(১)
মেসের নাম শান্তিনিকেতন। নামের সাথে মিল রেখে কামরুল আর সাজ্জাদের দুইজনের সংসার বেশ শান্তিতেই কাটছে বলা যায়। দুজনই চাকুরি করে। কামরুল বিবাহিত আর সাজ্জাদ অবিবাহিত। চাকুরিবেলা শেষে ঘরে ফিরে কামরুল ধূলোবালি, ঊর্ধ্বতনের শাসানি আর কন্ডাকটরের সাথে ভাড়া নিয়ে খিটমিট ভুলে গিয়ে সেলফোন নিয়ে বসে যায় বউয়ের সাথে আলাপে। যার অল্পকিছু অংশ সাংসারিক, আর বেশিরভাগই কামজ। যথাসম্ভব নিচু গলায় কথা বললেও সাজ্জাদ ওই ফিসফিসানির মধ্যেই বোঝা না বোঝা কথাগুলোর অর্থ নিজের মত করে দাঁড় করিয়ে নিয়ে সুখযৌনকল্পনায় মনোনিবেশ করতে পারে। সুতরাং, সান্ধ্যকালীন বিনোদনেও মেসের অন্যান্য খরচের মতো সুষম কামজ বন্টনের ভাগ পেয়ে দুজনেই বেশ খুশি থাকে। কামরুল যখন জানতে চায় রোখসানার পরনে কী, সাজ্জাদ তখন তার শ্রবণেন্দ্রিয়কে সজাগ করে। এরপর যখন কাপড়ের রঙ জানতে চায়, ওপাশের মিষ্টি রিনরিনে কামনামদির কৃত্রিম অনিচ্ছুক কন্ঠটা সে কল্পনা করে নেয়,
-লাল কামিজ পইরা আছি। কেন কনতো? আপনের মতলব ভালা না। আর কিছু জিগাইবেন না।
যথারীতি কর্ণপাত না করে কামরুল জিজ্ঞেস করতে থাকে অন্তর্বাসীয় কাপড়ের রঙ, কামিজের নিচে বক্ষবন্ধনী পড়েছে কী না, পড়লে তা কী রঙয়ের, আশেপাশে কেউ আছে কী না ইত্যাদি।
এই পর্যায়ে সাজ্জাদ তার নিম্নাঙ্গকে হস্তনির্দেশিত আহবান জানানো শুরু করে জেগে ওঠার জন্যে। ওপাশের কথাগুলো সে কল্পনা করে নেয়,
-কালা রঙের বেরা পরসি। আপনে যেটা দিসিলেন ঐডা। ছি! কী কন এইগুলা, আমি পারুম না।
এসময় কামরুল কী বলবে তা সাজ্জাদের মুখস্থ,
-দরজাটা বন কইরা দেও না!
