আপনাদের কাছে কি চাবুক আছে?
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
*
গতকাল রাতে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছি। অদ্ভুত না বলে ভয়ংকর বলাটাই যুৎসই হবে। শেষ রাত্তিরের দুঃস্বপ্ন নিয়ে অনেকের মধ্যে অমূলক ভীতি থাকে। আমার যুক্তিবাদী মন এসব কুসংস্কারের সাথে রীতিমত ফ্যাসিস্ট আচরণ করে। দুঃস্বপ্ন-তা শেষরাত বা ভরদুপুর, যে সময়েরই হোক না কেন ঘুমন্ত আমার প্রতি খুব তোড়জোড় করে জারিজুরি দেখিয়ে অবশেষে জাগ্রত চেতনের তর্কতীরে বিদ্ধ হয়ে পলায়ন করে।
দুঃস্বপ্নেরা আমার জীবনে ব্রাত্যজন।
তবে এটা অস্বীকার করা যাবে না, কাল রাতের দুঃস্বপ্নটা খুব স্পষ্ট ছিলো। চেনা চেনা মুখ, প্রিয় প্রিয় জন, ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা, অশুভ পরিকল্পনা, ভিকটিম আমি... সবমিলিয়ে একটা সার্থক নিউরন অনুরনন ছিলো, যা একজন মজবুত মানুষকেও কিছুক্ষণের জন্যে ঠুনকো করে দিতে পারে, ঘর্মাক্ত অবস্থায় তাকে জীবনের প্রতি সন্দেহপ্রবণ করে তুলতে পারে। আমি খুব ঘামছিলাম তখন। হৃৎপিন্ডটা স্পন্দিত হচ্ছিলো উন্মাদ পেন্ডুলামের মত।
-কী হয়েছে? এমন করছ কেন? শরীর খারাপ লাগছে? দুঃস্বপ্ন দেখেছো?
আমার স্ত্রী, রিনা। প্রেমময়ী। মায়াবতী। আমার দুঃস্বপ্নবর্ম! সে থাকতে কোন দুঃস্বপ্ন আমাকে স্পর্শ করবে না, এটা আমি মন থেকেই বিশ্বাস করি। এক্ষেত্রে কোন সন্দেহবাদী যুক্তি-তক্কোর তক্কে তক্কে থাকার কৌশলকে বিশ্বাসশৈলী দিয়ে কুপোকাৎ করে ফেলি! তবে বর্তমান পরিস্থিতিটা একটু অস্বস্তিকর। কারণ, এই স্বপ্নটার প্রধান চরিত্র, এবং অন্যতম প্রধান ষড়যন্ত্র পরিকল্পনাকারী সে'ই। শেষ রাতে ঘুম ভেঙে মৃদু নীল আলোয় এসব তুচ্ছ ব্যাপার অনেকসময় বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
-একটা খুব বাজে স্বপ্ন দেখলাম রিনা।
-কী দেখলে?
আমি একটু হেসেছিলাম তখন। শক্ত স্নায়ুর মানুষ আমি। সাময়িক মানসিক দূরাবস্থা কাটিয়ে ধাতস্থ হতে খুব বেশি সময় লাগে না।
-দেখলাম কী, তুমি আর শাকিল আমাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছ!
-ছি ছি! স্বপ্নদের কোন আক্কেল নেই। কী সব দেখায় না দেখায়! যত্তসব!
গনগনে কন্ঠে বলছিলো রিনা। তার গলায় আগুনের আঁচ।
-শুধু এটুকুই না, স্বপ্নটা আরো অনেক বিস্তারিত। আর খুন করার কারণটা আরো মর্মান্তিক। কোন একটা দুর্ঘটনায় বা অসুখে, মনে পড়ছে না এখন, আমি চলৎশক্তিহীন হয়ে গেছি। শাকিল তোমাকে অনেক হেল্প করেছে সেসময়, ইমোশনাল সাপোর্ট দিয়েছে, ধীরে ধীরে আমার সাথে তোমার দূরত্ব বেড়েছে, তোমাকে কব্জা করার চেষ্টা করেছে, সফল হয়েছে, তারপর একসময় তোমরা সিদ্ধান্ত নিলে যে আমায় খুন করে নতুন জীবন শুরু করবে। বলতে দ্বিধা নেই, আমার কাছে ঐ পরিস্থিতিতে তোমাদের সিদ্ধান্তটা খুব একটু অযৌক্তিক মনে হয়নি। হাহাহা!
