শুভ সমাপ্তি
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
মাত্র তের বছর বয়সেই মৃত্যুবিষয়ক ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হবার কারণে রেজা অনেক কিছু থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। ব্যাপারটার শুরু এভাবে, টেলিভিশনে একটা নাটক দেখছিলো সে পরিবারের সবার সাথে, সেখানে একজন ধনাঢ্য প্রৌঢ় ব্যক্তি উজ্জ্বল বর্ণের হাওয়াই শার্ট পরে সমুদ্রস্নানে এলে তার কুচক্রী প্রতিপক্ষের লেলিয়ে দেয়া মাস্তান বাহিনীর প্রধান জন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে তাকে অতিক্রম করার সময় শ্লেষমিশ্রিত হুমকি দেয় বুড়ো বয়সে এমন রঙচঙা শার্ট পরার জাগতিক অসারতা সম্পর্কে। তার জীবনে আনন্দ করার সময় যে ফুরিয়ে আসছে তাও জানান দেয় সিনেমাটিক ভঙ্গীতে উচ্চস্বরে টেনে টেনে হেসে। এসমস্ত অনভিপ্রেত ঘটনায় বুড়োর বিরক্তি উৎপাদন হয়েছিলো শুধু, কিন্তু তা গভীর এক ছাপ ফেলে রেজার কিশোর মনে। তার বয়স এক লাফে বেড়ে যায় পঞ্চাশ বছর। বিষণ্ণ মনে গুচি মাছ এবং করলা ভাজি দিয়ে ভাত খাওয়ার সময় মানবজীবনের নশ্বরতার কথা ভেবে রাতের খাবারের মেন্যু নিয়ে হৈ চৈ করার চিন্তা বাতিল করে দেয় সে।
তখন ফ্রিজে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় থাকা একটি ডিমের সাথে কিছু পেঁয়াজ এবং মরিচ চিয়ার্স করে।
রাতে ঘুমোবার সময় অভ্যাসবশত কম্পিউটারটা চালু করে মনের অজান্তেই বুকমার্ক করে রাখা পর্ন সাইটগুলোতে চোখ বুলাতে গিয়ে বিষণ্ণতা কিছুটা কাটিয়ে ওঠে সে।
কিছুক্ষণ পরে নিহত হয় টিস্যু বক্সের কয়েকজন বাসিন্দা।তাদেরকে নির্মমভাবে ছুড়ে ফেলা হয় ওয়েস্টপেপার বিনে।
কিছুটা ভারমুক্ত এবং রিলাক্সড হবার ফলে রেজার ঘুম পায়। বালিশে মাথা রাখার সাথে সাথেই সদ্যপ্রসূত ডিপ্রেসিভ এলিমেন্টগুলো তাকে জোর করে ধরে নিয়ে যায় দুঃস্বপ্নের রঙ্গমঞ্চে।
-আমি যাবো না, যাবো না, যাবো না! কেন আমাকে নিয়ে যাচ্ছ ওখানে?
-ওহে বিষণ্ণ কিশোর, মৃত্যুচিন্তা কি তোমাকে দুঃখী করে না? এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের অসারতা, অর্থহীনতা তোমার মনোজগতে স্থবিরতা সৃষ্টি করে না?
-হ্যাঁ, করে! কিন্তু ডিপ্রেশনে ভুগলেই যে দুঃস্বপ্ন দেখতে হবে এমন কোন কথা আছে? কোথায় আছে এমন যুক্তি?
-না, এরকম কোন কথা নেই, তবে ডিপ্রেশনে ভুগলে দুঃস্বপ্ন দেখার প্রবণতা বেড়ে যায়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সিজোফ্রেনিকদের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখার হার ১৬.৭% যেখানে স্বাভাবিক মানুষের মাঝে এটা ৪.৯%। সুতরাং...
-সুতরাং কী? আমাকেও দুঃস্বপ্ন দেখতে হবে? ওয়েট আ মিনিট! আমি সিজোফ্রেনিক হলাম কবে থেকে? আজ রাতে একটু মন খারাপ হয়েছে, তাতেই সিজোফ্রেনিক বানিয়ে দিলে? ছাড়ো আমাকে, আমি শান্তিতে ঘুমুবো।
-ঠিক আছে, শান্তিতে ঘুমুতে চাও, ঘুমাও। কিন্তু তোমার এরকম আচরণ আমাদের ডিপ্রেশানুভূতিতে আঘাত করছে। বিষণ্ণতার ঈশ্বর তোমার সহায় হোক।
তা ঈশ্বর সহায় হয়েছিলেন বই কী! দিন দিন রেজার মধ্যে মৃত্যুচিন্তা গেড়ে বসতে থাকে। বয়স্ক কোন মানুষকে হাসি-ঠাট্টা-ফূর্তি করতে দেখলে সে অবাক হয়। গড় আয়ূর হিসেবে বেশি দিনতো তাদের নেই। তবু কেন তারা হাসে? সে আরো অবাক হয় কাউকে মৃত্যপূর্ব কোন ইচ্ছার বয়ান করে জীবনকে সমর্পিত করতে দেখলে। যেমন, "মেয়েটার বিয়ে দিয়ে যেতে পারলে শান্তিতে মরতে পারি"। আহাহা কী সোজা! হাসপাতালে নিয়ে যখন অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে রাখবে, নিঃশ্বাসের জন্যে বুক হাহাকার করবে, তখন শান্তিতে মরণ কেমন তা বুঝতে পারবে! রেজার নৈরাশ্যবোধ অবশ্য কাউকে তেমন প্রভাবিত করছে না। কেউ জানছেও না। তের বছরের কিশোরদের মধ্যে জটিল মনস্তাত্ত্বিক নৈরাশ্যবাদ এলে তা প্রকাশ না করাই বাঞ্জনীয়, এটা রেজা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারে। এক বিকেলে বারান্দায় মন খারাপ করে বসে থাকার সময় তাদের বাসায় সদ্য আগত উঠতি বয়সের তুতো বোন তার মন খারাপ দেখে চিয়ার আপ করতে এলে পরে রেজা এ সংক্রান্ত নিজস্ব সিদ্ধান্তের যথার্থতা বুঝতে পারে।
-রেজা, কী হয়েছে তোমার? মুখটা এরকম শুকনা দেখাচ্ছে কেন? পেট খারাপ?
-না, মন খারাপ।
গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেজা বলে।
-ও মা, মন খারাপ কেন? কেউ কিছু বলেছে?
-কে আর কী বলবে! এমনিই। তুমি যাও তো রিনা আপু। ভালো লাগছে না।
-এ্যাই! কী হয়েছে আমাকে বল। নাহলে তোমাকে ছাড়ছি না। কারো প্রেমে পড়েছো বুঝি?
আগ্রহে রিনার চোখ-মুখ চকচক করতে থাকে। এর হাত থেকে সহজে নিস্তার নেই বুঝে রেজা অগত্যা বিস্তারিতভাবে বলেই ফেলে তার সাম্প্রতিক মানসিক জটিলতা। বলতে বলতে বিকেলের রোদ মরে আসে, মরা রোদ আঁকশী দিয়ে একটি রিপালসিভ সন্ধ্যা তুলে এনে বিছিয়ে রাখে বারান্দায়। রিনা উশখুশ করছিলো অনেকক্ষণ ধরেই। তার উৎসাহ মিইয়ে গেছে। রেজার দীর্ঘ মনোলগকে সে দ্রুত উপসংহার দিয়ে ফেলে এরকম হয়েই থাকে এবং তা খুব দ্রুতই ঠিক হয়ে যাবে বলে। টমেটো এবং সর্ষের তেল দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে দিলে তা এ ব্যাপারে ভালো প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে বলে তার মনে হয়, এবং এ প্রস্তাবে রেজারও কোন আপত্তি থাকে না।
আরেকটা বিকেল মরে যায় এভাবে, অযথাই!
রেজার বন্ধুরা তার মনোবিকলনের ব্যাপারটাকে আঁতলামী হিসেবে গণ্য করে এবং তাকে সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত আকর্ষণীয় জাভা গেমস এবং হিডেন ক্যাম ভিডিও সেলফোনের মেমোরি কার্ডে আপলোড করে দেয়। তারা তাকে অষ্টাদশোর্ধ কৌতুক শোনায় এবং সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত যৌনাবেদনময়ী শিক্ষয়ীত্রীর হাঁটার ভঙ্গী অনুকরণ করে দেখায়। হাসতে হাসতে রেজার পেটে খিল ধরে যায়। টিফিন টাইম শেষ হয়ে যায় খুব দ্রুতই। সমাপ্তিকে ইদানিং মৃত্যুর সমার্থক মনে হয় তার।
মারা যায় আরেকটা ঝলমলে টিফিন পিরিয়ড।
এখন রাতে ঘুমোবার সময় রেজার বিষণ্ণতা তরাণ্বতাকারী পরান্নভোজী ছায়ামানব রুটিন করে আসে। তার হাত ধরে নিয়ে যায় নাইটমেয়ার থিয়েটারে। তারা দুজন একসাথে বসে দেখে বিবিধ বিমূর্ত মৃত্যুচিত্র। চলমান অথবা স্থির। তাদের মধ্যে টুকটাক কথাও হয়।
-কী, কেমন বুঝছো? বেশ জাঁকিয়ে বসেছে অসুখটা, কী বল?
-তাই তো দেখছি! শেষতক সিজোফ্রেনিয়াক হয়ে যাবো নাকি?
-তা হতে পারো। আমি আশাবাদী। তুমি পারবে। পৃথিবীর সৃজনশীল মানুষদের অনেকেই সিজোফ্রেনিক ছিলো।
-কিন্তু আমি তো সৃজনশীল না! আমি না পারি কিছু লিখতে, না পারি আঁকতে, না পারি গড়তে...
-পারতেই হবে এমন কোন কথা নেই। সবাইকে দিয়ে কি আর সবকিছু হয়? তবে এই যে তুমি মৃত্যুকে অনুধাবন করছ, এটাও একরকম সৃজনশীল চিন্তা। শুধু তাই না, তুমি মৃত্যুবিষয়ক চিন্তাকে বিবর্ধিত করতে পেরেছো।
-কিরকম?
-তুমি শুধু নশ্বর মানবদেহের মৃত্যুই দেখো না। তোমাকে ভাবায় চিরেচ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া মৃত আমসত্ত, ওমলেট হতে গিয়ে বেঁচে যাওয়া ডিম তোমার কাছে গিয়ে কৃতজ্ঞতা জানায়...
-আমি সত্যিই ভাবি নাকি এরকম? কী অদ্ভুত কথা বলছো!
-না, ভাবো না স্বীকার করি। তবে মৃত্যুভাবনাশাস্ত্রকে উন্নত করতে এসব ভাবনার দরকার আছে।
থিয়েটারে তখন দেখাচ্ছিলো একটা বিশাল ডিমের ভেতর থেকে কুসুম বেরিয়ে এসে প্লাবিত করছে ফ্রিজ, স্যান্ডেল চাপায় নিহত আমসত্ত সাপের মত কিলবিলিয়ে বের হচ্ছে রিনা আপার ব্রেসিয়ার থেকে। কে একজন এসে তাকর চোখে থ্রিডি গ্লাস পরিয়ে দেয়। সে প্রাণভরে চিৎকার করতে থাকে।
-অনর্থক মৃত্যুচিন্তার সাথে অবচেতন মনের লোভ এবং কদর্যতা যুক্ত হলে তা বেশ অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রতিটা মৃত্যুকে সমানভাবে দেখলে, তা সে ফিলিস্তিনের শেলবিদ্ধ যোদ্ধা হোক, বা বটি দ্বারা কর্তিত আলু-বেগুন, বা মাস্টারবেশনের পরে ব্যবহৃত টিস্যুপেপার, সমন্বয় করা গেলে বেশ চমৎকার একটা দৃশ্যকল্প তৈরি হয়...যাহোক, চিৎকার বন্ধ কর। আমরা এখন দৃশ্যান্তরে চলে যাচ্ছি। এ অংশটি বেশ দুঃখের, আগেরটার মত ভৌতিক উপাদান নেই। তুমি দেখবে বিকেলের মরা রোদ , উচ্ছল বিশ মিনিট শেষে টিফিন টাইমের শবযাত্রা...
ঘুমের মধ্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে সে। কিছু অশ্রূ তার গাল বেয়ে বালিশের মধ্যে পতিত হয়ে হারিয়ে যায় চিরকালের জন্যে। তবে সেইসাথে এ প্রতিশ্রুতি বা হুমকি বা আশ্বাস দেয়, তারা আবার জন্ম নেবে। সাথে থাকবে চিরকাল।
দেখতে দেখতে বিষণ্ণতার নয় মাস এবং রেজার জীবনঘড়িতে চৌদ্দটা বেজে গেলো। জন্মদিনের প্রাক্কালে অন্যান্য মৃত্যুবিলাসীদের মত তারও জীবন থেকে একটা বছর হারিয়ে যাওয়ায় বিপন্নতার বোধ তৈরি হল। দুই পাউন্ড ওজনের ব্ল্যাক ফরেস্ট কেকের সাথে চোখাচোখি হল তার। একটু পরে কেকটাকে কেটেকুটে খেয়ে ফেলা হবে। বিভিন্ন মানুষের পাকস্থলিতে গিয়ে নানারকম বিক্রিয়া করবে। মিশে যাবে এসিড এবং এনজাইমের সাথে। তৈরি করবে দুর্গন্ধময় বর্জ্য। হায় কেক! হায় চকোলেট লেয়ার দেয়া কেক!
-হ্যাপি বার্থডে টু ইউ মাই সান!
বাবা আজকে একটা ঝলমলে বুটিকদার হাওয়াই শার্ট পরেছে। সেই হাওয়াই শার্টটার মত! টিভিতে একজন বয়স্ক লোককে যা পরতে দেখে রেজার জীবনের এই দীর্ঘ গ্ল্যাসিয়েশন পিরিয়ডের সূচনা। বাবার বয়স অবশ্য অত বেশি না। তার শুভেচ্ছার জবাবে একটা শীর্ণ হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে রাখে রেজা। মৃতপ্রায় হাসি। একটু পরেই টুপ করে খসে পড়বে, এবং মারা যাবে। এমন মৃত্যু প্রতিনিয়ত দেখে দেখে ক্লান্ত সে। কেউ একজন তার হাতে একটা ছুরি ধরিয়ে দেয়,
-নাও, কেক কাটো! সবাই অপেক্ষা করছে।
সে হাসিমুখে বড় করে তেকোনা একটা টুকরো কাটে। খাইয়ে দেয় মা'কে। হাততালি দিয়ে ওঠে সবাই।
রেজা খুব আগ্রহের সাথে কেকটা কেটে টুকরো টুকরো করে সবাইকে পরিবেশন করে। অনেকদিন পর তাকে স্বতস্ফূর্তভাবে কাজ করতে দেখে অভিভাবকেরা স্বস্তির শ্বাস ফেলেন, বন্ধুরা উল্লসিত হয়। রেজাকে ঘিরে অসংখ্য শুভবার্তা, খুনসুটি এবং উপহার। জীবনের প্রাচুর্যে ঝলমল করছে ঘরটা। হঠাৎ কারো হাত থেকে কেকের পিরিচ পড়ে ভেঙে যায়। কোলাহলমুখরিত ঘরটিতে তা কারো মনোযোগ আকর্ষণ করেনা তেমন। শুধু রেজা বিষণ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।
মৃত্যুবিষয়ক চিন্তা বেশি করে যারা, তাদের সহজে মৃত্যু হয়না। তারা খুব ভালো পর্যবেক্ষক হয়। তাদের চোখের সামনে অসংখ্য মৃত্যু ঘটে। দৃশ্যমান বা অদৃশ্য। তাদের পোষাক স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যায় অদৃশ্য অশ্রুর বর্ষণে। হৃদয়ে বিষণ্ণ গুল্ম জন্মে বিষাদকর্ষণে। রোজরাতে এখন মেলানকোলিক হরর থিয়েটারে যাওয়া হয়না তেমন আর। তত্ত্বাবধানকারী লোকটি মাঝেমধ্যে এসে দেখা দিয়ে যায়। সে জানে, বেশ ভালো করেই কর্ম সম্পন্ন হয়েছে। এখন শুধু ঘাপটি মেরে বসে থাকা। কখনও কোনরকম উল্টোপাল্টা হতে দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে প্রবল বিক্রমে, জীবনকে পরাভূত করবে মৃত্যুর বিভ্রমে।
বিভ্রম! বেঁচে থাকাটাকেই এক অলীক বিভ্রম মনে হয় রেজার। এতদিন মরে যাওয়াটাকে আশ্চর্য লাগতো, এখন লাগে বেঁচে থাকাটাকে। ঠুনকো একটা শরীরকে টিকিয়ে রাখতে কত আয়োজন! সহজপাচ্য খাবার খান, পেট ভালো থাকবে। রেড মিট টোটালি বন্ধ। কোলেস্ট্রল বেড়ে যাবে। সপ্তাহে দুইদিন ত্রিশ মিনিট করে ব্যায়াম। ডিমের কুসুম ফেলে দিবেন। নো সিগারেট। হাইপ্রেশার হবে। রেজা মেনে চলে সব। মৃত্যুকে তার বড় ভয়।
-অযথা মৃত্যুবিষয়ক চিন্তা করে হার্টকে ভারাক্রান্ত করবেন না।
সাইক্রিয়াটিস্ট বললেন।
-ঠিক আছে স্যার!
-আপনার বয়স কত?
-৩১
-এই বয়সে মৃত্যুচিন্তা করে মুখটা আমসি করে বেড়ালে হবে? কাম অন ম্যান! জীবনের এখনও কত বাকি। জীবন অনেক সুন্দর। পজিটিভলি নিতে শিখুন। ব্লা ব্লা ব্লা...
-আপনার এই হাওয়াই শার্টটা বেশ সুন্দর। রঙদার।
-ধন্যবাদ!
-আপনার বয়স কত?
-হাহা! কেন? ফিফটি ফাইভ। দেখুন না এই বয়সেও কত ইয়াং আছি! তো যা বলছিলাম... ব্লা ব্লা ব্লা...
আবার সেই রঙচঙে হাওয়াই শার্ট! ফূর্তিবাজ প্রৌঢ়। আবারও মনে সেই প্রশ্ন, আর কতদিন আছো এই পৃথিবীতে? সময় তো শেষ হয়ে আসছে, এত আনন্দ কেন? পুনরাবৃত্তি। রেজা আরো কিছুক্ষণ ব্লা ব্লা করে বেরিয়ে এলো মনস্তত্ত্ববিদের কামরা থেকে। কিন্তু ভেদ করতে পারলো না চক্র!
*
রাতের বেলা শুতে গেলে ভয় হয়। মনে হয় দূর থেকে নিখুঁত লক্ষ্যভেদে শেষ করে দিতে প্রস্তুত কোন স্নাইপার। প্যানিক এ্যাটাক। বুকের মধ্যে হৃৎপিন্ডটা লাফায়। সাফোকেশন। ঘুমোলেই যেন দ্বিচারিনী মত ছেড়ে যাবে এতদিনকার বিশ্বস্ত নিঃশ্বাস।
-ঘুমুবে না?
জড়ানো কন্ঠে প্রশ্ন করে আমার স্ত্রী।
-না, আমি লেখালেখি করব কিছুক্ষণ।
-তোমাকে জড়িয়ে ধরে না থাকলে আমার ঘুম হয়না।
স্ত্রীর আব্দার রাখতে গিয়ে আমার শরীর আব্দার করে বসে। অতঃপর আবারও ভারমুক্ত এবং রিলাক্সড বোধ করা। কিন্তু এবার আর ঘুম আসে না। ও ঘুমিয়ে যায় ঠিকই। এইসব রাতে এখন চোখ না বুজলেও সেই ডিপ্রেশন কেয়ারটেকার এসে উপস্থিত হয়। তার বয়সের চাকা যেন উল্টোদিকে ঘুরছে। তাকে খুব সতেজ, তরুণ এবং উৎফুল্ল দেখায়।
-আমাকে শুষে নিয়ে খুব সজীব হয়ে গেছিস দেখছি!
সম্বোধনের পরিবর্তনের সাথে কথার ধরণটাও পরিবর্তিত হয়। একই সাথে হৃদ্যতা এবং তিক্ততা প্রকাশ পায়।
-এমনটাই তো হবার কথা ফ্রেন্ডো!
-এতকিছুর পরেও আমাকে ফ্রেন্ডো বলিস কোন সাহসে?
-আমার সাহসের অভাব কি কোনকালে ছিলো? আর হৃদ্যতা প্রকাশ করব নাই বা কেন? আগে তোর বিষণ্ণতার বিষলতা পাহাড়া দিতাম। এখন সেটা বৃক্ষ হয়ে উঠেছে। আর কিছুদিন পর হয়তো মারা যাবি। তখনও তো তোর পাশেই থাকবো। ওটাকে ভয়াবহ করে তুলতে তোর স্মৃতি থেকে যাবতীয় অপকর্ম, অনুশোচনা, অপরাধ সব তুলে আনবো।
-তুই যা তো এখন! আমি লিখবো।
সে যায় না। পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমার ভয় করে। বুকের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে কেউ যেন হৃৎপিন্ডটা বের করে নিয়ে আসতে চাচ্ছে! এটা কী, হার্ট এ্যাটাক, হার্টবার্ন, নাকি প্যানিক এ্যাটাক? ভয় করে। বুকটা খাঁমচে ধরে বসে থাকি। তখনও পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে সে। সম্ভাব্য আততায়ী সঙ্গী। ভয় কাটানোর জন্যে আমি লিখতে থাকি। সে নিঃশব্দে পাশে এসে বসে। আবারো দমবন্ধ হয়ে আসছে...বুকব্যথা করছে... আমার স্ত্রীকে ডাকব নাকি? না, সে ঘুমুচ্ছে, ঘুমাক। আমি লেখাতে মনোনিবেশ করি আবারও।
-লেখাটা বন্ধ কর।
কোমল স্বরে বলে সে।
-না।
-বন্ধ কর, তোর ভালোর জন্যেই বলছি। একটা দারুণ জিনিস দেখাবো।
-কী জিনিস?
-একটা সিনেমার শেষাংশের ট্রেলার।
-বুঝতে পেরেছি। কী দেখাতে চাস। সে তো আমি দেখে আসছি দেড় যুগ ধরেই!
-আমার সঙ্গে আবার দেখ। আমিও যে তোর মত বিপন্ন। কথা দিচ্ছি, ওটা দেখা শেষ হলে চলে যাব আজ রাতের মত।
-ভয় করছে!
-করুক। যা বলছি তাই কর। লেখাটা থামা। আর তোর বউকে ডাকিস না। আমার কাছে আয়। আয়... আয়... আয়...
আমি লেখা বন্ধ করলাম।
*
"নিশ্চিত সমাপ্তির দিকে গুটিগুটি এগুতে থাকি ক্রমশ
আর রেখে যাই আমার পদচিহ্ন
সমাপ্তির ব্যাপ্তি জানা হয়
দেখা হয় মায়াবন জুড়ে সবুজ
আর হিমাগারের বরফ মিউজিয়াম
আমি রেখে দেই কিছু স্যুভনির
এ জগতে বা অন্য কোথাও
নিশ্চিত জানি
রয়েছে আমার হরিৎ অথবা ধূসর নীড়"
১১৮টি মন্তব্য ১১৮টি উত্তর
পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন
আলোচিত ব্লগ
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!
সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন
কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী
ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন