ওসি সাহেবের চা খাওয়ার শব্দে ঘরটা মোটামুটি কাঁপচ্ছে। চা খেতে কেউ এত শব্দ করতে পারে তা আমিন মেম্বারের ধারণা ছিল না। তার উপর যে চেয়ারটায় সে বসে আছে যে কোন মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে।প্রায় তিন পা বিশিষ্ট এই চেয়ারটার থাকা উচিত ছিল সার্কাসে, সেটা এই বিনোদপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কি করচ্ছে আমিন মেম্বার বুঝে উঠতে পারছে না। শালার স্কুলের হেড স্যারটা একটা ছাগল।
আনমনেই তার মুখ থেকে খিস্তি বের হয়ে গেল, ‘ব্যাটা খচ্চর’
সঙ্গে সঙ্গে ওসি সাহেবের চা খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল… গলা খাকড়ি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মেম্বার সাহেব কি কিছু বললেন?’
‘এ… না মানে ভাবতেছিলাম ব্যাপারটা লইয়্যা কি করন যায়’
‘এত ভাবাভাবির কি আছে? সব তো আপনাকে আমি জলবৎ তরলং করে বুঝিয়ে দিলাম’
হ … ভালই বুঝাইচ্ছস ব্যাটা খচ্চর। সবই যদি তোর অই জলবৎ তলবৎ হয় তাইলে তুই যানা খচ্চর… আমারে লইয়্যা টানস ক্যান। এমনিতেই শালার অর্শরোগটা আমারে যা পেইন দিতাছে। কাল সারারাত ঘুম হয় নাই তার উপর সকাল না হইতেই হেড ছাগুটা গিয়া ম্যাতকার শুরু কইরা দিছে। যেন তার স্কুলে ওসি আসে নাই তার শ্বশুর আসছে।
‘আপনি বড়ই জ্ঞানী মানুষ ওসি সাব… আপনি বুঝাইয়া কন। আমি কি বলতে কি বলি।’
‘ওহ মেম্বার সাহেব বেকুবের মত কথা বলবেন না… আমি আইনের লোক, আমার একটা বাইন্ডিংস আছে না।’
‘তা তো বটেই তা তো বটেই’।
পায়ুপথে আবার জ্বালাপোড়া শুরু করছে দেহি। মর জ্বালা নড়বারো তো পারুম না চেয়ারটার লাইগ্যা। আর হেড ছাগুটা কি মঙ্গল গ্রহে গেল গা নাকি। মঈন গো বাড়ি স্কুলের থন ১০ মিনিটের হাঁটা পথ।বড়জোর ৩০ মিনিট লাগনের কথা কিন্তু এরিমধ্যে ঘন্টা পার হইয়্যা গ্যাছে গা। তাইলে কি মঈনের মা ……
আমিন মেম্বারের কপাল বেয়ে ঘামের চিকন ধারা নেমে আসছে। বিষয়টা যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে বুঝে উঠতে পারছে না। এ সব অজ পাড়া গায়ের প্রভাবশালী কেউ হওয়া যেমন মজার আবার তেমনি এরকম হাঙ্গামায় নাকালের এক শেষ হতে হয়।
‘মেম্বার সাহেব আমি নিজেই যখন এখানে এসেছি বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ’
‘তা আর কইতে স্যার, আপনি চিন্তা কইরেন না’
‘ওসি স্যার … মেম্বার সাহেব আমি দুঃখিত… দেরী করার জন্য, রিয়েলি সরি’
ব্যাটা হেড হনুমান দেহি সাধু আর ইংরেজী ভাষার ঝড় চালাইতাছে। ‘এতক্ষণ কি করলা মাষ্টার?’
‘আর বইলেন না মেম্বার সাব… মহিলাটারে কোনভাবেই আনবার পারতেছিলাম না’
ওসি সাহেব নড়চড়ে বসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘উনি আসছেন?’
‘আসবে না মানে … আমি নিজে গেছি শুধু ও ক্যান ওর চৌদ্দগুষ্ঠি আসবে’
ব্যাটা আবার ম্যাতকার শুরু করছে দেহি; ‘মাষ্টর বেশি কথা বলবা না… যাও ওরে ভিতরে পাঠায় দাও আর তুমি বাইরেই থাইকো। ওসি সাহেব আর আমি অর লগে নিরালায় কথা কমু বুঝছো?’
দিলে বড় দাগা লাগল। এই এলাকায় তার মত শিক্ষিত লোক আর কেউ নাই। আর অই মূর্খ মেম্বার তারে কই সে থাকলে কিনা সমস্যা হইবো!! এই দেশটার এজন্যই কিচ্চু হইবোনা। মানীর মান নাই।
‘মঈনের মা ভিতরে যাও। ওসি সাব তুমার লগে কথা কইবো। আর ফুলিরে বাইরে রাঈখ্যা যাও। পুলাপান লইয়্যা এই ঝামেলায় আসো ক্যান?’
