১৯৯২-এর হিন্দু-মুসলিম রায়ট
১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সার্কের চেয়ারম্যান। সার্কভুক্ত সাতটি রাষ্ট্রের শীর্ষ সম্মেলন ঢাকায়। সাত জাতির শীর্ষ সম্মেলনের দিন-ক্ষণ-স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। সার্কের চেয়ারপার্সন হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া শীর্ষ সম্মেলন উদ্বোধন করবেন। শীর্ষ সম্মেলন উপলক্ষে কোন কোন রাষ্ট্রের সরকার প্রধানগণ আসতেও শুরু করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও এখনও ঢাকায় পৌঁছাননি। এরই মধ্যে ভারতে বাবরী মসজিদকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা হিন্দু-মুসলিম রায়ট শুরু হলো। সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী দলীয় নেত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জরুরী ভিত্তিতে মটর সাইকেল আরোহীকে ডাকলেন। মটর সাইকেল আরোহী ২৯নং মিন্টু রোডে বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার বাসায় উপস্থিত হলে বাবুর্চি বিরেস দৌড়ে এসে খবর দেয় যে, আম্মা (শেখ হাসিনা) আপনাকে এখনই ধানমণ্ডি বত্রিশে বঙ্গবন্ধু ভবনে যেতে বলেছেন। মটর সাইকেল আরোহী বত্রিশে পৌঁছলে সঙ্গে সঙ্গে জননেত্রী শেখ হাসিনা তাকে বঙ্গবন্ধু ভবনের লাইব্রেরী রুমে ডেকে বলেন, সারা দেশে হিন্দু-মুসলিম রায়ট (সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা) লাগিয়ে দাও। মটর সাইকেল আরোহী বলে, এটা ঠিক হবে না। নেত্রী বলেন, ঠিক-বেঠিক তোমার ভাবতে হবে না, রায়ট লাগাতে বলেছি, তুমি লাগাও।
মটর সাইকেল আরোহী বলে, আপনি এটা বলেন কি? আমি আরো রাত-দিন পরিশ্রম করে পাড়ায়-মহল্লায় যুবকদের সর্তক করে রেখেছি যাতে করে হিন্দুদের উপর কোন প্রকার আক্রমণ না হয়। আর আপনি বলছেন রায়ট লাগিয়ে দিতে। নেত্রী বলেন, হ্যাঁ আমি বলছি, তুমি রায়ট লাগাও। মটর সাইকেল আরোহী বলেন, না নেত্রী, এটা নীতিবিরুদ্ধ কাজ। নেত্রী রাগান্বিত হয়ে বলেন, রাখ তোমার নীতি-ফিতি। আমি যা বলছি তাই করো। আমি তোমার নেত্রী না তুমি আমার নেতা? আমাকে যদি নেত্রী মানো তাহলে আমি যা বলবো তাই করতে হবে। মটর সাইকেল আরোহী বলেন, আপনিই তো আমাদের নেত্রী, আপনি যা বলবেন তাই তো শিরোধার্য। তবে হিন্দুদের উপর আক্রমণ করলে হিন্দুরা আর এদেশে থাকবে না। সবাই চলে যাবে। আর এই হিন্দুরা তো আমাদেরই লোক। আমাদেরই রিজার্ভ ভোটার। নেত্রী বলেন, রাখ, যাবে কোথায়? যাবার জায়গা নেই। তুমি রায়ট লাগাও। মটর সাইকেল আরোহী বলে, হিন্দুরা ভারতে চলে গেলে ভারত থেকে যে মুসলমান আসবে সে মুসলমানের সবাই হবে ধানের শীষ, মানে বিএনপি। এটা কি ভেবে দেখেছেন নেত্রী? নেত্রী বলেন, আরে বোকা, সার্ক সম্মেলন পণ্ড করতে হবে না! কয়েক দিন পরেই সার্ক সম্মেলন। খালেদা জিয়া সার্ক সম্মেলন উদ্বোধন করবে। ইন্ডিয়ার প্রাইম মিনিস্টার নরসীমা রাও এখনও আসে নি। এই-ই সুযোগে, এখনই রায়ট লাগিয়ে দিলে সার্ক সম্মেলন পণ্ড হয়ে যাবে। তাছাড়া জাহানারা ইমাম যেভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে তাকেও তো সাইজ করতে হবে। জাহানারা ইমাম আমার নেতৃত্বের প্রতি হুমকি। যেভাবে সে দিনকে দিন মুক্তিযুদ্ধের ধারক- বাহক হয়ে যাচ্ছে তা ভয়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁকে (জাহানারা ইমাম) আর ছাড় দেওয়া যায় না, এই সুযোগ। এই সুযোগেই জাহানারা ইমামকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে। এক ঢিলে দুই পাখি। সার্ক সম্মেলন পণ্ড, জাহানারা ইমাম সাইজ। তুমি রায়ট লাগাও। হিন্দুদের উপর হামলা কর। এদেশের সকল হিন্দুরাই এখন জাহানারা ইমামের পিছনে চলে গেছে। ঢাকায় রায়ট বা হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা লাগানোর দায়িত্ব দেওয়া হলো মটর সাইকেল আরোহীকে এবং সিদ্ধান্ত হল ২৯ মিন্টু রোড বিরোধী দলের নেত্রীর বাসার এবং ধানমণ্ডি বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনের টেলিফোন ব্যবহার না করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার চাচাতো চাচা বঙ্গবন্ধু ট্রাস্টের মহাসচিব শেখ হাফিজুর রহমানের বাসার টেলিফোন থেকে ঢাকার বাইরের জেলাগুলোকে হিন্দু-মুসলমান রায়ট লাগানোর নির্দেশ দেওয়া হবে। খালেদা জিয়া সরকার যাতে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা কর্তৃক রায়ট লাগানোর পরিকল্পনা টের না পায় সে জন্য এই সতকর্তা। বিরোধী দলীয় নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দ্রুতগতিতে হিন্দু-মুসলমান রায়ট লাগানের জন্য সারা ঢাকা শহরের সকল গুণ্ডা-বদমাইশ এবং সন্ত্রাসীরা হাতে নগদ পাঁচ (৫) লক্ষ টাকা তুলে দেওয়া হলো। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কর্মসূচী বাস্তবায়িত করার জন্য প্রথমেই যাওয়া হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের পূর্ব পাশে অবস্থিত শিববাড়ী মন্দিরে। সেখানে দেখা গেল লুটেরা আর সুযোগ সন্ধানীদের জটলা। এই জটলাকারী লুটেরা সুযোগ সন্ধানীদের হাতে সঙ্গোপনে একাধিক একশ’ (১০০) টাকার কড়কড়ে নোট গুঁজে দিয়েই বলা হলো, ভারতে মুসলমানদের খুন করা হচ্ছে, মুসলমান নারীদের ইজ্জত আর ধন-সম্পদ লুট করে নেওয়া হচ্ছে। আর আমরা বাংলাদেশের মুসলমানরা চুপচাপ চেয়ে চেয়ে দেখছি, শুনছি। যান, শুরু করেন, নেন, লুট করে নেন। বলার সঙ্গে সঙ্গেই সুযোগ সন্ধানী লুটেরা হই হই করে মহা উৎসবে শিববাড়ী মন্দিরে লুটপাট শুরু করে দিল। সেখান থেকে চলে আসা হলো ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। এখানেও উৎসুক সুযোগ সন্ধানী লুটেরার জটলা। এখানেও নগদ টাকা আর একই কায়দায় বক্তৃতা এবং ঢাকেশ্বরী মন্দির লুট। এরপর এল রামকৃষ্ণ মিশন। নগদ অর্থ আর বক্তৃতায় কাজ হলো। রামকৃষ্ণ মিশনে লুটপাট শুরু হলো। তারপর যাওয়া হলো পুরান ঢাকার তাতি বাজার, শাখারি পট্টি, বাংলাবাজার, মালাকাটোলা, মিলব্যারাক, গুশাই বাড়ী, নারিন্দা, টিকাটুলি, ইসলামপুর ইত্যাদি জায়গায়। কিন্তু না, এটা পুরানো ঢাকা, এখানে সবাই পরিচিত। এখানে বক্তৃতা করা যাবে না। এখানে শুধু টাকার উপর দিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। বিভিন্ন মস্তান, সন্ত্রাসী ও নেশাখোর গ্রুপকে প্রচুর টাকা দেওয়া হলো। টাকায় কথা বললো। পুরাতন ঢাকায় হিন্দুদের দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়ীঘরে লুটপাট আরম্ভ হলো। ঘন্টা তিন-চারেক পরে ধানমণ্ডি বত্রিশ নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনে বিরোধী দলীয় নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে সারা ঢাকা শহরে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা রায়ট লাগিয়ে দেওয়ার সফল সংবাদ দিলে তিনি বেজায় খুশিতে আপ্লুত হয়ে বলে ওঠেন, এই তো কাজের ছেলে। তুমি না হলে কি হয়? তাই তো আমি তোমাকে খুঁজি। সামনের নির্বাচনে তোমাকে আমি মোকসেদপুর থেকে (গোপালগঞ্জের মোকসেদপুর-কাশিয়ানী আসন) এমপি বানাব। সারা দেশে হিন্দু-মুসলমান রায়ট শুরু হলো। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও ঢাকা এলেন না। সার্ক সম্মেলন পণ্ড হলো।
হায়দার আকবর খান রনোর বইতে এর সত্যতা মেলে। হায়দার আকবর খান রনো ( ৩১ আগস্ট ১৯৪২ – ১১ মে ২০২৪) ছিলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট বামপন্থী নেতা এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রবাদ পুরুষ। তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। তিনি একাধারে তাত্ত্বিক, বুদ্ধিজীবী এবং বহু গ্রন্থের লেখক। তিনি বাংলা একাডেমির কাছ থেকে ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
“… (বাবরী মসজিদ) দাঙ্গার সময় ঢাকার কাছেই শনির আখড়া নামে একটা জায়গায় গিয়েছিলাম। সেখানকার মন্দিরটি আগের রাতে ভাঙ্গা হয়েছে। মন্দির সংলগ্ন এলাকায় কিছু গরিব মানুষের বাস ছিল। তারা ধর্মে হিন্দু। তারা সবাই শ্রমজীবী। তাদের অতি দরিদ্র বস্তিতে আগুন লাগানো হয়েছিল। খােলা আকাশের নিচে বাস করছে প্রায় শ’খানেক নরনারী। দিনের বেলায় এই হতভাগ্য মানুষগুলাের সবাইকে পাওয়া যায়নি। কারণ তাদের কাজ করে খেতে হয়। যে ক’জন ছিল, তারা জানে না কেন হঠাৎ করে এই আক্রমণ এসেছে। তারা শুনেছে কোথায় নাকি মসজিদ ভাঙা হয়েছে। কিন্তু তারা তাে এই ভাঙাভাঙির মধ্যে ছিল না! শনির আখড়া ও কাছাকাছি কিছু এলাকা নিয়েই তাদের জগত। কোথায় অযােধ্যা – উত্তরে না দক্ষিণে, পূর্বে না পশ্চিমে তা তারা জানে না। দিন আনে দিন খায়, বেশির ভাগ দিন পেটপুরে খায় না। উপরতলার রাজনীতির খেলায় কেন তাদের সামান্য যা কিছু ছিল, তা হারাতে হবে? এ বড় কঠিন প্রশ্ন। সহজভাবে এই প্রশ্নের উত্তর আমরা সেদিন দিতে পারিনি।
তবে জনসভা করেছি। এ জনসভায় শেখ হাসিনা ছিলেন। আমিও বক্তৃতা করেছি। হতভাগ্য মানুষগুলোকে ওই সভা কোন ভরসা দিতে পারেনি।
আমাদের পার্টির একজন কর্মী আমাকে একপাশে ডেকে বললো — ‘ওই যে মঞ্চের ওই দিকে ক’টা ছেলে দেখছেন, তাদের একজন একটু আগে মাইকে বক্তৃতাও দিয়েছে, ওরাই কিন্তু গতকাল এখানে আগুন দিয়েছে, লুটপাট করেছে’॥”
— হায়দার আকবর খান রনো / শতাব্দী পেরিয়ে ॥ [ তরফদার প্রকাশনী – ফেব্রুয়ারি, ২০০৫ । পৃ: ৪৪২-৪৪৩ ]
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১১:১৮