সন্দেহ হওয়ার মতো দুর্বার গতিতে ধেয়ে আসছে দুটি মাছ ধরা ছোট নৌকা। সতর্ক হয়ে যায় মার্চেন্ট ভেসেলের সবাই। জাহাজের ক্যাপ্টেনের একটা ছোট্ট বুদ্ধিতে সেবারের মতো বেঁচে যায়। কিন্তু হাল ছাড়ে না একজন। জীর্ণশীর্ণ এই কৃষ্ণ জেলে পুনরায় রওয়ানা হয় তার আগের শিকারের দিকে। তার সাথে আরো তিনজন। এবার এই জেলে কাম পাইরেটরা দখলে নিয়ে নেয় আন্তর্জাতিক মার্চেন্ট ভেসেলের কন্ট্রোল ব্রিজ, জিম্মি করে জাহাজের ক্যাপ্টেনকে। কিন্তু এই বিশাল জাহাজকে পুরোপুরি কব্জায় আনতে পারে না তারা। ক্যাপ্টেন ও অন্যান্য ক্রুদের বুদ্ধিমত্তায় ভেস্তে যায় পাইরেটদের পরিকল্পনা। শেষতক ক্যাপ্টেনকে জিম্মি করে নিয়ে যায় তারা। জাহাজের লাইফবোট নিয়ে রওয়ানা হয় সোমালিয়ার দিকে। এদিকে খবর পেয়ে নড়েচড়ে বসে মার্কিন প্রশাসন। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আদেশে ভার্জিনিয়া থেকে পাঠানো হয় দুর্ধর্ষ কম্যান্ডো টীম নেভি সিলকে। সাথে পাঠানো হয় তিনটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ। ইস্পাতকঠিন হৃদয় আর বাস্তবভিত্তিক বুদ্ধিমত্তায় শেষতক উদ্ধার করা হয় মায়েরস্ক আলাবামার ক্যাপ্টেন রিচার্ড ফিলিপসকে। বলছিলাম গেল বছরের অন্যতম সেরা মুভি টম হ্যাঙ্কস অভিনীত ক্যাপ্টেন ফিলিপস এর ঘটনাপ্রবাহ। সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে অসাধারণ একটা মুভি বানিয়েছেন পরিচালক পল গ্রিংগ্রাস।
সিনেমার বাঁকে বাঁকে, খাঁজে খাঁজে আছে থ্রিল। আর সাউন্ড ট্র্যাকগুলোও সেইরাম। হাই কোয়ালিটির হেডসেট কিংবা উফারে বেস না দিয়ে এই মুভি দেখলে সেইরাম ভাবটা পাওয়া যাওয়ার কথা না। মুভির হ্যান্ড-হেল্ড সিনেমাটোগ্রাফির কথা না হয় নাই বললাম। এককথায় অসাধারণ। দৃশ্যমান কোন অভিনেত্রী না থাকলেও যারা অভিনেতা হিসেবে ছিল তারা সিনেমার সাসপেন্স আর বাস্তবানুগ চিত্রায়নে প্রায় শতভাগ সফল বলে আমার মনে হয়েছে। বিশেষ করে পাইরেট লিডার হিসেবে বারখাদ আবদির অভিনয় দেখে মনেই হয়নি যে সে অভিনয় জগতে তার ‘অভিষিক্ত ইনিংস' খেলছে। আমার কাছে কেন যেন এই ২৮ বছর বয়সীর অভিনয় দুইবার অস্কারজয়ী টম হ্যাঙ্কসের চেয়েও ভালো লেগেছে।
বারখাদ আবদি
আর শেষদিকে কঠিন চেহারার সিল কম্যান্ডারের “এক্জিকিউট” অর্ডারের সাথে সাথে তিন সিল মার্কসম্যানের একসাথে গর্জে ওঠা স্নাইপার রাইফেলের নির্দয় আওয়াজ এক নির্দয় অনুভূতি তৈরি করে। শেষ হয় যাবতীয় ক্লাইম্যাক্স।
এবার প্রাসঙ্গিক বিষয়ের উপর কিছু অপ্রাসঙ্গিক কথা... ইউএস নেভি সিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি এলিট কম্যান্ডো টীম। বিশ্বব্যাপী সবাই এদের চেনে। কি দুর্ধর্ষতায়, কি দক্ষতায়, সব ক্ষেত্রেই তারা এলিট টীমের মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। এগুলো আমরা কমবেশি সবাই জানি। কিন্তু এটা হয়তো আমরা সবাই জানি না যে, আমাদের নৌবাহিনীরও ঠিক এরকমই একটি এলিট কম্যান্ডো টীম আছে। নাম স্পেশাল ওয়ারফেয়ার ডাইভিং অ্যান্ড স্যালভেজ, সংক্ষেপে সোয়াডস। কাউন্টার এসপিওনাজ আর রেপিড রিয়্যাকশন ফোর্স হিসেবে এরা কোন অংশে ইউএস নেভি সিল থেকে কম নয়; বরং কিছু কিছু অংশে বেশী বললেও ভুল হবে না। কর্ণফুলীর তীরে দাঁড়িয়ে আমি একবার এদের এক আর্মি ম্যানের সাথে কথা বলতে পেরেছিলাম। দুর্ধর্ষমাত্রায় কঠিন ট্রেনিং দেওয়া হয় তাদের। অসাধারণ থ্রিলিং তাদের জীবন। ইউএস নেভি সিলের মতোই এরা বিভিন্ন রিয়েল টাইম কম্যান্ডো অপারেশন সফলভাবে একমপ্লিসড করে এবং করছে। কিন্তু সেটা সাধারণ্যের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। অথবা বলা যায় পৌঁছাতে দেওয়া হয় না। আমাদের দেশের ডিফেন্সের সত্যিকারের সৈনিকেরা এক কথায় অসম্ভব দক্ষ, অতিমাত্রায় দুর্ধর্ষ আর চিন্তাতীত অপ্রতিরোধ্য। তাই এই মুভিটা দেখার সময় কেউ যদি মনে করেন যে, প্যারাজাম্প করে উত্তাল সাগরে ঝাঁপ দেওয়া কিংবা নিখুঁত লক্ষ্যভেদে টার্গেটকে ঘায়েল করা স্পেশাল এলিট ফোর্সের সদস্যরা আমাদের দেশেরই কোন কম্যান্ডো টীম, তাহলে খুব একটা ভুল হবে না সেই মনে করাটা। এটা যে কেবল আমার বিশ্বাস তাই শুধু না, এটা আমার নিজ চোখে দেখা আর নিজ কানে শোনা অভিজ্ঞতাজাত উপলব্ধি।
এই মুভিটা দেখার সময় ক্ষণে ক্ষণে আমি আমার ছোট ভাইয়ের অনুপস্থিতি অনুভব করেছি। আমরা দুই ভাই। ও সাথে থাকলে মুভিটা দেখে আরো মজা পেতাম, আরো থ্রিলড হতে পারতাম। কঠিন কঠিন মেরিটাইম ওয়ার্ডগুলোর মানে জানতে পারতাম। আল্লাহ্ তায়ালার অশেষ রহমতে ও একজন মেরিনার, ভবিষ্যতের কোন এক বিশাল মার্চেন্ট ভেসেলের ক্যাপ্টেন। সিনেমার কঠিন কঠিন টার্মগুলো জানতে না পারলেও ওর কাছ থেকে মেরিটাইম কিছু কঠিন বাস্তবতার কথা অনেক আগেই জেনেছি। জেনেছি, বাংলাদেশের মেধাবী মেরিনাররা কত রিস্ক নিয়ে সমুদ্রে চলাচল করে। কিছু বছর আগে (২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর) বাংলাদেশের যে জাহাজটা (মনে আছে তো মার্চেন্ট ভেসেল জাহান মণির কথা?) সোমালিয়ান পাইরেটসদের কবলে পড়ে দীর্ঘদিন আটকা পড়ে ছিল, সেই জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিল ওর একাডেমিক বড় ভাই। মায়েরস্ক আলাবামা আমেরিকান ফ্ল্যাগ শিপ ছিল বলেই নেভি সিল, যুদ্ধজাহাজ হ্যান ত্যান এতো কিছু; কই আমাদের মার্চেন্ট ভেসেল জাহান মণিতে তো এর থেকেও বেশি জিম্মি ছিল, সেখানে তো এরকম কিছুই করা হয়নি। যা করা হয়েছে তা হল এক প্রকার নোংরা রাজনীতি। আমার মতে মার্চেন্ট মেরিনাররা দুইটা সার্টিফিকেট নিয়ে বিশ্বময় ঘুরে বেড়ায়। একটা তো জানাই আছে- কন্টিনিউয়াস ডিসচার্জ সার্টিফিকেট, সংক্ষেপে সিডিসি। আরেকটার নামও সিডিসি। তবে এটা হল কন্টিনিউয়াস ডেঞ্জার সার্টিফিকেট। সারা বিশ্বে দক্ষতার জন্য সুখ্যাতি পাওয়া আমাদের মেধাবী মেরিনারদের প্রতি আমার সতত সম্মান আবারো জ্ঞাপন করলাম।
মুদ্রার অপর পিঠের গল্পটা একটু সংক্ষেপে বলে শেষ করি লিখাটা। এই মুভিটা আমেরিকানরা না বানিয়ে যদি সোমালিয়ানরা বানাতো তাহলে তারা নিশ্চয়ই লোকচক্ষুর আড়ালে তাদের ভাগ্যের সাথে ঘটে যাওয়া ধ্রুব সত্যগুলো তুলে ধরতো। আর তাতে হয়তো উইকিলিকসের ন্যায় ফাঁস হয়ে যেতো গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীদের কুকীর্তির কথা; যাদের জন্য এইসব গরীব সোমালিরা পাইরেটস হতে বাধ্য হয় তাদের কথা। অতএব মুভিটা দেখেন, শিহরিত হোন, এমনকি আমার মতো উচ্চকিত প্রশংসা করেন সিনেমাটোগ্রাফির, অভিনয় দক্ষতার; কিন্তু সাথে সাথে আড়ালে রেখে দেওয়া কঠিন বাস্তবতার কথাও মনে রাখবেন।
এই লিঙ্ক থেকে মুভিটা নামাতে পারেন।
-----
এই মুভিটার উপর প্রায় বিশের উপর রিভিউ হয়েছে এবং সবই আমার এই রিভিউ অপেক্ষা অনেক অনেক গুণ ভালো মানের। তারপরও আমার মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করলাম। আশা করি পোস্টটা সবার ভালো না লাগলেও অন্তত জঘন্য লাগবে না।