তারপর কামরুলের গলা ভারী হয়ে আসার সমানুপাতে সাজ্জাদের শরীরে হস্তচালিত কম্পন বৃদ্ধি পেতে থাকে। সে অপেক্ষা করে শেষ সময় পর্যন্ত। তাদের কথা শেষ হলে সাজ্জাদ গোসল করতে যায়।
কামরুল যে এসব বোঝে না তা, না। তার বরং গর্ববোধ হয় এই ভেবে যে কেউ একজন তার বিশেষ পরিস্থিতির সুযোগের অপেক্ষায় বুভুক্ষু থেকে মনোরঞ্জন করছে। ঐ মুহূর্তটাতে তার মনে হয় সে কেবল একজন কামলা খাটা অধস্থন কর্মচারী না, যাকে সবসময় ঊর্ধ্বতন মহলের নজরদারীর ব্যাপারে তটস্থ থাকতে হয়। তার ইচ্ছে অনিচ্ছের ওপর অন্য একজনের দেহজ বিনোদন নির্ভরশীল। নিজেকে তার তখন বিরাট হোমরা-চোমরা মনে হয়। এই কলমপেষা নিস্তরঙ্গ জীবনে এটুকুই তার অনেক বড় অর্জন, সে অন্তত তাই মনে করে। শান্তিনিকেতন মেসের সুখময় পরিবেশ শুধুমাত্র এই দুইজনের পারস্পরিক অদৃশ্য সমঝোতার ভিত্তিতে রচিত কাম উপাখ্যানে নিহিত না। বিনোদনের জন্যে তারা সস্তা ডিভিডি প্লেয়ারে হিন্দি সিনেমা ও গান দেখে। তারা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজকর্মেও নিয়োজিত। দাবা খেলে সময়টা তাদের বেশ কেটে যায়। যদিও তারা দাবার আধুনিক রীতি, গিয়াকো পিয়ানো বা সিসিলিয়ান ডিফেন্স, ক্যাসলিং, এসব সম্পর্কে কোন ধারণা রাখে না। প্রথমে ঘোড়ার চাল দেয়া যাবে কী না, দুই নৌকা এক ঘর করে এগিয়ে দেয়া যাবে কী না এ নিয়ে প্রায়ই তাদের বচসা হয়। তবে খেলা শেষে জয়ীজনের আত্মপ্রসাদ হয় দেখার মতো। ওইদিন রাত্রে তার ভালো ঘুম হয়। সিগারেট একটা বেশি টেনে ফেলে। দাবার মতো সূক্ষ্ণ বুদ্ধির খেলায় জয়ী হয়ে তারা নিজেদের বাহবা দেয় এই বলে, "বুদ্ধি, জ্ঞান কম নাই তোমার। শুধুমাত্র ভাগ্যদোষেই এই কেরাণীর জব করতাছো"। তাদের জীবন এভাবেই ধীরগতিতে সম্পূরক ভালো বা মন্দ থাকায় বেশ কেটে যায়।
(২)
কদিন ধরে তাদের দুইজনের মন ভালো নেই। অফিসে দুজনকেই নানা ঝামেলায় পর্যুদস্ত হতে হচ্ছে। তাদের আনন্দ-বিনোদন-সুখের সাথে বেদনা এবং অশান্তিটাও সমান্তরালে আসাটা কাকতালীয় ব্যাপারই বটে। ইনক্রিমেন্ট হবে ভেবে রোখসানাকে একটা জামদানী শাড়ি এবং কিছু কসমেটিকস কিনে দিয়েছিলো কামরুল । কিন্তু এখন ইনক্রিমেন্ট তো দূরের কথা, চাকুরি বাঁচিয়ে রাখাই দায়! তাই বাসায় ফিরে সে এখন আর রোখসানার সাথে রঙ্গকথায় মেতে ওঠে না। ফোনই করে কালেভদ্রে। নতুন মুক্তি পাওয়া হিন্দি গান শুনতেও তেমন ভালো লাগে না। দাবার কোর্টটাও বের করা হয় না অনেকদিন। মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে হাজারো অশান্তির মাঝেও বিনোদন খুঁজে নিতে হয়। তাদের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটলো না। সাজ্জাদ একদিন দাবার কোর্টটা ঝাড়মোছ করে কামরুলকে আহবান জানালো,
-হবে নাকি কামরুল ভাই এক দান?
দাবা খেলতে বসলে এক দান কখনও খেলা হয় না। দুই-তিন দান খেলা হয়েই যায়। সময় এখন সিন্দাবাদের ভূতের মত তাদের পিঠের ওপর চেপে বসে আছে। সেটাকে ঝাড়া দিয়ে একটু ভারমুক্ত হওয়ার তাগিদে কামরুল সম্মতি জানালো। তবে দাবা খেলা জমলো না অন্যদিনের মতো। যেসব নিয়মের ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত অমিমাংসিত ছিলো, সেসব নিয়ে অন্যদিন তাদের হালকা বচসার পর সানন্দে কেউ না কেউ মেনে নিতো। তারপর খেলা চলতো রাত পর্যন্ত। দাবা খেলায় রাজা-উজির মারার সুখকল্পনায় মজে থেকে ঘুমুতে যেতো জীবনের সাফল্যের সনদ আরো ঋদ্ধ হয়েছে ভেবে। কিন্তু এবার সাজ্জাদ প্রথম চালে দুই সৈন্য এগিয়ে দিলে সেটা নিয়ে দীর্ঘ বাকবিতন্ডা হয় তাদের। ক্ষেপে উঠে কামরুল বলে,
-ঐ মিয়া, দুই সৈন্য আগায় দিলেন যে? এইসব বালের নিয়ম কৈত্থিকা পাইছেন?
কামরুল মুখ খারাপ করায় সাজ্জাদও তেড়ে ওঠে,
-কই পাইছি মানে? এটাই ইন্টারন্যাশনাল নিয়ম। না জাইনা হুদাই ফাল পারবেন না।
-ইন্টারন্যাশনালগিরি মারাবেন না আমার লগে। কাজ করেন তো ব্রোকার হাউজে। আপনে ইন্টারন্যাশনাল নিয়মের কী জানেন?
চাকুরি নিয়ে কথা বলায় আঁতে ঘা লাগে সাজ্জাদের,
-আপনেই বা কী শ্যাটার চাকরি করেন? নামেই কোহিনূর ইন্টারন্যাশনাল। কাম তো হয় লুকালের চেয়ে খারাপ। বেতন পান না দেইখা বউয়ের লগে কথা কইতে পারতাসেন না কয়েকদিন। বুঝি তো!
সান্ধ্যকালীন ইরোটিক বিনোদন থেকে বেশ কদিন বঞ্চিত থাকায় সাজ্জাদ বেশ ঝাঁঝের সাথেই বলে কথাগুলো।
-আর তুমি যে হাউয়া আমগোরে কথা শোনার জন্যে আড়ি পাইতা থাকো সেইটা বুঝি না ভাবসো? শালা লোফার!
লোফার মানে সাজ্জাদ জানতো না, তবে এটা যে একটা ইংরেজি গালি, তা সে বেশ বুঝতে পারে। তাই প্রতিউত্তরে সেও একঝাঁক ইংরেজি গালির পসরা বসিয়ে নিজেকে এই খেলায় এগিয়ে নিতে চায়,
-ইউ টক মি লোফার? আই নট লোফার। ইউ আর আ ইডিয়ট।
দাবাখেলা পণ্ড হলো, তাতে কী! নতুন এই খেলায় সাজ্জাদ মজা পেয়ে গেছে। আরো ইংরেজি কথা সে ঝুলি হাতড়িয়ে খোঁজার চেষ্টা করে প্রাণপন। কামরুলই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? সে ক্লাশ এইটে থাকতে তাদের ইউনিয়নের নামকরা ইংরেজি শিক্ষকের কাছে পড়েছে। সে কম পারে ইংরেজি?
-ইউ টক লেস। ইউ আর লোফার। ভেরি লোফার। লোফার ক্যান্ট বি ইয়ে... ইয়ে...ইয়ে...
বাক্য সম্পূর্ন না করতে পেরে রেগেমেগে দাবার গুটি এলোমেলো করে দেয় সে। তারপর গজরাতে গজরাতে বাথরুমে যায় আধখোলা লুঙ্গিটা কোমরে গুঁজতে গুঁজতে।
রাতে খাবারের পর সাজ্জাদ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যায়। তা দেখে কামরুল খুশি হয়ে ওঠে। অনেকদিন যাবৎ কোনকিছুতে জেতা হয় না তার। আজকে রাতে ফাঁকা মাঠ পেয়ে দূরন্ত স্ট্রাইকারের মত ড্রিবলিং করে গোল দেবে। দাবার বোর্ডটা সন্তর্পণে বের করে সাজায় সে। অদৃশ্য প্রতিপক্ষ সাজ্জাদকে একের পর এক মোক্ষম চাল দিয়ে নাস্তানাবুদ করতে থাকে। পরপর দুইটা গেম জেতার পর সে সিদ্ধান্ত নেয়, হ্যাট্রিক করে তবেই ছাড়বে। খেলা যখন মাঝপথে, নিশ্চিত আরেকটা বিজয়ের সম্ভাবনায় যখন সে উল্লসিত, তখন তার কাঁধের কাছে একটা হাতের স্পর্শ টের পায়।
-একা একাই খেলতাছেন ভাইজান? সিস্টেমটা ভালো। আমিও এখন থিকা একা একাই খেলুম আপনার বিরুদ্ধে। কোনকিছুতে জিততে না পারাটা বড় কষ্টের ভাইজান।
সে রাত্রে কামরুলের আর হ্যাট্রিক করা হয় না। সন্ধ্যার ঝগড়া বিবাদ ভুলে গিয়ে তারা নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা করে এক চমৎকার সমাধানে উপনীত হয়। দুইজনের পক্ষে মেসের ভাড়া মিটিয়ে জীবন চলাটা কষ্টকর। এখন সময়ের দাবীতেই তাদের আরাম-আয়েশ কিছুটা কাটছাট করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে মনোযোগী হতে হবে। তারা দুজন মিলে নতুন মেস মেম্বারের জন্যে বিজ্ঞাপন লিখে ফেলে একটা।
"৫৭/৩ হাতিরপুলস্থ শান্তিনিকেতন ভবনে নিরিবিলি পরিবেশে একজন মেস মেম্বার আবশ্যক (পুং)। মেসমেম্বারকে অবশ্যই নামাজী এবং অধূমপায়ী হতে হবে। যোগাযোগ..."
যদিও তারা দুজনের কেউই নামাজী এবং অধূমপায়ী না, তবে এসব লেখাই দস্তুর। লেখার পর তারা দুজনেই মুগ্ধ হয়ে তৎসম শব্দগুলির দিকে তাকিয়ে থেকে একে অপরকে বাহবা দেয়। এবং তারা এও একে অপরকে জানায় যে, তাদের কেউই বাংলায় প্রাইভেট পড়ে নি কখনও।
-কম্পিউটার কম্পোজের দোকানে নিয়া কম্পোজ কইরা পরে ফটোকপি লাগবো ১০০ কপি।
-আরে দোকানে দেওন লাগবো না। আমি বাংলা টাইপ পারি। অফিসের প্রিন্টারে প্রিন্ট দিমু নি।
কামরুল ঈর্ষাণ্বিত হয় সাজ্জাদের কম্পিউটার পারদর্শিতার কথা জেনে। তার আবার প্রিন্টারও আছে নিজের! পরাজিত বোধ করে সাজ্জাদকে উল্লসিত অবস্থায় রেখে বিমর্ষ মনে ঘুমুতে যাবার সময় মনে হয়, তার অফিসেও প্রিন্টার আছে। ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্যে না অবশ্য। তবে কম্পিউটার অপারেটরকে রিকুয়েস্ট করলে কি কম্পোজ করে প্রিন্ট দিতে দেবে না? গর্বভরে সে সাজ্জাদকে শোনায়,
-আপনের অত কষ্ট করতে হইবো না। আমিই অফিসের কম্পিউটার থেকে প্রিন্ট কৈরা নিয়া আসুমনে। ইট ইজ ভেরি ইজি জব!
পাশের বাসার মেয়েটা অতরাত্রেও বেআক্কেলের মতো জোরে তপুর গান বাজাচ্ছে,
"খুব তুমি জিতসো, তাই খুশিতে বাংলাদেশ..."
এরকম গান শুনে তারা অভ্যস্ত না, তবে সেই রাতে তাদের ভালোই লাগে গানটি।
(৩)
তাদের নতুন রুমমেটের নাম কবীর। এখনও চাকরি বাকরি কিছু করে না, তবে বেশ চৌকস ছেলে। বাসা থেকে মাসোহারাও কম পায় না বোঝা যায় তার সৌখিন ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি, দামী পোষাক আর সুগন্ধী পারফিউমে। সে আসার পর থেকে ইংরেজি গান চলে লাগাতার মেসটাতে, ছেলেটার আবার নিজের কম্পিউটারও আছে। বেশ জাঁকজমকপূর্ণ কম্পিউটার। গান, সিনেমা তো দেখা যায়ই, আবার ইন্টারনেটে কী কী যেন করাও যায়। মাঝেমধ্যে কানে হেডফোন লাগিয়ে চোস্ত ইংরেজিতে কাদের সাথে যেন কথা বলে স্কাইপিতে। কামরুল আর সাজ্জাদের সাথে সে কথা বলতে তেমন আগ্রহী হয় না কখনও। সাজ্জাদ অবশ্য একদিন বড়ভাইসুলভ ভারিক্কী ভাব ধরে ছেলেটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলো,
-কই থিকা পাস করসো তুমি?
-ঢাবি। বিবিএ।
ও আচ্ছা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছে বলে এত ফুটানি দেখায়! ছোহ! থাকে তো বাপের পয়সায়, এইসব লাফাঙ্গা ছেলেকে পাত্তা দিলেই মাথায় উঠে বসবে। খুব জানা আছে তাদের। কামরুলও তাই জিজ্ঞাসাবাদে যোগদান করে।
-চাকরি বাকরি কিছু আছে, নাকি বাপের পয়সায় চলো?
-বাসা থেকে কিছু টাকা পাঠায়। তবে না পাঠালেও চলতো। আমি ফ্রি ল্যান্সিং জব করি। ওডেস্কে। ঘরে বসে উপার্জন। আপনারাও করতে পারেন। ওডেস্কে একাউন্ট আছে?
ওডেস্ক কি তা তারা জানতো না। তারপরেও অনুজ রুমমেটের কাছে নত না হবার অভিপ্রায়ে গম্ভীর কণ্ঠে সাজ্জাদ বলে,
-হ আছিলো, তয় বুঝছো ঝামেলা লাগে। অফিসের কাম কইরা অতসব ইন্টারনেট পোষায় না। এমনিতেই ভালো আছি, বুঝলা? শখের কাজ আমগো মতন লোকের জন্যে না।
-ওহ আচ্ছা!
কবীর নিমিষেই তাদের কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট বিদ্যার গতিক বুঝে আর কথা বাড়ায় না। গভীর মনোযোগের সাথে কাজ করতে থাকে।
ইদানিং সাজ্জাদ আর কামরুল দুজনেরই অফিসের গুমোটাবস্থা কেটে গেছে অনেকটা। এখন আগের মতই কামরুল অফিস থেকে এসে রোখসানার সাথে কথা বলে যার প্রভাবে সাজ্জাদও উত্তেজিত হয়। কামরুল কবীরের কাছ থেকে শুনে বেশ কয়েকটা ইংরেজি শব্দ শিখেছে। সেগুলোর ব্যবহার করে বউকে চমৎকৃত করে সে।
-কাম অন বেবি, ইউ আর মাই হার্ট। আই মিস ইউ। ইউ মিস মি ঠু?
দিনগুলো ভালোই কাটছিলো তাদের, শুধু গলার কাঁটা হয়ে বিঁধে ছিলো নতুন রুমমেট। তার ঝলমলে উচ্ছল পরিচ্ছন্ন জীবনচর্চা প্রতি পদে পদে তাদেরকে বুঝিয়ে দিতো, তারা কত দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে, রুচি, রোজগার এবং আভিজাত্যে। দাবা খেলা নিয়মিত হলেও জয়ের স্বাদ কেউই তেমন উপভোগ করতে পারছিলো না।
(৪)
ওডেস্ক থেকে মোটা অংকের একটা বিল পেয়ে কবীরের মন বেশ ভালো। সে একটা মাইক্রোওয়েভ ওভেন কিনে ফেলেছে সেই খুশিতে। কক্ষপ্রতিবেশীদের অগ্রাহ্য করে চলা কবীর খোশমেজাজে তাদেরকে বললো,
-আজকে বুয়ার ওইসব হাবিজাবি রান্না খাওয়ার দরকার নাই। আপনাদেরকে পিজ্জা বানিয়ে খাওয়াবো।
ইতালিয়ান খাবারটির নাম তারা শুনলেও এটির স্বাদ সম্পর্কে অবগত ছিলো না কামরুল ও সাজ্জাদ। তাদের সংকুচিত ভাব দেখে অভয় দিলো কবীর,
-আরে ভয় পাবেন না। আমি রান্না বেশ ভালোই পারি। খেয়ে দেখেন, পিজ্জা হাটের চেয়ে কম স্বাদ হবে না।
পিজ্জা হাটের নাম অবশ্য তারা শুনেছে। তবে কখনও ঢোকার সাহস হয় নি। সেসব আড়ালে রেখে মওকামতো কামরুল দাও মারে,
-হ, পিজ্জা হাটের ঐসব খাওন দাওন কি ঘরের খাবারের সাথে পারে? আমার তো ভালোই লাগে না খাইতে ওগুলা।
-তাহলে আর চিন্তা কী! আপনারা দুজন আরামে দাবা খেলতে থাকেন। গেম শেষ হলে আমাকে বলবেন, গরমাগরম পরিবেশন করবো।
তারা দুইজন গভীর মনোযোগে দাবা খেলতে লাগলো। আজকের এই খেলায় জেতাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। দুজন নিজের সর্বোচ্চ মেধা আর চিন্তাশক্তি ব্যয় করে সময় নিয়ে খেলতে থাকে, ফলশ্রূতিতে পিজ্জা তৈরি হবার পরেও তাদের খেলা অমিমাংসিতই থেকে যায়। তারা খাবারের স্বাদে যত না, তার চেয়ে বেশি মুগ্ধ হয় তার সৌন্দর্য দেখে। কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ, টমেটো, গাঁজর আর রুটি মিলে যেন একটা গোলাকৃতি ফুল হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে সূর্যমুখী হাসি হাসছে। আয়েশ করে খেতে খেতে সাজ্জাদ তারিফ করে তার রান্নার।
-বহুদিন পর এত মজার পিজা খাইলাম বুঝলা? পিজা হার্টের পিজা খায়া অভক্তি ধইরা গেসিলো।
কামরুলও তার কথায় সম্মতি জানিয়ে মাথা নেড়ে বলে,
-সামনের শুক্কুরবারে তোমারে আমরা রান্না কইরা খাওয়ামু।
(৫)
দেখতে দেখতে শুক্রবার এসে যায়। ছুটির দিনে স্বাভাবিকভাবেই তারা একটু বেশি বেলা পর্যন্ত ঘুমোয়। তবে আজ তাদের একটু সকালে ওঠার তাড়া। কবীরকে রান্না করে খাওয়াতে হবে। সকাল নয়টায় এ্যালার্ম দেয়া ছিলো, কিন্তু ঘুম ভেঙে যায় সাড়ে আটটাতেই কবীরের উল্লসিত চিৎকারে।
-ইয়াহু! আমি সার্ক স্কলারশিপ পেয়েছি। ওহ এতদিন পর সাড়া মিললো!
ঘুমচোখে বিরক্তি জড়িয়ে তারা তাকায় কবীরের দিকে,
-কী পাইছো?
-সার্ক স্কলারশিপ।
কবীর বৃত্তান্ত বলতে থাকে এটা পেতে তাকে কত কষ্ট করতে হয়েছে, এবং এর ফলে সে কী কী সুফল ভোগ করবে।
-ভালা করছো। আমিও অবশ্য বৃত্তি পাইছিলাম কেলাশ ফাইভে থাকতে।
মিনমিন করে বলে অপ্রতিভ হয়ে যায় কামরুল । সার্ক স্কলারশিপের সাথে যে সেটা তুলনীয় না তা বেশ বুঝতে পারে। আর তাছাড়া বৃত্তি পাওয়ার কথাটাও মিথ্যে। সে কবীরকে রূঢ়ভাবে অগ্রাহ্য করে সাজ্জাদকে তাগাদা দেয়,
-ওঠেন মিয়া, বাজারে যাইতে হইবো না? আইজকা কবীররে স্পেশাল খানা খাওয়ামু। হ্যায় বিত্তি পাইছে।
সাজ্জাদ আনমনা মুখে বসে থাকে। কবীর হাসে।
বাজার করে আসবার পরে এবার রান্না করার পালা। বুয়া আজকে আসতে পারবে না, তাই তারা ঠিক করেছে দুজন মিলেই রান্নাপর্ব সারবে। রান্নাঘরে সবজি আর মাংস কাটতে কাটতে সকল হীনবোধ ছাপিয়ে তাদেরকে হামলে ধরে ভীষণ ক্ষুধা। এত ক্ষুধা কখনও পায়নি তাদের।
-তাড়াতাড়ি হাত চালাও মিয়া। ক্ষিদায় ছটফট করতাছি।
কামরুলের তাগাদার জবাবে সাজ্জাদ জানায় যে সেও ভীষণ ক্ষুধায় আক্রান্ত, এমনটা নাকি সে কোনদিন অনুভব করে নি।
-আপনাদের কাজে হেল্প করতে পারি? উৎসুক কণ্ঠে আগ্রহ প্রকাশ করে কবীর। কামরুল আর সাজ্জাদের তর সইছিলো না, তাই কাটাকুটির পর্ব ত্বরাণ্বিত করবার জন্যে তারা কবীরকে স্বাগত জানায়।
চটপটে ছেলে কবীর। অন্য সব কাজের মতো সবজি এবং মাংস কর্তনের ক্ষেত্রেও সে পিছু ফেলে দেয় তাদের দুজনাকে। তারা মনে মনে গজগজ করতে থাকে। হঠাৎ একটা দুর্ঘটনা ঘটে। পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে আঙ্গুল কেটে ফেলে কবীর।
-উফ!
মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে সে।
-কী হইছে?
-হাত কেটে ফেলেছি।
-কই দেখি?
সাজ্জাদ আর কামরুল বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকে। এমন জিনিস দেখার জন্যে তারা প্রস্তুত ছিলো না। কবীরের আঙুল বেয়ে রক্তের ধারা বইছে, সে রক্তের রঙ নীল!
-এভাবে কি দেখছেন? স্যাভলন ট্যাভলন আছে কী না দেখেন না!
কবীরের হাত বেশ অনেকটাই কেটে গেছে!
-তোমার রক্তের রঙ নীল!
বিমূঢ় কণ্ঠে বলে সাজ্জাদ। কামরুলও হা করে তাকিয়ে দেখছে।
-কী বলেন এইসব? এটা মশকরা করার টাইম হলো?
রেগে যায় কবীর। সে লাল রঙই দেখছে। রক্তের রঙ নিয়ে এসময় কেন তারা ফাজলামো করছে বুঝে উঠতে পারে না।
সাজ্জাদ আর কামরুলের মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় স্কুলে শেখা ফ্রেজ এ্যান্ড ইডিয়মসের কথা। ব্লু ব্লাড! নীল রক্ত। অভিজাত ঘরের সন্তানের রক্তপ্রবাহ দেখার জন্যে তারা এগিয়ে এসে ঘিরে ধরে তাকে। নীল রক্তের সুবাসে তারা মাতোয়ারা হয়ে যায়। এমন গন্ধ কামরুল কোথাও পায় নি। রোখসানার স্তনউপত্যকায় মুখ গুঁজে দিয়ে সে পাগল হতো, এ গন্ধ তার চেয়ে অনেক বেশি তীব্র, সম্মোহনী, আকর্ষক। সাজ্জাদও এমন গন্ধ কোথাও পায় নি। বেতন পাওয়া কড়কড়ে টাকার নোট আর কাপড়ে রাখা ন্যাপথালিনের গন্ধে সে নেশা খুঁজে পেতো। এ গন্ধের কাছে সেসব কিছুই না। ঘোরগ্রোস্ত জিন্দালাশের মতো তারা টলতে টলতে এগুতে থাকে। বটিটা দিয়ে এক পোঁচে কেটে ফেলে কবীরের গলা। অবিরাম ধারায় নীল রক্ত বের হতে থাকে। আরো ভালো করে দেখার জন্যে বটিটায় চাপ দিয়ে গলা থেকে মাথা খণ্ডিত করে ফেলে। নীলের প্রবাহে সারাঘরে সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে। সারা ঘর প্রজ্জ্বলিত হয় উজ্জ্বল নীল আলোতে। নীল আলো আর রক্তে স্নাত হয়ে তারা কবীরের বাকি অঙ্গপ্রতঙ্গগুলোও কাটতে থাকে বেভুলের মতো।
-আজকে খাওনটা ভালো জমবো ভাই।
সোৎসাহে সাজ্জাদ জানায় কামরুলকে। কামরুল তখন কবীরের দেহ খন্ড-বিখণ্ড করতে ব্যস্ত। এখন তারা বুঝতে পারছে কিসের এত ক্ষুধা জমে ছিলো তাদের, কেন তারা এত ক্ষুধার্ত ছিলো। নীল রঙের এমন নেশা, তাদের জানা ছিলো না। কলেজে থাকতে কামরুল একবার একটা গলাকাটা লাশ দেখেছিলো। তা থেকে লাল রঙের ভীতিকর রক্ত বইছিলো। আর এখন... এই নীল রঙ তাদের ক্ষুধা, যৌনতা, রুচি, গর্ব সব বাড়িয়ে দেয়। কাটাকাটি শেষ হলে একটা বড় গামলায় শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো রেখে ক্ষুধার্তের মতো গিলতে থাকে তারা। কবীরের নাক, কান, গলা, লিভার, কিডনী, হাত, পা সব খেয়ে শেষ করে ফেলে মুহূর্তের মধ্যে।
মাথাটা ওভেনের মধ্যে রেখে দেয় পরে খাবে বলে। ওটাই সবচেয়ে আকর্ষনীয় অংশ। নীলখেলা স্থগিত রেখে তারা দাবা খেলতে বসে। তবে এবারের বোর্ড সাজানো অন্যবারের চেয়ে অনেক আলাদা। শুধু একটি রাজা এবং একটি মন্ত্রী নিয়ে খেলছে তারা। সাদা-কালো গুটির কোন প্রভেদ নেই সেখানে। মেঝেতে গড়িয়ে পড়া রক্ত গুটিতে এবং বোর্ডে মেখে নীলাঞ্চল বানিয়ে ফেলে। কোন নিয়মের তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমত তারা চেক দিতে থাকে একে অপরকে, ইচ্ছেমত জিততে থাকে। এভাবে তারা যখন জয়শিকারে মগ্ন, তখন ওভেন থেকে কবীরের মাথাটা গড়িয়ে তাদের কাছে এসে বলে,
"বিশ্বাস করেন ভাই, আমার রক্তও লাল!"
(নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইনসমনিয়াকের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এই গল্প লেখা। )
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ৮:১৮