ভাবুন তো একটি ছোট বাবুর ছবি যার খেলনা নিয়ে খেলে বেড়ানোর কথা, কার্টুন নেটওয়ার্কে টম এন্ড জেরি কিংবা ডোরেমন দেখবার কথা কিংবা অফিসে যাবার আগে বাবার কোলে উঠে খেলনা কিনে দেবার বায়নাক্কা করার কথা অথবা যাকে খাওয়াতে গিয়ে তার পিছে পিছে একজন মায়ের দৈনিক তিন চার কিলোমিটারের মতো চক্কর দিয়ে ফেলার কথা। এটাই তো হয় একটা সংসারে আদরের মধ্যমণি হয়ে থাকা একটা ছোট্ট বাবুর ক্ষেত্রে। তার পর্যায়ক্রমিক উন্নতি, তাকে শোয়া থেকে বসতে দেখে বাবার উল্লসিত মুখ, তার প্রথম হাঁটতে শেখায় মায়ের আনন্দিত হাততালি, তার মুখের আধো আধো বোল সবার হৃদয়ে তোলে আনন্দের জোয়ার। সবাই এই রকম আনন্দময় ক্রমধারাই প্রত্যাশা করে, প্রত্যাশার প্রতিফলনে উল্লসিত হয়। কিন্তু মুদ্রার গতানুগতিক ধারার এই পিঠের বিপরীতটা যে অন্যরকম তার একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়ার নিমিত্তেই আজকের এই ছোট্ট আর্টিকেলটা লিখা।
কখনো কি দেখেছেন এরকম যে, একজন বাচ্চা তার আঙুল কামড়িয়ে খেয়ে ফেলতে চাইছে? আঙুলের একেকটা গিঁট কচি দাঁতের তীক্ষ্ণ চাপে আলাদা করে ফেলছে তার হাত থেকে? অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করলেও থামছে না তার এই আত্মবিধ্বংসী মনোভাব? সমানে কামড়ে যাচ্ছে সে তার আঙুলগুলো? কিংবা কখনো কি এমন দেখছেন যে, একটা ছোট্ট বাবুমনি তার নরম মাথা শক্ত দেওয়ালে নিজে থেকেই আছড়ে ফেলছে? নিজের শরীরের স্বল্প কিন্তু সর্বস্ব শক্তি দিয়ে ঠুকে ঠুকে ফাটিয়ে রক্তাত্ত করে দিচ্ছে মাথা? রক্তস্নাত করে ফেলছে সর্বাঙ্গ? অথবা কামড়ে ছিঁড়ে নিতে চাইছে নিজের জিহ্বা কিংবা নরম ঠোঁটটি... সবাই হয়তো ভাবছেন এও কি সম্ভব!!! সম্ভব। লেশ-নাইহান সিনড্রোম (Lesch–Nyhan syndrome) হলে একটি বাচ্চা এরকম আত্মবিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে। এটি একটি দুর্লভ প্রকৃতির সেক্স-লিঙ্কড রোগ। এটি বিশেষত ছেলে বাবুদের ক্ষেত্রে বেশী হয়ে থাকে। প্রতি তিন লক্ষ আশি হাজার জীবিত শিশুর মাঝে একজন এই রোগে আক্রান্ত হয়।
রোগটাকে লেশ-নাইহান সিনড্রোম বলার কারণ ১৯৬৪ সালে এটি সর্বপ্রথম শনাক্ত করেন মাইকেল লেশ এবং তার শিক্ষক, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম নাইহান। এটি মূলত হয় একটি জিনের মিউটেশনের কারণে। জিনটির নাম এইচপিআরটি১ (HPRT1 ) আর এটি যে এনজাইম কোড করে তার নাম হাইপোক্স্যানথিন-গুয়ানিন ফসফোরাইবোসাইল ট্রান্সফারেজ ( hypoxanthine-guanine phosphoribosyltransferase ); যাকে সংক্ষেপে HPRT বলে। এই এনজাইম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি পিউরিন তৈরিতে সাহায্য করে। পিউরিন হল ডিএনএ (DNA) এবং আরএনএ (RNA) এর একটি গাঠনিক উপাদান। আমরা তো জানি যে, ডিএনএ এবং আরএনএ তৈরিতে পাঁচটা নিউক্লিক এসিড বেস থাকে যার মধ্যে তিনটা কমন। এই তিনটা হল- অ্যাডেনিন (A), গুয়ানিন (G) এবং সাইটোসিন (C); প্রথম দুইটা হল পিউরিন। প্রাথমিক আলোচনার জন্য এগুলোকে একটু এখানে আনলাম। আসল কথায় ফিরি। এই জিনটা এক্স (X) ক্রোমোসোমে অবস্থিত। এই রোগে আক্রান্ত হয় ছেলে বাবুরা সবচেয়ে বেশী। আর সে এই রোগের বীজ নিয়ে আসে মায়ের কাছ থেকে। এই বিষয়টা একটু ক্লিয়ার করি। আমাদের শরীরে মোট ২৩ জোড়া (বা ৪৬টি) ক্রোমোসোম থাকে যার মধ্যে ২২ জোড়া অটোসোম আর বাকি দুইটা সেক্স ক্রোমোসোম। একটি এক্স (X) ক্রোমোসোম আর আরেকটা ওয়াই ( Y ) ক্রোমোসোম। এই দুইটা সেক্স ক্রোমোসোমের দ্বারাই নির্ধারিত হয় অনাগত বাবুটা ছেলে হবে না মেয়ে হবে। ছেলে বাবু বাবার কাছ থেকে ওয়াই আর মেয়ে বাবু এক্স ক্রোমোসোম পায়। অন্যদিকে ছেলে হোক বা মেয়ে সে মায়ের কাছ থেকে পায় এক্স ক্রোমোসোম। এখন যেহেতু মা-ই ছেলে বাবুর এক্স ক্রোমোসোমের একমাত্র উৎস, সেহেতু এই ক্রোমোসোমে কোন ঝামেলা থাকলে সন্তান সরাসরি এই রোগে আক্রান্ত হবে। ঠিক এমনটাই হয় এই লেশ-নাইহান সিনড্রোমের ক্ষেত্রে। মেয়ে শিশু এই রোগে আক্রান্ত হয়, কিন্তু সেক্ষেত্রে তার দুইটা এক্স ক্রোমোসোমই আক্রান্ত হতে হবে। যদি এমন হয় যে, তার একটা এক্স ক্রোমোসোম ঠিক আছে তাহলে সে আর আক্রান্ত হবে না; মেয়েটি জাস্ট এই রোগের বাহক হবে। কারণ লেশ-নাইহান সিনড্রোম একটি এক্স-লিঙ্কড রিসেসিভ অর্ডার। অর্থাৎ মেয়ে সন্তান আক্রান্ত হবে তখনই যখন সে আক্রান্ত বাবা এবং মা (আক্রান্ত কিংবা বাহক) উভয়ের থেকে মিউটেটেড জিনটি পাবে। অন্যদিকে ছেলে সন্তানের আক্রান্ত হবার ক্ষেত্রে একটি মাত্র এক্স ক্রোমোসোমই যথেষ্ট যা সে তার মায়ের কাছ থেকে নিয়ে আসে।
লেশ-নাইহান সিনড্রোমের কারণে বডি ফ্লুয়িডে ইউরিক এসিড জমতে থাকে। এর ফলে হাইপার ইউরিসেমিয়া ( hyperuricemia) এবং হাইপার ইউরিকোসুরিয়া ( hyperuricosuria) দেখা দেয়। অনেক সময় কিডনি, ইউরেটার কিংবা ব্ল্যাডারে পাথর জমতে পারে যা পরবর্তীতে আরথ্রাইটিস রোগের কারণ হতে পারে। পরিস্থিতি জটিল হতে পারে যখন প্রস্রাবের অনেক সময় রক্ত যাওয়া শুরু করে। লেশ-নাইহান সিনড্রোমের ফলে স্নায়ুতন্ত্রেও ঝামেলা দেখা দেয়। শিশুর বিকাশে সমস্যা হয়, বসা শিখতে সময় লাগে অনেক বেশী, অনেকের ক্ষেত্রে কথা বলায় সমস্যা থাকে, চরম মাত্রায় খিটমিটে হয় এইসব বাচ্চারা। স্নায়ুতন্ত্রের মোটর ফাংশনে সমস্যা থাকার কারণে অনেক শিশু কখনই আর হাঁটতে শিখে না; ফলশ্রুতিতে চিরকালের মতো সে হুইল চেয়ারকে সঙ্গী করে নেয়।