কে শুনে কার কথা… মঈনের মা যেন এ জগতে নেই। তার ঝাপ্সা চোখ দুটো স্কুলের মাঠ পেড়িয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
‘অই কি হইলো? মর জ্বালা… আরে তোর এসব ন্যাকামো বন্ধ কইরা ভিত্রে গিয়া শোন কি বলে… যা… ফুলি তোর মার আচল ছাইড়্যা দে’
‘আসো আসো মঈনের মা… আছো কেমুন? ঈশ রে তোমারে তো একদম জিন্দা লাশের মতন লাগতাছে’, আমিন মেম্বার ওসি সাহেবের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার তাইলে শুরু করি।’
ওসি সাহেব কিছু না বলে মাথা নাড়লেন। তার খুব অস্থির লাগছে। কেন লাগছে বুঝতে পারছেন না। এরকম ব্যাপার পুলিশি জীবনে ঘটতেই পারে। কিন্তু মহিলাটার চোখের দৃষ্টিটা এমন কেন? ঊফ!! একটা সিগারেট ধরালেন।
‘মঈনের মা তুমার উপর দিয়া যে কি যাইতাছে আমরা সবাই জানি। এরম একখান ঘটনা যে ঘটবার পারে কেউ কি ভাবছিল কও। এমন একটা তরতাজা পোলা হঠাৎ চইল্যা গেল’
ওহ খোদা… একখান লাশের লগে কি কথা কওন যায়… কিন্তু
‘শোন সব কিছুই ঐ উপরওয়ালার অছিলা। নইলে তুমি কও ঐ চায়ের দোকানে কত্ত মানুষ আছিল… গাড়িটা ক্যান তুমার পোলার গায়েই উঠবে? ইউ, এন,ও সাহেবের পোলা কি আর ইচ্ছা কইরা এইটা করছে। হঠাৎ বেরেক ফেইল হইছে। কি আর করবা কও আল্লার মাল আল্লা নিছে। যা হওনের তা তো হইয়্যায় গেছে তাই না। তুমি যদি এখন থানায় যাও তাহলে তোমার পোলার বয়সী আরেকজনের ঝামেলা হবে… কও তুমি কি তা চাও’
মঈনের মা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে… কার দিকে কে জানে…
‘শোন ইউ,এন,ও সাব একটা প্রস্তাব পাঠাইছেন… তোমারে প্রতিমাসে ২০০০ টাকা কইরা দিবেন আর তোমার ঘরটাও ঠিকঠাক কইরা দিবেন। তুমি চিন্তা কর কি দয়ার শরীর উনার। তোমার ফুলির কথাটাওতো ভাবা দরকার তাই না। ও মঈনের মা কি বলছি বুঝতে পারছো’
আবার সেই খালি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা।
‘শুনুন আপনি চাইলে মামলা করতে পারেন। কিন্তু মামলার খরচ চালাবেন কেমন করে? আর ঘটনাটাতো হঠাৎ করেই ঘটে গেছে তাই না… আদালতেও আপনার অভিযোগ ধোপে টিকবে না। খুব বেশি হলে জরিমানা করবে। উনারা মানী লোক অহেতুক ঝামেলায় যেতে চায়ছেন না দেখেই এই প্রস্তাব। এখনি কিছু বলার দরকার নেই আজকের দিন ভাবুন কালকে মেম্বার সাহেবকে জানালেই হবে। এখন আপনি আসতে পারেন।’
মঈনের মা ধীরে ধীরে বাইরে বের হয়ে আসলো। ফুলিকে যে জায়গায় বসিয়ে রেখে গিয়েছিল ঠিক সে জায়গায় বসে আছে। আসলে তার ৬ বছরের মেয়েটির পক্ষে একই জায়গায় বসে থাকাটাই স্বাভাবিক। এখনো সে মা ছাড়া আর কিছু ডাকতে পারে না। মা আর তার প্রিয় ভাইটাকে ছাড়া কাউকে সে চিনেও না। ভাই বোন দুটা ছিল মানিকজোড়।
এখনো অবুঝ চোখ দুটা ভায়কে খুঁজে ফেরে…
স্কুলের মাঠের শেষে এঁদো ডোবাটার পিছনে সূর্য্যটা ডুবতে শুরু করেছে। মঈনের মা ফুলিকে কোলে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সেই সূর্য্যের পানে। হঠাৎ সায়াহ্নের নিস্তব্ধতা ভেঙে একটি বাচ্চা মেয়ে ডেকে উঠলো ‘মা…’
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০১০ রাত ৮:৪৪