somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলা ব্লগ: ভাষা, সংস্কৃতি চর্চা ও এক্টিভিজমের নতুন পাটাতন

১০ ই নভেম্বর, ২০০৮ দুপুর ২:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভূমিকা: একটি নিপীড়নমূলক বিশ্বব্যবস্থায় প্রায় সকল রাষ্ট্রের অধিপতি শ্রেণীর বহুবিধ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সেন্সরশীপের কাছে যখন ভিন্ন মত, পথ ও চিন্তা প্রকাশের সম্ভাবনাগুলো জিম্মী হয়ে পড়েছে, এবং পড়ছে, প্রতিদিন-প্রতিনিয়ত, তখন অপেক্ষাকৃত স্বাধীন মত ও চিন্তা প্রকাশের একটি কার্যকর পাটাতন হিসেবে বিশ্ব মানবজমিনে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ব্লগ। গণতান্ত্রিক লেবাসে স্বাধীন মত প্রকাশের জিকির তুললেও সারা পৃথিবীতে মূলধারার গণমাধ্যমগুলো বিজ্ঞাপন নামের কলকব্জায় প্রধানত কর্পোরেট স্বার্থের কাছেই গভীর আন্তরিকতায় অনুগত। অপরদিকে আধা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা-আধা সামন্ত সংস্কৃতি প্রভাবিত প্রান্তিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর প্রধান প্রধান গণমাধ্যমগুলো, সেটি সংবাদপত্র হোক আর রেডিও-টিভি হোক, এখনও প্রবলভাবে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত এবং প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিকায়িত ডাগর চোখের কাছে বন্দী। এ রকম পরিস্থিতিতে এতদিন ধরে সীমিত পরিসরে প্রকাশিত অনুপত্রিকাই (লিটল ম্যাগাজিন) ছিল অন্যতম ভরসা। তথ্য প্রযুক্তির অসাধারণ বিকাশের ধারাবাহিকতায় ইন্টারনেট ভিত্তিক লেখালেখি, শিল্প-সাহিত্য চর্চা, মত প্রকাশ, তর্ক-প্রতর্কের মাধ্যম হিসেবে ব্লগ সে ভরসায় একটি সম্ভাবনাময় সংযোজন। মূধধারার সাংবাদিকতার বিপরীতে বিকশিত অংশগ্রহণমূলক সাংবাদিকতা বা সিভিল জার্নালিজমের ধারণা মত প্রকাশের নতুন পাটাতন হিসেবে ব্লগকে অনেক বেশি অনিবার্য ও জনপ্রিয় করে তুলেছে। ব্লগ সার্চ ইঞ্জিন টেকনোরতি ডিসেম্বর ২০০৭ এ সর্বমোট এগার কোটি বিশ লাখেরও বেশি ব্লগ চিহিৃত করেছিল (সূত্র: উইক পিডিয়া) যা ব্লগের উক্ত আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তাকেই জানান দেয়। ব্লগ সাইটগুলো নিয়ে পৃথিবীজুড়ে রাষ্ট্র, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, কর্পোরেট অধিপতিশ্রেণীর সতর্ক পর্যবেক্ষণ আর নিয়ন্ত্রণ প্রয়াসই প্রমাণ করে বিকল্প মত প্রকাশ এর মাধ্যম হিসেবে ব্লগের কার্যকারিতা।
ফ্লাশব্যাক: জন্মের সময় নামটা ছিল ওয়েবলগ। যতদূর জানা যায়, জর্ন বার্গার নামের একজন আমেরিকান ১৯৯৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রথম ওয়েবলগ শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি ব্লগ জগতের আদি মানুষদের একজন এবং প্রথম দিককার ব্লগ সাইটের উদ্যোক্তাও। বিবর্তনের ধারায় পরবর্তীতে ওয়েবলগ ব্লগ হিসেবেই পরিচিত হয়ে উঠেছে। ১৯৯৯ সালের এপ্রিল-মের দিকে পিটার নামের এক ব্যক্তি ওযেবলগ শব্দটিকে ভেঙ্গে 'উই ব্লগ’ হিসেবে ব্যবহার করেন। ক্রমান্বয়ে তার ব্যবহৃত শব্দটিই জনপ্রিয় হয়ে উঠে এবং সামাজিক যোগাযোগ ও মত প্রকাশের মাধ্যম হিসবে বিভিন্ন ব্লগ বিপুল পরিমাণ লেখক-পাঠক-ভিজিটরের অভূতপূর্ব সমাবেশ ঘটাতে সক্ষম হয়। যার ধারবাহিকতা এখনও চলমান এবং ক্রমশ: বিস্তৃত হচ্ছে।

বাংলা ব্লগ: তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক যোগাযোগ প্রক্রিয়ায় যেখানে ইংরেজি ব্লগের বয়সটাই এখনও অনেক কম সেখানে বাংলা ব্লগতো রীতিমত আঁতুড় ঘরের নবজাতক। তবে নবজাতক হলেও বাংলা ব্লগ ইতোমধ্যে বিপুল পরিমাণ সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে। এর বড় প্রমাণ হচ্ছে প্রথমআলোর মতো মিডিয়া অধিপতির বাংলা ব্লগ উদ্যোক্তা হিসেবে আবির্ভাব। ব্লগ বলতে যা বোঝায় সে হিসেবে ২০০৫ সালে প্রথম বাংলা ব্লগের যাত্রা শুরু। সামহোয়্যারইনব্লগ এর মাধ্যমে। তারপর এলো সচলায়তন, আমার ব্লগ, পেঁচালী। সর্বশেষ প্রথম আলো ব্লগ। বাংলা ভাষায় একটি পূর্নাঙ্গ ছবি চালুরও আয়োজন চলছে। আশা করা যায় এটিও খুব দ্রুত পথ চলতে শুরু করবে।
বাংলা ব্লগ: দৃশ্যমান সম্ভাবনার কয়েকটি দিক: প্রথম দিকে অনলাইনভিত্তিক ব্যক্তিগত দিনপঞ্জি লেখার ধারণা থেকে ব্লগের যাত্রা শুরু হলেও অল্প দিনের মধ্যে রূপ আর মাত্রিকতায় ভীষণ বৈচিত্রময় হয়ে উঠে। মূলধারার গণমাধ্যম থেকে ব্লগের উৎকর্ষতা ও জনপ্রিয়তার প্রধান সূত্রটিই এখানেই। ব্যক্তিগত জীবনে ঘটে যাওয়া নানা খুনসুটি থেকে শুরু করে সমাজ, সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনীতি, ডিজিটাল ফটোগ্রাফি, কী নেই এখানে। সবই আছে। ফলে বিষয় আর মতের এতো বৈচিত্র সমাহার অন্য কোথাও নেই বললে চলে। মূলধারার সংবাদপত্রে যেখানে একটি লেখা পাঠিয়ে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়, এবং জাত্যাভিমানের ব্যাকরণে নির্মিত সম্পাদনা নামের ছুরির কবলে অনেক সৃষ্টিই কোন দিন আর সৃষ্টি হয়ে উঠে না, সেখানে প্রচলিত ব্যাকরণে হয়তো অতি সাধারণ চিন্তক-লেখকও তার সৃষ্টিকে অনায়াসে তুলে ধরতে সক্ষম হন ব্লগের মাধ্যমে। মান-নিম্নমান ধারণার আড়ালে শিল্প-সাহিত্যের জগতেও যে একটি কেন্দ্র-প্রান্ত মেরুকরণ প্রক্রিয়া ঐতিহাসিকভাবে টিকে আছে ব্লগ সে প্রক্রিয়াকেই চ্যালেঞ্জ করে প্রান্তিক লেখক-চিন্তকদের জন্য একটি পাটাতন তৈরি করেছে। ফলে বাংলাদেশের যেকোন অঞ্চলের যেকোন অপ্রচলিত লেখক শুধু ইন্টারনেট সুবিধায় প্রবেশাধিকারের সুবাধে তুলে ধরতে পারছেন নিজের চিন্তা, মতামত এবং সৃজনশীলতা। এ ভাবেই বাংলা ব্লগ ইতোমধ্যে লেখালেখি জগতের প্রচলিত শহরকেন্দ্রীকতাকে, আরও সুস্পষ্টভাবে বললে ঢাকাকেন্দ্রীকতাকে অনেকখানি ভেঙে দিয়েছে, বিপরীতে ঢাকা, ঢাকার বাইরের জেলা এবং প্রবাসের বাংলা ভাষাভাষী লেখক-পাঠকদের মধ্যে নিয়মিত মিথস্ক্রিয়ার একটি ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার জায়গাটাকে আরও বিস্তৃত করার ক্ষেত্রে একটি সুসংবাদ। একই সাথে ব্লগারদের মধ্যে নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগ ও মিথস্ক্রিয়ার সুবাদে ভার্সূয়াল জগত এবং ভার্সুয়াল জগতের বাইরে সমচিন্তার মানুষদের মধ্যে সমাজরূপান্তরের আকাঙ্খাভিত্তিক এক্টিভিজমেও নতুন মাত্রা যোগ করেছে। যা জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন, বিমান বন্দরের সামনে থেকে বাউল ভাস্কর্য সরানোর বিরুদ্ধে চলমান সংগ্রাম, এনজিওদের ক্ষুদ্র ঋণের আড়ালে দরিদ্র মানুষদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন এর প্রতিবাদ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি, বিশ্বায়নের মোড়কে কর্পোরেট শোষণের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান সহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সামাজিক-রাজনৈতিক উদ্যোগে ব্লগারদের নিরবিচ্ছিন্ন সক্রিয় সংশ্লিষ্টতা, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ থেকে প্রমাণিত। বিদ্যমান এবং সম্ভাব্য সীমাবদ্ধতাগুলোর পরও বলা যায়, বাংলা ব্লগ আমাদের প্রাণের বাংলা ভাষাকে যেমন নতুনভাবে সমৃদ্ধ করার একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে তেমনি একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে বিতর্ক-প্রতর্ক করে সমাজ রূপান্তরের আকাঙ্খাগুলোকে আরও বেগবান করার অমিত সম্ভাবনাও সৃষ্টি করেছে। সুতরাং তরুন প্রজন্ম সহ যতবেশি বাংলাভাষী মানুষ বাংলা ভাষাভিত্তিক এ ব্লগিং-এ যুক্ত হবে, ব্লগিং এর অদৃশ্য সম্ভবানাগুলো তত বেশিই আবিস্কৃত হবে। সে আবিস্কারে নেশাটা তৈরি হওয়ার এবং তা তৈরি হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোর বিকাশের ওপর অনেকখানি নির্ভর করছে বাংলা ব্লগিং এর আগামী দিনের গতি-প্রকৃতি।
পুনশ্চ: এ লেখাটি চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে প্রকাশিত ছোট কাগজ-শ্লেট-এ প্রকাশিত হয়েছে। কাগজটির স্পেসের সীমাবদ্ধতার কারণে বাংলা ব্লগের সীমাবদ্ধতাগুলো আলোচনার বাইরে রাখা হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই নভেম্বর, ২০০৮ দুপুর ২:১৬
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×