কোন কি সমাধান নেই এই ভয়াবহ রোগটির? আছে। তবে তা এই রোগটির সম্পূর্ণ সারিয়ে ওঠানোর জন্য এখন পর্যন্ত কার্যকর হতে পারেনি। ইউরিক এসিডের মাত্রা কমাতে চিকিৎসকরা অ্যালোপিউরিনল সাজেস্ট করেন। এছাড়া এই রোগের অন্যসব উপসর্গ কমাতে লেভোডোপা, ডায়াজিপাম, ফেনোবার্বিটাল মেডিকেশন দেওয়া হয়ে থাকে। মলিকিউলার জেনেটিক টেস্টিং একটি কার্যকর পদ্ধতি সংশ্লিষ্ট এইচপিআরটি১ জিনের মিউটেশন শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে। তবে আশার বাণী যে নিরাশার ভেলায় ভেসে ভেসে হারিয়ে যাবে না তার একটি ছোট্ট উদাহরণ ২০০৬ সালের অক্টোবরে জার্নাল অব ইনহেরিটেড মেটাবলিক ডিজিজের একটি পেপারে প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে বলা হয়, এস-অ্যাডেনোসাইল মিথাইয়োনিন ( S-adenosyl-methionine) একটি পরীক্ষামূলক ওষুধ যা একটি নিউক্লিয়োটাইড পিউরিনের যোগানদাতা হিসেবে কাজ করবে। এটি ব্লাড ব্রেইন ব্যারিয়ার দিয়ে চলাচল করতে পারে। গবেষণার ফলাফল লেশ-নাইহান সিনড্রোমের রোগীদের স্নায়ুবিক, মানসিক আচার-ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ উন্নতি সাধন করে। তবে মা-বাবারা তাদের এই রোগে আক্রান্ত সন্তানদের হাত-পা কামড়ানো বন্ধে হাতে-পায়ে কাপড় পেঁচিয়ে রাখে। কখনো কখনো হাত-পা বেঁধে রাখা হয়। কিন্তু কতক্ষণ? এক দুঃখময় করুণ রোগের বলী হতে হয় শত শত নিষ্পাপ ছোট্টমনিদের এই ধরাধামে আসার পর থেকেই।
বিঃ দ্রঃ এতকিছুর পরও একথা চন্দ্র, সূর্যের মতো ধ্রুব সত্য যে সন্তানের কাছে মায়ের মতো নিরাপদ, বন্ধুবৎসল আর কেউ নেই। এই রোগের পিছনে মায়ের জেনেটিক কারণ দায়ী থাকলেও একথা কেউ ভুলে যাবেন না যে, সেই মাই কিন্তু তার আক্রান্ত সন্তানটিকে সদা, সতর্কতায় আগলে রাখেন। অতএব এখানে মাকে ভিলেন ভাবার ধৃষ্টতা দেখাতে যাবেন না কেউ।
-----
ইবোলা ভাইরাসের নয়া উপদ্রব... আফ্রিকার গিনিতে
-----
Genetic Engineering and Biotechnology Club - GEBC- সমাজের সকল স্তরে জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তির ব্যাপক পরিচিতিকরণ ও প্রচলন এবং এ সংক্রান্ত সকল বিষয় নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের একমাত্র পেইজ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ১০:৪৮