জনকল্যাণ নিশ্চিতকরণ এবং নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় গণতন্ত্রিক সরকারের প্রয়োজনীয়তা অপরীসীম । বিভিন্ন যুগের গণতন্ত্র ও আজকের গণতন্ত্রের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টিকরী একক হচ্ছে সমাজ ও ব্যক্তির মানসিকতা । তাই গণতন্ত্রের সঠিক ধারণা লাভের লক্ষ্যে এই বিবর্তন অধ্যয়ন আবশ্যক ।
প্রাচীন যুগ:
গণতন্ত্র প্রথম উদ্ভাবিত হয় গ্রীসের এথেন্সে ৫০৮ খ্রিষ্টপুর্বাব্দ যা ছিল মুলত নগর রাষ্ট্রেটির রাজনৈতিক দর্শনের ফসল । এথেন্সের প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র দুটি বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে আবর্তীত হয় । এগুলো ছিল ১) বিদ্যমান সরকারি প্রশাসন, বিচার আদালত ও শাসন সভায় সাধারণ নাগরিকের অংশগ্রহণ । ২) কোন নারী, দাস, বিদেশী, নিজস্ব ভুমিহীন ব্যক্তি এবং অনুর্ধ্ব ২০ বছর বয়সের কোন পুরুষ নাগরিক বলে বিবেচ্য না হওয়া । মোট জনগণের কেবল ৭ শতাংশ এর ফলে জনগণ হিসেবে গণ্য হত যাদের জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ ছিল বাধ্যতামূলক । জনগণের অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয় বলেই এথেন্সের গণতন্ত্র প্রত্যক্ষ ছিল । এটি প্রত্যক্ষ হওয়ার কারণ ছিল যে নগর রাষ্ট্রের নাগরিকেরা সমগ্র রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করত । খ্রিষ্টপুর্ব ৭০০ অব্দে স্পার্টায় ৩০ বা তদুর্ধ্ব বছর বয়সের পুরুষদের নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করা হয় । এপেলা নামক একটি মাসিক জনসমাবেশে এথেন্সের জনগণ নম্বর দিয়ে অথবা চিত্কার করে কোন প্রতিনিধির পক্ষে তাদের সমর্থন জ্ঞাপন করত যা পরবর্তীতে এরিস্টটল কর্তৃক ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয় । তবে স্পার্টা এটি গ্রহণ করার পেছনের কারণ ছিল নির্বাচন সংক্রান্ত অসংগতি সমূহ দূর করা । রোমান সাম্রাজ্যের মোট জনগণের একটি ক্ষুদ্র অংশই নাগরিক বলে বিবেচিত হত এবং প্রতিনিধি নির্বাচনে অভিজাত শ্রেণীর প্রভাব ছিল স্পষ্ট । রোমান প্রজাতন্ত্র ছিল ইউরোপের প্রথম প্রজাতন্ত্র যদিও সেটি সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ছিল না । তা সত্ত্বেও রোমান সরকার কাঠামো পরবর্তী যুগগুলোতে গণতন্ত্রের বিকাশে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে । আধুনিক প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলো গ্রীসের চেয়ে রোমান মডেলকেই অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে ।
মধ্য যুগ:
মধ্যযুগে ইউরোপের অধিকাংশ অঞ্চলই সামন্তপ্রভু ও পাদ্রীদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল । অনেক নগর রাষ্ট্র সে সময় মেয়র বা ধনী নাগরিকদের দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে । সামন্তবাদী সরকার কাঠামোর অবলুপ্তি সাধনে নগর রাষ্ট্র ও শিল্প-বাণিজ্যিক কেন্দ্রের ভুমিকা ছিল অপরিসীম । তত্কালীন নির্বাচন ও সরকার ব্যবস্থাগুলো কতগুলো নিয়ম-নীতির ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হত । এই নগর রাষ্ট্রগুলো ইউরোপে বিশেষ করে ইতালীয় উপদ্বীপ অঞ্চলে গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনের জন্য ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে । ইউরোপীয় রেনেসাঁর ফলে বিজ্ঞান চর্চায় অধিকতর স্বাধীনতা স্বীকৃত হয় । ক্যাথলিক চার্চের অত্যাচারের মুখে প্রটেসটান্ট ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ ইউরোপীয় সমাজ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে । কেননা ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপকরা ও গণতন্ত্রের বিরোধীতা করার মাধ্যমে রাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখই ছিল ক্যাথলিক চার্চের উদ্দেশ্য । প্রটেস্টান্ট সংস্কার আন্দোলন ছিল ইউরোপের খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের নিজ নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষে লড়াই করে যাওয়ার বার্তা স্বরুপ । চার্চের বিরুদ্ধে এ ধরণের আলোচনা ও সমালোচনা গণতন্ত্রে উন্নয়ণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
আধুনিক যুগ:
বর্তমান আমেরিকা-যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনেই সমগ্র বিশ্ব গণতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে । ব্রিটেনের পুরিটান নামক এক খ্রিষ্টান সম্প্রদায় ১৬২০ সালে আমেরিকান কলোনির নিউ ইংল্যান্ডে যে স্থানীয় সরকার কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছিল তা যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । বিল অফ রাইটস পাসের পর ব্রিটেন নাগরিক অধিকার সংরক্ষণের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে । এটি ব্রিটেনের গণতন্ত্রকে ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অধিক মর্যাদা প্রদান করে । ১৮৮৪ সালে ফ্রান্স সার্বজনীন পুরুষ ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে সক্ষম হয় যা ছিল ১৭৮৯ এর ফরাসী বিপ্লবেরই ফসল । ১৭০৭ সালে ব্রিটেনের প্রথম পার্লামেন্ট গঠিত হলেও এটি নির্বাচন করতে পারত মোট জনসংখ্যার কেবল ৩ শতাংশের ইচ্ছার ভিত্তিতে । উপনিবেশিক আমলে আমেরিকাতে কেবল তারাই নাগরিক হিসেবে গণ্য হত যারা ছিল পুরুষ ভূস্বামী । এসময়ই সমগ্র বিশ্বের পাশাপাশি আমেরিকাতেও দাস প্রথার বিরোধীতা শুরু হতে থাকে । ১৮০৭ ও ১৮৩২ সালে দুটি পৃথক আইন ও তার সংস্কারের ওপর ভিত্তি করে ১৮৩৩ সালে ব্রিটেন তার সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে দাস প্রথা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৫৫-১৯৫৮ সালে আফ্রিকান আমেরিকান আন্দোলনের মাধ্যমে আমেরিকাতে সার্বজনীন ভোটাধিকার স্বীকৃত হয় । পরবর্তীতে সাম্রাজ্যবাদের বিলুপ্তি, অর্থনৈতিক মন্দা, ফ্যাসিবাদ ও নাত্সীবাদ নারীদের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে প্রভাবিত করে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে জার্মানী, ইটালি, অস্ট্রিয়া ও জাপানের মত দেশগুলোর সম্পর্ক হয়ে ওঠে গণতান্ত্রিক ও অগণতান্ত্রিকের মাঝে দ্বন্দের । স্পেন, পর্তুগাল, আর্জেনটিনা, বলিভিয়া, ব্রাজিল, উরুগুয়ে, চিলিসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৭০-১৯৯০ এর মধ্যে । স্নায়ুযুদ্ধের অবসান, সোভিয়েত রাশিয়ার পতন ও জার্মানির পুণঃএকত্রীকরণ গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে ব্যাপকভাবে প্ৰভাবিত করে ।
গণতন্ত্রের সমস্যা ও সম্ভাবনা:
বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের স্বরুপ প্রকৃতি এক নয় । গণতন্ত্রের একটি পুরনো সমস্যা ছিল যে এটি গুণের চেয়ে সংখ্যার ওপর নির্ভর করে যা কালের বিবর্তনে অধিকাংশ দেশে এখনও বিদ্যমান । তাছাড়া প্রশাসনিক দুর্বলতা, পুজিবাদীদের গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করা, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব প্রশ্নে দূর্বলতা পোষণ ইত্যাদি থেকে গণতন্ত্রিক সরকার কাঠামো এখনও মুক্ত হতে পারে নি । তবে সাম্য প্রতিষ্ঠা, জনমতের প্রধান্য প্রদান ও রাজনৈতিক শিক্ষা ও সচেতনতা প্রদান গণতন্ত্রের অদ্বিতীয় গুণ ।
গতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কতটা জনকল্যাণকর সেই বির্তক বিগত শতাব্দিতে মানব জাতি পেরিয়ে এসেছে । এখনকার বিতর্কের বিষয় হল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কোন পন্থাটি অধিক কার্যকর । গণতন্ত্র বলতে সমাজের একটি বড় অংশ আজও কেবল সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকেই বোঝে । কার্যত এটি ভুল নয় । তবে গণতন্ত্রের সফলতার জন্য নাগরিকদের সুশিক্ষা, দক্ষ নেতৃত্ব, সহনশীলতা ও আইনের শাসনও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মতাই গুরুত্বপূর্ণ । তাই সমাজ ও রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক কাঠামো গঠনে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় ও মিথষ্ক্রিয়া জরুরী ।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১৬ বিকাল ৪:৪৪