১৪ মার্চ, ২০১৮
সকালে ছেলে-মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে আবার কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার বিলাসিতাটা আমি করতে পারি কারণ আমার অফিস শুরু বেলা ১১টায়। কাজে ১৪ মার্চের সকালেও আমি এমন গড়াগড়িতেই ছিলাম। গড়াগড়িটা টুটে গেল প্রথম আলো’র অনলাইনের প্রধান সেলিম খানের ফোনে।
“মুনির ভাই, আপনার ওস্তাদ তো চলে গেল। আর আপনি ঘুমাচ্ছেন!’।
সেলিম ভাই-এর কথা শুনে প্রথমেই আমার মনে হলো – কেন, আজকেই কেন? ওস্তাদ অসুস্থ। সে তো ১৯৬৩ সাল থেকেই। তখনই তো ডাক্তাররা তাকে বলেছিলেন বেশি দিন বাঁচবেন না। তারপরও তো এতোদিন বেঁচে ছিলেন, প্রবল বিক্রমে। দুই দুইটি বিয়ে করেছেন। তিন সন্তান আর অসংখ্য গুণগ্রাহী তৈরি করেছেন।
পদার্থ বিজ্ঞানে হেন কোন পুরস্কার নেই যা পাননি। তারপরও আমার মনে হলো – আহারে। ওস্তাদ তো তাহলে আর নোবেল পুরন্কার পাবেন না!!!
দ্যাগ হ্যামারগোল্ড ছাড়া আর কাউকে মরণোত্তর নোবেল দেওয়া হয়নি। পশ্চিমারা আমাদের মতো মৃত্যুর পরে মূল্যায়নে বিশ্বাস করে না। কাজে, আলফ্রেড নোবেল তার উইলে জীবিতদেরই কেবল এই পুরস্কার দেওয়া যাবে বলে গেছেন।
আর পদার্থবিজ্ঞানে কাজ করলেও হকিং-এর কাজের সঙ্গে গণিতেরই কাজ কারবার বেশি। গ্রীণউইচ মানমন্দিরে একবার এক টেলিস্কোপে চোখ রেখে খুবই বিরক্ত হন হকিং। তারপর আর ভুলেও পর্যবেক্ষণ-পরীক্ষার ধারে কাছেও যাননি। সে হিসেবে নোবেলের কাছে তিনি গণিতেরই লোক। আর আলফ্রেড নোবেলের সঙ্গে গণিতের হিংসার কথা কে না জানে।
বেচারা আলফ্রেড ডিনামাইট বানানো নিয়ে চরম ব্যস্ত, নাওয়া খাওয়া ভুলে বাসাতে ল্যাবরেটরী বানিয়ে ফেলেছে। আর তার প্রেমিকা অপেক্ষায় থাকতে থাকতে থাকতে হয়ে পড়েছে হতাশ। তখন তার জীবনে আলো নিয়ে হাজির হয় এক গণিতবিদ। ডিনামাইটের টাকাকড়ি গোণাগুণতির পর নোবেল আবিস্কার করলেন গণিতের হাত ধরে চলে গেছে তাঁর প্রেমিকা। সেই থেকে গণিতবিদদের আর দেখতে পারেন না তিনি। উইল করার সময়, তাই বলে গেছেন “পরীক্ষাগারে, হাতে –কলমে প্রমাণিত না হলে” কাউকেই তাঁর টাকার ভাগীদার করা যাবে না।
কাজে সেই ১৯৭৪ সাল থেকে চেষ্টা চরিত্র করেও হকিং-এর কোন আবিস্কারকে এই শর্ত পূরণের জন্য যথেষ্ট মনে করানো যায়নি। ভাবা যায়, মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের পর বিশ্বের সবচেয়ে অসাধারণ বিজ্ঞানী কি না নোবেল পুরস্কার না পেয়েই চলে গেলেন!
সেলিম ভাই-এর ফোন পেয়ে আমার মনে তাই প্রথমেই নোবেল পুরস্কারের ভাবনাটাই এলো। আচ্চা, হকিং কি নোবেল পুরস্কার না পাওয়ার বেদনায় কখনো ভারাক্রান্ত হয়েছেন?
তাঁর অফিসে বসে সেই কথা জানতে চেয়েছিলাম ২০ বছর আগে। স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে তিনি আমার পেছনে থাকান। আমিও মাথা ঘুরিয়ে আবিস্কার করি নোরমা জিনকে। তাই তো, দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ‘ফটোগ্রাফড’ মহিলাটিও তো একাডেমি এওয়ার্ডের জন্য কখনো মনোনীত হোননি।
কিন্তু আজকে কেন? আজ কী কোন বিশেষ দিন!
হ্যা, আজ পাই দিবস। গণিত উৎসব শুরু করার পর আমরা নানা উপরক্ষ খুঁজি যাতে গণিত নিয়ে একটা কিছু করা যায়। খুঁজতে গিয়ে আমরা প্রথম খুঁজে পাই পাই দিবস। বৃত্তের পরিধিকে ব্যাস দিয়ে ভাগ করলে যে ধ্রুব সংখ্যাটি পাওয়া যায় সেটির নামই পাই। আর তার মানের প্রথম তিন সংখ্যা হলো ৩.১৪। মার্কিন রীতিতে তারিখ লেখার কায়দাতে এটা হয় ৩/১৪ বা মার্চের ১৪ তারিখ। সেই হিসাবে প্রতি বছর গণিতবিদরা ১৪ মার্চ পাই দিবস হিসাবে পালন করে।
কিন্তু আলফ্রেড নোবেল যতই হকিং-কে গণিতবিদ ভাবুন না কেন, হকিং-তো আসলে নোরমা জিনের ভক্ত। তিনি তো গণিত থেকে সিনেমার লোক বেশি। আর নোরমা জিন ওরফে মেরিলিন মনরোর জন্মদিন বা মৃত্যুদিন কোনটাই তো ১৪ মার্চ নয়। হকিং-এর প্রিয় অভিনেত্রী মনরো’র জন্ম জুনের ১ তারিখে আর মৃত্যু আগস্টের ৫ তারিখে।
তাহলে?
১৪ মার্চ কেন আমার ওস্তাদ বেছে নেবেন তাঁর মহাপ্রস্থানের দিন হিসাবে।
ভাবতে গিয়ে মনে পড়লো, আরে ওস্তাদের রুমে তো আরও একজনের পোস্টার ছিল।
সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষের মনে একটা প্রশ্ন আমি কোথা থেকে এলাম, কোথায় যাবো? এই দুনিয়া (Universe) কেমন করে সৃষ্টি হয়েছে? কেমনেই বা শেষ হবে? আদৌ শেষ হবে কিনা।
আর এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মানুষের হাতিয়ার হয়ে ওঠে বিজ্ঞান – পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ। গ্যালিলিও গ্যালিলের নানা বুদ্ধিকে সংকলিত করতে গিয়ে আইজ্যাক নিউটন আধুনিক বিজ্ঞানকে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। সেই গ্যালিলিও গ্যালিলের সঙ্গে হকিং নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নিয়েছেন জন্মের সময় থেকে।
কিন্তু তিনি তো নিউটনের দুনিয়ার লোক নন। হকিং-এর জীবন জুড়ে মেরিলিন মনরো ছাড়া অন্য আর একজনের যে প্রভাব তিনি তো নিউটন নন। তিনি অ্যালবার্ট আইনস্টাইন – আপেক্ষিকতার লোক।আর আইনস্টাইনের জানানো দুনিয়ার সবচেয়ে সফল লোকটার নামই তো স্যার স্টিফেন উইলিয়াম হকিং!
আমাদের জানা দুনিয়ায় (Universe) দুইটি শক্তিশালী তত্ত্ব হলো আইনস্টাইনের আপেক্ষিতার বিশেষ ও সাধারণ তত্ব এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। প্রায় ১০০ বছরের অধিককাল ধরে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন এই দুইকে ছাদনা তলায় নিয়ে জোড় বাধঁতে। সেই সাফল্যের প্রথম কাজটি করেছেন হকিং। এবং তাঁর কারনেই আমরা এখন জানি কৃষ্ণবিবর আসলে "কৃষ্ণ" নয়, বরং সেখান থেকে বের হয়ে আসছে কণা স্রোত, শূণ্যস্থান ‘শূণ্য’ নয়, কণার সৃষ্টি আর বিলয়ের এক সার্বক্ষণিক কারখানা। দুনিয়ার শুধু শুরুই নেই, বরং দুনিয়া শুরুর ‘আগে’ বলে কোন ‘আগেই’ নেই।
আইনস্টাইনের দুনিয়ার সফল এই মানুষটি কি তাঁর সঙ্গে আইনস্টাইনকে বাঁধবেন না? সেই সুযোগ কি তিনি হেলায় হারাবেন?
ভাবতে ভাবতে আমার চকিতে মনে পড়ে গেল, আজ মহাবিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের জন্মদিন! গ্যালিলিওর মৃত্যুদিনে যে লোকের ধরাধামে আগমন সে যে আইনস্টাইনের জন্মদিনেই সেটা ত্যাগ করবেন তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে!!!
মনে একটা শান্তি নিয়ে পত্রিকার জন্য লিখতে বসলাম টেবিলে। কিন্তু খচখচানিটা থেকেই গেল?
হকিং-কি আসলেই এই দিনের বিশেষ মাহাত্মকে মানবেন?
আমি যতোই ভাবি না কেন আইনস্টাইনের জন্মদিনে তাঁর চলে যাওয়াটা মহাকালের একটা জটিল হিসাব- এটা কি তিনি মানবেন?
আমার এই ধারণার পেছনের কারণ হলো ৮ জানুয়ারি - হকিং-এর জন্মদিন। ঐ দিনের বিশেষ তাৎপর্যের ব্যাপারটা কি মানতেন হকিং নিজে?
[সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ - এটি কোন জীবনী লেখার চেষ্টা নয়। লেখালেখি নিয়ে আমার নানা রকম এক্সপেরিমেন্টের এটি একটি নতুন অপচেষ্টা। যে ভাবে আমরা সাধারণত জীবনী লিখি তার থেকে ভিন্নভাবে একজন বিজ্ঞানীকে দেখা। আমার সঙ্গে হকিং-এর জানাশোনার তিন দশকের স্মৃতিকে ঘিরে এই অপচেষ্টা আমি করতে থাকবো। যাদের মনে এই ধরণের অপচেষ্টা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আপত্তি থাকবে তারা দয়া করে তফাতে থাকবেন। এই সিরিজে চোখ না দিলেই ভাল]
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ সকাল ৮:২৬