somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

 সাদাসিধে কথাঃ প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ও বাংলাদেশ

০৫ ই মার্চ, ২০১১ দুপুর ২:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যেসব ছাগুরা, জাফর ইকবাল স্যার সম্পর্কে উল্টা-পাল্টা মন্তব্য করে বিশেষ করে তিনি নাকি বিএনপি'র প্রতি বিষেদাগার করে থাকেন আর আ'লীগ সরকারের গুনগান করেন, সেইসব ছাগুদের নিচের লেখাটি পড়ার জন্য বলছি। তিনি কেবল ভালো কাজের প্রশংসা করেন না, অন্যায়ের প্রতিবাদও করতে জানেন।
.............................................................................................
--------------------------------------------------------------------------
............................................................................................


সাদাসিধে কথা
প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ও বাংলাদেশ

মুহম্মদ জাফর ইকবাল


যাঁরা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুস, গ্রামীণ ব্যাংক, বাংলাদেশ সরকার এবং দেশের আইনকানুন নিয়ে নির্মোহ, বস্তুনিষ্ঠ এবং নিরপেক্ষ আলোচনা পড়তে চান, তাঁদের এ লেখাটি পড়ার প্রয়োজন নেই। এটি সে রকম একটি লেখা নয়, এটি প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে অসম্ভব পছন্দ করে, সে রকম একজন মানুষের অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট একটি লেখা।

আমি প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে অসম্ভব পছন্দ করি এবং তার চেয়ে বেশি সম্মান করি। আমি জানি, এ দেশে আমার মতো এ রকম মানুষের কোনো অভাব নেই। মনে আছে, প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার খবরটি পেয়ে আমি আনন্দে কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষের মতো চেঁচামেচি করেছিলাম। ক্রিকেট বাংলাদেশ টিম যখন পাকিস্তান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডের মতো টিমকে হারায়, তখন টেলিভিশনের সামনে লাফঝাঁপ দিয়ে আনন্দে চিৎকার করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু একটি খবর শুনে আনন্দে লাফঝাঁপ দিয়ে চিৎকার করার ঘটনা আমার জীবনে খুব বেশি ঘটেনি। আমার একজন পরিচিত মানুষ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, সেটি আনন্দের কারণ ছিল না, আনন্দের কারণ ছিল এক ধাক্কায় বাংলাদেশের মর্যাদার জায়গাটি অনেক উঁচুতে উঠে যাওয়াটুকু। যাঁরা জীবনের একটা অংশ বিদেশের মাটিতে কাটিয়ে এসেছেন, শুধু তাঁরাই জানেন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিটিকে বিদেশের মাটিতে কী নিষ্ঠুরভাবে তাচ্ছিল্য এবং অসম্মানের সঙ্গে উপস্থাপন করা হয় এবং প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস একা সেটিকে কত বড় একটি মর্যাদার আসনে নিয়ে গেছেন।

কিছুদিন আগে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে বাংলাদেশের ওপর খুব চমৎকার একটা রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল, সেখানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মানুষের মানসিকতার স্বরূপ বোঝানোর জন্য লেখা হয়েছিল, পাকিস্তানের জনগণের কাছে জাতীয় বীর হচ্ছেন দুর্বৃত্ত (ৎogue) নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানী আবদুল কাদির খান, যিনি বেআইনিভাবে দেশে-বিদেশে নিউক্লিয়ার অস্ত্র চোরাচালানি করেন আর বাংলাদেশের জাতীয় বীর হচ্ছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে দরিদ্র নারীদের সাহায্য করেন।

