[আমার প্রথম সংযুক্তি। আবার দিলাম।]
।। নাসীমুল বারী।।
হলুদ, কালো, লাল, নীল, মেরুনের চমৎকার ছোপ ছোপ সাজের প্রজাপতিটা উড়ছে। গাছের এ পাতা থেকে ও পাতায় বসছে। উড়ে উড়ে অপরূপ বর্ণচ্ছটাই বিকিরিত করছে দৃষ্টির তরঙ্গে।
ফটোস্ট্যাট দোকানের সামনে রাখা লম্বা বেঞ্চিটায় বসে একদৃষ্টিতে দেখছে ওই দৃশ্যটা হিমেল। প্রজাপতির অপরূপে দৃষ্টি ফেরাতেই পারছে না।
ক্লাসে বিরতি।
আড্ডা না দিয়ে সোজা চলে আসে ক্যাম্পাসের গেটে। গেটের সাথে বাইরেই ছোট ফটোস্ট্যাটের দোকান। সাথেরটা চায়ের। এ বেঞ্চিটা দু দোকানীরই কমন। চায়ের জন্যেই এখানে আসা হিমেলের। তাই তো বেঞ্চিতে বসে পড়া। আর তখনই নজরে পড়ে উপমিত সুন্দরের ওই প্রজাপতিটা।
চোখটা এখনো ফেরাতে পারছে না।
সৃষ্টির কী অপূর্ব দৃষ্টান্ত! তবে একদম আনমনা হয়ে যায় নি। চেতনা লোপ পায় নি। একটু নড়ে চড়ে বসে চায়ের অর্ডার দেয় হিমেল।
তখনি পাশে এসে বসে সহপাঠী সুমা। লেখা পড়ার শেয়ার এন্ড কেয়ারে পারস্পারিকতা বেশ সৌহার্দপূর্ণ। দোকানী চা বাড়িয়ে দেয়। সুমা ইশারায় আরেক কাপ চা দিতে বলে ওটা তুলে নিয়ে খেতে শুরু করে। হিমেল প্রজাপতিটার দিকে তাকিয়ে থেকেই হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, দেন।
অমনি সুমা হাতটায় টোকা মেরে বলে, কী দেখছ ও দিকে? চা তো আমি খাচ্ছি।
-ও! এই আরেকটা চা। আচ্ছা সুমা দেখ তো প্রজাপ্রতিটা!
সুমা তাকায়।
রং বাহারী দারুণ এক প্রজাপতি। পাশের ওই ছোট গাছগুলোতে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে।
-রংয়ের কী বাহার, তাই না সুমা?
-হুঁ।
-আসলে সৃষ্টিতে কী অপূর্ব সৌন্দর্যই না ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমার কি সম্ভব হবে এমনি চমৎকার রংয়ের কারুজাজ সৃষ্টি করা?
কথাটা বললেও তাকিয়ে রয়েছে হিমেল প্রজাপতিটার দিকেই। আরে! একি! বড়ো একটা প্রজাপতি আসছে হিমেলের দিকে। ছন্দায়িত চলায় লম্বা বিনুনী দুলছে মাথায় দুই পাশে। সবুজ জমিনে খয়েরি-বটিকের পোশাকটাও অপূর্ব। ছোপ ছোপ বটিকের কাজটাই প্রজাপতির রং-আলপনা। বাতাসে ওর ওড়নার উড়াটা যেন প্রজাপতি পাখা মেলে উড়ছে। ধীর লয়ে হিমেলের পাশে এসে দাঁড়ায়। তারপর শান্তকণ্ঠে হিমেল-সুমাকে জিজ্ঞেস করে, ক্লাসে যাবে না?
হিমেল ওর চোখের দিকে তাকায়।
টানা টানা চোখে কাজল পড়েছে। এমন টানা চোখে কাজল পরায় ওকে আরও মোহনীয় করে তুলেছে। হিমেল শুধু তাকিয়েই আছে ওর দিকে। ওর চোখের দিকে। ঠিক তখনি ওদের পাশ দিয়ে প্রজাপতিটা উড়ে যায়। সুমা হিমেলকে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলে, প্রজাপতিটা তো উড়ে চলে গেল।
-ও, হা! বী-না - - -! বীনা তুমি এলে কখন?
-আমি এসে তোমার কাছে দাঁড়ালাম। ক্লাসে যাবার ব্যপারে জিজ্ঞেস করলাম। আর এতক্ষণ পর জানতে চাইছো কখন এলাম? আচ্ছা তুমি কি স্বপ্নের জগতে ছিলে?
-না মানে?
-আমি তোমার সহপাঠী। আমাকেই চিনতে কষ্ট হল? নাকি নতুন দেখলে আজকে?
এবার হিমেল কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। তাই জড়ানো কণ্ঠে বলে, আমি সহপাঠী বীনাকে নয়, দেখছিলাম প্রজাপতি বীনাকে। রঙ্গিন বীনা!
হিমেলের পাল্টা এমন কথায় বীণাও লজ্জা পেয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সুমা ব্যপারটা সহজ করার জন্যে বলে, চল চা খাই।
-না, থাক। আমি বাইরের কিছু খাই না।
হিমেল ততক্ষণে ঘুরে তাকায় ওই গাছগুলোর দিকে। সুমার কোন কথা খেয়ালই করে নি। ও খুঁজছে প্রজাপতিটা। প্রজাপতিটা কি আছে ওখানে? নাকি বীনাই সত্যি সত্যি ওখান থেকে বড় হয়ে চলে এসেছে এখানে?
হিমেল দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। এমন সময় বীনাই বলে, যাবে না ক্লাসে? তোমারা কি এখানে গল্প করবে আরও?
সুমা সাথে সাথে প্রতিবাদের সুরে বলে, আমরা কি ক্লাস ফাঁকি দিয়ে গল্প করি?
তারপরেই মুচকি হেসে দেয় সুমা। বীনাও।
হিমেল আবার ওদের দিকে ফিরে তাকায়। সেও মুচকি হেসে দেয়। মৃদু বাতাস বয়ে চলছে। এ বাতাসে সুমার খোলা চুল উড়ছে। উড়ছে বীনার ওড়নাটাও। জর্জেটের পাতলা ওড়না বলেই ওটা একটু বাতাসেই উড়ে। হিমেল দাঁড়িয়ে চুল উড়নার উড়োউড়ি দেখছে। কোন কথা বলছে না।
হিমেলের চিন্তা-ভাবনাকে ওর সহপাঠীরা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। এই তো সেদিন ক্লাস থেকে বেরিয়ে বড় জামতলাটায় এসে বসে হিমেল, বীনা, সুমা, ফয়সাল, শিখা, তাহান আর রমিজ। আড্ডা দিচ্ছিল সবাই। জম্পেস আড্ডা। হঠাৎ হিমেল গম্ভীর হয়ে বলে, একটু পরেই নববধু আসবে এখানে।
-মানে?
চমকে সবাই জিজ্ঞেস করে।
ওই যে দেখ না চঞ্চলা কন্যারা দৌড়াদৌড়ি করে বৌচি খেলছে। ওদেরই বয়েস বাড়বে। ঘোমটা পরবে। সে ঘোমটায় চাঁদ-সুরুয কিছুই দেখা যাবে না। তারপর শৈশব-কৈশোরের মায়ার বাঁধন ছিড়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে আসবে আমার কাছে। এখানে। ওদের কান্নার পরশ হৃদয়-মন ছুঁয়ে যায়। ঘোমটা পরা কন্যারা বধু হয়েই তো এভাবে চলে আসে নতুন জগতে, তাই না?
সবাই তাকায় এদিক ওদিক। কোথায় চঞ্চলা কন্যার দৌড়াদৌড়ি? কোথায় হিমেলের মানস কন্যারা? কন্যা তো দূরে থাক, কোন প্রাণীরই অস্তিত্ব দেখা গেল না দৃষ্টির সীমায়। একটু বিরক্ত ভাব নিয়ে সুমা বলে, খামাখা কথা বলে লাভ কী যে কথায় ভিত্তি নেই?
পাশ থেকে বীনা বলে, নাকি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছ কোন কিশোরী কন্যাকে? পুরুষ মানুষের চোখ তো?
-বা রে! স্বপ্ন দেখব কেন? তোমরা এতগুলো জ্যান্তসুন্দরী কন্যা সামনে থাকলে স্বপ্ন দেখে কেউ?
হিমেলের মৃদু হাসির এমন কথায় কেউ কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। শুধু ফয়সাল বলে- দেখ, তুই সব সময় এমনসব হেঁয়ালী কথা বলিস, যার মাথা-মুণ্ডু থাকে না। কোথায় তোর বৌচি খেলা মেয়ের দল? কোথায় ঘোমটা পরা বধু? দেখা তো আমাদের?
হিমেল আরও একটু হেঁয়ালীভাব নিয়ে বলে, আকাশের দিকে তাকা তো। সাদা আর ছাই রংয়ের মেঘগুলো দৌড়ে বৌচি খেলছে না?
-হাঃ হাঃ - - -।
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে সবাই। সুমা বলে, তুমি প্রকৃতির সাথে মানুষকে সবসময় মিলিয়ে ফেল। তোমার ভাবনাটা ভিন্নই বটে।
এবার হিমেল হাসি হাসি ভাব নিয়ে বলে, জানো ওই চঞ্চলা কন্যারাই একসময় কেঁদে কেঁদে চলে আসবে আমার কাছে।
-কেন, তোমার গলায় মালা পরাতে?
বীনার এ কথায় হিমেল নির্লিপ্তভাবে বলে, হয়ত!
অমনি তাহান বলে, বীনা সুমা বুঝলে কথাটা? মেঘগুলো বৃষ্টি হয়ে ঝরবে। সেটাই বলছে, তাই না হিমেল?
হিমেল শুধু হাসল। কোন কথা বলল না।
হিমেল এখনও বসে আছে বেঞ্চিতে। সুমা আবারও তাড়া দেয়, চলো হিমেল ক্লাসে।
শান্ত কণ্ঠে হিমেল বলে, তুমি যাও। আমি এখন যাব না।
সুমাও শান্ত কণ্ঠে বলে, ঠিক আছে আমি যাচ্ছি। আমার থেকে পরে জেনে নিও লেকচার পয়েন্ট আর সামারী।
মাথাটা কাত করে সায় দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে বেঞ্চিতে। বসে বসে ভাবছে হিমেল সুন্দরের সংজ্ঞা কী? বীনাকে তো প্রতিদিনই দেখে। এ ড্রেসে আরও দেখেছে। কিন্তু এমন চমৎকার সৌন্দর্যের বিচ্ছুরণ তো কোনদিন নজরে পড়ে নি। কিংবা প্রজাপতি! অমন রঙ্গিন প্রজাপতিও আরও দেখেছে।
মনের সংবেদনশীল অংশে আচমকা যে অনুভূতির ছায়া পড়ে, তা-ই বাস্তবতার স্বরূপে উদ্ভাসিত হয়। তখনই ভালোলাগা, মন্দলাগা প্রকট হয়ে উঠে। মনের এই সংবেদশীলতার ছায়াচিত্র ইতিবাচক হলেই তা ভালোলাগা আর নেতিবাচক হলেই তা মন্দলাগা। ভালোলাগা মানেই সুন্দরের স্বরূপ।
মনের অনুভূতির এমন সংবেদনশীলতা সবার সমান নয়। যাদের অনুভূতিটা বিশেষভাবে পরিচালিত হয়- তারাই মনে নানা রংয়ের, নানা সুর-ছন্দের অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে। হিমেল হয়ত তেমনি একজন। কখন কোন সাধারণ ঘটনা, বস্তু কোন অনুভূতিতে মূর্ত হয়ে উঠে, তা হিমেলও হয়ত জানে না। জানে না বলেই এখন প্রজাপতি আর বীনার সৌন্দর্যকে একই তরঙ্গে সমান্তরাল করে ফেলেছে। এ জন্যেই বীনার কাজলপরা টানা টানা চোখ, সবুজ-খয়েরির বটিক ড্রেস আর প্রজাপতির রঙ্গিন ডানা যেন একাকার।
বীনা- বীনার অপূর্বময়তাই তাকে বেশ অণুরণিত করেছে। ক্লাস এখন গৌণ। মুখ্য বীনা আর বীনার সৌন্দর্যের সাথে প্রকৃতির একাত্মতা। হিমেলের কাছে বীনা তাই প্রজাপতি। উড়ে উড়ে শুধু সৌন্দর্যের ভালবাসাই ছড়াচ্ছে।
আচমকা কার যেন আলতো স্পর্শে হিমেল চমকে তাকায় পেছনে। সুমা। ‘আরে তুমি!’ চমকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কখন এলে? বীনা এলো না? প্রজাপতিটা এলো না? আচ্ছা সুমা বীনা কি প্রজাপতির মতো উড়তে পারে না?’
-ধ্যাৎ ছাই! আমি কি প্রজাপতি না? তোমার সাথে সাথে আমি প্রজাপতি হয়ে ঘুরে বেড়াই না?
- তুমি - - -! তুমি তো আমার বন্ধু, প্রজাপতি হবে কেন? প্রজাপতি তো সৌন্দর্যের। প্রজাপতি তো ভালবাসার।
প্রচণ্ড বিরক্তি ঝরে পড়ে সুমার মন মেজাজ থেকে। বীনার এমন কী সাজ তাকে মোহিত করে ফেলেছে? হিমেলের সাথে সুমার কথা বলতে ইচ্ছেই হয় না। ক্ষণিক চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। বীনাও এসে দাঁড়ায় পাশে। কোন কথা বলার আগেই সুমা বিরক্ত কণ্ঠে বলে, আমি গেলাম।
তারপরই হন হন করে হাঁটা দেয় সুমা বাসার দিকে।
বীনাও আর দাঁড়ায় না।
হিমেল তাকিয়ে থাকে ওদের চলে যাওয়া পথের দিকে। ওই তো রঙ্গিন প্রজাপতিটা উড়ে চলে যায় হিমেলের মাথার উপর দিয়ে অনন্ত পথের পানে।
#