স্কুল খোলার দিনে, প্রতিদিন সকালে বিদুষীকে স্কুলের জন্য রেডি করতে করতে আমার প্রায়শ মন খারাপ হয়। আহারে কত্তো কত্তো মেয়ে নিয়ত হারিয়ে যায়। বাড়ির মেয়েটা ছেলের মতো নজর পায় না। ছেলের জন্য বাবা-মা যা করে মেযের জন্য সব সময় সব বাবা মা সেটি করে না। কিন্তু তারা কী কম?
ছেলেদের সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিয়ে ভার্সিটি পর্যন্ত আসে। ঢাবির সমাবর্তনে স্বর্ণ পদক পাওয়াদের বেশিরভাগই ছিল মেয়ে। আমি যবে থেকে এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই, তারপর থেকে পারফেক্ট জিপিএ করেছে একজন মেয়ে!
কিন্তু তারপর তারা কোথায় যায়? সরকারী হিসাবে ১৯৭৪ সাল তেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত পাবলিক মেডিকেল থেকে পাস করা মেয়েদের ৫০% নাকি ডাক্তারী করেইনি। আমি এখন দেখি কম্পিউটার বিজ্ঞানে এই হার আরও বেশি। কেন?
অথচ সেই ষাটের দশকে, আমার মা যখন চট্টগ্রাম কলেজে পড়তেন তখন কলেজের পরীক্ষায় সুরাইয়া খালা প্রথম হয়েছেন দেখে পাজি ছেলেগুলো বোর্ডে লিখে রেখেছিল "অল দ্যা গ্লোরিস লিড টু দ্যা ডেকচি"। সেই পাজি ছেলেদের একজন পরে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন। মা'র কাছ থেকে এ গল্প জানার পর আমি সব খালাদের খুঁজে বের করে জেনেছি - না, ওনারা কেউ কেবল রান্না বান্না করেন নাই। প্রত্যেকেই নিজের আলাদা স্বাধীন স্বত্ত্বা বজায় রেখেছেন। আমার মা চাকরি করতেন বলে আমার দাদা যে কোন পারিবারিক সভায় মা'র কথার আলাদা গুরুত্ব দিতেন।
১৯৫০-এর দশকে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত একমাত্র নিয়মিত ম্যাগাজিন ছিল "কল্লোল"। সেটি সম্পাদনা করতেন আমার সেজ খালা মোহসেনা বেগম। সেই কল্লোলের নিয়মিত ফটোগ্রাফার ছিলেন নভেরা (ভাস্কর নভেরা)।
সেই আমলের আমার মা-খালারা কেউ শুধু রান্নাবান্না করে নাই। আর এখন আমরা সযতনে চেষ্টা করি আমাদের বালিকারা যেন জি-বাংলা, সাজুগুজু আর প্রেম-প্রেম ইত্যাদি ফালতু কাজে নিজেদের জীবন বরবাদ করে, জীবনের স্বাদ যেন না পায়।
* আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রতি তিনজন মেয়ের একজনের বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছরের আগেই। এর অর্থ হলো প্রতিদিনই বিশ্বে ৪৭,৭০০ বালিকা তার আনন্দের দিনগুলি থেকে বঞ্চিত হতে শুরু করে।
*১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই প্রতিদিনই ২০ হাজার মেয়ে মা হয় ।
ইয়াসমীন হক ম্যাডাম আমাকে একবার বলেছিলেন - সন্তান মানুষ করার চেয়ে পিএইচডি করা অনেক সহজ!
এরকম বৈরি পরিবেশে আমাদের মেয়েরা কিন্তু সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। সংখ্যায় হয়তো দ্রুত বাড়ছে না, কিন্তু ঠিকই তারা জিতে নিচ্ছেন নিজেদের জায়গা। বাংলাদেশের সিএস পড়ুয়াদের মধ্যে এখন ২৯% মেয়ে। অনেকেই কাজের ক্ষেত্র হিসাবে বেছে নিয়েছেন এই খাতকে। সঙ্গে সন্তানকেও বড় করছেন। সংখ্যাটা অনেক কম। ৩-৭% এর মধ্যে ঘোরাঘুরি করে। কিন্তু যারা করে তারা পিএইচডি সামলায় ঘরে।
আর আমার হিসাব নিকাশ যদি ঠিক হয় তাহলে কোন ফরচুন ৫০০ আইটি কোম্পানির প্রথম বাংলাদেশী সিইও হবেন একজন মেয়ে!
তাদের এই অর্জনকে উদযাপন করার জন্য প্রথমবারের মতো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অ্যাডা লাভলেস উদযাপনের। সাহসিকা নোভা আহমেদের নেতৃত্বে একদল মেয়ে তাদের এই উদযাপনের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করছেন।
অ্যাডা লাভলেস বিশ্বের প্রথম প্রোগ্রামার। গ্রেস হপার প্রথম কম্পাইলার বানিয়েছেন। মার্গারিটা হ্যামিল্টন চাঁদে মানুষ পাঠানোর এপোলো-১১ মিশনের কম্পিউটার টিমের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
আগামী ২-৩ জানুয়ারি ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকে এই আয়োজন। ঢাকার বাইরে থেকে যারা আসবে তাদের জন্য লালমাটিয়াতে হোস্টেলেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ঐদিন আইসিটি খাতের নারী সাহসিকাদের সম্মান জানানো হবে যাদের কেউ বাংলাদেশে প্রথম ব্যাংকিং সফটওয়্যার লিখেছেন ও সফটওয়্যার রপ্তানী শুরু করেছেন, কেউ প্রোগ্রামার হিসাবে কাজ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হয়েছেন, কেউ সেই ২৫+ বছর আগে দেশের শীর্ষ স্থানীয় সফটওয়্যার কোম্পানির সূচনা করেছেন, কেউ এখন ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।
অনেকই অংশ নেবেন প্রবাস থেকে - বলবেন নিজেদের অভিজ্ঞতা, জানাবেন কী করলে নতুন প্রজন্মের মেয়েরাও একই পথে আরও এগিয়ে যেতে পারবে।
আগ্রহীরা ওয়েবসাইটে বিস্তারিত দেখতে পারেন
ইভেন্ট পেজের লিংক - এখানে
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:২৮