সেই প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে এ দেশের সরকার খুব ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে হেনস্থা করতে শুরু করেছে। এটি নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি এজেন্ডা ছিল এবং আগে হোক পরে হোক, এটি নিশ্চয়ই শুরু হতো। গত ডিসেম্বর মাসে নরওয়ের একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান এই হেনস্থাকরণ-প্রক্রিয়া শুরু করার চমৎকার একটা সুযোগ করেছিল। নব্বইয়ের দশকে নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়া সেই বিষয়টির সূত্র ধরে প্রথমেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে এমন কঠোর ভাষায় কিছু বক্তব্য দিলেন, যেটি শুনে এই দেশের কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন প্রত্যেকটি মানুষ হতবাক হয়ে গেল। আমাদের সংস্কৃতিতে আমরা সম্মানী মানুষের, বিশেষ করে বয়োজ্যেষ্ঠ সম্মানী মানুষের সম্মান রক্ষা করে কথা বলি, তাই প্রধানমন্ত্রীর সেই কথাগুলো এ দেশের অনেক মানুষকে অত্যন্ত ব্যথিত করেছিল। আমাদের অর্থমন্ত্রী প্রথমে যৌক্তিকভাবে কিছু কথা বললেন, কিন্তু নিশ্চয়ই তখন তাঁকে রূঢ় ভাষায় কথা বলার জন্য চাপ দেওয়া হলো এবং তখন তিনিও একই ভাষায় কথা বলতে শুরু করলেন। সাধারণভাবে বাঁশের চাইতে কঞ্চি বড় হয়ে থাকে, তাই সবচেয়ে কদর্যভাবে কথা বলতে শুরু করল ছাত্রলীগ। তাদের কথাগুলো লেখার মতো নয়, যত দূর মনে পড়ে, তারা নোবেল পুরস্কার কেড়ে নেওয়ার হুমকিও দিতে থাকে। মৌখিক খিস্তির পর আমরা রাষ্ট্রীয় হেনস্থার স্বরূপটি দেখতে পেলাম। বাংলাদেশের আনাচকানাচে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নামে মামলা হতে লাগল এবং আমরা দেখতে পেলাম, প্রফেসর ইউনূস সারা দেশে ছোটাছুটি করে সেই মামলার জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছেন। যে মানুষটি সারা পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানী মানুষদের একজন, তাঁকে তাঁর দেশের সরকার এ রকমভাবে অসম্মান করতে পারে, সেটি নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না। আজকের (বৃহস্পতিবার) খবরের কাগজে দেখেছি, সরকার তাঁকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অপসারণ করেছে। আমি নিশ্চিত, সরকারের পক্ষ থেকে নানা রকম আইনকানুন দেখানো হবে, কিন্তু পুরো বিষয়টি এমনভাবে ঘটে এসেছে যে, আমি বাজি ধরে বলতে পারি, এ দেশের সাধারণ মানুষ আর সেগুলো বিশ্বাস করবে না। তারা ধরেই নেবে, এটি হচ্ছে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে হেনস্থা করার আরও একটি ধাপ, শত হাইকোর্ট দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে তাদের বিশ্বাস থেকে টলানো যাবে না।

এ খবরটি অবিশ্বাস্য দ্রুততায় এবং অবিশ্বাস্য গুরুত্বের সঙ্গে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। বেশ কয়েক বছর আগে জেএমবি যখন সারা দেশে একসঙ্গে বোমা ফাটিয়েছিল, তখন দেশের খুব বড় একটা ক্ষতি হয়েছিল, পৃথিবীর অনেকেই ধরে নিয়েছিল, আমাদের দেশটি বুঝি জঙ্গিদের। অনেক দিন পর আবার দেশের খুব বড় একটা ক্ষতি হলো, সারা পৃথিবী ধরে নিল, এ দেশের সরকার হচ্ছে অকৃতজ্ঞ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। যে মানুষটি এ দেশের মর্যাদা সারা পৃথিবীর সামনে উঁচু করেছেন, এ দেশের সরকার তার পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করছে তাঁকে অসম্মান করার জন্য!

প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক এবং ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়। এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক মানুষ। আমাদের সবারই ইচ্ছে, এ বিষয় নিয়ে গবেষণা হোক, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে যুক্তিপূর্ণ আলোচনা হোক এবং ভেতরের সত্যটুকু বের হোক। কতটুকু আশার ব্যাপার, কতটুকু স্বপ্ন, কতটুকু বাস্তব এবং কতটুকু অবাস্তব, সেই তথ্যগুলো আমাদের সামনে প্রকাশিত হোক, কিন্তু তার মানে কি এই বিষয়ের স্বপ্নদ্রষ্টাকে অসম্মান করা হবে? এবং এত স্থূলভাবে?
সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশ পৃথিবীর সামনে পরিচিত হতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। এই সরকার বিশ্বাস করুক আর না-ই করুক, এই দশকে পৃথিবীতে বাংলাদেশ পরিচিত হয় প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে দিয়ে। কাজেই যখন এ দেশে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে অসম্মান করা হয়, তখন যে বাংলাদেশকেই পৃথিবীর সামনে অসম্মান করা হয়, সেই সহজ কথাটি কি এই সরকারের ভেতর কেউ জানে না?
প্রকাশ্যে থুথু ফেলা অশোভন কাজ। যদি ফেলতেই হয়, তাহলে নিচের দিকে ফেলতে হয়। কখনোই ওপরের দিকে কাউকে লক্ষ্য করে থুথু ফেলতে হয় না। তাহলে অবধারিতভাবে সেই থুথু নিজের মুখের ওপর এসে পড়ে।

এই সরকার কি জানে, তারা মুখ ওপরের দিকে করে থুথু ফেলছে?
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক। অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

কৃতজ্ঞতা: প্রথম আলো
১১টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×