এই আমি আবার বেঁচে যাবো
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
(১)
-কাল সকালে ফ্রি আছো?
-না কাজ আছে।
-কী এমন রাজকার্য?
-তার চেয়েও বেশি, ঘুমকার্য।
-ওহ, আমি ভাবলাম কী না কী! শোনো...
-কিচ্ছু শুনতে পারবো না। কোনো কাজ গছিয়ে দেয়া চলবে না। সপ্তাহে একটা দিন মাত্র ছুটি পাই, ঐদিন ঘুম ছাড়া আর কোনকিছুই গুরুত্ব পেতে পারে না।
-একটু সময় দিতে পারবে না? খুব জরুরী। রক্ত দিতে হবে একটা বাচ্চাকে। মাত্র দেড় বছর বয়স। ও নেগেটিভ ব্লাড খুব রেয়ার জানোই তো।
দেখো, শুরু করেছে এখন ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিং! দেড় বছরের বাচ্চা অসুস্থ, তার জন্যে জরুরী ভিত্তিতে রক্ত দরকার, এসব কথা শুনিয়ে আমাকে পরোপকারী ব্যক্তি হতে বাধ্য করে মহৎ কার্যে নিয়োগ করা! কী জ্বালা! অত মহৎ হবার শখ নেই আমার। সারা দেশে অসংখ্য অসুস্থ শিশু আছে, তাদের মর্মন্তুদ কাহিনী শুনলে হৃদয় আর্দ্র হবেই কিছুটা, কিন্তু এসব ছুটির দিনের ঘুম নষ্ট করে এসব মানবিকতাপনা করে বেড়ানোর কোন মানে হয় না। কিছুক্ষণ নীরব থেকে আমার আপত্তি জানানোর কৌশল গ্রহণ করি। সভ্য সমাজে তো আর সবকিছু সরাসরি বলা যায় না!
-কী হলো? চুপ করে রইলে যে? দেবে না রক্ত?
-না, আসলে হয়েছে কী আমার শরীরটা বেশি ভালো না...দেখো না অন্য কোথাও...
এবার রিনা তার মোক্ষম চালটা দিলো।
-ঠিক আছে। তুমি রেস্ট নাওগে। আমি যাই রায়ানের সাথে কথা বলে আসি। ও তো সন্ধানীর মেম্বার। ঠিক খুঁজে দিতে পারবে।
রিনা ভালো করেই জানে যে রায়ানের সাথে ওর মেলামেশা, এমন কী কথা বলা পর্যন্ত আমি সহ্য করতে পারি না। ইদানিং ও রায়ানের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছে নাকি? আমি জানি রায়ানের মত সুযোগসন্ধানী পাকা খেলুড়ের পাতা ফাঁদ অবলীলায় এড়িয়ে যাওয়াটাই রিনার জন্যে স্বাভাবিক, তবে সুযোগ বুঝে রায়ানের কথা বলে আমাকে রাগিয়ে কাজ করিয়ে নেয়ার মেয়েলীপনাটাও সে ছাড়বে না! বরাবরের মত এবারও এই পদ্ধতিতে চমৎকার কাজ হলো। ফোন রাখার সময় আমি হাসপাতালের লোকেশন, কেবিন নাম্বার আর রক্ত গ্রহীতা শিশুর অভিভাবকের ফোন নাম্বার নিয়ে গজগজ করতে করতে থাকলাম।
কিছুই ভালো লাগছে না। কী করবো ভেবে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। আজকে রাত জাগবো বলে বেশ কয়েকটা গা শিউরানো হরর মুভি যোগাড় করে রেখেছিলাম। রাতের বেলায় হরর সিনেমা দেখে ঘুমোনোর মজাই আলাদা। চমৎকার সব দুঃস্বপ্ন দেখা যায়। দুঃস্বপ্নের সাথে সখ্য করেই তো বেঁচে থাকা! দুঃস্বপ্নের মাঝে আমি আকাশচুম্বী অট্টালিকা থেকে মাটিতে পড়ি, খুনীদের সাথে হুল্লোড় করে মদ খাই, এলোপাথারি চাকু চালিয়ে দেই প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বীদের বুকে, কখনও কখনও মারাও যাই গলায় ছুরির আঘাতের চিহ্ন নিয়ে। আজ রাত জেগে আরো কিছু দুঃস্বপ্নের সেলুলয়েডীয় উপাদান সংগ্রহ করতে গেলে কাল সকালে আর ওঠা হবে না। তার ওপর আবার রয়েছে রক্ত দেবার ধকল। সাধারণত ছুটির দিনটায় আমি বিকেল পর্যন্ত ঘুমাই। কাল সকালে উঠে রক্ত দেবার পর সারাদিন করবোটা কী? একবার ঘুম চটে গেলে আমার আর ঘুম আসে না, ক্লান্তি আর অস্বস্তি জেঁকে ধরে। অবশ্য রিনার উষ্ণ স্পর্শ পেলে ক্লান্তভাবটা কেটে যাবে। রিনাকে কালকে পেতেই হবে যে করে হোক! সারাদিনের জন্যে। আশা করি সে তার প্রিয় হাত- অজুহাত দিয়ে আলগোছে সরিয়ে দেবে না আমার স্পর্শপ্রস্তাব। স্পর্শের অগ্রীম বোধ আমার শরীরে তাপ ছড়িয়ে দেয়। তপ্ত হাতে আমি ফোনটা হাতে নিই।
-রিনা, কালকে ফ্রি আছো?
-না। কাল আমার একটা পরীক্ষা আছে। তোমাকে আগে বলি নাই?
-কখন পরীক্ষা?
-২টা থেকে ৪টা। কেন?
-কেন আবার? তোমার সাথে ঘুরবো ভেবেছিলাম।
-নাহ। কালকে বাদ দাও। পরীক্ষা শেষ হতে হতে বেলা পড়ে যাবে প্রায়। বাসায় দেরীতে পৌঁছুলে আবার রাগ করবে। যা ছোট দিন এখন! আর রাস্তাঘাটের অবস্থা তো বোঝোই!
-এনাফ! আর ফিরিস্তি দিতে হবে না। আহা...সতী, দয়াবতী মেয়ে একজন! রোগীদের রক্তঘটক হয়েছো! একে ওকে রক্ত খুঁজে দেবার মহান দায়িত্ব নিয়েছো! ব্লাডি ব্লাডম্যাচার! আমার সারাটাদিন কালকে তোর কারণে নষ্ট হবে। আগে রায়ানের কাছে যাস নাই কেন? লয়ালিটি দেখাইতে?
-তোমার মধ্যে কী বিন্দুমাত্র মনুষ্যত্ব নেই? একটা বাচ্চা মেয়ে মারা যাচ্ছে, আর তুমি আছো সিলি জেলাসি, উইকেন্ড ফান আর মাথায় শিশ্ন নিয়ে!
-হ্যাঁ আমার মাথায় শিশ্ন! আমি সাধু না। আর তোমার সতীপনা আমি ছুটাবো বুঝলা? অনেক রাইখা ঢাইকা চলছো, ভেতরে যে তোমার মধ্যেও একটা কামুকী বাস করে তা জানি না ভাবছো?
-হতে পারে, আমার ভেতরে বাস করে, অনেক ভেতরে। কিন্তু তোমার ভেতরে, বাহিরে সবখানেই বিচরণ করে বেড়ায় একজন কামুক। মাঝেমধ্যে খুব প্রকটভাবে তা প্রকাশিত হয়। একটা বাচ্চা মেয়ে রক্তের অভাবে মারা যাচ্ছে, আর তুমি ভাবছো মাংসের কথা! থাক, তোমার রক্তের দরকার নেই ওর। মৃত মানুষের রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকার দরকার নেই অভাগীর। মরুক!
-আমাকে মৃত মানুষ বলছো কোন আক্কেলে? রূপক মারাচ্ছো, না? আমার ভেতর মনুষ্যত্ব মারা গেছে হেন তেন...এসব কে শিখাইছে তোমাকে? রায়ান হারামজাদাটা?
রিনা ফোন রেখে দিলো। আমার শরীর রাগে কাঁপছে। মাথার ভেতর কে যেন উনুন চাপিয়ে দিয়েছে। টগবগ করে ফুটছে মগজ, পুষ্টি, বিবেক। আজ রাতে আর ঘুম হবে না। একটা ঠান্ডা শাওয়ার দরকার আমার এই মুহূর্তে।
(২)
বেসিনের সামনে গিয়ে নিজের মুখটা ভালো করে দেখি। চমৎকারভাবে কামানো মুখমন্ডল। ঢেউ খেলানো চুল। চোখে এখনও রাত্রির রঙদানী থেকে আঁকিয়ে এসে এক ছোপ দিয়ে যায়নি। চমৎকার দেখাচ্ছে আমাকে। তবে কালকে সকাল নাগাদ এই সতেজ ভাবটা থাকবে না আর। না ঘুমোনোর অবসাদ এবং রক্ত দেয়ার ধকল মিলিয়ে রূক্ষ্ণ হয়ে যাবে। গালের কাছে একটা ব্রনের মতো দেখতে পাচ্ছি। এটা আবার কবে গজালো? বিরক্ত হয়ে খুঁটতে গিয়ে রক্ত বের হয় সেখান থেকে। বেশ ব্যথাও অনুভূত হলো। রক্ত প্রদানের প্রতি অনিচ্ছার রূপক হিসেবেই যেন ব্রনটা হঠাৎ করে গজিয়ে হঠাৎ মরে গেলো। ওটাকে সমূলে বিনাশ করার উদ্দেশ্যে আরো খোঁটাতে লাগলাম আমি। এবার রক্তের বদলে হলুদ রঙের বিচ্ছিরি পুঁজ বের হতে থাকলো। রক্ত যতটা গ্ল্যামারাস, পুঁজ ঠিক ততটাই কুৎসিত। আবার ফোঁড়া টোড়া হয়ে গেল নাকি? তুলো আর স্যাভলন দিয়ে যত্নের সাথে পরিষ্কার করার পরেও দেখি গড়িয়ে পড়ছে কালচে রক্ত আর হলদে পুঁজের ধারা। রাত এখন নিজঝুম, আমার চোখ ঘুমঘুম, কিছুক্ষণ বিছানায় গিয়ে গড়িয়ে নেয়া যেতে পারে, কিন্তু হতচ্ছারা ব্রনটা দিচ্ছে কই! বেশি রাত জাগা, সারাদিনের অবসাদ এবং মানসিক অস্থিরতার ফলেই হয়তোবা আমার দৃশ্যবিভ্রম হতে শুরু করলো। আমি দেখতে পাচ্ছি, অসংখ্য ব্রন আমার মুখ ঢেকে দিচ্ছে, আমি প্রাণপনে খাঁমচে যাচ্ছি, খাঁমচি খেয়ে সেগুলো ধেবড়ে যাচ্ছে, কিন্তু রক্ত বা পুঁজ কোনটাই বের হচ্ছে না। মৃত মানুষের মতো! শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ঘাড়ের ওপরে শীতল পানি প্রবাহিত হতে দিই আমি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতনন্ত্রের উত্তেজনাকে মন্ত্র পড়িয়ে ঠান্ডা করতে। এমন বিশ্রী রকম হ্যালুসিনেশন হবার পেছনে রিনারও দোষ আছে। সেইতো আমাকে মৃত, শিশ্নমস্তক আরো কী কী বাজে কথা বললো! কালকে কাছে পেলে তার কথার যথার্থতা প্রমাণ করেই ছাড়তাম। অনেক হয়েছে সাধু সেজে থাকা। তিক্তমুখে বাথরুম থেকে বের হবার সময় বেসিনের আয়নায় এক পলক নিজেকে দেখে নিতে গেলে মৃত ব্রনটা যেন নীরবে আমাকে লক্ষ্য করে উপহাসের হাসি হাসে। অযথাই!
(৩)
সকালে ঘুম ভাঙলো অচেনা নাম্বারের ফোনে। যশোর-খুলনা অঞ্চলের কড়া আঞ্চলিক টানে একজন কথা বলছে ও প্রান্ত থেকে।
-হ্যালো, আপনি কি রেজা সাহেব বলতিছেন?
-জ্বী, বলেন।
-বলছি রিনা কি আপনাকে বলিছে কোন কিছু রক্ত দিয়ার ব্যাপারে?
-হ্যাঁ বলেছে।
ঘুমজড়িত ক্লান্তি আর বিরক্তি ঢাকার কোন চেষ্টাই করি না আমি। কিন্তু গাঁইয়া লোকটা তা বুঝলে তো!
-তা ভাইজান, রক্তটা একটু আর্জেন্ট দরকার পইড়ে গেছে। আপনি তাড়াতাড়ি আসলি পরে সুবিদে হয়।
কী আবদার! আমি আদৌ আসবো কী না সে হিসেব নেই, এখনই চলে আসার ফরমায়েশ করছে! ঠিক আছে, যাবো। একটা ছুটির দিন না হয় বঞ্চিত হলো আয়েশী যাপন থেকে!
-হাসপাতালের লোকেশনটা বলেন।
যেতে হবে শহরের আরেক প্রান্তে। গিয়ে আবার অলিগলি খুঁজতে হবে। হ্যাঁ, এমনটাই তো হবার কথা আজকে। না হলেই অবাক হতাম।
ছুটির দিনেও মানুষের কর্মচাঞ্চল্যের শেষ নেই! ছুটির দিন পেয়েছো, একটু আরাম করো, তা না গুষ্টিশুদ্ধ সবাই নেমে পড়েছে রাস্তায়! যে শহর এত কর্মমুখর তার এই দুরবস্থা হলো কেন ভাববার বিষয় বটে!
হাসপাতালের সামনে পৌঁছুলে একটা ঢ্যাঙামত লোক হন্তদন্ত হয়ে আমাকে খুঁজে নিলো।
-আপনিই রেজা সাহেব?
-জ্বী। আপনি?
-আমার নাম শাহীন। সামিহা, মানে মিয়েটা আমার ভাস্তি।
-ও আচ্ছা। তা রক্ত দিতে হবে কোথায় চলেন।
-একটু তো টাইম লাগবে। ক্রসম্যাচিং করতি হবে। তারপর না সেন নেবে! আসেন, ক্রসম্যাচিংটা সাইরে নেই।
ভালো! ক্রসম্যাচিং করতে গিয়ে আরো কতক্ষণ লাগে কে জানে! তবে ব্যাপারটার সুখকর দিক হলো, ক্রসম্যাচিংয়ের জন্যে রক্ত নিতে যে নার্সটা এসেছে সে বড়ই সুন্দর। তার হাতের ছোঁয়া পেয়ে জানলাম সে নরমও! আমার বাহুতে, আঙুলে তার হাতের স্পর্শে নিমিষেই চাঙ্গা হয়ে উঠলাম। মেয়েটা কথাও বলে বেশ মিষ্টি করে।
-এর আগে কখনও রক্ত দিয়েছেন?
তার টিয়াকন্ঠ আর গোলাপস্পর্শে আমার প্রথমবারের মত মনে হয় দিনটা নেহায়েৎ মন্দ না! প্রসন্ন কন্ঠে তাকে জিজ্ঞেস করি রক্ত নেবার সময়ও সে থাকবে নাকি।
-হ্যাঁ আমিই থাকবো। কোন ভয় নেই!
নাও হে শুভ্রসেবিকা, আমাকে নিঙড়ে নাও। অনেকক্ষণ ধরে নিও কেমন! রক্তের নমুনা দেয়া শেষ হলে হাত দিয়ে চুল আঁচরাতে গিয়ে তার উদ্দেশ্যে ছুড়ে দিই অদৃশ্য বাক্যাবলী। সে না বুঝলেও ক্ষতি নেই। সবকিছু বুঝিয়ে দেবার দরকারটা কী!
-রিপোর্ট পাতি আরো আধাঘন্টার মতো লাগবে। চলেন একটু চা খায়ে নেই এই ফাঁকে।
-চলেন!
লোকটার সঙ্গ আর আঞ্চলিক টানের কথা খারাপ লাগছে না আমার এখন আর। তবে চা পানের আগে মুখে একটু পানির ঝাপটা দিয়ে আসা দরকার। শুভ্রসেবিকার সামনে কর্কশ চেহারা নিয়ে যাওয়াটা মোটেও উচিৎ হবে না।
বাথরুমে গিয়ে আমি চুলে পানি দিই, আঙুল দিয়ে আঁচড়ে নেই, মুখে পানির ঝাপটা দেই। সবকিছুই ঠিকঠাক, শুধু গতকাল রাতে খোঁচানো ব্রনটা আরো বিকশিত হয়ে জাঁকিয়ে বসেছে। মৃত জিনিসেরও বিকাশ ঘটে! রেগে গিয়ে আমি ওটাকে আরো খোঁচাতে গিয়ে থেমে যাই। আবার যদি পুঁজটুঁজ বের হয় বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে। মৃতদেরও বিশ্বাস নেই আজকাল।
টঙ দোকানে বসে দু-কাপ চা হাতে নিয়ে আমরা আলাপ চালাতে থাকি। আলাপ বলতে গেলে পুরোটাই একপাক্ষিক। সে বিস্তারিত বলছে কীভাবে রোগ ধরা পড়লো, কতখানি ভুগলো মেয়েটা, তাদের কত খরচ হলো ইত্যাদি ইতং বিতং। আমিও বেশ আগ্রহ করে শোনার ভান করছি।
-বুঝলেন ভাই, আর্লি স্টেজে যদি ধরা পড়তো বাচ্চাটাকে এতো ভুগতি হতো না। কালীগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যখন প্রথম নিয়ে যাই, তারা নাইরে চাইরে দেইখে বললো যে সে কিছু না। তারো মাসখানিক পরে যখন ব্যথায় আর টিকতি দিচ্ছিলো না, সদর হাসপাতালে নি গেলাম। ততদিনে বাচ্চা আমাগের পিশাপ করতি পারে না, পেট ফুইলে সে কী অবস্থা!
-বলেন কী!
আমারও তখন বেশ প্রস্রাবের বেগ পেয়েছিলো। তাই বাচ্চাটার দুরবস্থাটা বেশ ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারি। শিউরেও উঠি কিছুটা।
-হয় ভাই। তারপর ডাক্তার কলো যে মায়ের পেটেরথেই এই রোগ নিয়ে আসিছে সে। টিউমার অপারেশন করে পিশাপ-পাইখানার জন্যি বাইপাস কইরে আলাদা রাস্তা বানায়ে দিতি হবি। অপারেশন তো আর যশোরে সম্ভব না, বায়োপসি করতি পারে বড়জোর। তো তারা বললো...
আমার কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিলো শুনতে। ছোট্ট শরীরে এত ধকল সইছে কীভাবে? আমি জোয়ান পুরুষ গ্রীষ্মের দুপুরে পানি কম খেয়ে বেশি হাঁটলেই ঘেমে টেমে জলস্বল্পতায় ভুগে প্রস্রাবের যে যন্ত্রণায় ভুগি তাই মাঝেমধ্যে অসহ্য লাগে, আর এখানে ছোট্ট একটা বাচ্চা, দিনের পর দিন...মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে আমার। তবে এটা কেটে যাবে শীঘ্রই। এমন তো কতই দেখি, কতই শুনি। সবকিছু মনে রাখলে ছুটির দিন দুপুরে সিনেমা দেখতে দেখতে শিল্প আলোচনা করার তাগদ থাকে না। বাসায় গিয়ে একটা ভালো কমেডি মুভি দেখতে হবে, ভাবি আমি।
-চলেন মিয়েটাকে দেইখে আসি।
-চলেন যাই।
অসুস্থতা প্রত্যক্ষণের কোন অভিপ্রায় না থাকলেও অনিচ্ছাকৃত সহমর্মিতা দেখাতেই হয়।
লিফটে করে চারতলায় উঠে যাই আমরা। ৪০৬ নং কেবিন। ঢুকতেই একটা অসুস্থ এবং অশুভ গন্ধের ঝাঁপটায় আমার নাক কুঁচকে আসে।
-সামিহা কি ঘুমাচ্ছে?
বিছানায় বসে থাকা রুগ্ন এক মহিলাকে জিজ্ঞেস করে সে।
-হয়। এতক্ষণ চিক্কুর পাইরে মাত্রই ঘুমালো।
-জ্বর আসিছিলো?
-আছে, কম।
আমিও ভদ্রতা করে জ্বর দেখার জন্যে তার কপালে হাত রাখি।
সামিহা আমার দিকে পেছন ফিরে ছিলো। আমার স্পর্শ পাওয়া মাত্রই সে মাথা ঘুরিয়ে ডুকরে কাঁদা শুরু করলো। আশ্চর্য, মেয়েটা আমার চোখের দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? এত তিব্র চোখ! এত প্রখর অভিমান! শিশুরা বুঝদার হয়ে গেলে বড়দের বিপন্নতার শেষ থাকে না। এই মেয়ে চোখ সরাও! চোখ সরাও মা। দোহাই লাগে মামনি চোখ সরাও! হ্যাঁ আমার ভুল হয়েছে। আমি তোমার ছোট্ট অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ভেতর কর্কট বিষের জ্বালা বুঝতে পারি নি। আমি তোমাকে রক্ত না দেয়ার জন্যে ছুতো তৈরি করে বিলাসী অবকাশ যাপন করতে চেয়েছিলাম। আমি তোমাকে রক্ত দিতে এসে নানাবিধ দেহজ লোভকল্পনায় মজে ছিলাম। আমি বুঝতে পারি নি মা। কান্না বন্ধ কর। আমার দিকে এভাবে অভিমানের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছিস কেন? আমি কে তোর? ওহ, তোরা তো দুনিয়ার আত্মীয়তার এত জটিল হিসেব-নিকেশ বুঝিস না। সবাইকেই আপন ভাবিস। দেবশিশুদের এত কষ্ট দেয় কেন ঈশ্বর? তোর শরীরে সূঁচের আগ্রাসন। স্যালাইন, ক্যাথেটার। তোর ব্যথা কমানোর জন্যে বটিকার ভেতর নানা রসায়ন। তোর মাংস কেটে যন্ত্রণা লাঘব করার চেষ্টায় চিকিৎসকেরা। আর আমি...হ্যাঁ আমিও আছি এই আয়োজনে মামনি। কাঁদিস না। কাঁদিস না এভাবে প্লিজ! ও কী! চোখ ফিরিয়ে নিলি কেন? আমার দিকে তাকা, দেখ ভালো করে দেখ। তোর কাছে তো কিছুই লুকোনোর নেই। দেখ আমার চোখের মামুলি নির্ভরতা, জলজ মমতা, কোন কাম নেই, লোভ নেই। ওহ, তুই তো এসব শব্দের মানে শিখিস নি এখনও। তুই খালি জানিস আদর আর অভিমান। আর অভিমান করিস নে আমার ওপর মা। আমি কথা দিচ্ছি এই ঔষধের ঘ্রাণঅলা বাজে ঘরটা থেকে তোকে সূর্যের কাছাকাছি খোলামেলা প্রান্তরে নিয়ে যাবো, সেখানে থাকবে সরিষার তেলের স্বাস্থ্যকর গন্ধ আর আদরকাঁথার ওম। সেরে উঠলে পরে ফুলতোলা বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে তুই তোর বাবা-মাকে খুব জ্বালাবি, কেমন?
-রেজা সাহেব, আধাঘন্টা মনে হয় হইয়ে গেছে। চলেন নিচে যায়ে ক্রসম্যাচিংয়ের রিপোর্ট দেইখে আসি।
-ও, হ্যাঁ! যেতে হবে। এক মিনিট, আমি একটু বাথরুম থেকে আসি।
কান্নার দমকটাকে ছেড়ে দিতে বাথরুমে যেতে হয় আমার। মমতার সাগর কী আর কোন বাঁধ দিয়ে আঁটকানো যায়? চোখ মুছতে মুছতে বেসিনের আয়নায় তাকালে পরে কোন মৃত ব্রন আমার চোখে পড়ে না।
রক্তের ছটায় প্লাবিত মুখে অশ্রুর সংযোগে আমি বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে পাই।
৮২টি মন্তব্য ৮২টি উত্তর
পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন
আলোচিত ব্লগ
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!
সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন
কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী
ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন