গ্র্যান্ড আজাদ হোটেলে এইম-ওয়ের অফিস কক্ষে সাইয়্যেদ রিদওয়ান বিন ইসহাক -সকালের খবরছয় মাসে দ্বিগুণ টাকার হাতছানি এইম-ওয়ের
ফয়সাল আলম:
১ লাখ টাকা জমা নিয়ে ছয় মাসে ২ লাখ টাকা দেওয়া হচ্ছে। এইম-ওয়ে নামের একটি প্রতিষ্ঠান অভাবনীয় এই সুযোগ দিচ্ছে। রাজধানীর কেন্দ্রস্থল পল্টন মোড়ের পাশেই গ্র্যান্ড আজাদ হোটেলে অফিস করে প্রতিষ্ঠানটি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। গ্রাহকরাও লোভনীয় আশ্বাসে প্রতিষ্ঠানের অফিসে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। ইতোমধ্যে এইম-ওয়ে তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সারা দেশে ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করেছে। এর শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, মাত্র দুই মাসে তাদের গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখের ওপরে। এ পর্যন্ত তারা ৫শ’ কোটি টাকার বেশি আমানত সংগ্রহ করেছেন বলেও স্বীকার করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধাররা এক সময় বিভিন্ন মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। নামিদামি তারকা থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র পরিচালক-প্রযোজক, রাজনীতিবিদ, খেলোয়াড় এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এর সঙ্গে জড়িত হয়েছেন।
প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান সাইয়্যেদ রিদওয়ান বিন ইসহাক বলছেন, তারা হালাল পথে ব্যবসা করছেন। তাদের ব্যবসার মূল লক্ষ্য হচ্ছে সুস্থ শরীর গঠন, অর্থনৈতিক মুক্তি, সৌন্দর্য এবং পরকালের মুক্তি। মানবকল্যাণে ব্রতী হয়ে এই ব্যবসা শুরু করায় একজন হিন্দু বা অন্য ধর্মের লোকও বৈধপথে হালাল এ ব্যবসা করতে পারেন। সেই সঙ্গে বলেন, তিনি যে ধর্মের লোকই হন না কেন শুধু আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখলেই বেহেশতে যাবেন।
জানা গেছে, ২০১১ সালের ১ জুলাই এইম-ওয়ে করপোরেশন লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু। এজন্য জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে রেজিস্ট্রেশন ও ট্রেড লাইসেন্স করা হয়েছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগ, অঞ্চল-৪ থেকে গত ১১ জুলাই ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া হয়। লাইসেন্সে চেয়ারম্যান হিসেবে নাম রয়েছে সাইয়্যেদ রিদওয়ান বিন ইসহাকের। তিনি নিজেকে চরমোনাই পীর বলে পরিচয় দিলেও বর্তমানে চরমোনাই পীরের মূল দায়িত্ব পালন করছেন মুফতি সৈয়দ রেজাউল করিম। তিনি রিদওয়ান বিন ইসহাকের ভাতিজা।
লাইসেন্সে প্রতিষ্ঠানটি একশ’ ভাগ পণ্য বিপণনকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইউনিপেটুইউসহ দেশের অন্যান্য এমএলএম কোম্পানির শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তা এখানে যোগ দিয়েছেন।
কোম্পানি তার শেয়ার হোল্ডার কিংবা গ্রাহকদের জন্য কয়েকটি শর্ত পালন করলে দৈনিক ৫শ’ টাকা থেকে ৪ লাখ টাকা আয় করার প্রস্তাব দিচ্ছে। এজন্য তিন মাসের বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এ সময়ের মধ্যে সিলভার অ্যাকাউন্টে ৫ হাজার থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা, গোল্ডেন অ্যাকাউন্টে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা, প্লাটিনাম অ্যাকাউন্টে ৫ লাখ টাকা এবং ডায়মন্ড অ্যাকাউন্টে ১০ লাখ টাকার পণ্য ক্রয় করা যাবে। পণ্য হিসেবে দেওয়া হচ্ছে লতা হারবাল এবং পল্লীবধূ ন্যাচারাল প্রোডাক্টস কোম্পানির প্রসাধনী সামগ্রী। এছাড়া একই পরিমাণ টাকা খাটালে শতকরা ১০ ভাগ ভ্যাট কেটে মাত্র ছয় মাসে
দ্বিগুণ লাভ দেওয়া হবে। মাত্র দুই মাসে ৩ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় ৫শ’ কোটি টাকার বেশি আমানত গ্রহণ করা হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানের অ্যাসোসিয়েট শেয়ার হোল্ডার রফিকুল ইসলাম মনির জানান। তিনি আরও জানান, এইম-ওয়ের ব্যবসা কার্যক্রম সারা দেশে চলছে। এজন্য বেশ কয়েকটি বিভাগ এবং জেলায় অফিস নেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক (অর্থ) মশিউর রহমান অবশ্য আমানত গ্রহণের পরিমাণ আনুমানিক শত কোটি টাকা হবে বলে দাবি করছেন। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান রিদওয়ান বিন ইসহাক জানান, এ পর্যন্ত তাদের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ। তাদের কাছে আমানতের টাকার পরিমাণ কত জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা সঠিকভাবে জানা নেই। তবে টাকা গ্রহণের পর তা সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করা হয়।
প্রতিষ্ঠানের প্রধান সাইয়্যেদ রিদওয়ান বিন ইসহাক বলেন, তারা যেসব পণ্য গ্রাহকদের হাতে দিচ্ছেন তা সর্বোত্কৃষ্ট। বিশেষ করে পল্লীবধূর উত্পাদিত পণ্য তুলসী চা খেলে জীবনেও কারও গ্যাস্টিক কিংবা ডায়াবেটিস হবে না। এমন আরও কিছু পণ্য রয়েছে, যা ব্যবহার করলে কোনো দিন চিকিত্সকের কাছে যেতে হবে না বলেও তিনি দাবি করেন।
গত শনিবার প্রতিষ্ঠানের অফিসে গিয়ে দেখা যায়, গ্রাহকদের সামলাতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হিমশিম খাচ্ছেন। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিষয়ে পরামর্শ, গ্রাহকদের কাগজ বুঝিয়ে দেওয়াসহ নানা কাজে শতাধিক কর্মকর্তা ব্যস্ত। কেউ এইম-ওয়ের পণ্যবাহী ব্যাগ নিয়ে অফিস ত্যাগ করছেন। অফিসে ঢুকতেই ডান পাশের রুমে এক গ্রাহককে ব্রিফ দিচ্ছিলেন অ্যাসোসিয়েট শেয়ার হোল্ডার সাইফুল ইসলাম মনির। তিনি বলেন, এক সময় ডেসটিনি, নিউওয়েতে কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করে দেখেছেন ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এইম-ওয়ের আকাশ-পাতাল ফারাক। তিনি বলেন, এমএলএম ব্যবসায় অন্য কোম্পানিতে কোনো একটি হাত কাজ না করলে টাকা আয় করা যায় না। কিন্তু এখানে এক হাত কাজ না করলেও টাকা আসতেই থাকবে।
মনির বলছিলেন, তাদের প্রথম পরিকল্পনায় ছিল কেউ অ্যাকাউন্ট করলে কোনো কাজ না করেও নির্ধারিত সময় অন্তর মুনাফার টাকা উঠাতে পারবেন। যা অন্য কোম্পানিতে নেই। গ্রাহকের কাছে কোম্পানির মালিকদের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, এর মূল মালিক চরমোনাই পীর। সঙ্গে রয়েছেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার ছেলে দিপু চৌধুরী, মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ভাতিজা টিটু, নায়ক রুবেল, চরমোনাই পীরের ভাগিনা মামুন, বিএনপি নেতা সরফুদ্দিন সেন্টুর ভাতিজা শিবলী, চলচ্চিত্র পরিচালক-প্রযোজক রফিকুল আলম কিরন এবং নাদিম। একজন পরিচালক-প্রযোজকের নাম করে ৬টি ছবি বানানোর কথাও জানান তিনি। এছাড়া প্যানেল উপদেষ্টা হিসেবে আবদুল মতিন খসরুর নামও বলেন। তিনি বলেন, এরা যে প্রতিষ্ঠানে জড়িত সে প্রতিষ্ঠান টাকা হাতিয়ে গা-ঢাকা দেওয়ার সম্ভাবনা নেই। যদিও আবদুল মতিন খসরু বলেন, এ প্রথম এই প্রতিষ্ঠানের নাম শুনলাম। এই কোম্পানির কাজ কিংবা অফিস কোথায় কিছুই জানি না। আমি এমন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নই এবং কখনও সুপারিশও করিনি। আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, ওদের জুতা পেটা করা দরকার। এ রকম প্রতারণা ব্যবসার সঙ্গে আমার ছেলে জড়িত নয়।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রচার সম্পাদক আহমেদ আবদুল কাইয়ুম জানান, বিশ্বাস হয় না, ছয় মাসে বৈধপথে কোনো প্রতিষ্ঠান দ্বিগুণ লাভ দিতে পারে। এইম-ওয়ে করপোরেশন যদি এই আশ্বাস দিয়ে থাকে তাহলে সেটা প্রতারণা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
অন্যদিকে ডেসটিনির প্রফিট শেয়ারিং ডিস্টিবিউটর শাহরিয়ার আরিফ বলেন, দ্বিগুণ টাকাই যদি দেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে সরকার যে পরিমাণ টাকা বাজেট ঘোষণা করে তা ছয় মাসের জন্য এ খাতে বিনিয়োগ করে পরবর্তীতে দ্বিগুণ টাকা বাজেট ঘোষণা করতে পারে।
এইম-ওয়ে চেয়ারম্যান সাইয়্যেদ রিদওয়ান বিন ইসহাকের কাছে কীভাবে এত টাকা লাভ দেওয়া সম্ভব জানতে চাইলে তিনি পরিচালক (অর্থ) মশিউর রহমানকে দেখিয়ে দেন। পরে মশিউর রহমান মার্কেটিংয়ের লোকের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। প্রতিষ্ঠানের সম্পদ সম্পর্কে জানতে চাইলে মশিউর বলেন, নারায়ণগঞ্জে জমি রয়েছে। এছাড়া আরও কয়েকটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তবে কোন এলাকায় কতটুকু সম্পদ রয়েছে, তা তিনি বলতে পারেননি। গ্রাহকের টাকা আত্মসাত্ করা হবে না তার গ্যারান্টি কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা সরকারের নীতিমালা অনুসরণ করে মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ পদ্ধতিতে লেনদেন করছেন।
ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা : প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ইসহাক জানান, ডেসটিনির রফিকুল আমিনের কাছ থেকে তিনি বুদ্ধি নিয়েছেন, কিন্তু পাল্টা তিনি কোনো বুদ্ধি দেননি। এটাই তার অন্যতম গুণ। সে হিসেবে ডেসটিনির চেয়ে তার এবং তার প্রতিষ্ঠানের বুদ্ধি বেশি বলেও দাবি করেন তিনি। তিনি বলেন, ১৭শ’ লোকের জন্য কবরস্থানের একটি জমি কিনে ১ লাখ টাকায় প্রতিটি কবর বিক্রি করা হবে। কবরের ওপরে বসানো হবে সোলার প্যানেল। যেখান থেকে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন করা হবে। এছাড়া সেখানে মাছ ফ্রিজিং করার ব্যবস্থাও করা হবে। মৌসুম শেষে মাছ বিক্রি করে সেখান থেকে প্রচুর টাকা মুনাফা আসবে বলে জানান চেয়ারম্যান। এছাড়া মসজিদ, এতিমখানা, কারিগরি বিদ্যালয় এবং প্রবীণ নিবাস করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে হারবাল ফুড কারখানা তৈরির জন্য মাওয়া রোডে ৯১ শতাংশ এবং কবরস্থানের জন্য নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে ১৮ বিঘা জমি কেনা হয়েছে। এছাড়া পুরানা পল্টনে চারটি ফ্লোর এবং গাইবান্ধায় তুলসী চা তৈরির জন্য পল্লীবধূর কারখানার জন্য যৌথ উদ্যোগে জমি কেনা হয়েছে।
তথ্যসূত্র: দৈনিক সকালের খবর