কাঁটাখেকো
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
ইয়াসমিন
-তুমি কি ঐ মাগীটাকে চুমু খেয়েছো?
-আহ! ইয়াসমিন! আর কতবার এই একই কথা জিজ্ঞাসা করবা? বাদ দাও না!
-বাদ দিতে চাইলেই কি বাদ দেয়া যায়। ঐ হারামজাদী তোমাকে কেন বিয়ের পরেও নক করলো? আর তুমিই বা কেন গদগদ হয়ে তার মেসেজের রিপ্লাই দিলা?
-আমি কই গদগদ হয়ে রিপ্লাই দিলাম? আমি তো তাকে যথেষ্ট এ্যাভয়েড করেছি। দেখো এখন আর সে আমাকে মেসেজ পাঠায় না। তোমাকে আর কতবার বোঝাবো...
জুবায়ের আর ইয়াসমিনের দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসা, পারস্পরিক বিশ্বাস, সমঝোতা এসবের কোন অভাব নেই। নেই ব্যক্তিত্বের দন্দ্বের মতো রাশভারি পরিভাষার স্থিতিকাল। সমস্যা একটাই, জুবায়েরের যে আগে কোন প্রেম ছিলো এটা ইয়াসমিন মেনে নিতে পারে না। জুবায়ের যদিও বিয়ের আগে আবেগমথিত কণ্ঠে ইয়াসমিনকে দলছুটের গান শুনিয়ে অতীত ভুলে বর্তমানের স্বর্গীয় রথে চলার আহবান জানিয়েছিলো 'বাজী' গানটার নিম্নোক্ত লাইনগুলো শুনিয়ে,
"তুমি প্রথম, বলিনা এমন
শেষ হতে পারো কি?
তাই নিয়েছি শেষ বিকেলে
নিঃস্ব হবার ঝুঁকি"
ইয়াসমিন তখন আবেগের ভেলায় ভেসে সানন্দে মেনে নিয়েছিলো নবজীবনের এই আহবান। কিন্তু বিয়ের পরে আবেগ থিতিয়ে আসে, হানা দেয় অতীতের স্নিগ্ধ পুষ্প বিষাক্ত কালো মাকড়সা হয়ে। তারপরেও ইয়াসমিন সেসব প্রসঙ্গ তুলতো না, মনের সাথে লড়াই করে অনভিপ্রেত প্রশ্নগুলোর গলা টিপে ধরতো। তবে জুবায়েরের প্রাক্তন প্রেমিকা সোহানা যখন তাকে ফেসবুকে মেসেজ পাঠালো তাদের বিয়ের খবর সম্পর্কে অবহিত হয়ে, সেই ডুবোবেদনার চোরাবালিতে নিমজ্জিত হওয়া মেসেজটি ইয়াসমিনের সামনে এতদিনের চেপে রাখা জিজ্ঞাসাগুলোকে ভুল পথে পরিবাহিত হবার সুযোগ করে দিয়ে তাদের দাম্পত্য জীবনের প্রথম জটিলতা সৃষ্টি করলো। সেদিন সে জুবায়েরকে অনেকটা হালকা মেজাজে খেলাচ্ছলে তদন্ত করার উদ্দেশ্যেই জিজ্ঞাসা করেছিলো,
-সোহানা তোমাকে খুব ভালোবাসতো, না?
জুবায়ের তখন বুঝতে পারে নি যে ব্যাপারটা এত গুরুতর আকার ধারণ করবে। তাই সে গাঢ় স্বরে হৃষ্টচিত্তে জবাব দিয়েছিলো,
-হ্যাঁ!
এই ইতিবাচক উত্তরটি যে কত নেতিবাচকতার সম্মুখীন করিয়ে দিবে তাদেরকে তা যদি সে জানতো! এরপর ইয়াসমিন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সোহানা সম্পর্কিত নানাবিধ প্রশ্ন করে, এবং তাদের সম্পর্কের গুরুত্ব সম্বন্ধে অবহিত হয়ে রাগে, ক্ষোভে, হিংসায় ফুঁসতে থাকে। তার আয়েশী মেজাজ ক্রুদ্ধতায় রূপান্তরিত হতে থাকে। এবং অবশেষে সে মুখ খারাপ করেই বসে, যেটা পরবর্তীতে সময়ের ছন্দিত স্পন্দনে বারবার পুনরাবৃ্ত হতে থাকে।
-তুমি ঐ মাগীটার শুধুই হাত ধরেছো? নাকি আরো কিছু করেছো? লুচ্চা কোথাকার!
জুবায়ের
আমি যখন ইয়াসমিনের প্রেমে পড়ি, তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, অনেক হয়েছে, আর কোন ছেলেমানুষী নয়, অতীতের উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজে বেশ হালকা থাকবো। প্রেমে পতিত হওয়ার সময়টায় শুধু নিজের আশ্চর্য পতন উপভোগ করতেই ব্যস্ত ছিলাম। কখনও ভাবি নি ভবিষ্যতগামী পতনোন্মুখ আমার দিকে অতীতের কড়া আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাকে আলোখেকো পতঙ্গের মতো টেনে নিবে, আর আমি পুড়বো, পুড়বো কেবল। বিয়ের আগে ইয়াসমিনের প্রাক্তন ভালোবাসা সম্পর্কে বিষদ জেনে নিয়েছিলাম আমি। জানতাম, এসব জিনিস সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকলে হঠাৎ আবির্ভাবে তা একদম জাঁকিয়ে বসতে পারে মনের ওপর, যন্ত্রণা দিতে পারে অসীম। তাই এসব অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির আগমন রহিত করতে আমি জেনে নিয়েছিলাম তার শাহীন নামে একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিলো, এবং সেই ছেলেটার অতি অধিকার ফলানো এবং সন্দেহবাতিকতার কারণে দুই বছরের গভীর সম্পর্কটি আর টেকে নি।
ব্যস!
আমি ভেবেছিলাম ঘটনা এখানেই শেষ। এ নিয়ে ভবিষ্যতে আর কোনো কথা হবে না তার সাথে। কিন্তু আমি জানতাম না যে অতীত স্মৃতি বড়ই প্রবঞ্চক এক খেয়ালী হেয়ালী। কোন না কোন ভাবে এটা একদিন সম্মুখে আসবেই, ছোবল দেবে, বিষ উগড়ে দেবে। ঘটনার সূত্রপাত এভাবে, সে তার এক বান্ধবীর বিবাহ সম্পর্কিত জটিলতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলো। সম্পর্কটার সূতো কোনভাবেই গিঁট বাধছিলো না। তার বান্ধবীর প্রবাসী স্বামীর সন্দেহপ্রবণতা এবং পজেসিভনেস ক্রমশ সম্পর্কটাকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছিলো। ইয়াসমিন পুরো পরিস্থিতি সতর্কতার সাথে অবলোকন করে মতামত ব্যক্ত করে যে, তাদের ডিভোর্স হয়ে যাওয়া উচিত। আমি অবশ্য এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ছিলাম। ছেলেটা বিদেশে থাকে একা একা, এমন অবস্থায় তার মনে নানারকম সংকীর্ণতা এবং সম্পর্ক সম্বন্ধে নিরাপত্তাহীনতা অনুভূত হতেই পারে। এজন্যে ডিভোর্স চাওয়াটা বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। আমার এই যুক্তির পাল্টা জবাব দিতে গিয়েই ইয়াসমিন তার বাচালতা এবং নির্বুদ্ধিতার কারণে বড় একটা ভুল করে ফেললো। সে হয়তো বা সৎ মনেই পরিস্থিতিটা নিজের মত করে বিবেচনা করে একটা অনুপুঙ্খ মতামত দিতে চেয়েছিলো, সে বলেছিলো তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে এসব লোক দূরে থাকুক বা কাছে, তাদের স্বভাবের কোন পরিবর্তন হয় না। নিজের জীবনের কথা উল্লেখ করায় আমার ভেতর ফ্ল্যাশব্যাকের মতো তার অতীতের ব্যক্ত এবং অব্যক্ত কথাগুলোর চিত্ররূপ ভেসে উঠলো।
সে তার নিজের জীবনের প্রসঙ্গ তুললো কেন? এই জীবনের সাথে নিশ্চিতভাবেই তার প্রাক্তন প্রেমিক শাহীন জড়িত! যে কিনা ছিলো এক নির্বোধ খবরদারকারী সন্দেহবাতিকতায় আক্রান্ত অসুস্থ যুবক। তার কথা সে কেন উত্থাপন করলো? সে কি এখনও তাকে ভুলতে পারে নি? আমার প্রশ্নের জবাবে সে ব্যাপারটা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চাইলো।
-আরে কী যে তুমি বলো না! ওকে আমি ভুলে গিয়েছি সেই কবে! এখন আমার জীবনে শুধু তুমি।
এসব সিনেমাটিক ন্যাকাবোকা কথাবার্তায় আমি বিরক্ত হচ্ছি বুঝতে পেরে সে কাব্যিকতার আশ্রয় নেয়।
-দেখো, তোমার সাথে আমার সম্পর্ক হবে এটাই ছিলো নির্ধারিত, এটাই আমাদের নিয়তি। আর সবকিছু মিথ্যে। আমি জানি, সেসবকিছু ঘটেছিলো তোমার আর আমার সম্পর্কের উপলক্ষ্য হবে বলে।
ততক্ষণে আমার ভেতর স্মৃতিসর্পরা ছোবল দিতে শুরু করেছে। আমার বারবার মনে হচ্ছিলো, এসব কথা সে আগেও কাউকে বলেছে, আমি তার জীবনের প্রথম পুরুষ নই, আমার আগে কেউ তাকে স্পর্শ করেছে। আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না এসব। বারবার তাকে জিজ্ঞেস করছিলাম নানারকম অস্বস্তিকর এবং অনাহূত প্রশ্ন।
-তুমি কি এখনও তাকে ভালোবাসো?
-না!
-তুমি কি তাকে স্বপ্নে দেখো?
-না!!
-হঠাৎ যদি তার সাথে তোমার দেখা হয়ে যায় তাহলে তুমি কী করবে?
চোয়াল শক্ত করে শুধোই আমি। তবে সেদিনকার মতো বুদ্ধিদীপ্ত এবং কৌতুকপ্রদ এক বিচক্ষণ উত্তরে সে সেদিনকার মতো প্রসঙ্গটি চাপা দিতে সক্ষম হয়!
-যদি তার সাথে আমার দেখা হয়, তাহলে আমি কিছু করবো না। আমার সাথে তো তুমি থাকবেই, তুমি গিয়ে ওর ঠ্যাংটা ভেঙে দিবে!
সে হাস্যচ্ছলে কথাগুলো বললেও আমার সত্যিই তখন তেমন কিছু ইচ্ছে করছিলো। আমি জানতাম না এই ইচ্ছেটা কিছুদিন পর পর ফণা তুলে ছোবল দিয়ে আমাদের সুখী দাম্পত্য জীবন তছনছ করে দেবে!
সোহানা
জুবায়েরের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের পর আমাকে খুব ভুগতে হয়েছে। আঘাতটা এত তীব্র ছিলো যে আর কখনও কোন ছেলের সাথে সম্পর্ক হতে পারে এটা আমি ভাবতেই পারতাম না। মনে হতো সারাজীবন আমাকে একলাই থাকতে হবে। একা থাকা নিয়ে আমার কোন সমস্যা ছিলো না, জুবায়ের আবার আমার কাছে ফিরে আসবে এমন অলীক কল্পনায় বিভোর হয়ে বেশ কাটতো সময়। আমাদের মধ্যে ব্রেকআপ হবার পরপরেই অনুভূতিটা মোটেই দুঃখের ছিলো না। আমি ভীষণ রেগে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, সে যদি তার ভুল বুঝতে পেরে কোনদিন আমার সাথে যোগাযোগ করেও আমি আর তার সাথে সম্পর্ক পুনরুস্থাপন করবো না। যথেষ্ট হয়েছে প্রেমের নামে কদর্য ঝগড়া আর ছেলেমানুষী ভুল বোঝাবুঝি। আমি আর এসবের মধ্যে নেই। আমার ধারণা সত্যি প্রমাণ করে জুবায়ের ফোন করেওছিলো মাস ছয়েকের মধ্যে। আমার রাগ আর জেদ তখনও ভালোবাসা আর আবেগকে ঠুনকো অনুভূতি ভেবে অগ্রাহ্য করতে সক্ষম ছিলো। আমি ফোন ধরি নি। ফোন ধরলে কি আমার জীবনের গল্পটা অন্যরকম হতে পারতো? কে জানে! মাস তিনেক পরে আমার জেদ আর রাগ দূরীভূত হতে শুরু করলো। আমি ভাবলাম, তাকে আরেকটা সুযোগ দিয়েই দেখি! কিন্তু ততদিনে তার ফোন নম্বর পাল্টেছে, ফেসবুকেও আর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমাকে ব্লক করেছিলো সে। তখন আমার ভেতর ধীরে ধীরে একটা পরিবর্তন আসতে থাকে। ইস্পাতদৃঢ় জেদ আর আগুনমুখো রাগের পরিবর্তে স্থান করে নেয় শঙ্কা। সে অন্য কারো সাথে জড়িয়ে গেলো না তো? আমাকে ভুলে থাকুক, মানতে পারি। আমাকে ভুলে সারাজীবন একা থাকুক তাও মানতে পারি, যেমনটা আমি থাকবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমাকে ভুলে, তাকে ভুলে। কিন্তু সে আর কতদিন স্মৃতি আঁকড়ে ধরে জাবর কাটবে! সে তো কোন চতুষ্পদ গৃহপালিত জানোয়ার না! তার জীবনে যদি অন্য কেউ আসে, আমি কি মেনে নিতে পারবো? সে কি আমাকে ভুলে অন্য কারো সাথে জড়িয়েছে? দিনে দিনে জমতে থাকে প্রশ্নের পাহাড়। উত্তর মেলে না। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে একাকী প্রেমহীন কাটখোট্টা জীবন কাটানোর জন্যে প্রস্তুতি নিতে থাকি।
শাহীন
মানসিক চিকিৎসকের চেম্বার থেকে বেড়ুনোর পর শাহীনের মনে হতে থাকে, কী লাভ এসব করে! যে যন্ত্রণা তার বুকে বিষাক্ত তীরের মত বিদ্ধ হয়েছে, তা কি কখনও লাঘব হবে? সে বিষ তো ছড়িয়ে পড়েছে শরীরের সবখানে। হৃদয়ঘাতী নিরাময়ের অযোগ্য বিষ। ইয়াসমিনকে সে কখনও ভুলতে পারবে? ইয়াসমিন! বড় সুন্দর একটা মেয়ে ছিলো। তার মতো একটা কালো-মোটা-বেঁটে-গুণহীন ছেলের জন্যে বড্ড বেশি কিছু। এই সৌন্দর্যই তাদের সম্পর্কের ইতি টেনে দিলো। শাহীন সবসময় একটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতো। ইয়াসমিনের কতদিন তাকে ভালো লাগবে আর? সে কি অন্য কোন দেখতে সুন্দর ছেলের প্রতি আকৃষ্ট হবে না? তার তো আবার বড্ড উচ্ছল,বেড়ুনো স্বভাব। তার চারিদিকে গুণগ্রাহীর অভাব নেই কোনো। সেই ছেলেরূপী লোভী হায়েনাগুলোর মধ্যে থেকে কখন কে ক্যাসানোভার চরিত্রে আবির্ভূত হয় কে বলতে পারে! এসব ভাবনা থেকে শাহীন ইয়াসমিনের গতিবিধির ওপর চরম কড়াকড়ি আরোপ করলো। তার কারণেই সে শিক্ষা সফরে যেতে পারে নি, তার কারণেই তাকে সেলফোনের সিম বদলাতে হয়েছিলো। এতসবকিছুও ভালোবাসার মোহে অন্ধ হয়ে ইয়াসমিন সানন্দে মেনে নিয়েছিলো। কিন্তু তারপরেও যে সংশয় কাটে না! বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারিতে ইয়াসমিন উত্তীর্ণ হবার পরে তার সৌন্দর্য ছাপিয়ে যোগ্যতাটা শাহীনের মনে নতুন প্রতিবন্ধকটা সৃষ্টি করে। ইয়াসমিন বড্ড বেশি উঁচুতে উঠে যাচ্ছে না? সে যদি বিসিএস এর রিটেন এবং ভাইবাতেও টিকে গিয়ে উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা হয়ে যায় তাহলে কি আর তাকে পাত্তা দেবে? মনে হয় না। ততদিনে শাহীন বেশ ভালো খবরদারী আরোপ করতে সক্ষম হয়েছে ইয়াসমিনের ওপর। সে আদেশের সুরে ঘোষণা করলো, তার বিসিএস এর রিটেন পরীক্ষা দেয়ার দরকার নেই।
আর তখন থেকেই সম্পর্কের ভাঙ্গন শুরু। ইয়াসমিন ছিলো হিন্দি রোমান্টিক ছবি দেখে প্রেমের প্রতি ইউটোপিয়ান ধারণায় নিমগ্ন এক কল্পনাচারী তরুণী। হিন্দি ছবির মতোই তার প্রেমবিষয়ক দর্শন ছিলো সরল এবং কিছু অনুমেয় বাঁক এবং প্রতিবন্ধকতার মোড়কে আবৃত। সে কখনও ভাবতেও পারে নি বাস্তব জীবনের প্রেমে এতসব বিচিত্র জটিলতা থাকতে পারে। তাই প্রেমমগ্ন সে শাহীনের সব অন্যায় আবদার আর খবরদারী মেনে নিলেও বয়স বাড়ার সাথে সাথে বুঝতে পারে, কোন একটা কিছু খুব ভুল খাতে প্রবাহিত হচ্ছে। জীবন সম্পর্কে বাস্তব এবং বৈষয়িক মনোভাবের আগমনের সাথে সে বুঝতে পারে শাহীনের সাথে সম্পর্ক টেকসই হবার নয়। তাই কোন এক বিষণ্ন শরতদিনে সে শাহীনকে চুড়ান্ত কথাটি বলে দেয়। "এ সম্পর্ক রাখতে আমি আর আগ্রহী না"। বলার পর কিছুদিন তার মন খারাপ থাকলেও ধীরে ধীরে তার উপলদ্ধি হয়, কত বড় একটা আপদ থেকে বেঁচে গেছে সে। তার মাথাটা হালকা লাগতে থাকে, আর শাহীন মানসিকভাবে চূড়ান্ত অবনমনের শিকার হয়। বাধ্য হয়েই টানা এক বছর সাইক্রিয়াটিস্টের দ্বারস্ত হওয়া, এবং আবিষ্কার করা, জীবন কারো জন্যে থেমে থাকে না। বরং জীবনের চলার বাঁকে নতুন নতুন উপাদান উপহার হিসেবে সামনে আসে। ঠিকমতো বুঝে বেছে নিতে পারলেই হলো। ঠিক যেমন তার জীবনে এসেছিলো সোহানা!
চতুষ্কোণ
সোহানা এবং শাহীন। দুজনেই ছিলো বিপর্যস্ত এবং বিদ্ধস্ত অবস্থায়। এমবিএ করতে গিয়ে একই ইউনিভার্সিটির একই ক্লাশে পাশাপাশি বসার সূত্র ধরে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা। এরপর যা হয় আর কী, নিজেদের জীবনের কষ্টকর অভিজ্ঞতার কথা ভাগাভাগি করে তারা একে অপরের খুব ভালো বন্ধু হয়ে যায়। তারপর শোককে ভালোবাসায় পরিণত করে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। তবে তারা সঙ্গোপনে লুকিয়ে রেখেছিলো প্রাক্তন প্রেমের প্রতি প্রবল টানের কথা। সুযোগ পেলে যে আবার তারা প্রাক্তন প্রেমিক বা প্রেমিকার সাথে সম্পর্ক ঝালাই করতে এগিয়ে যাবে, তা নয়। তবে বুকের ভেতর গোপন দীর্ঘশ্বাসের ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হবার কথা তারা একে অপরকে জানতে দিতো না কখনই।
এদিকে ইয়াসমিন আর জুবায়েরের সমস্যাটা অন্য। তাদের কারোরই নিজেদের অতীত হয়ে যাওয়া ভালোবাসা নিয়ে মাথাব্যথা নেই, কিন্তু অন্যের অতীত নিয়ে খোঁচানোটা তাদের অবসেশনে পরিণত হয়েছে। কেন ইয়াসমিন শাহীনের সাথে সম্পর্ক করেছিলো, কেন সে আরো অপেক্ষা করতে পারলো না জুবায়েরের জন্যে, এসব বলে নিষ্ফল ক্রোধে জুবায়ের দেয়ালে ঘুষি মেরে নিজের হাত জখম করে। আর ইয়াসমিন জুবায়েরকে তিরষ্কার করে কেন সে সোহানার ফেসবুক মেসেজের জবাবে এড়িয়ে না গিয়ে উত্তর দেবার ভদ্রতাটা করলো! এসব ভাবতে গিয়ে তার হৃদয় জখম হয়।
পৃথিবীটা আশ্চর্য রকম ছোট। তাই এর বাসিন্দাদের জীবনের জটিল উপাখ্যানগুলো অনেকসময় জট পাকিয়ে একে অপরের মুখোমুখি হয়ে সৃষ্টি করে অনভিপ্রেত পরিস্থিতির। যেমনটা ঘটলো গল্পে উল্লেখিত দুই জোড়া প্রেমিক প্রেমিকার জীবনে। তারা জুটি বেঁধে ঘুরছিলো নিউমার্কেটে। হঠাৎ একে অপরের সাথে দেখা হয়ে যায় তাদের। শাহীন প্রথম দেখতে পায় ইয়াসমিনকে। দেখে তার মধ্যে যে চঞ্চলতা সৃষ্টি হয়েছিলো তা সে কোনভাবেই প্রবোধ দিতে পারে না। তার এমন চঞ্চল দৃষ্টি অনুসরণ করে সোহানা খুঁজে নেয় ইয়াসমিনের পাশে তার কাঁধ ধরে থাকা জুবায়েরকে। দীর্ঘশ্বাস গোপন করার কোন চেষ্টাই করে না সে। তার আশঙ্কাই সত্যি হলো! জুবায়েরের বাহুলগ্না হয়ে অন্য কোন মেয়েকে তার দেখতে হলো! ততক্ষণে ইয়াসমিন দেখে ফেলেছে শাহীনকে, আর জুবায়ের সোহানাকে। তাদের বিমুঢ় দৃষ্টি কিছুক্ষণের জন্যে অপ্রতিভ করে ফেলে নিজেদের। ইয়াসমিনই প্রথম নীরবতা ভাঙে,
-দেখো, আমার দিকে এগিয়ে আসছে যে ছেলেটা সেটাই শাহীন। তুমি দয়া করে কোন সিনক্রিয়েট করো না।
-ওটা শাহীন! গড! ওর পাশে ওটা কে, জানো?
-কে! সোহানা না নিশ্চয়ই!
-গড ফরবিডস! ওটাই সোহানা।
ততক্ষণে তারা একে অপরের মুখোমুখি হয়ে গেছে। সোহানা ভাবছে, সেদিন কেন সে জুবায়েরের ফোন ধরলো না! তাহলে ইয়াসমিনের জায়গায় সে থাকতে পারতো। শাহীনের বুক ধড়ফড় করছে, ইয়াসমিনকে দেখে মনে হচ্ছে এতদিনের কাউন্সেলিং, ঔষধপত্র, চিকিৎসা সব বুঝি গেলো বৃথাই! তার অসুস্থতা ফিরে আসছে আবার! ইয়াসমিন ভাবছে, এই ডাইনীটাই তাহলে সোহানা! এর মধ্যে কি মধু পেয়েছিলো জুবায়ের? বিচ! জুবায়েরের তখন ইচ্ছে করছে সভ্যতার সমস্ত নিয়ম কানুন ভেঙে ফেলে শাহীনের কলার ধরে ঝাঁকিয়ে বলে "হারামজাদা! কেন তুই আমাকে ইয়াসমিনের জীবনের প্রথম পুরুষ হতে দিলি না?"
পরস্পরকে অতিক্রম করার সময় তাদের মধ্যে কোন কথা হয় না। তবে দৃষ্টির দূরদর্শীতায় তারা জেনে যায় এই মৌন আলাপ তাদের অনেক ভোগাবে। কাকতালীয়ভাবে তারা একে অপরকে একই প্রশ্ন করে বসে, জুবায়ের ইয়াসমিনকে সুধোয় যদি তারা আজ বাসায় গিয়ে দেখে যে সোহানা আর শাহীন তাদের পাশের ফ্ল্যাটেই ভাড়া নিয়েছে তাহলে কী হবে? নতুন করে প্রেম চাগাড় দিয়ে উঠবে? অতীত স্মৃতি খল অভিনেতা হিসেব উচ্চকণ্ঠে হেসে দুর্দান্ত গতিতে তাদের ভালোবাসার প্রাসাদে প্রবেশ করবে? শাহীন আর সোহানার মধ্যেও এমন কথার আদান প্রদান হয়, তবে তা নীরবে, অবচেতন মনের পাগলাঘন্টিতে চেতন মনের জাগরূক হবার অভব্যতায়।
চতুষ্পদ
তারা সবাই সুস্থ সবল মানুষ। হাত এবং পা অক্ষত। চারটে হাত পা প্রতিজনের, কিন্তু এ অংকের হিসেব করার সময় সবার হাত-পা একটি করে ধরতে হবে। বাকি তিনটির একটি করে খেয়েছে মোহ, একটি ঈর্ষা, আর একটি ক্ষোভ। তারা চারজনে যদি কখনও আবার এক হয়, যদি তাদের অমূলক এবং অবিশ্বাস্য নাটুকে চিন্তাকে সত্যি করে পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকে, কিংবা এতকিছু যদি নাও হয়, অনেক দূরে থেকে অতীতকে কাছে টেনে বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে গ্রাস করতে চায়, তাহলে তাদের শূন্যস্থানের মাঝখানের অনুর্বর ভূমি ভরে উঠবে অসংখ্য ধারালো ক্যাকটাসে। আর তারা তাদের ক্ষয়ে যাওয়া হাত পা গুলি বিসর্জন দিয়ে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত-শরীর-মন সব একীভূত করে একটি করে হাত বা পা নিয়ে তৈরি করবে এক কাঁটাখেকো অদ্ভুত প্রাণী। যাদের প্রিয় খাদ্য জীবনসংহারী ক্যাকটাস।
অথচ পাশেই ভালোবাসার উর্বর ভূমি, স্বচ্ছ জলাধার, স্নাত হয়ে সবকিছু ধুয়ে মুছে ফেলার সুবর্ণ সুযোগ।
কিন্তু অত পথ তারা যাবে কীভাবে, তাদের তো মাত্র একটি করে হাত বা পা, এবং পরস্পর সংযোগে তৈরি হয়েছে এক উদ্ভট মন্থর প্রাণী!
সেদিন নিউমার্কেটে এমন একটি অদ্ভুত মন্থর কাঁটাখেকো হাঁচড়ে পাঁচড়ে ছেচড়ে যাচ্ছিলো, অন্য সবার দৃষ্টি এড়িয়ে,
গোপনে।
৬৩টি মন্তব্য ৬৩টি উত্তর
পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন
আলোচিত ব্লগ
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!
সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন
কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী
ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন