আমার মা শ্রী যুক্ত কুসুমকুমারী দাশ বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতায় বেথুন স্কুল’এ পড়তেন। খুব সম্ভব ফাষ্ট ক্লাশ অবধি পড়েছিলেন, তার পরেই তার বিয়ে হয়ে যায়। তিনি অনায়াসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষায় খুব ভালোই করতে পারতেন, এ-বিষয়ে সন্তানদের চেয়ে তার বেশি শক্তি ছিল মনে হচ্ছে । পঁচিশ ত্রিশ চল্লিশ বছর আগে আমাদের বরিশালের বাড়িতে পরিবারের লোকসংখ্যা অনেক ছিল। জেঠমাকে ও মাকে সারা-দিন গৃহস্থালির কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতে দেখেছি। তখনকার দিনে পরিবারের অবস্থা বিশেষ স্বচ্ছল ছিল না। কিন্তু জেঠমা’র ও মা’র অক্লান্ত কাজকর্মে এবং ওপরে ঠাকুরমার তদারকে কত বিরোধী অস্বভাবী অবস্থার ভিতর দিয়ে কী রকম সহিষ্ণু, নিরলস ও সার্থক ভাবে সংসারের কাজ সম্পন্ন হত, সে-কথা ভাবলে আজ আশ্চর্য হয়ে থাকতে হয়। খুব সকালবেলা-শীতকালেও খুব ভোরে—তারা ঘুম থেকে উঠতেন এবং অনেক রাত্রে সংসারের কাজকর্ম সেরে ঘরে আসতেন ; কোনও রেহাই ছিল না। রেহাই তারা পান নি, পরিশ্রমকে ভয় করতেন না, কর্তব্যবোধ পরিপূর্ণ ভাবে সজাগ ছিল, দায়িত্বকে এড়াবার কথা তারা ভাবতেও পারতেন না—-আরাম বিরাম কাকে বলে সেকথা তারা নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতায় অনুভব ক’রে দেখেন নি, শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্য কী জিনিস—সে-কথা ভাববার অবসর ছিল না। নিজের স্বকীয় সংসারের জন্য ঠিক ময়—একটা প্রকাও বড় বিমিশ্র সংসারের জন্য-যেখানে প্রায়ই অতিথি আসত শত শত, পরিজন আসত বহুল পরিমাণে—সেই বৃহৎ বিমিশ্র সংসারের কাজে দক্ষিণ্য ভরসায় ভরপুর অক্লান্ত সেবিকার মতো নিজেদের নিয়োজিত করে রাখতেন।
মনে পড়ে বরিশাল’এর শীতের সেই রাতগুলো; যখন খুব ছোট ছিলাম, প্রথম রাতেই চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে যেত—আমাদের পড়াশোনা, খাওয়া-দাওয়া শেষ হত। বাবা বাতি জ্বলিয়ে অনেক রাত অবধি লিখতেন। টের পেতাম মা রান্নাঘরে আছেন। সংসারের শেষ মানুষটির খাওয়া-দাওয়া সাঙ্গ হলে তবে তিনি ঘরে ফিরতেন। কিন্তু যতই রাত হোক-না কেন, মা ঘরে না ফিরলে দু চোখ ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আসলেও ঘুম প্রতিশোধ করে জেগে থাকতে চাইতাম। মা ঘরে এলে তবে ঘুমোব। খুব দেরিতে আসতেন, চারিদিকে শীতের রাত তখন নিথর, নিস্তব্ধ; আমাদের বাড়ির থেকে খানিকট দূরে নারিকেল বীথির ভিতর থেকে বাজকুড়ুল পাখি ডাকত, প্রহরে প্রহরে সেই পাখি দুটো—বরিশালের শীতের শিয়রে অনন্ত অন্ধকারে দেবযানী আত্মাদের সঙ্গে। মা ঘরে এসে ঘুরতেন-ফিরতেন—এবং সেবা করতেন—দূরে পাখির ডাক— আমি এখনও জেগে আছি কেন-কত দূর কী পড়াশোনা করেছি জিজ্ঞেস করতেন। ঘুমিয়ে পড়তে বলতেন। বাইরে পৃথিবীর অন্ধকার—অস্থান-পৌষের শীত। ভয় পেতাম কোনও পড়শির বাড়ির লোক ডাকতে আসতে পারে—কারু মারাত্মক