রিনা চুপচাপ শুনেছিলো এসব। আমি ভেবেছিলাম সে বাধা দেবে, মুখ চেপে ধরবে, তার স্বভাব অনুযায়ী সেরকমই করার কথা! কিন্তু সে আমাকে কিছুটা অবাক করে দিয়ে চুপচাপ শুনলো পুরোটুকু। এখন হয়তোবা ভেজা কন্ঠে কিছু প্রেমবাচক শব্দ প্রক্ষেপন করে আমার বুকে মুখ গুঁজে দেবে। আবারও আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হল!
-শাকিল হারামজাদা যদি আমার যেকোন পরিস্থিতিতে, তা সে যত নাজুক পরিস্থিতিই হোক না কেন, এ্যাডভান্টেজ নেয়ার চেষ্টা করে, ওকে আমি খুন করব! চাবকাবো ধরে!
তার কন্ঠ থেকে আগুনের শিখা নিভিয়ে দিয়েছিলো যেন কেউ। এখন সেখানে বরফের ভাঁপ। শীতল। শিউরে ওঠার মতন! স্বপ্নটা আমার চেয়ে ওকেই বেশি প্রভাবিত করেছিলো যেন। আর ও এমনভাবে কথা বলছিলো, যেন স্বপ্ন না, বাস্তবেই এমন কিছু ঘটছে!
"আরে শোন", আমি ওকে আশ্বস্ত করতে উদ্যোগী হয়েছিলাম,
-স্বপ্ন হল ঘুমের মধ্যে অবচেতন মনের প্লে-গ্রাউন্ড। সুযোগ পেয়ে যা খুশি তাই করে ব্যাটা! এই যে আজকের স্বপ্নটা, এর পেছনে কারণ কী? না, ঘুমুতে যাবার আগে শাকিল তোমাকে ফোন করেছিলো, তোমরা অনেকক্ষণ ধরে কথা বলেছিলে, হেসেছিলে, সেটাই সাবকনশাস মাইন্ড এ্যাম্পলিফাই করে, সোজা বাংলায় তিলকে তাল করে আমার স্বপ্নে র্যা ন্ডম স্লাইড শো হিসেবে দেখিয়েছে।
-হয়েছে, আর ব্যাখ্যা দিতে হবে না! মেজাজটা খারাপ হয়ে আছে! তোমার অবচেতন মনটাকে ধরে চাবুক কষাতে ইচ্ছে করছে। শালা বেয়াদব!
-হাহাহা! থাক চাবুকটা রেখে দাও বরঙ, ভবিষ্যতে সেরকম কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে কাজে দেবে!
-হু, রেখে দেবো।
অতঃপর সে আমার বুকে মুখ বুঁজে ঘুমিয়ে পড়ে। দুঃস্বপ্নটা দেখার পর তার চাবুকনীতি সম্পর্কিত ঋজু মনোভাব আমাকেও অনেকটা স্বস্তি দেয়! ডায়াজিপামের মত। মাসল রিলাক্স্যান্ট। এরপরে খুব চমৎকার ঘুম হয় আমার।
*
আগেই বলেছি, বাজে স্বপ্ন নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করার মত মানুষ আমি না। দুঃস্বপ্ন দেখা আমার জীবনে রুটিনের মত। অবচেতন মনের রুটি-রোজগারের ধান্ধাকে অত প্রশ্রয় দেয়ার কিছু নেই। সপ্তাহখানেকের মধ্যে আমি ভুলেও গিয়েছিলাম স্বপ্নটার কথা। কিন্তু, ঠিক দুপ্পুর বেলা ভূতে মারে ঢেলা। একদিন দুপুরবেলা সহকর্মী এ্যাকাউন্টেন্টের রূপে ভূতে ঢিল ছুড়লো, এবং তার প্রতিক্রিয়ায় অন্তঃজ্ঞানীয় বস্তুগুলো কিলবিল করে বের হতে শুরু করল।
-খবর শুনেছেন? ভেরি স্যাড।
-কি স্যাড ঘটনা ঘটলো আবার?
-আমাদের এইচ.আর সেকশনে ছিলো না একটা ছেলে? মাহমুদ নাম। এ্যাক্সিডেন্ট করেছে। কোমড়ের নীচ থেকে পুরোটাই অবশ। বাকি জীবনটা বেচারার কাটবে বিছানায় শুয়ে।
-বলেন কী? আসলেই দুঃখজনক। এই সেদিনই ছেলেটার বিয়ে খেয়ে এলাম।
-হ্যাঁ রে ভাই! সাত বছরের প্রেম ছিলো ওদের। বেচারা মেয়েটা!
-মেয়েটা এখন চাবুক নিয়ে ঘুরবে তো?
-জ্বী, কী বললেন?
বেফাঁস কথাটা বলে ফেলায় বড্ড অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। কোনমতে হাবিজাবি কিছু একটা বলে সামাল দিতে হবে এখন!
-না বলছিলাম কী, মেয়েটাকে শক্ত হতে হবে এখন। প্রতিকূল, বেয়াড়া সময়কে চাবুকপেটা করে বশে রাখতে হবে।
-ও হো হো! আপনারা সাহিত্যিক মানুষ, আপনাদের রকমসকমই আলাদা।
তার ব্যঙ্গাত্মক স্তুতিহাসির জবাবে আমি অভদ্রের মত চুপ করে থাকি। নিজের প্রতি খুবই বিরক্ত লাগছে।
-যাই ভাই, কাজ করি। ঘটনাটা শুনে মনটা খুবই খারাপ হয়েছে, কিন্তু কী করব বলেন, দিস ইজ লাইফ!
-হু। সামটাইমস, ভেরি আনফেয়ার।
কাজে মন বসছে না আমার একদম। বারবার মাহমুদ, তার নবপরিণীতা স্ত্রী, এবং তার সাম্প্রতিক দুর্ভাগ্যের সাথে আমার সর্বশেষ দুঃস্বপ্নটা সমস্বত্ব মিশ্রণের মত মিশে যাচ্ছে। পৃথিবীর রহস্যময়তা নিয়ে আমি মোহগ্রস্থ না, দ্যা এক্স ফাইলস আমার পছন্দের টিভি সিরিয়াল হলেও কখনও ওসব বিষয় নিয়ে অবসেসড হইনি। দুঃস্বপ্নকে ভবিষ্যতের অশনি সংকেত হিসেবে ভাবার মত গর্দভ এখনও হতে পারিনি, কিন্তু মন্দ ভাবনার এক্সপ্রেস ট্রেইনকে সিগন্যাল দেয়ার মত কোন ঝান্ডা খুঁজে পাচ্ছি না। মস্তিষ্কের ক্রসিংকে অবজ্ঞা করে দুর্মর গতিতে ছুটে চলেছে ভাবনার রেলগাড়ী। তাতে যাত্রীসংখ্যা খুব বেশি না।
রিনা আর আমি একটা কামরায়। ট্রেইন চালাচ্ছে সময়। একটু পর আমি নেমে গেলাম কিছু একটা কিনতে। রিনা একা একটি কামরায়। ট্রেইন চালাচ্ছে শাকিল! আমি দৌড়ে ট্রেইনে উঠতে গিয়ে কাটা পড়লাম। আমাকে চাপা দিয়ে ট্রেইন চালিয়ে গেলো সময়। আমাদের কেবিনের দরজা ধরে ধাক্কা দিচ্ছে শাকিল। রিনা খুলছে না। সে কাঁদছে। অনন্তকাল ধরে সে যেন কেঁদেই চলেছে, আর শাকিল ধাক্কা দিয়েই চলেছে। একসময় রিনা দরজা খুলে দিলো। আর খুব হাসতে লাগলো দুজন মিলে!
দুঃখের বিষয়, এটা দুঃস্বপ্ন না, সুখের বিষয় এটা বাস্তব না। অবশ্য সুখকর বাস্তব বলে আদতে যদি কিছু থাকে! উত্তপ্ত এবং বিষাদী মনের এলোমেলো ভাবনায় আমার কাজে ভুল হতে থাকে বারবার। আজকে অফিস শেষে বাসায় না গিয়ে মাহমুদকে দেখতে যেতে হবে, সিদ্ধান্ত নিই। মাহমুদের স্ত্রীও থাকবে নিশ্চয়ই? অত্যন্ত অস্বস্তির সাথে খেয়াল করি, মাহমুদকে দেখতে যাওয়ার পেছনে সহকর্মীসুলভ সহমর্মিতার চেয়ে আমার সাম্প্রতিক মানসিক দোদূল্যমনতার প্রেক্ষিতে তাদের অবস্থাটা খতিয়ে দেখে নিজের সংশয়, সন্দেহ এবং কিছুটা আতঙ্ক মিশ্রিত কৌতূহলের ক্ষুন্নিবৃত্তি করাটাই প্রধান উদ্দেশ্য। হয়তোবা তাদেরকে সমবেদনা জানানোর চেয়ে মাহমুদের স্ত্রীর কোন ঘনিষ্ঠ ছেলেবন্ধু আছে কী না, সময় এবং পরিস্থিতি তাদেরকে কোন পথে নিয়ে যাবে এ নিয়েই বেশি উৎসুক থাকবো আমি! কুল ডাউন! নিজেকে অটোসাজেশন দেয়ার চেষ্টা করি। তুমি যাচ্ছো, স্রেফ একজন বন্ধুর বিপদে সহমর্মী হয়ে, ঠিক? যে উত্তরটা আসে তা আমার মনঃপুত হয়না।
*
এরকম জটিল মানসিক অবস্থায় একজন পুরুষের স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহপ্রবণ, অস্থির এবং আবেগগত দিক দিয়ে অস্থিতিশীল হবার কথা। আমার ক্ষেত্রে তা হয় না। ব্যাপারটাকে স্পোর্টিংলি নিই। খেলাটাকে উপভোগ্য করার জন্যে স্বপ্ন এবং অবচেতনের সাথে অলৌকিক কাকতালীয় সাইকিক ব্যাপারগুলোও অন্তর্ভূক্ত করি। ধরে নিলাম, সেদিনের স্বপ্নটা শুধু স্বপ্ন না হয়ে ভবিষ্যতের কাহিনীচিত্রের দৃশ্যায়ন অথবা নিয়তি নামক বস্তুটির দূরদর্শী কূটচালও হতে পারে! রিনার সাথে সেদিনের কথোপকথনটা রিওয়াইন্ড করে শুনি আবার। এটা গুরুত্বপূর্ণ।
সে বলেছিলো এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে, কেউ আমাদের দূরবস্থার সুযোগে সুবিধে নিতে গেলে তাকে খুন করবে, চাবুকপেটা করবে। রিনা যখন শাকিলের সাথে কথা বলে, আমার একটা অসুস্থ ইচ্ছে জাগে তেমন পরিস্থিতি নিজে থেকেই তৈরি করবার জন্যে। যেমন, একটা ট্রাকের সামনে ছুটে গিয়ে প্রত্যাঘাতে অথর্ব হয়ে যাওয়া, অথবা অনেকগুলো ফেনোবারবিটান গিলে নিরামিষমানবে পরিণত হওয়া। তখন কী করবে তুমি রিনা? প্রশ্নটাতে ভুল আছে। এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সাত বছর পরে তুমি কী করবে রিনা?
চাবুক ছুড়ে মারবে? পাগলা ঘোড়া ছুটে এলে? নাকি তাতে সওয়ার হবে? জানি, এই প্রশ্নগুলোর সঠিক জবাব পাওয়া যাবে না এখন, কী উত্তর আসবে তাও জানি। শুধু জানি না, প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি আমাকে হতে হবে কী না কখনও।
রিনা শাকিলের সাথে কথা বলছে ফোনে। দুজনে খুব ভালো বন্ধু। তুই-তোকারি করে। না, সন্দেহ করার কোন কারণ নেই। আমি কোন ভেড়াপুরুষ না, যে সন্দেহজনক কারো সাথে আমার স্ত্রীকে কথা বলতে দেখেও নির্বিকার থাকবো। যখন নির্বিকার থাকার সময় আসবে, মানে বলতে চাইছি যে, যখন আমি চাইলেও কিছু করতে পারবো না, এরকম কোন পরিস্থিতি যদি আসে, ধরে নেয়া যাক সাত বছর পরে, তখন সন্দেহজনক কেউ এলে রিনা কী করবে এটা দেখার জন্যে আমি উদগ্রীব।
আচ্ছা, সাত বছরের ব্যাপারটা মাথায় এলো কেন? সম্ভবত মাহমুদ এবং তার স্ত্রীর বিবাহপূর্ব প্রেমের শক্ত ভিত্তির কথা চিন্তা করে। শেকড়... তুমি কতদূর ছড়িয়েছো? কত ঝড় দূর্বিপাক সহ্য করার ক্ষমতা রাখো তুমি ভালোবাসার শেকড়?
*
মাহমুদের সাথে আমার কখনও খুব একটু সখ্যতা ছিলো না। কত সহকর্মী এলো গেলো, কে অত খবর রাখে! কিন্তু তার পরিস্থিতিটা বিশেষ। তার খোঁজখবর আমি ঘনঘনই নিই। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে শুনলে কেমন যেন আশাহত হই! স্বীকার করি, এ আমার অসুস্থ, স্বার্থপর কৌতূহল। এ নিয়ে এখন আর লজ্জিত হইনা। মাহমুদের স্ত্রী-হেনা, স্বাভাবিকভাবেই খুব ভেঙে পড়েছে। হেনা। সুন্দরী। আকর্ষণীয়া। রুগ্ন হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। হাসপাতাল থেকে বলে দিয়েছে তাদের আর কিছু করার নেই। বাসায় নিয়ে গিয়ে বিশ্রামে এবং শশ্রুষায় রাখতে হবে এবং ওপরঅলার কাছ থেকে অলৌকিক নিরাময়ের জন্যে প্রার্থনা করতে হবে। মাহমুদ! দু বেলা স্যুপ খাইয়ে দেবে তোমাকে হেনা। তোমার মুখের মাংসপেশীর অসারতার জন্যে তা গড়িয়ে পড়বে গলা বেয়ে। তোমার যৌনক্ষমতা বলে কিছু নেই। তবুও তুমি তার প্রেমময় স্বামী। পাগলা ঘোড়ারা ছুটে আসবে, হেনাকে একটা চাবুক দিও। ওর কাছে এখন অবশ্য আছে একটা। তবে ওটা পুরোনো হয়ে গেলে তোমাকেই কিনে দিতে হবে নতুন চাবুক। পারবে তুমি তা? অথবা হেনা কি পারবে তার চাবুকটা সবসময় চকচকে রাখতে?
-কবীর ভাই, একটু আসতে পারবেন? মাহমুদ কেমন যেন করছে। মনে হয় হাসপাতালে নিতে হবে।
-হাসপাতালে বারেবার যাবার সুত্রে হেনার সাথে আমার একটা বেশ ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। আমার তরফ থেকে সেটা অবশ্য স্রেফ একটা অসুস্থ অনুসন্ধিৎসা, ওহ তার ফলাফল তো বলা হয়নি, এখনও পর্যন্ত বেশ ভালো। এক বছর পার হয়ে গেছে। হেনার সাথে অন্য কোন ছেলেকে অন্তরঙ্গ হতে দেখিনি। হেনা ভালো জানে চাবুকের ব্যবহার। তবে আমার প্রতি সে খুব নির্ভর করে। আমিও চেষ্টা করি সে নির্ভরতার প্রতিদান দিতে। সময়ের সাথে সাথে আমার অসুস্থ অনুসন্ধিৎসাও থিতিয়ে এসেছে অনেকটাই।
-আমি আসছি হেনা, চিন্তা করনা কোন।
ওদের বাসায় গিয়ে দেখি মাহমুদ ঘুমিয়ে আছে।
-কী হয়েছিলো?
-খুব ছটফট করছিলো। বোঝেনই তো, সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমে গড়বড়, মাঝেমধ্যেই খুব অস্থির আচরণ করে। তবে আজকে একটু বেশিই করছিলো। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। পরে অবশ্য ওষুধ দেয়ার পর ঘুমিয়ে পড়েছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেনা। ক্লান্ত বাতাসেরা তার মনোদৈহিক পীড়নের কথা জানায় নিঃসীম সমুদ্রের অতলে পড়ে থাকা শঙ্খের হাহাকারের মত।
-আপনি বসুন, আপনার জন্যে চা বানিয়ে আনি।
টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়ায় হেনা দুর্বল শরীরে। হাঁটতে গিয়ে পড়ে যায়। আমি দ্রুত গিয়ে তাকে ধরে ফেলি। তার অনাবৃত পেটে আমার হাত।
-শরীরটার ওপর বড্ড ধকল যাচ্ছে কবীর ভাই!
-হু বুঝতে পারছি।
টিভিতে তখন একটা ওয়েস্টার্ন মুভি চলছিলো। ক্লিন্ট ইস্টউড যাচ্ছিলো ঘোড়া দাপিয়ে। তার কাছে কোন চাবুক ছিলো না।
*
-আগামী বৃহস্পতিবার ফ্রি আছো সন্ধ্যার পর?
চুলে স্কুলবালিকাদের মত পিগটেইল বাঁধতে বাঁধতে রিনা সুধোয় আমাকে।
-হু আছি। কেন?
-শাকিলের জন্মদিন। যেতে বলেছে।
-অনেকদিন শালার সাথে দেখা হয় না। যাওয়া দরকার আসলেই।
শাকিলের সাথে আমার নিজেরও বেশ ভালো জমে। খেলা, সিনেমা, সাহিত্য সবকিছু নিয়ে আলোচনা করা যায় ওর সাথে। অনেকদিন ওর সাথে দেখা হয় না। বাস্তবেও না, স্বপ্নেও না। সেই স্বপ্নটা! দেড় বছর আগের সেই স্বপ্নটা! হাহা। ভুলেই গিয়েছিলাম প্রায়। আবার মনে পড়ে গেলো। আমার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। গলা শুকিয়ে আসে। মনে পড়ে গেলো আবার! এবার ভূত ঢেলা ছুড়লো সন্ধ্যেবেলায়। বাজে ভাবনার ট্রেইন ছুটে চলে আবার মস্তিস্কের অন্ধকার প্রান্তরে অবচেতনের নিওন সাইন ধরে পথ চিনে। যাত্রীরা এবং যাত্রী ওঠানামার পর্যায়ক্রম ঠিক আগের মতই! পুরোনো স্মৃতি, পুরোনো দুঃস্বপ্ন, অসুস্থ অনুসন্ধিৎসা, খেলার মনোভাব ফিরে আসে আবার। ঠিক আছে শাকিল, খেলা চলুক আবার! ঠিক আছে রিনা, তুমিও প্রস্তুত হও!
-শাকিলকে জন্মদিনে একটা দামী ধারালো ছুরি উপহার দেবো। কেমন হবে বলত?
-ও মা, এটা আবার কেমন গিফ্ট হল?
রিনার কন্ঠে বিস্ময়।
-শাকিল একবার কথাচ্ছলে বলেছিলো আমাকে একটা ভালো ছুরির খুব শখ তার।
আমি বলি। যদিও শাকিল কখনও আমাকে এমন ইচ্ছার কথা জানায়নি। তবে খেলার উপকরণ হিসেবে এটা বেশ জরুরী। কখন তার (অথবা তাদের!) কাজে লাগে কে জানে!
বৃহস্পতিবার।
-হ্যালো, রিনা। শোনো তুমি ক্যাপ্টেনস ক্লাবের ওখানে অপেক্ষা কর, হ্যাঁ, হ্যাঁ, শাহীন স্কুলের ওখানে। আমি ওদিক থেকে তোমাকে পিক করব।
-আচ্ছা, আমি একটা সিএনজি নিয়ে বেরুচ্ছি এখনই। তোমার ছুরি কেনা হয়েছে?
খিলখিলিয়ে হাসে সে।
-হ্যাঁ, কিনেছি।
আমিও হেসে প্রত্তুত্তর দিই।
নিয়তি...অবচেতন...স্বপ্ন...বাস্তবতা...আমি...তুমি...সে...
খেলা চলছে। তোমরা অস্ত্র এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি প্রস্তুত রেখো!
-এ্যাই, তুমি কোথায়? কতক্ষণ লাগবে?
-আর পাঁচ মিনিট! মহাখালির জ্যামটা ছুটলেই সাঁই করে চলে আসবো।
-হুহ! খালি পাঁচ মিনিট আর পাঁচ মিনিট!
-আই সিএনজি যাইবা?
-কই যাইবেন?
-বাড্ডা।
-ড্রাইভারটাকে একটু আস্তে চালাতে বলনা! এ তো এ্যাক্সিডেন্ট করে বসবে!
এ্যাক্সিডেন্ট! মাহমুদ যেমন করেছিলো। তারপর যেমন ভেজিটেবল হয়ে গিয়েছিলো! এখন যদি আমারও এমন হয়? কী করবে রিনা তুমি? কী করবে বছর সাতেক পর? তোমার চাবুকনীতি বজায় থাকবে তো? কিছুদিন থাকবে জানি, সেটা কতদিন?
ফাঁকা রাস্তা পেয়ে চালক গতিমাতাল হয়ে গেছে।
-একটু আস্তে চালান না ভাই। এ্যাক্সিডেন্ট করবেন তো।
কথাটা বলার সময় হুট করে কেন যেন মোড়কবন্দী ছুরিটার দিকে আমার হাত চলে যায়। যে খেলা শুরু করেছিলাম, না ভুল হল, যে খেলা শুরু হয়েছিলো আমাদের ক্রীড়নক করে, তার উপসংহার অথবা মধ্যবিরতি কি আজই?
*
-রিনা ভাবীর এখন কী অবস্থা কবীর ভাই?
-ভালো না। ওর নার্ভাস সিস্টেম একটা বড় ঝাঁকুনি খেয়েছে। দেহের কয়েক জায়গায় কম্পাউন্ড ফ্র্যা কচার। আর কখনও উঠে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, কথা বলতে, ভাবতে পারবে কী না তাও সন্দেহ।
কিছুক্ষণ কুহক নীরবতা।
-আপনার শরীর ভালো তো কবীর ভাই?
-হ্যাঁ, আমি ভালো আছি। খুব ভালো আছি!
ঝরঝর করে কেঁদে ফেলি আমি। বুকের ভেতর ভয়ংকর শূন্যতা। কেউ যেন খাঁমচে তুলে নিয়েছে আমার হৃৎপিন্ড, পাঁজর।
-আমি আসছি।
হেনার কন্ঠে সেই ক্লান্তির ভাবটা নেই এখন আর। দেড় বছরে নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছে।
-আসো...
জানি না কাকে কোথায় কখন কীভাবে আসতে বলি।
১৫৯টি মন্তব্য ১৫৭টি উত্তর
পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন
আলোচিত ব্লগ
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!
সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন
কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী
ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন