যেখানে আমার জন্যে কোন অরণ্য নেই, সবুজ নেই, লাজুক কিশোরীর চাহনি নেই, সেই কংক্রিটাক্রান্ত মেদবহুল শহরে আমি থাকবো না। আমার জন্যে হাত বাড়িয়ে আছে কেরোসিনের সলতের মৃদু আগুনে ডুবে থাকা গ্রামরাত্তির, আদুরে শিশুর মত পাশ ফিরছে ঝিঝিডাকা তুমুল নিস্তব্ধতা বাঁশবাগানের পৌরাণিক প্রেতাত্মাদের আহবানে, খেলাচ্ছলে। এই শীতেই যাবতীয় শহুরে সুঘ্রাণ ত্যাগ করে ভাঁপা পিঠা আর সোঁদামাটির গন্ধ নিতে কয়েকদিনের জন্যে হলেও ফিরে যাবো গ্রামে, অথবা অরণ্যে। আমি বড্ড তৃষ্ণার্ত। ঢোকঢোক করে পান করব সবুজ পানীয় জোনাক পোকাদের আপ্যায়নে...
এটুকু লিখে আমার সিগারেটের পিপাসা পেলো। ছয়টা বেনসন মজুদ আছে আমার ড্রয়ারে। রাত্রি জাগার জ্বালানী হিসেবে। আয়েশ করে একটি ধরাতে গিয়ে দেখি, সিগারেট ছটা ঠিকঠিক থাকলেও ম্যাচের কাঠি মাত্র দুটো। ধুশ শালা! দুটো ম্যাচের কাঠি দিয়ে ছটা সিগারেট ধরাবো কীভাবে! ম্যাচে তো অন্তত হলেও দশটা কাঠি থাকার কথা। গেলো কই? এত রাত্তিরে ম্যাচ কিনতে যাই বা কোথায়! বাড়িঅলা হারামজাদা তো কলাপসিবল গেট লাগিয়ে দিয়েছে। আর আমিও নিয়ম মেনে ঠিক এগারটার মধ্যেই বাসায় এসেছি। এখন ম্যাচের দরকারটা খুব জরুরী। আমার শ্বাসনালী পুড়ে ছাই হোক, আজকের ধুম্রউদযাপন আমার জন্যে ক্যান্সারের উপলক্ষ্য হোক, ম্যাচ যেভাবেই হোক যোগাড় করতেই হবে। বাড়িঅলাকে কাকুতি-মিনতি করে দেখবো নাকি, হঠাৎ ফোন পেয়ে মরণাপন্ন কোন নিকটাত্মীয়কে রক্ত দিতে হবে বলে? কিন্তু বাসায় ঢোকার সময় মাসের মাঝামাঝিতেও ভাড়া না দেয়ার ব্যাপারটা কটাক্ষ করে উল্লেখ করায় সে সাহস হয় না। অবশ্য এখানে আরো একটা ব্যাপার বিবেচ্য, আমার এক বন্ধুর স্ত্রীর অবস্থা মরমর। তাকে রক্ত দিতে হতে পারে আজকালের মধ্যেই যেকোন সময়। এই মুহূর্তে শালা একটা ফোন দিয়ে যদি জানাতো যে তার বউয়ের এই মরে কী সেই মরে অবস্থা তাহলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যেতো। মরণাপন্ন রোগীর কথাটা জোরগলায় বাড়িঅলাকে বলতে পারতাম। সমস্যা হল, এখন মিথ্যে বলতে গেলেও কন্ঠে সে জোর আসবে না। ধূর্ত বাড়িঅলা ঠিকই ধরে ফেলবে। মানবিকতাকে হাওয়াই মিঠাই বানিয়ে খেয়ে ফেলেছে হারামীগুলো। যাইহোক, এগুলো পরে ভাবা যাবে। এখন দেখি, বর্তমানের অনুপাস্থনযোগ্য সংকটাবস্থার কোন সুরাহা করা যায় কী না। রান্নাঘরে গিয়ে দেখা যেতে পারে। হয়তোবা