somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিরপেক্ষ শান্তিকামুকেরা

১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ঘুমপর্ব
হঠাৎ করেই আমাদের দেশে যুদ্ধ লেগে গেলো। কতদিন ধরে যুদ্ধ চললো তা মনে নেই। বছরাধিক তো হবেই। যুদ্ধ শেষে তারা সবাই ক্লান্ত, বিদ্ধস্ত এবং পরিশ্রান্ত ছিলো। এক পক্ষ ছিলো জয়ের আনন্দে মাতোয়ারা, আরেকদল পরাজয়ের বেদনায় বিমূঢ়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে আমি ছিলাম অন্যতম। কেন যুদ্ধ হয়েছিলো, বলতে অপারগ। যুদ্ধের পুরো সময়টাই আমি তথাকথিত নিরাপদ জায়গায় অন্তরীণ ছিলাম। তথাকথিত বলছি এ কারণে, আসলে এক ইঞ্চি জায়গাও নিরাপদ ছিলো না। আমার সাথে যারা আশ্রয় নিয়েছিলো, তাদের বেশিরভাগই মৃত। নিঝুম মফস্বঃলের ঘুড়ি ওড়ানো দুপুর বা জোনাকরাত, কিছুই যুদ্ধের আওতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে নি। আমি পড়াশোনা করতাম দেশের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত একটি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার পর দেশের বাহিরে প্রতিবেশি অঞ্চলের এক পাহাড়ী অঞ্চলে সময় কাটানোর কথা ছিলো আমাদের। কিন্তু আমরা ভাবলাম, বাড়তি দুটো দিন থেকেই যাই। ছয় মাস কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে পরীক্ষার জন্যে। তাই পরীক্ষার পরপরেই ভ্রমণের ধকল পোহাতে চাই নি। আমি, রবি, রাসেল, সিরাজ, মেহেদী আর হীরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে অবস্থান করে ঘুমিয়ে, কার্ড খেলে, আর নেশা করে কয়েকটা দিন কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। হায়! কী সর্বনাশা সিদ্ধান্তই না ছিলো সেটা! যুদ্ধ বেধে গেলে দেশের বাইরে কোথাও যাবার উপায় ছিলো না। আমরা আটকা পড়ে গেলাম একদম। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেও থাকার উপায় রইলো না। সেখানে জোর তল্লাশি চলছিলো। আমরা লুকিয়ে কোনমতে শহরের শেষ প্রান্তে একটা ঘর বেছে নিই সস্তায়। সেই এলাকাটায় যুদ্ধ তখনও ছড়িয়ে পড়ে নি। আমাদের টাকা ফুরিয়ে আসছিলো। সমস্ত রকম বিলাসব্যসন বাদ দিতে হয়েছিলো। কিন্তু যুদ্ধ থামছিলো না। আমাদের এখানে সংবাদপত্র আসার ব্যবস্থাও ছিলো না। তাই আমরা যুদ্ধের হালনাগাদ জানতে পারি নি। বিদ্যুতের অভাবে টেলিভিশনও ছিলো অচল। এর তার কাছ থেকে গুজব বা প্রকৃত সংবাদ শুনেই অবস্থা ঠাহর করে নিতে হচ্ছিলো। তাই যুদ্ধ কেন হয়েছিলো, কারা আধিপত্য বিস্তার করছে, আদর্শিক লড়াই বা ক্ষমতার দম্ভ, কোন পক্ষ জিতে যাচ্ছে, আমরা কোন পক্ষে যাবো কিছুই ধারণা করা সম্ভব ছিলো না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি আমাদের দলটা বেশিরভাগ সময়ই ঘুমিয়ে কাটাতো। যুদ্ধাবস্থায়ও এর ব্যত্যয় ঘটে নি। আহা ঘুম! যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির ছদ্মবেশে অশ্লীলরকম নিরপেক্ষ থাকার কী দারুণ একটা সুযোগ! আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ সোমত্ত জোয়ান ছেলেই অবশ্য যুদ্ধে গিয়েছিলো। যারা দুর্বল তারাও নৈতিক সমর্থন দিয়ে গেছে। এমন কী মেয়েরাও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে, পরবর্তীতে তারকাখচিত রণখেতাব পেয়েছে যাদের কেউ কেউ। আমাদের ঘুম এবং অজ্ঞানতা দেখে তারা বিদ্রুপ করতো। কানে তুলো গুঁজে আমরা বধির হয়ে যেতাম। খামোখা আমাদের নিরবিচ্ছিন্ন জীবনে আপদ টেনে আনার কোন মানে হয় না!

