কথায় বলে না, হাতি ফাঁদে পড়লে টিকটিকিও লেজ নাড়ে। হাসিনার অবস্থাও হয়েছে অনেকটা সেইরকম। বিপদে পড়ে হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন দেখে এখন যে যেভাবে পারছেন হাসিনার সমালোচনা করছেন। যেন হাসিনার ভালো কাজ বলতে কিছুই ছিল না। আমরা এটা মেনে নিতে পারি না। আমরা হাসিনাকে তার প্রাপ্য যথাযথভাবে দিতে চাই। হাসিনা যা করেছেন তার স্বীকৃতি দিতে চাই। আহ! দেশের জন্য হাসিনা কী না করেছেন! উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিয়েছেন। কিছু সমালোচকের কারণেই আজ তার সব অর্জন ধূলায় মিশে যাবে? এটা হতে দেওয়া যায় না। চলুন মোটাদাগে তার বড় বড় অর্জনগুলোতে আরেকবার চোখ বুলিয়ে আসি:
১. গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থা:
একতরফা নির্বাচন: ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম, বিরোধী দলের প্রার্থীদের ওপর হামলা, ভোট ডাকাতি ও ভোটারদের কেন্দ্র যেতে না দেওয়ার অভিযোগ ছিল। ২০২৪ সালের নির্বাচনও কার্যত প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন হয়েছে।
বিরোধী দলের দমন: বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, কারাবন্দি রাখা, মিথ্যা মামলা দেওয়া, সভা-সমাবেশে বাধা দেওয়া।
২. গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যা:
গুম ও অপহরণ: মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, গত এক দশকে শত শত মানুষ গুম হয়েছে, যার মধ্যে অনেকে আর ফিরে আসেনি।
বিচারবহির্ভূত হত্যা: র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধের নামে মানুষ হত্যা করা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিত হয়েছে।
৩. দুর্নীতি ও লুটপাট:
ব্যাংক ও অর্থনৈতিক খাতের দুর্নীতি: রিজার্ভ চুরি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ লুটের ঘটনা ঘটেছে।
সরকারি প্রকল্পে লুটপাট: পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল (যদিও পরে নির্মিত হয়েছে), রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি (পিপিই, মাস্ক কেলেঙ্কারি) ইত্যাদি।
সরকারি আমলা ও দলের লোকদের দুর্নীতি: আওয়ামী লীগের নেতা ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিপুল সম্পদ অর্জনের তথ্য ফাঁস হয়েছে, যা জনগণের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।
৪. বাকস্বাধীনতা ও মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ:
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: এই আইনের মাধ্যমে সাংবাদিক, লেখক, কার্টুনিস্ট ও সমালোচকদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি করা হয়েছে।
গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ: বেশিরভাগ বড় মিডিয়া সরকারপন্থী হয়ে গেছে, নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার সুযোগ কমে গেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নজরদারি: ফেসবুক ও অন্যান্য মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করলেই গ্রেপ্তার বা হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
৫. অর্থনৈতিক সংকট ও মুদ্রাস্ফীতি:
ডলার সংকট: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত কমে গেছে, যা আমদানি ও বাণিজ্যে প্রভাব ফেলছে।
পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি: চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।
বেকারত্ব বৃদ্ধি: সরকার উচ্চ প্রবৃদ্ধির দাবি করলেও, প্রকৃতপক্ষে বেকারত্ব বেড়েছে এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে গেছে।
৬. শিক্ষাক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা ও দলীয়করণ:
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দখলদারিত্ব: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণ, হল দখল, নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস ও শিক্ষা মানের অবনতি: স্কুল-কলেজের পরীক্ষাগুলোতে একাধিকবার প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটেছে, যা শিক্ষার মান নষ্ট করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণ: অনেক জায়গায় কেবল সরকার-সমর্থক শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যা শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করছে।
৭. আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসনের রাজনৈতিকীকরণ:
প্রশাসনে দলীয়করণ: পুলিশ, বিচার বিভাগ ও প্রশাসনকে দলীয়ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, যা নিরপেক্ষতা নষ্ট করেছে।
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও চাঁদাবাজি: ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজি, জমি দখল ও টেন্ডারবাজির সঙ্গে জড়িত।
ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন: দেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের হার বেড়েছে, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধীরা রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে শাস্তি পায় না।
৮. বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যর্থতা:
বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি: ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মালিকদের হাজার হাজার কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে, অথচ লোডশেডিং বেড়ে গেছে।
জ্বালানি সংকট: গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে, অথচ সরবরাহ নিশ্চিত হয়নি।
সংক্ষেপে: বললে, শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে বাংলাদেশে অনেক উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু একইসঙ্গে ব্যাপক দুর্নীতি, স্বৈরাচারী শাসন, গুম-খুন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, অর্থনৈতিক সংকট ও প্রশাসনের দলীয়করণের মতো গুরুতর সমস্যাও তৈরি হয়েছে। এসব সমস্যা নিরসন না হলে ভবিষ্যতে দেশের স্থিতিশীলতা আরও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
শুধু এগুলোই নয়, হাসিনার আসল অর্জন ছিল ভারতের সাথে কৃত তার বিবিধ গোলামি চুক্তি আর অবৈধ সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া। শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে ভারতের সঙ্গে করা কিছু চুক্তি ও সুবিধা বিতর্কিত হয়েছে, বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও অর্থনৈতিক খাতে। এগুলোর বেশ কয়েকটি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে, যেগুলো নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিচে দেওয়া হলো—
১. আদানির সাথে বিতর্কিত বিদ্যুৎ চুক্তি
ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে করা বিদ্যুৎ চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছে।
✅ চুক্তির মূল বিষয়:
আদানি গ্রুপ ভারতের ঝাড়খণ্ডে ১,৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করে, যেখান থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ কিনবে।
বাংলাদেশ এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য গ্যারান্টি দিয়েছে, অর্থাৎ বিদ্যুৎ কিনুক বা না কিনুক, টাকা দিতে হবে (ক্যাপাসিটি চার্জ)।
বিদ্যুতের দাম বাজারের তুলনায় অনেক বেশি ধরা হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত কয়লা ভারতের ভেতর থেকে কেনা হবে, কিন্তু তার ব্যয় বাংলাদেশকেই বহন করতে হবে।
❌ সমালোচনার কারণ:
ব্যয়বহুল চুক্তি: আদানি থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি দাম ১০-১৪ টাকা, যা অন্য দেশ থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের তুলনায় অনেক বেশি।
অন্যায্য শর্ত: বাংলাদেশের উচিত ছিল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাংলাদেশে স্থাপন করা, তাহলে পরিবহন খরচ কমত এবং সরাসরি নিয়ন্ত্রণ থাকত।
একতরফা সুবিধা: আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বাংলাদেশ সরকার অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা ব্যয় বহন করছে, যা আদানির লাভ বাড়িয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের ওপর বোঝা তৈরি করেছে।
২. ট্রানজিট ও বন্দর সুবিধা
বাংলাদেশ ভারতের জন্য আখাউড়া-আগরতলা, চট্টগ্রাম-মোংলা-কলকাতা, ফেনী নদীর ওপর সেতুসহ বিভিন্ন ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে।
✅ চুক্তির মূল বিষয়:
ভারত এখন বাংলাদেশের রাস্তা, রেল ও নদীপথ ব্যবহার করে উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য পরিবহন করতে পারে।
চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করার অনুমতি পেয়েছে।
ভারতীয় জাহাজ বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে পারবে, যা আগে নিষিদ্ধ ছিল।
❌ সমালোচনার কারণ:
বাংলাদেশের লাভ কম: ভারত এসব সুবিধা পেলেও, বাংলাদেশ পর্যাপ্ত ট্রানজিট ফি পাচ্ছে না, যা ভারতের তুলনায় অনেক কম।
রাস্তাঘাটের ক্ষতি: ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক ও কনটেইনার পরিবহনের ফলে বাংলাদেশের রাস্তাগুলোর উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ছে, কিন্তু ক্ষতি পূরণের ব্যবস্থা নেই।
সীমান্তে হয়রানি: ভারত ট্রানজিট সুবিধা পেলেও, বাংলাদেশি ট্রাক ও পণ্য ভারতে প্রবেশ করতে গেলে সীমান্তে ব্যাপক হয়রানির শিকার হয়।
৩. তিস্তা চুক্তি না হওয়া ও পানির অসম বণ্টন
✅ সমস্যার মূল বিষয়:
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে, যার মধ্যে তিস্তা অন্যতম।
শেখ হাসিনার সরকার ২০১০ সাল থেকে ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করার চেষ্টা করলেও, এখনো হয়নি।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার এ নিয়ে টালবাহানা করছে।
❌ সমালোচনার কারণ:
শুধু প্রতিশ্রুতি, কোনো বাস্তব সমাধান নয়: ২০১১ সালে চুক্তির প্রতিশ্রুতি দিলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব: ভারত শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি আটকে রাখে, ফলে উত্তরবঙ্গের কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বন্যার সময় উজানের পানি ছেড়ে দেওয়া: বর্ষাকালে হঠাৎ অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশে বন্যা হয়।
৪. সীমান্ত হত্যা ও বিএসএফের দমননীতি
✅ সমস্যার মূল বিষয়:
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (BSF) প্রতি বছর বাংলাদেশি নাগরিকদের গুলি করে হত্যা করছে।
শেখ হাসিনার সরকার বারবার নিন্দা জানালেও, হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি।
❌ সমালোচনার কারণ:
দায়মুক্তি: বিএসএফ কোনো জবাবদিহিতা ছাড়াই বাংলাদেশিদের হত্যা করছে।
অসম আচরণ: বাংলাদেশিরা সীমান্ত অতিক্রম করলে গুলি করে মারা হয়, কিন্তু ভারতীয়রা সীমান্ত পার হলে এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
৫. ভারতীয় কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসা সুবিধা
✅ চুক্তির মূল বিষয়:
ভারতীয় কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে ব্যবসা করার ব্যাপক সুবিধা পাচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো ভারতে সমান সুযোগ পাচ্ছে না।
রিলায়েন্স, টাটা, আদানি, এনএমডিসি-এর মতো কোম্পানিগুলো কর সুবিধা ও বিনিয়োগ ছাড়পত্র পাচ্ছে সহজেই।
❌ সমালোচনার কারণ:
বাংলাদেশের বাজার ভারতীয় কোম্পানির দখলে: ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কম দামে পণ্য এনে বাংলাদেশের বাজার দখল করছে, যার ফলে দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
শুল্ক বৈষম্য: ভারতীয় পণ্যের শুল্ক অনেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশি পণ্য ভারতে রপ্তানিতে নানা বাধার সম্মুখীন হয়।
বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থপাচার
শেখ হাসিনার শাসনামলে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার (লাখ কোটি টাকার বেশি) বিদেশে পাচারের অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন গবেষণা ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের প্রধান উপায় ও পরিমাণ