রোগ হয়েছে হয়তো—কোনও দুঃস্থ পরিবারকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের আশ্রয় থেকে, হয়তো কোনও নিম্ন-শ্রেণির লোকের মৃত্যু হয়েছে, হয়তো কোনও অনাথ স্ত্রীলোক বিশেষ কারণে বিপন্ন, হয়তো কোনও প্রতিবেশীর ঘরে ছেলেপিলে হবে-মা’র কাছে খবর এসে পৌছুলেই তিনি চলে যাবেন, সারা-রাত বাড়িই ফিরবেন না হয়তো আর। জেগে বা ঘুমিয়ে একাই পড়ে থাকতে হবে আমাদের। বাইরের থেকে এ-রকম কোনও ডাক না এলে মা প্রদীপের পাশে সেলাই করতে বসে যেতেন হয়তো, কিংবা সমস্ত দিনের শেষে দু-চারটে পত্র-পত্রিকা বই নিয়ে বসে পড়তেন। মায়ের মুখচোখের সামনের সেই প্রদীপটির দিকে তাকিয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তাম।
সেই বয়স-তখনকার সেই মা-প্রথম মহাযুদ্ধ’র গোড়ার দিকের সেই অপেক্ষাকৃত নির্দোষ পৃথিবী—আজ মনে হচ্ছে কোনও পীস কনফারেন্সই মানুষের বিক্ষিপ্ত জীবনে সেই অনবতুল সমাবেশ ফিরিয়ে দিতে পারবে কি আর ; ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছে তো—কিন্তু সর্বান্তঃকরণে নয়। মূল্যচেতনায় বিশুদ্ধি হচ্ছে, মনীষীদের ও দিকনিরূপকদের মনে ও কাজেকর্মে এ-রকম দাবি চারি-দিক থেকেই খুব বিশেষ ওজনের সঙ্গে ঘোষিত হচ্ছে, কিন্তু হৃদয় কি নির্মল ও নিঃস্বার্থ হচ্ছে, হৃদয়ে স্বার্থের ও রিরংসার অবলেশ কেটে না গেলে কি আর শান্তি আসবে জাতির বা মানুষের জীবনে; চল্লিশ বছর আগে জীবনে উপকরণ-আড়ম্বরের এ-রকম বিষম অষ্টপ্রাহরিক সর্বস্বত ছিল না; কর্ম বলে যাকে আধুনিক পৃথিবীতে প্রকাশ করা হয়, কিন্তু যা সত্যিকারের কর্ম সত্যিই নয়, বাস্তবিকই অকৰ্ম, সে-সব জিনিসের বাড়াবাড়ি নিয়ে অপরিমেয় ব্যস্ততা ছিল না, মূল্যচেতনা শুদ্ধ না হলেও আজকের অনেক প্রোথিত মূল্যচেতনার চেয়ে শুদ্ধতর ছিল–এবং আমার মায়ের মতন লোকেদের হৃদয় ঠিক ছিল; সে-জন্যে তাদের সংস্পর্শে এলে একটি শান্ত উন্নত পরিমণ্ডলের ভেতর প্রবেশ করবার সুযোগ পাওয়া যেত । আজ অনুভব করি যে, তাদের নানা বিজ্ঞানের ভূষণ ছিল না, কিন্তু মহত্তর মর্মজ্ঞান ছিল; তাদের উচ্চাকাঙক্ষা ছিল না, কিন্তু সকলের জন্য যত দূর সম্ভব হিতাকাঙ্ক্ষা ছিল। ভাবনা-বেদনা-সংকল্প-স্বপ্নের কোনও ক্ষয়প্রাপ্তির হাতে, ইতিহাসের অন্ধকার ক্ষমতার হাতে মা নিজেকে কোনও দিন সমৰ্পিত করতে যান নি। যে-বড় ভূমিকা তার পাওয়া উচিত ছিল সংসারে, সে-পটভূমি পান নি তিনি। কিন্তু, তা হলে কী হবে, তিলধারণের মতো তুচ্ছ ভূমিকায় দেখিয়েছেন ব্ৰহ্মাণ্ড প্রতিফলিত হয়ে উঠতে পারে।
আমরা তার সন্তান-ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ ক’রে বেরিয়েছি অনেক দিন হতে চলল। কিন্তু কার কাছে শিক্ষা পেয়েছিলাম আমরা? আমি অন্ততঃ তিন জন মানুষের কাছে। এক জন বাবা, এক জন মা, আর-এক জন ব্ৰজমোহন স্কুল’এর হেডমাষ্টার আচার্য জগদীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। বরিশালএর স্কুল থেকে পাশ ক’রে বেরিয়ে অনেক বড়-বড় কলেজে পড়েছি, ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি; কিন্তু আজ জীবনের মাঝামাঝি এসে প্রতিনিয়তই টের পাচ্ছি যে, আমার জীবনের শিক্ষার ভিত্তি এঁদের হাতে গড়া। এক-এক সময়ে মনে হয়, মহাভারতএর রচনাকর্তা বেদব্যাস’এর মতো দৃষ্টি নিয়ে এঁরা সবাই শিখিয়েছিলেন আমাকে; আমার জীবনে সে-শিক্ষা যদি ব্যবহারিক ভাবে ফলপ্রসূ না হয়ে থাকে, তা হলে তাদের কোনও দোষ নেই; যদি মনোলোক কিছু সার্থক হয়ে থাকে, তা হলে এঁদেরই প্রকাণ্ড দানের ফলে । নানা নামী কলেজের বড়-বড় অধ্যাপকদের কাছে পড়েছি বটে; সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি সম্পর্কে অনেক অনেক খবর জুগিয়েছেন তারা, কিন্তু বোধির অভাবে সে-খবর পরীক্ষার খাতায় পর্যবসিত হয়ে ডিগ্রি দান ক’রে অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেছে। জীবনের যা-কিছু কাণ্ডজ্ঞান, মর্মজ্ঞান, রসাস্বাদ, যা-কিছু লোকসমাজে এষণাশক্তি বা নির্জনে ভাবনাপ্রতিষ্ঠা, যা-কিছু mother wit, যা কিছু সংবাদকে বিদ্যায় পরিণত করতে পারে, বিদ্যাকে জ্ঞানে-সমস্ত জিনিসেরই অন্তর্দীপন বিধিনিয়ম এঁদের কাছ থেকে লাভ করবার সুযোগ হয়েছিল আমার। তার মুখের-ভাষা কী রকম প্রাণক্ষরা ছিল, কত লোকগাথাও প্রবাদের যথোচিত সংমিশ্রণে তির্যক ও উজ্জ্বল হয়ে উঠত; বরিশাল’এ যত দিন তার উদ্যম ও কর্মপ্রবাহ অক্ষুন্ন ছিল তত দিন তা শুনেছি, বুঝেছি। সে-ভাষা প্রকৃতিকে ও প্রকৃতির মতো মানুষগুলিকে নিখুঁত ভাবে ধরতে পেরেছিল ব’লেই অমন সহজ পবিত্রতায় ব্যক্ত হতে পারত ! সমস্ত ইস্কুলের জীবন তিনি আমাদের ইস্কুলের পড়া শিখিয়েছেন সংসারের কাজকর্মের ফাঁকে-ফাকে—ইস্কুলি পড়া শেখাবার সুযোগে যে-বুনিয়াদ গড়েছেন, সেট ইস্কুল-কলেজের ক্যারিকুলাম”এর সঙ্গে খাপ খেয়ে চলে না শুধু-সদর্থ আবিষ্কার ক’রে চলতে থাকে সংসারের, সমাজের, দেশের, জীবনের। সে পরমার্থগুলো আজও প্রায়-সম্পূর্ণ ভাবে সত্য। কোনও নিপট দর্শন এসে খণ্ডন করতে পারে নি সেগুলোকে, কোনও নতুন বিজ্ঞান এসে ছেদ করতে পারে নি। মানুষ এত দিন পৃথিবীতে থেকে পৃথিবীকে ভুল বুঝেছে, অথবা নিজের জীবনকে চিনতে পারে নি, এ-মত পোষণ করা চলে না। সমাজ ও জীবন সম্বন্ধে অনেক দীর্ঘস্থায়ী—হয়তো শাশ্বত সত্য আবিষ্কার করেছে মানুষ। জীবনে সে-সব সত্যের প্রচলন চেয়েছেন সৎ মানুষেরী; মা’ও আজীবন সেই জিনিসই চেয়েছিলেন। সাহিত্য পড়ায় ও আলোচনায় মা’কে বিশেষ অংশ নিতে দেখেছি। দেশি বিদেশি কোনও-কোনও কবির ও ঔপন্যাসিকের কোথায় কী ভালো, কী বিশেষ দিয়ে গেছেন তারা, এ-সবের প্রায় প্রথম পাঠ তার কাছ থেকে নিয়েছি। ওয়ার্ডসওয়ার্থ’এর অনেক ছোট-ছোট কবিতা তার মুখে শুনেছি এবং শেলি-ব্রাউনিং-এর। বৈষ্ণব পদাবলি থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত আমাদের দেশের কবিতার মোটামুটি সম্পূর্ণ ঐতিহ্য জেনে ও ভালোবেসে ও বিদেশি কবিদের কাউকে-কাউকে মনে রেখে তিনি তার স্বাভাবিক কবিমনকে শিক্ষিত ও স্বতন্ত্ৰ ক’রে রেখেছিলেন ।
মা’র বাবা চন্দ্রনাথ দাশ’ও গান ও কবিতা লিখেছেন অনেক। এঁরও দেখেছি অব্যর্থ স্বভাব রয়েছে যা বিশেষ ভাবে শিক্ষিত ও নিয়ন্ত্রিত হলে কাব্যে প্রকাশিত হয়ে উঠতে পারে-না হলে, অশিক্ষিতপটুত্ব উল্লেখ্য পদ্যে—কোনও-কোনও লাইনের বা উপমার উল্লেখযোগ্যতা আরও কিছু প্রগাঢ় হলেও, দাদামশায়ের অনেক লেখা ঈশ্বর গুপ্ত, মধুসূদন, হেম, রঙ্গলাল ইত্যাদিকে মনে করিয়ে দিলেও, তার সফলতর লেখা—বিশেষ ক’রে কয়েকটি গানে, লোকগাথায় ও লোককবিতায় খানিকট সার্থক উত্তরসাক্ষ্য হিসেবে টিকে থাকবে, মনে হয়। মা বেশি লেখবার সুযোগ পেলেন না। খুব বড় সংসারের ভেতরে এসে পড়েছিলেন যেখানে শিক্ষা ও শিক্ষিতদের আবহ ছিল বটে, কিন্তু দিনরাতের অবিশ্ৰান্ত কাজের ফাঁকে সময় ক’রে লেখা–তখনকার দিনের সেই সংসারের এক জন স্ত্রীলোকের পক্ষে শেষ-পর্যন্ত সম্ভব হয়ে উঠল না আর । কবিতা লেখার চেয়ে কাজের ও সেবার সর্বাত্মকতার ভেতরে ডুবে গিয়ে তিনি ভালোই করেছেন হয়তো। তার কাজকর্মের আশ্চর্য নিষ্ঠা দেখে সেই কথা মনে হলেও ভেতরের খবর বুঝতে পারি নি; কিন্তু তিনি আরও লিখলে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ কিছু দিয়ে যেতে পারতেন, মনে হয়। মা’র কবিতায় আশ্চর্য প্রসাদগুণ । অনেক সময় বেশ ভালো কবিতা বা গদ্য রচনা করছেন দেখতে পেতাম। সংসারের নানা কাজকর্মে খুবই ব্যস্ত আছেন এমন সময়ে ব্ৰহ্মবাদীর সম্পাদক আচার্য মনোমোহন চক্রবর্তী এসে বললেন : এক্ষুনি ব্রহ্মবাদীর জন্য তোমার কবিতা চাই, প্রেসে পাঠাতে হবে, লোক দাঁড়িয়ে আছে। শুনে মা খাতাকলম নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে এক হাতে খুন্তি, আর-এক হাতে কলম, নাড়ছেন দেখা যেত; যেন চিঠি লিখছেন, বড় একটা ঠেকছে না কোথাও; আচার্য চক্রবর্তীকে প্রায় তখনই কবিতা দিয়ে দিলেন।
স্বভাবকবিদের কথা মনে পড়ত আমার, আমাদের দেশের লোক-কবিদের স্বভাবী সহজতাকে। অনেক আগে, প্রথম জীবনে, মা কয়েকটি কবিতা লিখেছিলেন; যেমন, “ছোট নদী দিনরাত বহে কুলকুল’ অথবা ‘দাদার চিঠি কিংবা বিপাশার পরপারে হাসিমুখে রবি উঠে। একটি শান্ত, অর্থঘন সুখিত ভোরের আলো, শিশির, লেগে রয়েছে যেন এ-সব কবিতার শরীরে। সে-দেশ মায়েরই স্বকীয় ভাবনা-কল্পনার স্বীয় দেশ। কোনও সময় এসে সেখান থেকে এদের স্থানচ্যুত করতে পারবে না।
আজকের পৃথিবীর জীবনবেদের তাৎপর্য মা বেশি বুঝেছিলেন; তাঁর গদ্য-লেখায় অভিভাষণে সমাজের ও নানা সমিতির কাজকর্মে লোকসমাজের সঙ্গে লেনদেনে নানা রকম বিখ্যাত বই-এর ও চিন্তার ধারার সঙ্গে পরিচয়ের পিপাসায় ভাবনা-বিচারের আধুনিকতার মর্ম বুঝে দেখছিলেন যখন–তার কিছু অাগেই কবিতা লেখা প্রায় ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন তিনি; ফলে, যে-মহৎ কবিতা হয়তো তিনি লিখে যেতে পারতেন, তার রচিত কাব্যের ভেতর অনেক জায়গাতেই প্রায় আভাস আছে–কিন্তু কোনও জায়গাতেই সম্পূর্ণ সিদ্ধি