বুয়া রান্না করতে গিয়ে গ্যাসের চুলার পাশে ম্যাচবক্স ফেলে রেখে গেছে দুয়েকটা উদ্বৃর্ত কাঠি সহ। বেশ টেনশনের ব্যাপার। যদি না থাকে তো রাতটাই মাটি হবে। এর চেয়ে যা আছে তা দিয়েই রাততাড়িত কাব্যময় সময়টা উপভোগ করি আপাতত। আমি একটা সিগারেট ধরালাম। বাকি থাকলো পাঁচটি সিগারেট এবং একটি ম্যাচের কাঠি। ব্যাপারটা অবশ্য এভাবেও সমাধান করা যায়, একটা সিগারেট দিয়ে আরেকটি ধরিয়ে দ্রুত শেষ করে ফেলা। কিন্তু এভাবে সিগারেট শেষ হবে, রাত শেষ হবে না। একটা সবুজ রাত অনেকদিন পরে এলো আমার কাছে জলপ্রপাতের মত ভাসিয়ে নিতে। এই রাতটাকে কোনভাবেই অবজ্ঞা করতে পারি না আমি অর্থলোভী বাড়িঅলার রক্তচক্ষু বা বুয়ার অপচয়কৃত দিয়াশলাই কাঠির কথা ভেবে। ফিরে যাই সবুজের আবাহনে। আমার বুয়াটা বড় ভালো। তার সাথে প্রকৃতির গন্ধ মিশে আছে। তার কথায় কোন কৃত্রিমতা নেই। তাকে নিয়ে কয়েকলাইন লেখাই যায়, অবশ্যই পূর্বলিখিত লাইনগুলোর সাথে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে...
"প্রস্তরাচার্য শহরের পাঠ্যসূচী ছিড়ে ফেলে আমি যাবো প্রৌঢ় গ্রামাণ্বিতার গ্রামোফোন রেকর্ড শুনতে। সেই কলের গান, যা আজ বিস্মৃত এই প্রাযুক্তিক শহরে, পুরোনো অভিজাত বাড়িগুলোতে খুঁজলে হয়তো অকেজো স্মৃতিস্মারক হিসেবে পাওয়া যাবে। তবে আমার মনে হয়, কলের গান, বায়োস্কোপ, এইসব ভুলে যাওয়া সুরকৌশল শুধুমাত্র গ্রামে বা অরণ্যেই মানায়। যা কিছু হারিয়ে যায় সময়ের করাল গ্রাসে বা সন্ত্রাসে, সবকিছুই থেকে যায় সবুজের মায়াদর্পণে। আমি জানি এই দর্পণ সবার জন্যে উন্মুক্ত না। কেউ কেউ সেখানে গেলে দেখবে পারাখসা আয়নায় আবছা আকৃতি অথবা কেউ দেখবে নিজের সুস্পষ্ট শাহরিক বিভৎস প্রতিবিম্ব। আমি জানি আমাকে ফিরিয়ে দেবে না সেই আয়না, কারণ আমি প্রকৃত স্বত্ত্বাধিকারী কর্তৃকই আমন্ত্রিত হয়েছি প্রকৃতিতে। আমার গৃহপরিচারিকা, যার রঙটি সবুজ এবং গন্ধটি সুফলা সরিষাক্ষেতের মত, সে আমাকে সহৃদয় আমন্ত্রণ জানিয়েছে তার গ্রামে যেতে,
"ভাইজান, এতদিন তো শুধু ডিমের ছালুন বানাইয়া খাওয়াইছি, এইবার শীতে আমগো গেরামে আইসেন, দেখবেন, কতরকম পিঠা, আর পুকুরের তাজা মাছ, আফনেরা তো কী ফরমালিন না কী সদাই কইরা আনেন, গঞ্জে বিক্রী দেওনের আগেই আপনারে তাজা ফুলকপি আর টমেটো দিয়া সরপুটি খাওয়ামু, খাইয়া কইবেন কী স্বোয়াদ..."
