দেখে এলাম চোরাবালি
মুক্তি পেল নির্মাতা রেদোয়ান রনির পরিচালিত প্রথম ছায়াছবি "চোরাবালি"। আর মুক্তি পাবার সময় যেহেতু ভাগ্যবশত দেশে আছি, প্রথম দিনেই ছবিটা দেখতে হবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। ফার্স্ট ডে, ফার্স্ট শো দেখার ইচ্ছা ছিল। তবে সেটা সকাল ১১টায় দেখে সেই ইচ্ছাকে আর আমল দিলাম না। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার শো এর টিকেট বুকিং দিয়ে এলাম।
রেদোয়ান রনি আমার অল্প কিছু প্রিয় নির্মাতাদের মাঝে অন্যতম। তার করা মেগা সিরিয়াল "হাউসফুল" দেখেই তার ফ্যান হয়ে যাই। এছাড়াও অনেক এক পর্বের নাটকে সে তার প্রতিভার ছাপ রেখেছে। "উচ্চতর শারীরিক বিজ্ঞান" অথবা "বিহাইন্ড দ্য সীন" নাটকগুলোর কথা আমার যেমন এখনো মনে আছে। যাইহোক, আসল কথা হল ফারুকির ভাই বেরাদার গ্রুপ থেকে অনেক অগা-মগা-বগা রাতারাতি ডিরেক্টর বনে গেছে (উদাহরণঃ মোস্তফা কামাল রাজ), কিন্তু তার মাঝে রনি ব্যাতিক্রম। সে আসলেই ট্যালেন্টেড এবং সবসময় একটু ভিন্য কিছু করার চেষ্টা করে। তাই সে ছবি বানাবে সেটা শোনার পর থেকেই একটা আলাদা আগ্রহ ছিল ছবিটার প্রতি। তার উপর জয়া আহসান কেন্দ্রীয় চরিত্রে। সব মিলিয়ে আমার এক্সপেকটেশন আকাশছোঁয়া।
সিনেমার নামে লম্বা নাটক (নাকি টেলিফিল্ম?) তৈরি করে ১-২টা হলে সীমিত পরিসরে রিলিজ করে আর একই দিনে টিভি তে মুক্তি দিয়ে যে ফাজলামি মার্কা একটা কালচার ফারুকির হাতে শুরু, তারই সাগরেদ রেদোয়ান রনি যেন তার গুরুকেই ছাড়িয়ে গেল। এটা পুরদস্তুর একটা কমার্শিয়াল ফিল্ম। নাচ-গান, একশান, ড্রামা কি নেই এতে? এটাকে আসলেই বাংলা ছায়াছবি বলা যায়। নায়ক ইন্দ্রনীল এর অভিনয় ভালো। আর তার ফিসিক ও ফিটনেস এদেশের তারকাদের জন্য অনুকরণীয়। আর জয়া আহসান এর ক্যারেক্টারের তেমন করার কিছু ছিল না। সে যেন ছিল শুধুই ছবির শোভা বর্ধনের জন্য। তবে শোভা বর্ধন সে করেছে বৈকি! সিনেমার প্রতিটি ফ্রেমে জয়া কে অসাধারন লেগেছে। এর আগে এত সুন্দর হয়ে হয়ত সেলুলয়েডে জয়া ধরা দেননি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গেছেন সহিদুজ্জামান সেলিম। উইদাউট এনি ডাউট, হি ইজ দ্য শো স্টীলার ইন দিস ফিল্ম। অসাধারণ অভিনয় করেছেন তিনি। তার ডায়ালগ ডেলিভারি, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, ননভারবাল সবই অনবদ্য। এছাড়াও এটিএম শামসুজ্জামান ছোট্ট রোলে ছিলেন সপ্রতিভ। সহেল রানা, হিল্লোল এরা গেস্ট এপিয়ারেন্স দিয়েছেন।
এখন আসি সিনেমার মেকিং এ। ডিরেকশান নিয়ে আমি এক কথায় খুশি। রনির গল্প বলার ধরণ আর স্টাইল আমার খুবই ভালো লেগেছে। সে যে একজন শক্তিমান নির্মাতা তা ছবির শুরুর ১০মিনিটেই বোঝা যায়। এবং এটা যে তার প্রথম ছবি এটা দর্শক ঘুনাক্ষরেও টের পাবেন না। সিনেমার কোন জায়গাতেই বোরিং লাগে না। কাহিনির একটা ফ্লো আছে। আর সিনেমাটোগ্রাফি বলব এই সিনেমার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক। অসাধারণ বললেও কম বলা হয়। ঢাকা শহরের বেশ কিছু শট আছে যা দেখলে চোয়াল ঝুলে যাবে। এরকম ক্যামেরার কাজ ঢাকাই ছবিতে আগে দেখা যায়নি। ডিরেক্টর অফ ফটোগ্রাফি কে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ! আর যেটা আমার চোখে পরেছে তা হল এই ছবিতে নির্মাতা ডিটেইল এর প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন যতদুর সম্ভব। যেমন ছবিতে জয়া একটি কাল্পনিক পত্রিকায় কাজ করতেন। তো সেই পত্রিকার অফিসের শটে দেখা যায় অফিসের লকজন সেই পত্রিকার লোগো সংবলিত মগে চা খাচ্ছেন। এধরনের ডিটেইলের দিকে সাধারনত আমাদের দেশি ছবিতে মনোযোগ দেওয়া হয়না। বোঝাই যাচ্ছে রনি বেশ আন্তরিক, আরও বড় বাজেট পেলে রনি সেট ডিজাইন ও প্রপস এর পিছনে আরও মনযোগী হতেন।
এবার খারাপ দিকে আসি। সিনেমার দুর্বল দিক হল কাহিনী। কাহিনী খারাপ না হলেও ভালো ও বলা চলে না। নতুন প্রজন্মের নির্মাতা থেকে এরচে ভালো কিছু আশা করাই যায়। কাহিনী গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। সেই একই ইনভিন্সিবল নায়ক এখানেও বিদ্যমান। তবে এটা হয়ত বাণিজ্যিক ছবির হিসেবে ক্ষমাযোগ্য কারন রনির টার্গেট হয়ত ছিল সব সারির দর্শককে হলে টানা।
তবে কোলকাতা থেকে কেন নায়ক ভাড়া করে আনতে হল এই জিনিসটা বুঝলাম না। দেশে নায়কের এতই আকাল? বুঝলাম রনি সাকিব খানকে কাস্ট করতে চায়নি, কিন্তু আরও তো নায়ক আছে। জয়া যেমন টিভি অভিনেত্রী তেমনি অন্য কোন টিভি অভিনেতা কে কি কাস্ট করা যেত না? তবে হ্যাঁ, সেই কোলকাতাইয়া নায়ক অভিনয় ভাল করে আর ক্যারেক্টারেও বেশ মানিয়েছে। তাই রনির কাস্টিং সেন্স ভাল বলতেই হয়। তবে নেক্সট টাইম বিদেশি আর্টিস্ট এর বদলে দেশি আর্টিস্ট কেন্দ্রীয় চরিত্রে দেখব এই আশা করাটা বোধহয় অন্যায় হবে না। আর যেই কথা না বললেই নয় সেটা হল উৎকট আইটেম সং এর ব্যবহার। আমি আইটেম সং এর বিরুদ্ধে নই। তবে এই মুভিতে গান টা মোটেই মানানসই ছিল না আর চিত্রায়ন ও ছিল দৃষ্টিকটু। আর সিনেমার এক জায়গায় ইন্দ্রনীল কেন যে জয়া আহসান কে কিডন্যাপ করে সেই ব্যাখ্যা নেই। তার পরিকল্পনা কি ছিল তা জানা যায়না। সে কি তাকে সারা জীবন লুকিয়ে আটকে রাখত? যখন আপনারা সিনেমাটি দেখবেন তখন আপনাদেরও এই প্রশ্ন মনে জাগবে।
যাইহোক, সিনেমাটি পারফেক্ট নয়। রনির কাছ থেকে আরও ভালো কিছু আশা করছিলাম। কিন্তু তারপরেও এর অনেক শক্তিশালী দিক আছে। স্টোরি দুর্বল হলেও এর মেকিং খুবই ভাল। তাই তার নেক্সট ফিল্ম এর ব্যাপারে আমি আশান্বিত। দেশের তরুন নির্মাতাদের হাত ধরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অনেক অনেক উচ্চতায় চলে যাবে সেই আভাস দেখা যাচ্ছে। রনি আর তার মত তরুন নির্মাতাদের জন্য রইল শুভকামনা।
রেটিং : ৩.৫/৫
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৪৮