি চর্চার নামে কলুষিত ছাত্ররাজনীতি আবার প্রচলন না করতেন। এ ঘটনা ঘটত না যদি আপনি ছাত্রলীগের পৃষ্ঠপোষকতা না করে ছাত্রী হয়রানীর বিচার করতেন, যদি ছাত্রী হয়রানির বিচার করতেন তবে হয়তো অঙ্কুশ-নিনাদকে এভাবে গভীর রাতে মার খেতে হতো না, যদি অঙ্কুশ-নিনাদকে নির্যাতন করার বিচার করতেন তবে হয়তো আজ ছাত্র-শিক্ষক নির্বিশেষে গণহারে মার খেতে হত না। আমাদেরও এই কলঙ্কের দেখা পেতে হতো না।
শিবেন-আলমগীর আপনারাই কুয়েট ছাত্রলীগের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক, আপনারাই কুয়েটের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী। আপনাদের মদদেই ছাত্রলীগ সাধারণ ছাত্রদের পিটিয়েছে, স্যারদের পিটিয়েছে, আবার তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে। আমি সেই মামলার একজন আসামী বলছি- “আপনাদের উপর আল্লাহর গজব পড়ুক”।
কাঁদল ছাত্র,কাঁদল শিক্ষক। কুয়েট(পর্ব-১)
রক্তাক্ত হৃদয়ে কুয়েট আমার
এদের থেকে সাবধান। এরা কুয়েটের অভিশাপ,দেশের অভিশাপ। এই গুণ্ডাদের শাস্তি চাই।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০১২ বিকাল ৪:১৭