ধুরো! একটা কাব্যত্তীর্ণ সিগারেটের শেষাংশে আমাকে সমস্ত সম্ভ্যাব্যতার নেতিবাচকতাকে অগ্রাহ্য করে রান্নাঘরে যেতেই হয়।
নাহ! ঢেপসী মাগীটা কোনো ম্যাচের কাঠি অব্যবহৃত রাখে নাই। ওর "তুমি যাবে ভাই, যাবে মোর গাঁয়" মার্কা আহবান, ক্লিশে। এইসব বিবর্ণ পল্লীপঙ্কতির নিটোল দেহের ওপর আমি উপগত হই! চাইরটা সিগারেট আর একটা ম্যাচের কাঠি বাকি। আগুন জ্বালানো বাকি। আমি আগুন জ্বালাইতে চাই এই নষ্ট শহরের যাবতীয় জৈবিক সম্ভোগের পশ্চাদ্দেশে। আমি আগুন জ্বালায়া দেখতে চাই গহীন অরণ্যে লুকায়া থাকা গিরগিটির রঙ, পাখির কলতান, সবুজমুখর ছুটির দিন, ভাঁপা পিঠার নেশাতুর ধোঁয়া। কিন্তু ঝুলন্ত স্তনের ঐ মাগী আমার জন্যে কোন পথসংকেত অথবা সম্ভোগইশারা কোনটাই রাইখা যায় নাই। তার বয়স পঞ্চান্ন, আমার বয়স পঁচিশ, আর রাত্রি কেবল যৌবনে প্রবেশ করছে। এইডা কিছু হইলো!
সিগারেট বাকি চারটা। ম্যাচের কাঠি একটা। আর রাত... সে তার অনিঃশ্বেষ যৌনজোছনা আর সিডাক্টিভ আঁধার নিয়ে আমাকে কামরাবন্দী করে রেখেছে। আমাকে কামড় দিচ্ছে তার সূতীক্ষ্ণ চোয়াল, ভ্যাম্পায়ারের মত। আই এ্যাম গেটিং এ্যারাউজড! কিন্তু বিগতযৌবনা সবিতাবুয়ারে ভাইবা মাস্টারবেশন কইরা আমি আমার মূল্যবান স্পার্ম নষ্ট করতে চাই না। স্পার্ম জিনিসটা এ্যাকচুয়ালি অনেকসময় চরমভাবে মিসইউজড হয়। যেমন ধরেন আমার বন্ধুর বউয়ের কথা। ঐ হাউয়ার পুতে পুরুষানুক্রম বজায় রাখতে গিয়া বউরে গর্ভবতী বানায়া ফালাইলো। এখন চোদনের মজা বুঝতাছে। দুইদিন পরপর ফুন কৈরা কয়,
"দোস্ত, রক্ত লাগতে পারে তোর ভাবীর লিগা। তোর আর হের রক্তের গ্রুপ তো একই। প্লিজ..."
আমিও গদগদ হয়ে বোকাচোদার মত জবাব দিছিলাম,
"দোস্ত, এনিটাইম! যক্ষুনি দরকার পড়ব ফোন দিবি। আই উইল বি দেয়ার"
ভাতিজ এ্যাহোন ফোন দেয় না ক্যান? তার বউ কী ভালো হয়া গেছে? রক্ত দিতে আমার আপত্তি নাই, তয় দিলে আজকে রাইতেই দিমু। আমার কাব্য, সবুজ গ্রাম এবং অপটু শহুরে জীবনযাপনের দোহাই! বস্তুতান্ত্রিকতার দোহাই! ফোন দে একটা। আমি কাজের বুয়া সংক্রান্ত আধাযৌন স্বপ্নবিলাস এবং কড়া বাড়িঅলার চড়া মৌনসন্ত্রাস সন্পর্কে অবহিত হৈয়াও ফ্রয়েডীয় এবং প্লেটোনিক ভাবনাগুলোকে অবদমিত রাখুম, তবুও ফোন কৈরা আমারে ক যে তোর বউয়ের রক্ত দরকার, অথবা অবস্থা আগের চেও খারাপ হৈছে!
কিন্তূক তাহা হইলে আমার সমস্যা আছে বৈ কী! কারণ রাত এবং সিগারেটের অসম সমীকরণ সমাধান করা হয়নাই এখনও। তবে তুমি ভাইবো না যে, তুমার বৌ, আমার বুয়া এবং আমার কাব্যিকতাই একমাত্র সঙ্গী।
এখনও চারটা সিগারেট আর একটা দিয়াশলাই কাঠি সঞ্চিত আছে আমার কাছে। আমি জ্বলন্ত সিগারেটের বাট দিয়া আরেকটা সিগারেট ধরাই...
বাকি থাকলো তিনটা সিগারেট, একটা ম্যাচ আর অর্ধেক রাত্রি। আমি আবার লিখতে বসি, তার আগে আপনাদের একটা কথা স্পষ্ট করে বলা দরকার, শুধুমাত্র সিগারেটে আমার মত মাদার সুপ্রিমের কোন পিনিক হয় না। এতক্ষণ ধরে ভদকা গিলেছি রেডবুল সহকারে। এতে সুবিধা কী, বমিভাব আসে না, জিনিসটা বেশ টেস্টিও লাগে। এতক্ষণ বলতে সংকোচ বোধ করছিলাম, কারণ আমি দেশী ভদকা খাই, এবং চেয়েচিন্তে মাত্র তিন পেগ নিয়ে এসেছি বোতলে করে। সংযম করাটা অবশ্যই ঈমানদারের দায়িত্ব। যেমন একদিন বারে এক প্রৌঢ় লোক বলেছিলো রোজার মাসে তিনি ভদকা বাদ দিয়ে রয়াল ডাচ সেবন করে ধর্মকে মহিমান্বিত করছেন!
আজকের রাতটা হয়তোবা মহিমান্বিত না, তবে আমি মহিমান্বিত করতে পারি আমার সবুজমন, তিমিরঝর্ণা আর বিলুপ্তপ্রায় ঘুঘুপোকাদের ডাক কলমবন্দী করে।
"রক্তস্বল্পতায় ভোগা বন্ধুপত্নীকে দেখে আমার মধ্যে মায়া জাগ্রত হয়েছিলো। তাকে আমি কখনও আত্ময়িক সম্বোধণে ডাকিনি। আমি জানতাম তার মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে নীলচে হ্রদ আর চোখের ভেতর সংহতিপাঁপড়ি। তার হিমোগ্লোবিনহীন রক্তে সাঁতার কাটতো অপাপবিদ্ধ শিশুরা। আর্বোভাইরাসের "স্বর্গের শিশু"দের মত। আমি তার হাতে হাত রেখে বলেছিলাম, "আপনি ভালো হয়ে যাবেন। সন্ধানীতে আমার বন্ধুবান্ধব আছে। রক্ত লাগলে জানাবেন"। বন্ধুর পত্নীকে আমি বন্ধুর পথে হাঁটতে দেখতে চাই নি। তার সংহর্ষিত সংহারমূর্তি আমাকে দ্বন্দ্বে ফেলে নি কখনও।"
রইলো বাকি তিনটা সিগারেট, একটা ম্যাচের কাঠি, আর এক পেগ ভদকা। দেশি কেরুর ভদকা ইজ ফাকিং স্ট্রং ম্যান! আমার কথা না। আমার এক লন্ডনপ্রবাসী শুভানুধ্যায়ী পান করতে গিয়ে এই কথাটাই বলেছিলো। এক পেগ দিয়ে বাকি রাত ঘোরের ঘরে বন্দী হয়ে কাটানো যাবে, কিন্তু সিগারেট? এখনও রাত পোহাতে অনেক বাকি। তিনটা সিগারেট একটা ম্যাচের কাঠি দিয়ে শেষ করব কেমনে? ধুরো ছাই! এতক্ষণ ছাইভস্ম না ভেবে বাড়িঅলার কাছে গিয়ে অনুনয় করে বললেই হত, রাত একটা পর্যন্ত আমি কাব্যকেলী করে বেড়ালাম, এড়ালাম এলেমভরা বাড়িঅলাকে! ভদকার প্রতিক্রিয়ায় ইতিমধ্যেই আমার মাঝে সাহস বেড়ে গিয়েছে, তবে তা বাড়িঅলার সামনে গিয়ে সুপটু মিথ্যে কথা বলার মত না। চুতমারানি বন্ধুর প্রসবাচ্ছন্ন উদরের বউটা এখনও মরে না কেন? আমাকে তাড়া দিয়ে ফোন করে না কেন?
আমারই ফোন করা উচিত। শালা ফোন করলে ধরে না। নিশ্চয়ই মৃত্যুপথযাত্রী বউয়ের সাথে আগাম নেক্রোফিলিক আচরণ শুরু করেছে শুয়োরটা! মদের বোতল খালি হবার পরে আমার মধ্যে মানবতাবোধ জেগে ওঠে, অবশ্য সেটা সবসময়ই উপস্থিত ছিলো! বেচারা বন্ধুটা! তিন নম্বর সিগারেটের অবশিষ্টাংশ দিয়ে আমি আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে লিখতে বসি, মৌলিক কোনো কিছু না, প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের অবিস্মরণীয় একটি গান,
"আলু বেচো,ছোলা বেচো
বেচো বাকরখানি
বেচোনা বেচোনা বন্ধু তোমার চোখের মনি
কলা বেচো কয়লা বেচো,বেচো মটরদানা
বুকের জ্বালা বুকেই জ্বলুক,কান্না বেচোনা।
ঝিঙে বেচো পাঁচ সিকেতে,হাজার টাকায় সোনা
বন্ধু তোমার লাল টুকটুকে স্বপ্ন বেচোনা।
ঘরদোর বেচো ইচ্ছে হলে,করবনাতো মানা
হাতের কলম জনমদুঃখী তাকে বেচো না।"
বেচোনা বন্ধু, না বেচে বেঁচে থাকো। আমিতো আছিই তোমার সাথে কান্নার সংসর্গে, সৃজনের স্বর্গে, শিশুদের পারিজাতে, পরিযায়ী পাখিদের সাথে। আমি তোমাকে ভালোবাসি বন্ধু! তোমার সহধর্মীনির ক্লান্ত অবক্ষয়কে বিষাদরুমালে বেঁধে উড়িয়ে দেবো শান্তির পায়রাদের দলে। শুধু আমাকে একটা ফোন কর, অথবা আমাকে এক বাক্স ম্যাচ কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দাও। আমি তোমার বউয়ের জন্যে রক্ত এবং মাংস যা লাগে সব দেবো। নিজেকে বেচো না শুধু...
এত রাতে কলাপসিবল গেট ধাক্কা দিচ্ছে কে! বাড়িঅলার ক্ষুদ্ধ ভর্তসনা শুনতে পাচ্ছি...
-এত রাইতে কুরিয়ার মানে? ফাইজলামি পাইছো? পিটায়া সোজা কইরা দিবো তোমারে!
কুরিয়ার প্রেরণকারীকে আমার খুব আপন মনে হয়। আমি তড়িঘড়ি করে ছুটে যাই নীচে। আবারও সিগারেট দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে দ্রুত টান দিয়ে শেষ করি। সমীকরণটা এখন বেশ সহজ হয়ে উঠেছে। এটা শেষ করলে আর মাত্র একটি সিগারেট বাকি থাকবে। ম্যাচের কাঠিও একটি। আঁধারস্নাত এই রাত্তিরে বাকি থাকে শুধু একটি সিগারেট, একটি ম্যাচকাঠি, আর বিস্ময়কর এক কুরিয়ার উপহার! বাড়িঅলাকে অগ্রাহ্য করার শক্তি অর্জিত হয় আমার ভেতর।
-আরে চাচ্চা, এইটা জরুরী একটা জিনিস। মূল্যবান কিছু হইলে আপনারে ওডি বেইচ্চা এই মাসের ভাড়া দিয়া দিমু কসম!
তিনি আমার দিকে দৃষ্টিবাণ নিক্ষেপ করে চলে গেলেন।
-ভাই, একটা সাইন লাগবো।
-তা তো অবশ্যই। কলমটা দেন।
আমি ঝটপট সিগনেচার করে উপরে যাবো, তখন মনে হল কিছু বখশিশ দেয়া যেতে পারে তাকে। সে হয়তোবা ওটা আঁচ করতে পেরেই দাঁড়িয়ে ছিলো। পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট দিতে গেলে সে উপেক্ষার হাসি হাসলো!
-বখশিশ লাগবো না ভাইজান। আপনে যায়া চেক কইরা দেখেন জিনিস ঠিক আছে কী না!
-আচ্ছা তা ঠিক আছে। কিন্তু প্রেরকের ঠিকানা কই? কৈত্থিকা আসলো এই প্যাকেট?
-সেটা প্যাকেট খুললেই বুঝবেন। অবশ্য নাও বুঝতে পারেন! বোঝাবুঝিতে আসলে কিছু এসে যায় না।
আইছে! কোথা থেকে এক দার্শনিক! আরে ব্যাটা করস তো কুরিয়ারগিরি, তাইতে এত ফুটানি! আমি প্যাকেটটা বগলদাবা করে ঘরে ফিরে যাই। এই নিথর রাত্রিতে একটা সারপ্রাইজের খুব দরকার ছিলো। রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আর কিছুক্ষণ পরে উড়ে যাবে কাব্যকণিকারা, নামবে উদ্ভট রঙের ভোর সূর্যের কোলন ডি ইমো সহ। প্যাকেটটা খুলতে খুলতে আমি শেষ সিগারেটটা ধরাই ম্যাচের শেষ কাঠিটা দিয়ে।
আমি প্যাকেটটা খুলতে থাকি সিগারেটের আয়ূক্ষয়ের সাথে সাথে। কী থাকতে পারে ওখানে? সিগারেটের ধোঁয়া ফুসফুস পর্যন্ত নিয়ে আমার কৌতুহলকে নিয়ন্ত্রণ করি। ধীরে সুস্থে খুলি প্যাকেটটা।
একটার পর একটা পরত খুলতে থাকি, বেশ ঝামেলার ব্যাপার! মোটা কাগজ আর স্কচটেপ দিয়ে এমনভাবে বাঁধা, খুলতে বেশ বেগ পেতে হয়। সিগারেটের আর অর্ধেকটা বাকি, প্যাকেটটাও খুলে ফেলেছি প্রায়। বেশ ভারি এবং শক্ত একটা জিনিস মনে হচ্ছে! সিগারেটে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে প্যাকেটটা খুলে ফেলি।
একটা এ্যাশট্রে।
বাহ! কী চমৎকারভাবে মিলে গেলো সমীকরণটা! শেষ সিগারেট, শেষ দিয়াশলাই কাঠি, এবং ছাই ফেলার জন্যে প্রয়োজনীয় উপকরণ। কৃস্টাল পাথরের দামী এ্যাশট্রেটায় আমি সিগারেটটা ফেলে দিয়ে লিখতে বসি আবার। এই রাতটা বৃথা যেতে দেয়া যায় না।
"আমাদের স্বপ্নানুভূতিতে আঘাত করেছে ধূসর উর্দি পরিহিত স্মৃতি হন্তারকেরা। একেকটা নির্ঘুম রাত কেটে যায় দুঃস্বপ্নের মুর্দাফরাসদের মুহূর্মুহূ তত্ত্বাবধানে। আমি এখান থেকে চলে যাবো, চলে যাবো সবুজ ঐন্দ্রজালের ফাঁদে স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে। সাথে আমার প্রিয় বন্ধুটিও যাবে। সুষ্ঠুভাবে প্রসবকার্য সম্পন্ন করার পরে যদি নবজাতক এবং তার মা অস্বস্তি বোধ করে এই সীসা জর্জরিত বাতাসে, তাদেরকেও নিয়ে যাবো দিগন্তবিস্তৃত সোনারঙের শষ্যক্ষেত্রে অথবা দৃষ্টিকে প্রশান্তি দেয়া সবুজ বনে, হয়তোবা এই নবান্নে। ভালো হয়ে ওঠো কালো তারা, দুশ্চিন্তার বেখাপ্পা মুখোসটা খুলে ফেলো প্রিয় বন্ধু! হাসপাতালের বেডে শায়িত তোমার পত্নীকে নিয়ে আমি আর কোন মুক্তগদ্য লিখতে চাই না"
বেশ কাটলো রাতটা! লেখালেখি, মানবতাবোধের উন্মেষের সাথে সিগারেট এবং ম্যাচের কঠিন সমীকরণটা সহজেই মীমাংসা করা গেল। এখন ঘুমুতে যাওয়া যায়। আগামীকাল ছুটি। একটা দীর্ঘ ঘুম দরকার আমার। হঠাৎ করে ফোন বেজে ওঠায় ঘুমের সিদ্ধান্তটা মিনিট খানেকের জন্যে পিছিয়ে দিই। কে ফোন করবে এত রাতে?
-দোস্ত, আমার বউয়ের জন্যে ব্লাড দরকার। ইমার্জেন্সি!
রাত চারটার সময় ফোন কইরা বন্ধুত্ব ফলাইতাছে! আমার যখন ম্যাচের কাঠি দরকার ছিলো তখন কই আছিলি? তখন তো ফোন করলে ধরস না! স্বরোষে স্বগতোক্তি করি আমি।
-হ্যালো হ্যালো, নেটওয়ার্ক প্রব্লেম, কিছু শোনা যাচ্ছে না...
পাশ কাটিয়ে দিতে চাই।
এ্যাশট্রে থেকে একটা পোড়া গন্ধ বের হচ্ছে।
-ফোনটা ঠিক করে ধর, উল্টা কইরা ধরসোস নাকি দেখ! খুব জরুরী দোস্ত!
পোড়া গন্ধটা বেড়ে যাচ্ছে। ঘর ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে। ছুড়ে দেয়া সিগারেটটা কোন এক অবলম্বনকে আঁকড়িয়ে ধরে সৃষ্টি করছে আগুন এবং ধোঁয়া। আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আমি আতংকিত হই এই আচম্বিত বায়বীয় ঘটনায়। টেনে টেনে শ্বাস নিয়ে বলি,
-হাসপাতালটা কোথায় যেন? হ্যাঁ, হ্যাঁ এখন শোনা যাচ্ছে সব।
আমার ঘরে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। নতুন লেখা গদ্যিতাটাও আক্রান্ত হয়েছে। পরিত্রাণের একমাত্র উপায় এখান থেকে বের হয়ে যাওয়া। ইশ! এত সাধের লেখাটা! আমি ঠিকানাটা ভালোভাবে শুনে নিয়ে ঘর থেকে বের হই। নীচে গিয়ে দেখি বাড়িঅলা ক্রুর হাসিমুখে তালাবদ্ধ কলাপসিবল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে চাবির গোছা হাতে নিয়ে। সে কীভাবে জানলো যে এখন আমার বেরুনোর প্রয়োজন? আর তার এত সহৃদয়তার কারণই বা কী? আমার ঘরের আগুন দেখে উৎকন্ঠিত হয়ে বের হয়েছে? আরো অবাক ব্যাপার এই যে, আমি বের হবার পরপরই ঘরের আগুন, ধোঁয়া এবং পোড়া গন্ধ নিমিষে উধাও হয়ে গিয়েছে!
"দোস্ত তুই আসবি না?"
সেলফোনে মেসেজ আসে।
"কী, যাইবা না তুমি? ঘাড়ানি খাওনের পর যাইবা? তোমারে আর রাখুম না"
বাড়িঅলা শাসায় আমাকে।
আসা-যাওয়া-আর্তি-হুমকির এই সমীকরণটা মেলানো আমার কাছে ছয়টা সিগারেট আর দুটো কাঠির সমীকরণের চেয়েও কঠিন মনে হয়।
-খাড়ান চাচা, একটু মিলায়া নেই। মাথার ভিতর সব তালগোল পাকায়া গেছে।
-আমার হিসাব কিন্তু ক্লিয়ার কইরা রাখছি।
-আপনি ঘুমান নাই ক্যান? আপনার না ব্লাডপ্রেসার?
এই প্রশ্নটা করার পরে আমার মনে হয়, এতক্ষণ বলপয়েন্টের কালো কালিতে না লিখে হৃৎকলমের লাল হরফে লিখলে এখন আর এত প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হওয়া লাগতো না!