নেই—মাঝে-মাঝে কবিতার ভেতর দু-চারটে বিচ্ছিন্ন সিদ্ধিকে বাদ দিয়ে । গদ্য সন্দর্ভ রচনায়ও এক জন সৎ সাহিত্যিকের উপাদান ছিল তার মধ্যে। বাবা’র ও পিসেমশায়ের অবর্তমানে তিনি বরিশালএর ব্রাহ্মসমাজে আচার্যের কাজ করতেন। আরাধনা উপাসনা আশ্চর্য নিৰ্ঝরের মতো ধ্বনিত হয়ে—তবুও ধ্বনির অতীত অর্থগৌরবের দিকে—আমাদের মর্ম ফিরিয়ে রাখত; কোথাও ঠেকতেন না, তাল কেটে যেত না—পুনরুক্তি ছিল না, কিন্তু যে-সাহিত্যিকের ও কবির গরিমা তার প্রাপ্য ছিল, সেটাকে অন্তর্দমিত ক’রে রাখলেন তিনি—প্রকাশ্য কোনও পুরস্কার নিতে গেলেন না। শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের লেখায় ও নিজের লিখিত অমূর্ত ভাবনায়, বিতর্কের ও ধ্যানের ভিতর, কেমন যেন আত্মনিধান খুঁজে পেলেন আত্মশুদ্ধির জন্য।
অনেক দিন আগে, চিত্তরঞ্জন’এর মৃত্যুর পর, তার ওপর আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম। মা নিজে কবি—-পত্র-পত্রিকার পাতায় আমার সেই প্রায়-প্রথম-জাতক কবিতাটি সম্বন্ধে তার মতামত জানবার জন্য মা’কে এক কপি সাহিত্যপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। মা আমাকে ফেরত-ডাকে লিখলেন : চিত্তরঞ্জন সম্বন্ধে লিখেছ, ভালোই করেছ, কিন্তু রামমোহন’এর ওপর লিখতে বলেছি তোমাকে, মহর্ষির ওপরেও। তিনি প’ড়ে বিক্ষুব্ধ বোধ করেছিলেন–এ যেন ধান ভানতে শিবের গীত। কিন্তু দেশের নানা রকম সাময়িক ঘনঘটাচ্ছন্নতার অতীত রামমোহন—যে কত বড় পুরুষ, আমাদের সক্রিয় সচেতন মনে সে-অঙ্গীকারের একটি স্পষ্ট জীবনবেদ দেখতে চাইতেন তিনি। অনেক আগে আমার মন বড়-বড় আদর্শ পুরুষকে তাদের উচু পীঠস্থান থেকে নামিয়ে পরীক্ষা ক’রে দেখতে চাইত তাদের সত্যিকারের মূল্য নিরূপণের নামে বিনাশী বুদ্ধিবলে তাদের আঘাত ক’রে ; মা টের পেয়েছিলেন, বলেছিলেন, ও–রকম ক’রে হয় না— আগে তাদের মহত্ত্বে বিশ্বাস করে—মনের নেতিধর্ম নষ্ট ক’রে ফেলো; শুধু মহামানুষ কেন, যে-কোনও মানুষ কতখানি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের পাত্র অনুভব করতে শেখো! দেশের ও বিদেশের যে-সব মহাপুরুষের তালিকা দিয়েছিলেন তিনি আমাকে, অনেক অনুতর্ক-বিতর্কের পরে টের পেয়েছি সত্যিই তারা মহৎ। যে-কোনও তুচ্ছ মানুষকে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস করতে বলেছিলেন। এখন বুঝেছি, ঠিকই বলেছিলেন।
যদিও মায়ের সেই নির্ধারিত পথে মন-পবনের মাঝির দল চলেছে যত বেশি, বাস্তব তত সেই অনুপাতে কিছুই হয়ে উঠছে না ব্যক্তির বা জাতির বা পৃথিবীর জীবনে। বিদ্বেষই বেশি, হিংসা কেটে যায় না, সংঘর্ষ নষ্ট ক’রে ফেলতে চায় সব । রোলা’র মতে, টমাস মান, রবীন্দ্রনাথ, আইনষ্টাইন, গান্ধিজির মতন এক জন লোক তবুও আশা ক’রে বসে থাকেন। ইতিহাস চেনে তাদের। আমার মা’র মতন এক জন মহিলাও আশা ক’রে বসে ছিলেন, বিশ্বাস করতেন।
*পাণ্ডুলিপির খাতা থেকে, ১৯৪৮
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১১:২৩