হাসানুল কাদির
নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ_জেএমবি গঠনের মূল হোতা জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের (বর্তমানে দলটি নামের শেষের 'বাংলাদেশ'কে নামের শুরুতে নিয়ে 'বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী' নির্ধারণ করেছে) সঙ্গে মিল রেখে জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ নাম প্রস্তাব এবং শায়খ আবদুর রহমানকে আমির বানিয়েছিলেন তিনিই। সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া জেএমবিপ্রধান মাওলানা সাইদুর রহমানও তাঁর হাত ধরেই প্রথমে জামায়াতের রাজনীতিতে যুক্ত হন। পরে যোগ দেন জেএমবিতে। জামায়াতে ইসলামীতে সরাসরি গোলাম আযমের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠা একটি বিশেষ বাহিনী দিয়েই তিনি পরিচালনা করেন জেএমবিকে। জেএমবির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া জেএমবির প্রথম কমিটির মজলিশে শুরার অন্যতম সদস্য ফারুক হোসাইন খান ওরফে খালেদ সাইফুল্লাহ এ প্রতিবেদককে এসব তথ্য জানিয়েছিলেন। খালেদ সাইফুল্লাহকে শায়খ আবদুর রহমানের সঙ্গেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
জেএমবির শুরা সদস্য ও আইটি বিশেষজ্ঞ মাওলানা সায়েম জানান, শায়খ আবদুর রহমান ও গোলাম আযমের মধ্যে অসংখ্যবার বৈঠক হয়েছে। তাঁদের উভয়ের সমঝোতায়ই সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালিত হতো। শায়খ রহমান জেএমবির আমির ছিলেন। তবে মূল পরামর্শক ও নীতিনির্ধারক গোলাম আযম।
বর্তমানেও কি গোলাম আযমের সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক আছে_এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'শায়খ রহমানের পর মাওলানা সাইদুর রহমান সংগঠনের আমির হন। তিনি তো গোলাম আযমেরই শিষ্য। কিন্তু সাইদুর রহমানসহ আমরা গোলাম আযমের অনেক নীতির সঙ্গে এখন আর একমত নই। এর মূল কারণ হলো, আমরা বারবার বলে আসছি, জামায়াত ও শিবির কর্মীদেরও জেএমবির নেতৃত্বে পরিচালিত জিহাদে যুক্ত করা হোক। আমাদের যথেষ্ট অস্ত্র ও অর্থ আছে। দেশে ইসলামী হুকুমত কায়েমের জন্য তাগুতি সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনার জন্য যে পরিমাণ জনবল দরকার, তা আমাদের নেই। জামায়াত ও শিবির কর্মীরা আমাদের সঙ্গে প্রকাশ্যে জিহাদে যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও তারা এখনো যোগ দিচ্ছে না।'
আপনি জেএমবির শুরা সদস্য। গোলাম আযম আপনার সংগঠনেরই নীতিনির্ধারক হয়ে থাকলে কেন তাঁর নাম প্রকাশ করছেন? এটা পত্রিকায় ছাপা হলে তো আপনাদেরই ক্ষতি হবে। তাই না_এ প্রশ্নের জবাবে জেএমবির আরেক শুরা সদস্য মাওলানা মাহফুজ আহমেদ বলেন, 'দেখুন, জেএমবিতে যুক্ত হওয়া আর মৃত্যুবরণ করা এক কথাই। জীবনের স্বাদ সবাই উপভোগ করতে চায়। আমরাও এর ব্যতিক্রম নই। গোলাম আযম সাহেব আমাদের এ পথে ঠেলে দিয়েছেন। এখন চাইলেও আমরা স্বাভাবিক হতে পারব না। দেশে যেকোনো মূল্যে ইসলামী হুকুমত কায়েম করবই। আমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকলেও মরে গেলেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে না। আমরা চাই, কথামতো জামায়াত-শিবির কর্মীরাও আমাদের সঙ্গে ঘোষণা দিয়ে জিহাদে অংশ নিক। সম্মিলিভাবে আমরা দেশে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন করি।'
জামায়াত-শিবিরের লোকজন কি প্রকাশ্যে আপনাদের পাশে আসবে_এমন প্রশ্নের জবাবে মাওলানা সায়েম বলেন, 'অবশ্যই আসবে। দুদিন আগে আর পরে। কারণ তাদের এবং আমাদের মিশন এক। তা হলো, দেশে আল্লাহর আইন কায়েম করা। আমরা শুধু অগ্রবর্তী বাহিনী। তবে জামায়াত-শিবিরের সবাই আমাদের পাশে আসবে_এমন আশা আমরা করি না। কারণ জিহাদে সবাই অংশ নেয় না। মুসলমানদের একটি বিশেষ গোষ্ঠীই জিহাদের দায়িত্ব পালন করে। বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে জেএমবিই সেই বিশেষ গোষ্ঠী। আমরা এ দেশে ইসলামী হুকুমত কায়েম করবই।'
জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরপরই জামায়াতে ইসলামী কৌশলগত কারণে প্রকাশ্যে ও গোপনে কাজ করার পরিকল্পনা তৈরি করে। দলের 'আল্লাহর আইন চাই' স্লোগান বাদ দিয়ে দেয়। ওই সময়ই শায়খ আবদুর রহমানকে আমির বানিয়ে গঠন করা হয় জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ_জেএমবি। তখন জামায়াতের আমির ছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযম। তিনিই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে নামের মিল রেখে জামা'আতুল মুজাহিদীন নামটি প্রস্তাব করেন। সবার সম্মতিতেই তাঁর এ নামটিই গোপন সংগঠনের নাম হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে চূড়ান্ত করা হয়।
আহলে হাদিসে বিভক্তি তৈরি ও মধ্যপ্রাচ্য কানেকশন
আহলে হাদিস অনুসারীদের দাবি, বাংলাদেশের প্রায় দেড় কোটি মানুষ আহলে হাদিস মতাদর্শে বিশ্বাসী। দেশের বিভিন্ন এলাকায় তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলেও রাজশাহী অঞ্চলে তাদের মতাদর্শের লোক বেশি। বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমানদের বেশির ভাগই সুনি্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানরা আহলে হাদিস তথা সালাফি মতাদর্শে বিশ্বাসী। এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের উদ্দেশ্যে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম শায়খ আবদুর রহমানকে দিয়ে জেএমবি গঠন করেন। এর একটি হলো, বাংলাদেশে আহলে হাদিস সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করে তাদের শক্তিকে দুর্বল করে দেওয়া। দ্বিতীয় এবং মূল উদ্দেশ্য হলো, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সমর্থন ও ধর্মকেন্দ্রিক বিভিন্ন কাজে বরাদ্দকৃত ফান্ড সংগ্রহ করা। এ ক্ষেত্রে জামায়াতের হয়ে ব্যবহৃত হওয়ার জন্য আহলে হাদিস মতাদর্শের লোকের প্রয়োজন ছিল, যারা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সংস্থার কাছে জামায়াতকেও আহলে হাদিস অনুসারী বলে পরিচিত করে তুলতে সহায়কের ভূমিকা পালন করবে। শায়খ আবদুর রহমান আহলে হাদিস মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং সৌদি আরবে পড়াশোনা করেছেন। দীর্ঘদিন সেখানে থেকে দেশে ফিরলে শায়খ আবদুর রহমানকেই জামায়াত বেছে নেয়।
সেই লিফলেটও গোলাম আযমের লেখা
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশে একযোগে বোমা হামলা করে জেএমবি। সিরিজ বোমা বিস্ফোরণের পর সব বোমার সঙ্গেই পাওয়া যায় একটি করে লিফলেট। 'বাংলাদেশে ইসলামী আইন বাস্তবায়নের আহ্বান' শীর্ষক ওই লিফলেটটি লিখেছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযম। সেটি ছাপা হয়েছিল জামায়াত নিয়ন্ত্রিত মগবাজারের আল-ফালাহ প্রিন্টিং প্রেসে। জেএমবির সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এমন দাবি করেছে।
এসব বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে তাঁর প্রেস সেক্রেটারি খোরশেদ আলম খন্দকার জানান, আমিরে জামায়াত (নিজামী) কথা বলবেন না। জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের বক্তব্য নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করা হলে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী নাজমুল হক জানান, তিনি মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলবেন না।
এটি একটি কপি/পেস্ট পোস্ট। মূল লেখা এখানে : Click This Link