...ছোটবেলা থেকেই আমি বাবা-মায়ের বাধ্য সন্তান ছিলাম.. কখনোই আমার বাবা-মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করিনি.. সব সময় তারা যা বলেছে সেটাই করেছি.. বুঝতাম, হয়তো তারা যা করেন; আমার ভালোর জন্যই করেন !
.
স্কুল জীবনে বাবার ইচ্ছে ছিল "সাইন্স" নিয়ে পড়ানোর.. কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল "কমার্স".. মূহুর্তেই নিজের ইচ্ছাকে মাটি চাপা দিয়ে, বাবার ইচ্ছায় "সাইন্স" নিলাম.. বছর শেষে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট আসলো না.. বাবা আমাকে দোষী করলেন !
.
আমি নাকি সারাদিন ফেসবুক আর বন্ধু বান্ধব নিয়ে থাকায় পড়াশোনায় মনযোগী ছিলাম না.. ইচ্ছামত বকাঝকা করে পেটালেন আমাকে.. কিন্তু আমি যে "সাইন্স" গ্রুপটাতে মন বসাতে পারিনি, বাবা তা একবারো বুঝতে পারলো না !
.
বিশ্বাস করেন, কমার্সের সাবজেক্ট গুলো পড়লে আমার ভেতর যে ভালো লাগা কাজ করতো.. সেই অনুভুতিটা কখনোই সাইন্সের বইগুলো পড়ে পেতাম না.. কেমন জানি নিজেকে পাগল পাগল মনে হতো.. যার ফলে আমি শত চেষ্টা করেও বাবার খুশিমত রেজাল্ট করতে পারিনি !
.
কলেজে ভর্তির সময় গ্রুপ চেন্জ করতে চাইলাম.. সেখানেও বাবা বাঁধ সাধলেন; দিলেন না.. সাইন্স নিয়ে পড়লে ভবিষ্যৎ উজ্জল হয় স্বপ্ন দেখালেন.. আবার শুরু হলো ইচ্ছের বিরুদ্ধে পথ চলা !
.
কিন্তু এবার আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়লাম..বাহিরের জগত থেকে একদম আলাদা করে ফেললাম নিজেকে.. সারাক্ষন চারকোনা বইয়ের মধ্যে গুজে থাকতাম.. পরীক্ষায় রেজাল্টও খুব ভালো আসলো.. বলতে গেলে একদম বাবার মন মত !
.
বাবা খুশি, আমি খুশি, সবাই খুশি! কিন্তু সব খুশির ভীরেও কেন জানিনা আমার খুশিটা বড্ড নিঃপ্রান মনে হতো.. হয়তো আমার খুশিটাও সীমা ছাড়িয়ে যেত, যদি আমার পছন্দের গ্রুপ থেকে এই রেজাল্ট করতে পারতাম !
.
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় আমি চাইলাম বুয়েটে ভর্তি হতে.. কিন্তু বাবা চাইলেন মেডিকেল.. মেনে নিলাম, কারন বাবা তো আমার ভালোই চান! ভর্তি পরীক্ষায়ও টিকে গেলাম.. বাবার কাছে আদর্শ সন্তান হলাম.. কিন্তু হেরে গেলাম নিজের কাছে.. পড়তে ভালো লাগেনা তবুও পড়তে হয় !
.
হঠাৎ একদিন ব্যাচের একটা মেয়েকে প্রচন্ড ভালো লেগে গেলো আমার.. ধীরে ধীরে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেললাম মেয়েটাকে.. তাকে পেয়ে বুয়েট নিয়ে পড়তে না পারার হতাশা; এমনকি এতদিনের সমস্ত অপূর্ণ ইচ্ছা নিমিষেই মন থেকে মুছে গেলো.. বড্ড সুখী মনে হলো নিজেকে !
.
কিন্তু পড়াশোনা শেষ করে বাবাকে যখন মেয়েটার কথা জানালাম.. বাবা রাজি হলেন না.. তিনি এর চাইতেও ভালো কোনো মেয়েকে পুত্রবধু হিসেবে দেখতে চান.. ছেলে ডাক্তার, বড় ঘরের মেয়ের বাবারা লাইন দেবে বিয়ের জন্য.. সেখান থেকে কাউকে বেছে নিবেন.. থমকে গেল আমার পুরো পৃথিবী !
.
এতটা বছর যেই বাবার প্রতিটা ইচ্ছা আমি নীরবে পূরন করে এলাম.. সেই বাবা কিনা আজ আমার একটা ইচ্ছাকে পূরন করতে চাইছেন না.. আমি আমার সবটা দিয়ে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুই হলোনা.. তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন.. একবার মনে হয়েছিল, একাই বিয়ে করে ফেলি, কিন্তু পারিনি !
.
আজ তিন বছর হলো আমি একটা মানুষের সাথে সংসার করছি.. কিন্তু জানেন, আমি যখন আমার স্ত্রীর হাতটা ধরি, শরীর ঠিকই জাগে, কিন্তু মন জাগে না.. তবুও আমি চলছি, প্রতিনিয়ত সবকিছু মানিয়ে নিচ্ছি !
.
আমি আমার চার বছরের প্রেম ভুলে গিয়েছি.. আবেগ ভুলে গিয়েছি.. ভালোবাসা ভুলে গিয়েছি.. দিনে দিনে আমি একজন পাকা অভিনেতা হয়ে গেছি !
.
মাঝে মাঝে মনে হয় বড্ড ভুল করে ফেলেছি বাবার পছন্দে বিয়ে করে.. সারাটা জীবন নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চলেছি.. ভালো না বেসেই বলেছি "ভালোবাসি".. খুশি না হয়েই বলেছি "খুশি হয়েছি".. নিজেকে এতগুলো মিথ্যে বুঝাবো কি করে?
.
আচ্ছা সব স্বপ্ন পূরণের দায় শুধু সন্তানকে নিতে হবে কেন?.. বাবার স্বপ্ন পূরণ করেছি আমি.. আমার স্বপ্ন পূরণ করবে আমার সন্তান.. তার স্বপ্ন তার সন্তান.. এভাবেই কি আমরা দিনের পর দিন নিজের স্বপ্ন অন্যের কাধে চাপিয়ে দেব? বদলাবেনা কিছুই?
.
জানেন, এখন মনে হয়- আমার বাবা আমাকে পড়াশুনা করিয়ে আদর্শ সন্তান রূপে একটা আদর্শ প্রতারক বানিয়েছে.. প্রতিনিয়ত প্রতারণা করে যাচ্ছি মানুষের সাথে.. এমনকি নিজের স্বপ্নের সাথেও.. কারন আমি অভিনেতা, আমাকে সব সময় ভালো থাকার অভিনয় করে যেতে হবে..!!