যুদ্ধভাষণ

"প্রিয় কমরেডরা, কাগজ কেটে ফুল-ফল, চোর-ডাকাত খেলার সময় নেই এখন। আপনারা জানেন, গত চব্বিশ বছর ধরে আমরা পশ্চিমা পরাশক্তির কাছে নিপীড়িত, নির্যাতিত। এখনও যদি ঘরে বসে থাকি, এখনও যদি অপমান সহ্য করে নিজের আখের গোছানোর নিরাপদ পন্থা অবলম্বন করি, তাহলে এই দেশের মাটি আমাদের ক্ষমা করবে না। দেশের কাছে আমাদের অনেক ঋণ, যেমনটা আমাদের মায়ের কাছে। মৃত্তিকাস্তন পান করে আমরা বলবান হয়েছি, দেশকে মাতৃসম ভেবেছি। এখন ঋণ পরিশোধের সময়। আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায় ওরা। আমাদের প্রাপ্য সম্মান প্রদান করতে কুণ্ঠিত তারা। আমাদের দেশটাকে তাদের খেলার মাঠ ভেবে যা ইচ্ছে করে যাচ্ছে তারা। আমরা নেতাদের ইঙ্গিতের অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু তাদের এক পক্ষ ছিলো বড় আপোষকামী। বন্ধুরা, নেতা ছাড়া যুদ্ধে জয়লাভ করা যায় না। তাই আমরা অপেক্ষায় ছিলাম একজন নেতার উদাত্ত আহবানের। গত সাত তারিখে তিনি আমাদের সর্বস্ব সম্বল করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এখন আর ঘরে বসে থাকার সময় নেই। মায়ের কাছে আরেক মাকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো। বাবার কাছে দেশরক্ষার প্রতিজ্ঞা করো। বোনের কাছে তার সম্ভ্রম রক্ষার নিশ্চয়তা দাও। ভাইকে বলো রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়তে। বন্ধুরা, প্রিয় ফুল-ফল খেলার সময় নেই এখন। ঐ শোন দামামা বাজছে যুদ্ধের। নৈতিক শক্তিতে বলবান হয়ে আদর্শের লড়াইয়ে জয়ী হবার প্রতিজ্ঞা করো। অবকাশযাপন রহিত রাখো। একটা পরীক্ষা শেষে আমাদের আরো বড় একটা পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হচ্ছে আজ। এ লড়াইয়ে আমাদের জিততেই হবে"।

ঘুমপর্ব
তো এভাবেই শুরু হয়ে গেলো যুদ্ধ। জনৈক মহান দেশবন্ধুর আদেশে নিজের প্রাণটাকে খুচরো পয়সার মতো সস্তা করে বিকিয়ে দিতে প্রস্তুত হলো আমাদের গরিষ্ঠ অংশ। আমরা তখন কেবল ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছি। ঘড়িতে আটটা বাজলে ডাইনিংয়ের ঘন্টা বেজে ওঠে, টুং! ডাইনিংয়ের খাবার আমাদের মুখে রোচে না। তাই বাড়তি খরচ করে বাইরেই খাই। যেহেতু আমরা যুদ্ধে অংশ নিচ্ছি না, সবাই আশা করেছিলো আমরা তাদের পক্ষ অবলম্বন করে নৈতিক সমর্থন দিয়ে যাবো। আসিফ একদিন এসেছিলো তার দল নিয়ে যুদ্ধের মন্ত্রে আমাদের উদ্বুদ্ধ করতে। সে অনেকক্ষণ কড়া নেড়ে চলে গিয়েছিলো। কারণ, আমরা যে তখন গভীর ঘুমে বিভোর! ঘুম থেকে উঠে কিছুটা মদ্যপান এবং আহার শেষে কার্ড খেলতে বসে যেতাম অতি উচ্চলয়ের ধাতব সঙ্গীতের লয়ে মিলমিশ হয়ে। ফলে বাইরের কোন শব্দ আমাদের কানে যেতো না। নিজেদেরকে জন লেননের ইউটোপিয়ান আদর্শে মিথ্যেই বলীয়ান ভেবে শান্তিবাদী সেজে থাকতে বড় আনন্দ। যুদ্ধ হচ্ছে হোক, এখন আমাদের কেউ না ঘাঁটালেই হয়। প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যুদ্ধের শেষে বিজয়ী দলের আনন্দমিছিলে আমরা সোৎসাহেই অংশগ্রহণ করবো।

যুদ্ধভাষণ
...অথচ এই লড়াইটা আমাদের একার না। এই লড়াইয়ে সবার অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। আপনারা চাইলেই যুদ্ধবিরোধী অহিংস ভাষণ দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্যাতি কুড়োতে পারেন। আমরা চাইলেই চুপচাপ থেকে মুখ বুঁজে আঘাত আর অপমান সহ্য করে যেতে পারি। কিন্তু তা কী করে সম্ভব বন্ধুরা! কোমল ঘাসে গা এলিয়ে প্রিয়তমার সাথে খুনসুটি করতে গিয়ে তোমরা কি শুনতে পাওনা মাটির কান্না? হাঁটার সময় তোমাদের জুতোয় জীর্ণ বসুন্ধরার তোবড়ানো হাড়কুঁচি আর ক্ষত থেকে নির্গত রক্তবিন্দু পায়ে লেগে যায় না? ঘুমোনোর সময় বাতাসের ফিসফিস শোনো না, আশ্রয় চাইছে তোমার কাছে। তুমিই পারো এ দেশটাকে সামরিক শাসন আর অত্যাচারের জাঁতাকল থেকে বের করে নিয়ে আসতে। এতকিছু জানার পরেও তোমাদের যাদের ঘুমের আবেশ কাটে না, তাদেরকে আমরা বিষবৎ পরিত্যায্য করলাম। শত্রুকে ত্যায্য করা যায় না, কারণ শত্রুর মুখোমুখিই হতে হয়। কিন্তু তথাকথিত নিরপেক্ষ শান্তিবাদীরাই সবচেয়ে ভয়ংকর। বন্ধুরা, দেশের এই পরিস্থিতিতে হয় তুমি আমাদের পক্ষে, নয়তো বিপক্ষে। এর মাঝামাঝি কোন অবস্থান নেই"।

যুদ্ধের আগে ও পরে ঘুমার্তরা

দয়া করে যুদ্ধকালীন অবস্থার কোন খতিয়ান আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করবেন না। কোন দেশ হেরে গেলো, স্বদেশ না অন্যদেশ তাতে কিছু এসে যায় না। আমরা শুধু নিরাপদে থাকতে চাই। আরাম করে ঘুমোতে চাই। যুদ্ধের আগের অবস্থা যদি আমাদের ভাষ্যে শুনতে চান, তা খানিক বলা যাবে। আমরা ভালোই ছিলাম। আমরা আমাদের মেধা দিয়ে বিবাদমান দুই পক্ষের ভাষাই আত্মস্থ করেছিলাম। যেকোন একটা ভাষা হলেই আমাদের চলে যেতো। যেকোন একটা জাতীয় সঙ্গীত হলেই আমাদের চলতো। দেশের অন্যভাগের মানুষেরা চৌকস। তারা আমাদের মতো ভেতো না। তারা নিয়মিত রুটি খায়। তারা বলবান এবং সুদর্শন। তারা আমাদের ভাষার কবিতা এবং গানকে ধর্মপরিপন্থী বলে নাকচ করে দিতে চেয়েছিলো। তারা তাদের ভাষাকেই সবখানে প্রচলন করতে চেয়েছিলো। আরে বাবা, সেসব দাবী মেনে নিলেই তো হয়! খামোখা কার্ফিউ ভঙ্গ করে রক্ত বিলোনোর জন্যে ক্ষেপে উঠলে কেন বাপ! আচ্ছা, ক্ষেপে উঠেছিলে ভালোই করেছো। তোমাদের দাবীও প্রতিষ্ঠিত হলো। এখন তোমাদের পক্ষে গান গাইতে কোনো আপত্তি নেই। আমরা তোমাদের ভুলবো না। যাও, বললাম তো ভুলবো না! তো এটাই কি যথেষ্ট ছিলো না? তারপরেও কেন স্বাধিকার, আধা ডজন দফা ইত্যাদি নিয়ে জেল খাটা, আরো রক্ত, ঘাম এবং প্রাণ বিসর্জন? আমাদের দেখে শেখো বুঝলে? আমাদের ঘুমচোখে স্বাধীকারের অবাস্তব স্বপ্ন ধরা দেয় না। এর চেয়ে বরঙ সেইদিন যে সম্মিলিতভাবে স্বপ্ন দেখলাম পশ্চিম আকাশে সামরিক প্রভু সাঁজোয়া যানসহ উদিত হলেন, তা দেখে ভ্রাতৃত্ববোধের স্বপ্নদোষে ভোগা ভালো। সেই স্বপ্নের পর আমাদের সবারই অধিক উত্তেজনায় বীর্য নির্গত হলেও আমরা কেউ পরিষ্কার হবার অভিপ্রায়ে গোসল করি নি। কেউ যদি তোমার ওপর উপগত হতে চায়, এবং তাতে যদি প্রাণটা বাঁচে সেটাই কি শ্রেয় না? আবার কদিন পরে দেখলাম তোমরা ঘোড়দৌড়ের ময়দান দখল করে সমাবেশ করছো। কত মানুষ! হাজার তো ছাড়! লাখ পেরিয়ে নিযুতের ঘরে চলে গিয়েছিলো সংখ্যাটা। সেটা দেখেও আমাদের ভালো লেগেছিলো। নিরপেক্ষভাবে সবকিছু বিশ্লেষণ করতে না পারলে ক্ষান্ত দাও! উজবুকের মতো লড়াই করে প্রাণ খোয়াতে যাওয়া কেন? সেদিন কি বলা হয়েছিলো আমাদের স্পষ্ট খেয়াল নেই। তবে তোমাদের জমায়েত দেখে আশান্বিত এবং শঙ্কিত দুই'ই হয়েছিলাম। আশান্বিত এ কারণে, কোন পক্ষই কারো চেয়ে কম না, শঙ্কার কারণ, যদি এর ফলে যুদ্ধ বেঁধে যায়! আমাদের শান্তিকামী না বালে শান্তিকামুক বলতে পারো। একটু শান্তি পেলে আমরা বর্তে যাই। শান্তিকে দেখে আমাদের কামভাব জাগে। তাই আমরা শান্তিকামুক। এবং তোমাদের ভাষায় "অশ্লীলরকম নিরপেক্ষ"।

এখন...

যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। আমরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে চললাম মুখ গোমড়া করে। একটি নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে উল্লসিত হলাম। জায়গাটা সরিসৃপদের শীতনিদ্রার মত যুদ্ধনিদ্রা দেয়ার জন্যে বেশ ভালো। কিন্তু ভালো ব্যাপারগুলো আর সর্বৈব ভালো থাকে কই! একদিন রাতে, আমরা যখন গভীর ঘুমে নিমগ্ন, তখন বিকট আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো। উঠে দেখি আকাশে চাঁদ তারার বদলে গুলিবৃষ্টি। মর্টারের আলোক রোশনাই। দৃশ্যটা দূর থেকে দেখতে চমৎকার। কিন্ত বিপত্তি বাঁধালো যখন আচমকা একটা মর্টার শেল এসে আমাদের ছয়জনের মাঝে একজনকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো। পরবর্তীতে এই ঘটনা নিয়মিত ঘটতে থাকলো, এবং আমরা ছয়জন থেকে কমে তিনজন হয়ে গেলা। বাকি রইলাম আমি, সিরাজ আর পলাশ। যুদ্ধ সম্পর্কে আপাতত আমরা এই বলতে পারি, আমাদের তিনজন নিহত হয়েছিলো। কারা মেরেছে তা অবশ্য জানতে পারি নি। যদি যুদ্ধের পরাজিত পক্ষ হয়, তবে প্রতিশোধের নেশায় আমরা জয়ী দলকে উচ্চকন্ঠ শ্লোগান দিলেও দিতে পারি। আর যদি জয়ী দলের কর্ম হয় এটা... তাহলে কিছুই করার নেই। আমরা শান্তিকামুক মানুষ। যুদ্ধ বুঝি না, মায়ের ছেঁড়া কাপড়ের অপমান বুঝি না, ভাইয়ের কাফনের কাপড়ের খরচা দিই না, বোনের সম্মান রক্ষাও আড়ম্বর মনে হয়। শান্তি দেখলে আমাদের উত্থিত লিঙ্গ থেকে কামরস বের হয়। আমরা শান্তিকামুক।

যুদ্ধকালীন সময় সম্পর্কে আমরা আরো কিছু তথ্য দিতে পারি। আমাদের মধ্যে সিরাজটা ছিলো একটু বোকা ধরনের। নিরাপদ যুদ্ধনিদ্রার আশ্রয় ছেড়ে সে একদিন গেলো শরীরের আড়মোড়া ভাঙার জন্যে বাইরে হাঁটতে। আমরা নিদ্রালু কন্ঠে পইপই করে নিষেধ করলাম, বাইরে যেও না, যুদ্ধজুজু আছে। সে আর শুনলো কই! সে বাইরে বের হলো, তখন যুদ্ধের অন্তিম অবস্থা। কোন এক পক্ষ জিতে যাচ্ছে, কিন্তু কারা সেটা তা আমরা জানি না। সিরাজ বাইরে গেলো, এবং একদল ছাগলের শিঙের আঘাতে পর্যুদস্ত হলো। ছাগলের দল শুধু এই করেই ক্ষান্ত হয় নি, তাদের চাঁদ-তারা অঙ্কিত শিং নেড়ে তেড়ে এসেছিলো আমাদের ঘর পর্যন্ত। ভাগ্যিস আমাদের ছাগলের ভাষা জানা ছিলো! আমরা সসম্মানে তাদেরকে আমাদের গৃহে অভ্যর্থনা জানালাম। তারা আমাদের আকুল এবং করুণ ব্যা ব্যা শুনে সন্তুষ্ট হলেও সিরাজকে ফাঁসির দন্ড দিলো। ছাগলের দলকে আমরা চিনতাম না। তবে তাদের যুদ্ধংদেহী মনোভাব লক্ষ্য করে ঠিকই বুঝলাম তারা যুদ্ধের কোন এক পক্ষ, স্থানীয় এবং তারা চায়, আমরা যেন তাদের আদেশ অনুযায়ী আমাদের বন্ধুটিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হুকুম তালিম করি। শেষ পর্যন্ত বীরত্বের সাথে আমরা তা করেছিলাম। আমাদের বন্ধুটির শেষ আহারের জন্যে তারা যথেষ্ট পরিমান কাঁঠালপাতা দিয়ে গিয়েছিলো। ফাঁসি কার্যকর করার আগে তাকে খাইয়ে অনেকখানি বেঁচে গিয়েছিলো। যেটা খেয়ে আমরা আকালের সেই সময়ে ক্ষুধানিবৃত্ত করেছিলাম। এই হচ্ছে যুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের সর্বশেষ স্মৃতি, এবং একমাত্র বীরত্বগাঁথা। এই সাহসিকতার পুরষ্কার স্বরূপ আমরা কাঁঠালপাতায় ছাগলায়িত বীরচিহ্ন পেয়েছিলাম। সেটা আমরা যত্ন করে রেখে দিই। ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে। আর যদি তারা পরাজিতপক্ষ হয়, যদি বাঘের দল জয়লাভ করে, তবে মধ্যবর্তী প্রাণী, ক্ষমতাবান প্রাণীদের কাছ থেকে সেটা কৌশলে ব্যাঘ্রায়িত করা যাবে খন।

যুদ্ধ শেষ এখন। কারা যেন আনন্দমিছিল করতে করতে এগিয়ে আসছে এখানে। যাক, অবশেষে মিটলো ব্যাপারটা। আমরা, শান্তিকামুকেরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তাদের বিজয়রথে শামিল হই বন্ধুর লাশ নিয়ে। লাশের চেয়ে ভালো অবলম্বন আর কী আছে জয়ীদের সহানুভূতি পেতে! আমরা নিরপেক্ষ ছিলাম। সুতরাং যে কারো বিজয় মিছিলেই মিশে যেতে পারি।


৪২ বছর পর...

যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত মামলার রায় হয়েছে। তা আবার এক পক্ষের পছন্দ হয় নি। আবার সেই পুরোনো নাটকের মঞ্চায়ন। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো। শহরের ব্যস্ততম এলাকায় জমায়েত হতে শুরু করলো আবালবৃদ্ধবণিতা। শান্তিকামুক আমরা ততদিনে অনেক পরিণত হয়েছি। আসন্ন সহিংসতার ক্ষতি থেকে বাঁচাতে আমরা তাদের নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করি। তাদেরকে বোঝাতে চাই, একজনের অপরাধ প্রায় মওকুফ করা হয়েছে বলে সবাই ক্ষতি স্বীকার করতে পারে না। তাদেরকে প্রশ্ন করি, তারা শুধু এই রায়ের জবাবে একত্রিত হয়েছে কেন। দেশে কি আর কোন সমস্যা নেই? প্রশ্ন করতে গিয়ে মাতৃভাষাটা ভুলে গিয়ে বহুদিন আগে রপ্ত করা ছাগভাষাটা বেশ কাজে লাগে। এই প্রশ্নগুলো করার জন্যে এ ভাষাই সর্বোত্তম। প্রথমে একটু সমস্যা হলেও ছাগলের দল আমাদের সাহস যোগায়। যুদ্ধংদেহী মনোভাব পরিত্যাগ করে তারাও আজ আমাদের মতো নিরপেক্ষ শান্তিকামুক। তবে আমাদের শাণিত যুক্তিগুলো বেয়াদব আবেগের মুখোমুখি হলে আবারও নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যেতে হয়। এবং পেয়েও যাই। ছাগলের দলের তৈরি বাঁশের কেল্লায় জমায়েত হয়ে সতর্ক নজর রাখি জমায়েত তরুণদের রাগী চোখে। তাদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চললে বিব্রত আমাদের কাছে গল্প এবং কলাম লেখার ফরমায়েশ নিয়ে আসে সুবিধাবাদী সর্বোচ্চ বিক্রীত এবং বিকৃত প্রভাবশালী খবরের কাগজ। দুই দিক থেকেই অবস্থা পোক্ত করে আমরা এবার নিজেদের মনমতো যুদ্ধ এবং প্রতিবাদের লিপি তৈরি করি। একদম নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে। যদিও বিয়াল্লিশ বছর আগেকার যুদ্ধের স্মৃতি ভুলে গিয়েছি আমরা স্টেডিয়ামে ভাতৃত্ববোধের প্রণোদনায় মেতে উঠে বাঘেদের পাশাপাশি পরাজিত ছাগলের দলকেও সমান সমর্থন দেয়ার ফলে।

গত যুদ্ধে অতি সাবধান থাকতে গিয়ে আমাদের বন্ধুদের প্রাণ গিয়েছে। এইবার, পরিণত মস্তিষ্কের আমরা আর তা হতে দেবো না। কখনও সর্বাধিক বিক্রীত এবং বিকৃত কাগজের ছত্রছায়ায়, কখনও বাঁশের কেল্লার কাঁঠালপাতার ছায়ায় বেশ নিরাপদেই থাকি আমরা, নিরপেক্ষ শান্তিকামুকেরা।

৭৫টি মন্তব্য ৭৫টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×